প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৯

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৯
Writer Mahfuza Akter

তরী সকালের পর থেকে সৌহার্দ্যের পুরো ফ্ল্যাটটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। দুই ইউনিটের ফ্ল্যাটটা বেশ বড় ও অভিজাত লাগছে তার নজরে। সবটা সাজানো-গোছানো-ই আছে! কিন্তু এসব কিছু একদমই ভালো লাগছে না তার। নিজেকে প্রচন্ড শূন্য শূন্য মনে হচ্ছে। তার পরিচিত জায়গা ও মানুষগুলো ফেলে এসে এই অপরিচিত শহরে কীভাবে মানিয়ে নেবে সে নিজেকে? এতোক্ষণে তো বাড়ির সবাই হয়তো জেনে গেছে তাদের বাড়ি ছেড়ে চলে আসার কথা! সবার কী অবস্থা এখন কে জানে? মালিহার চিন্তা মাথায় আসতেই তরী ভীষণ বিষণ্ণ হয়ে গেল।

কলিং বেল বাজছে। নিশ্চয়ই সৌহার্দ্য এসেছে। তরী দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। সৌহার্দ্য-ই এসেছে। তার দু’হাত ভর্তি ব্যাগপত্র। পেছনে আরো একজন এসেছে। তার হাতে ও কাধে ব্যাগপত্র ও সরঞ্জাম। সৌহার্দ্য সবকিছু ভেতরে রেখে লোকটাকে বিদায় করে দিলো।
তরী এতোক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে সবটা দেখছিল। সৌহার্দ্য এবার তরীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“না বুঝে-শুনে দরজা কেন খুলে দিয়েছো?”
তরী অবুঝের মতো তাকিয়ে বললো,
“না বুঝেশুনে কই? আমি জানতাম আপনিই আসবেন!”
“আমি ছাড়া অন্য কেউও তো হতে পারতো! না দেখে দরজা খোলার মতো বোকামি শুধু তুমি-ই করতে পারো!”
তরী অবাক হয়ে বললো,

“আমি দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে কীভাবে দেখবো ঐপাশে কে দাঁড়িয়ে আছে?”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি সত্যিই জানো না দরজায় যে ছোট একটা লুকিং গ্লাস থাকে?”
তরী ঘনঘন পলক ফেলে দু’পাশে মাথা নাড়ালো। মানে সে সত্যিই জানতো না। বললো,
“আমি তো অনেক কিছু-ই জানি না! সারাজীবন গ্রামে ছিলাম। কখনো ঢাকায় আসিনি, শহর দেখিনি। আমি কীভাবে কী করবো এই অপরিচিত শহরে?”

সৌহার্দ্য তরীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাতে হাত ভাজ করে বললো,
“এখন থেকে তো এই পুরো পৃথিবী-ই তোমার কাছে অপরিচিত, চাঁদ! পুরো পৃথিবীর সামনে তোমার ঐ ছোট্ট পরিচিত গ্রামটা কিছুই না। তাই তোমাকে অপরিচিত জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।”
তরী আঙুলে ওড়না পেঁচাতে পেঁচাতে মাথা নিচু করে বললো,
“আমি এখানে কাউকে চিনি না।”

সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তরীকে দেখতে দেখতে বললো,
“আমাকে তো চেনো, চাঁদ! এটুকুই কি যথেষ্ট নয় তোমার জন্য?”
তরী অবাক চোখে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। সৌহার্দ্য হেসে উঠে বললো,
“থাক! আর কনফিউজড হতে হবে না। চলো, কিচেনে সব জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখবে। দুপুরে লাঞ্চের পর আমরা শপিংয়ে যাবো। তখন কাপড়-চোপড়ের সাথে তোমার বইপত্রও কেনা যাবে।”
তরী মাথা নাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

মালিহা সৌহার্দ্যের ঘরে গিয়ে দেখলো, পুরো ঘরে কেউ নেই। ঘরের দরজাও খোলা। তরী আর সৌহার্দ্য তো এতো সকালে ঘরেই থাকে! তার মানে আজাদ সত্যি বলছিলো? সৌহার্দ্য তরীকে নিয়ে চলে গেছে এই বাড়ি ছেড়ে! সুজাতার কারণে ওরা সত্যি সত্যি এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেল? মালিহার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। সে নিজের মাথা চেপে ধরলো। সে নিশ্চিত যে, সুজাতা কিছু মিশিয়েছিল চায়ে। নয়তো তার এভাবে ঘুমানোর কথা না।
মালিহা ক্রোধান্বিত কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো,

“আমার মেয়েকে এভাবে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিলো! কেন এমনটা করলো?”
মালিহা রাগে-দুঃখে চিৎকার করতে করতে সুজাতার কাছে গেল। মালিহার কান্না ও চিৎকার শুনে আফনা বেগম লাঠি ভর দিয়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। মধুও হতভম্ব হয়ে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। মালিহা সুজাতার ঘরের সামনে গিয়ে অনেকবার দরজা ধাক্কালো, ডাকাডাকি করলো। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সুজাতা বেরিয়ে এলো না।

আফনা বেগম অবাক হয়ে আজাদকে জিজ্ঞেস করলো,
“কী হইসে রে, আজাদ? এসব কী হইতাছে এই খানে?”
আজাদ গতরাতের ঘটনা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটা খুলে বললো। আফনা বেগম প্রচন্ড রাগ ও বিরক্তি নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল রায়হান সাহেবকে ফোন করার জন্য। মধু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। এক রাতের ব্যবধানে এতোকিছু হয়ে গেল আর তারা বুঝতেও পারলো না! অবিশ্বাস্য!!

সকালে নাস্তার টেবিলে মুগ্ধকে দেখতে না পেয়ে বেশ অবাক হলো প্রহর। চেয়ারে বসতে বসতে ডক্টর শাহরিয়ারকে প্রশ্ন করলো,
“বাবা, মুগ্ধ কোথায়? ও কি ব্রেকফাস্ট করবে না?”

ডক্টর শাহরিয়ার নিরুত্তর ভঙ্গিতে খাবার খেয়ে চলেছেন। যেন প্রহরের প্রশ্নটা তিনি শুনতেই পাননি! প্রহর অবাক হয়ে নিজের মায়ের দিকে তাকালো। মিসেস শিরিন হতাশ মুখে প্রহরের প্লেটে খাবার দিতে দিতে বললেন,
“জানি না কী হয়েছে আমার ছেলেটার? কালও নাস্তা করে বের হয়নি। সকাল সকাল না খেয়ে চলে গেলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে! কাল রাতেও কিছু খায়নি।”

প্রহর অবাক হলো এমন কথা শুনে। ডক্টর শাহরিয়ার তাহলে ঠিকই বলেছিলেন গত রাতে। মুগ্ধ হঠাৎ এরকম আচরণ করছে কেন? নাহ্! তাকে মুগ্ধর সাথে কথা বলতে হবে। কী এমন হয়েছে যে, নিজেকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে ও?
প্রহর কোনো রকমে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে গেল। ভার্সিটিতে যাওয়ার আগে মুগ্ধর মেডিক্যাল কলেজে যেতে হবে তাকে। কলেজের সামনে পৌঁছাতেই সৌহার্দ্যের কল এলো। প্রহর কল রিসিভ করে বললো,

“জী, জনাব! বলুন, কী কী ফরমায়েশ করার জন্য কল দিয়েছেন?”
সৌহার্দ্য প্রহরের কথা শুনে হাসতে হাসতে বললো,
“কাজের লোকের কথা বলেছিলাম।”
“ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কালকে চলে যাবে তোর বাসায়। আর?”
সৌহার্দ্য কৌতুকের সুরে বললো,

“একটা বিয়ে করে নে। বউকে আমার বাসায় দিনের বেলায় পাঠিয়ে দিস। আসলে কাল থেকে আমি একটা মেডিক্যাল কলেজে জয়েন করছি। আমার বউটা এখনো বাচ্চা। একা ফেলে গেলে টেনশান হবে আমার।”
প্রহর দাঁত কটমট করে বললো,
“শালা! ভার্সিটির লেকচারার হয়ে তোর বাসার কাজের লোক জোগাড় করে দিচ্ছি। এতে মন ভরছে না তোর? এখন আমার না-হওয়া বউকেও তোর খেদমতে লাগিয়ে দিবো? নিজের বাচ্চা বউকে নিজের কোলে চড়িয়ে হসপিটাল জয়েন কর!”

বলেই প্রহর ফোন কেটে দেওয়ার জন্য সামনে নিতেই দেখলো, সৌহার্দ্য ওর গালাগালির ভয়ে একমিনিট আগেই কল কেটে দিয়েছে। মুহুর্তেই রাগে উবে গেল তার। হাসতে হাসতে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।
প্রহর মুগ্ধর ডিপার্টমেন্টে গিয়ে শুনলো, মুগ্ধদের ব্যাচের ক্লাস হচ্ছে। হতাশ হয়ে প্রহর পাশের একটা চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। অরুণী ল্যাব থেকে বেরিয়ে দেখলো, প্রহর কিছুটা দূরে বসে আছে। অরুণী এগিয়ে গিয়ে প্রহরের সামনে দাঁড়ালো,

“আরেহ্! তুমি এখানে? হঠাৎ?”
প্রহর ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকাতেই অরুণীকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বিরক্তি নিয়ে বললো,
“দরকার ছিল। তাই এসেছি।”
অরুণী ছোট করে ‘ওহ’ বলে চলে যেতে নিলেই প্রহর ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“শোন! তোর সাথে কিছু কথা ছিল।”

অরুণী ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক চোখে তাকালো,
“আমার সাথে?”
“হু!”
“বলো!”
প্রহর এক মুহুর্তের জন্য নীরব রইলো। মুগ্ধর ব্যাপারে অরুণীর সাথে কথা বলাটা একদমই সমীচীন নয়। কিন্তু সে নিরূপায়। সত্যটা মুগ্ধ তাকে খুলে না-ও বলতে পারে। এখন অরুণীর কাছ থেকেই আসল ঘটনা জানা যাবে যে, সেদিন আসলে মুগ্ধ কেন শহরে ফেরার জন্য এতো তাড়া দেখাচ্ছিল?
কিছুটা ইতস্ততবোধ নিয়েই প্রহর বললো,

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৮

“আসলে আমি মুগ্ধর ব্যাপারে তোকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম!”
অরুণী মলিন হাসলো। প্রহর বুঝলো না সেই হাসির মানে। অরুণী বললো,
“মুগ্ধ এখন আমার সাথে কথা বলে না। দেখলেও এমন আচরণ করে যেন, আমাকে চেনেই না। ওর দৃষ্টিতে আমি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মেয়ে।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩০