প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩০

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩০
Writer Mahfuza Akter

প্রহর আর অরুণী মাঠের নীরব এক কোণে ঘাসের ওপর মুখোমুখি বসেছে। এই দিকটায় কোলাহল কম। প্রহর আড়ালে ফোনের রেকর্ডারটা অন করে নিলো। প্রেমঘটিত ব্যাপারে তার তেমন ধারণা নেই। অরুণীর কথাগুলোর রেকর্ডিং রাখা হয়তো দরকার। একবারে না বুঝলে বারবার শুনে বোঝার চেষ্টা করা যাবে। মেয়েটা এমনিতেও ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলে সবসময়। তাছাড়া কে জানে কখন কোন কাজে লেগে যায়!!

“হুম! বলো কী জানতে চাও?”
অরুণীর প্রশ্নে কিছুটা নড়েচড়ে বসলো প্রহর। অরুণীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে বললো,
“মুগ্ধর সাথে তোর কোনো ঝামেলা হয়েছে?”
অরুণী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“কোনো ঝামেলা তো হয়নি! কেন বলো তো?”
“সেদিন রাতে মুগ্ধ গ্রাম ছেড়ে চলে এলো। তার আগে তোর সাথে ওর কথা হয়েছিল। কী এমন কথা বলেছিলি তুই ওকে যে, ও গ্রাম ছেড়ে চলে এলো?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

প্রহর চোখ ছোট ছোট করে অরুণীকে দেখছে। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। যেন মুগ্ধর গ্রাম ছাড়াটা এক বিশাল অন্যায় কাজ, আর সেই কাজের জন্য একমাত্র অরুণী দায়ী। অরুণী মলিন মুখে হেসে বললো,
“এমন ভাবে আমাকে চার্জ করছো, যেন আমি কোনো অপরাধ করে ফেলেছি!”
প্রহর বিরক্ত হয়ে বললো,

“আমি ওভাবে বলিনি। জাস্ট জানতে চাইছি। মুগ্ধ গ্রাম থেকে আসার পর অনেক উদ্ভট আচরণ করছে। আমি আর বাবা-মা সবাই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক চিন্তিত।”
অরুণী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আকাশের দিকে দৃষ্টি মেলে দিয়ে বললো,
“মানুষ হাজারো ভালোবাসা পেয়েও একজনের ভালোবাসার অভাবে নিজেকে কষ্ট দেয়।”
প্রহর বুঝতে না পেরে বললো, “মানে?”

“মানেটা বোঝার জন্য তুমি মুগ্ধর দিকে তাকাতে পারো। আই মিন, মুগ্ধর উদাহরণ দিতে পারি তোমায়। মুগ্ধর জীবনে সব কিছু আছে। বাবা-মায়ের ভালোবাসা, তোমার মতো বড় ভাই আর বেশ সুন্দর একটা জীবন যেটার স্বপ্ন সবাই দেখে। তবুও সে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে, কষ্ট পাচ্ছে। কেন, জানো? ও এমন একজনের ভালোবাসা চায়, যে অন্য কারো প্রেমে মগ্ন। এখন তুমি মুগ্ধকে কী বলবে? সৌভাগ্যবান? নাকি দুর্ভাগ্যবান?”

প্রহর এক দৃষ্টিতে অরুণীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার মাথায়ও প্রশ্নটা ঘুরছে। মুগ্ধ কি আসলেই সৌভাগ্যবান? তার কাছে তো সব কিছুই আছে! কিন্তু সে যা চায়, তা তার কাছে নেই। তাহলে কি মুগ্ধকে দুর্ভাগ্যবান বলা উচিত? প্রহর কোনো উত্তর পেলনা। অরুণী আবারও বললো,

“এইবার আমার কথা ভাবো। আমার জীবনে বাবা-মায়ের ভালোবাসা নেই বললেই চলে। বাবার সাথে তা-ও কথা হয় মাঝে মাঝে, কিন্তু মায়ের ছোঁয়াও সহ্য হয় না আমার। খুব কাছের কোনো মানুষ নেই। তবুও ভালো ছিলাম আমি। ভেবেছিলাম যাকে সারাজীবন চেয়ে এসেছি, সে অন্তত আমায় দূরে ঠেলে দেবে না। ভালোবাসবে। কিন্তু নাহ্! সেটাও হলো না। সে অন্য একজনকে বিয়ে করলো। তার চোখে অন্য কারো জন্য গভীর প্রেম দেখেছি আমি। সেদিন বুঝে গিয়েছিলাম, অরুণী’স লাইফ ইজ ইক্যুয়াল টু আ বিগ জিরো। কিছুই নেই আমার জীবনে। এখন আমাকে তো তুমি নির্দ্বিধায় দুর্ভাগা বলবে, তাই না?”

অরুণী প্রহরের দিকে তাকালো। প্রহর কী বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। মুখের ওপর কাউকে দুর্ভাগা বলে দেওয়া যায় না। নয়তো সে বলেই দিতো, “অরুণী, তোর মতো দুর্ভাগা মেয়ে আমি জীবনেও দেখিনি।” কিন্তু এভাবে বলে কাওকে কষ্ট দিতে চায় না সে। তাই মনের কথা মনে রেখেই বললো,
“জানি না।”
অরুণী সহাস্যে বললো,

“আসলে তুমি আমাকে যতটা দুর্ভাগ্যবান ভাবছো, আমি ঠিক ততোটাও নই। পৃথিবীতে এমন একজন আছে, যে আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। আর সেই মানুষটা হলো তোমার ভাই। সে জন্যই নিজের লাইফটাকে জিরো লেভেলের বলতে পারি। তা না হলে আমি তো মাইনাস লেভেলে থাকতাম! বেঁচে থাকার কোনো মানেই থাকতো না আমার।”
প্রহর অবাক চোখে তাকালো। অরুণী নিজের চোখের কোণের পানিটুকু মুছে বললো,

“ভালোবাসার মানুষের সংসার ভাঙায় প্রলুব্ধ হয়েছিলাম আমি। আর সেটা শুনেই তোমার ভাই গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু যাওয়ার আগে আমার চোখের পর্দা তুলে দিয়ে গিয়েছিল। আসলে ‘ভালোবাসারা ভালো থাকুক’ ভাবনায়-ই প্রকৃত ভালোবাসা স্বার্থক। আমি চাই সৌহার্দ্য ভালো থাকুক। আর ওর ভালো থাকার কারণ শুধু মাত্র তরী, আমি নই। তাই আমি নিজেই নিজেকে ওদের মাঝ থেকে সরিয়ে এনেছি। রাতের আঁধারে পালিয়ে এসেছি নিজের জেদের কাছ থেকে। ভালোবাসায় যখন জেদ চলে আসে, তখন সেটা আর ভালোবাসা থাকে না। হিংস্রতায় রূপ নেয়। আর প্রেম কখনো হিংস্র হতে পারে না।”

প্রহর কিছু বলার আগেই অরুণী বসা থেকে উঠে চলে গেল। প্রহর হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। মানুষ কীভাবে নিজের সর্বস্ব দিয়ে আরেকটা মানুষকে ভালোবাসতে পারে? ব্যাপারটা তাকে আজ আবারও অবাক করলো।

দুপুরে খাওয়ার পর সৌহার্দ্য তরীকে নিয়ে কেনাকাটা করতে যাবে। কিন্তু খাওয়ার পরপরই সৌহার্দ্য একাই কোথায় যেন চলে গেছে। তরী খাবারের টেবিল গুছিয়ে রেখে বেডরুমে চলে এলো। তার মাথায় নানা চিন্তা ঘুরঘুর করছে। কাল রাতে এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়েছে তারা। এখন সে বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হবে কী করে। তার কাছে তো এই মুহুর্তে কোনো জামা কাপড় নেই! তার পরনের জামাটা পরে কীভাবে বাইরে যাবে? এটার তো বেশ বাজে অবস্থা!
তরী চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে এমনসময়ই সৌহার্দ্য এলো। তরীর দিকে একটা ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বললো,

“এটা পরে নাও। আধঘন্টার মধ্যে আমরা বেরোচ্ছি।”
“এটা কী?”
সৌহার্দ্য তাড়া দিয়ে বললো,
“খুলে দেখো, আর রেডি হও। আমি বাইরে ওয়েট করছি।”
সৌহার্দ্য বেরিয়ে গেল। তরী ব্যাগ খুলে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। সৌহার্দ্য কী করে তার প্রয়োজনগুলো মুখ ফুটে বলার আগেই বুঝে যায়? ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো তরী। আর সময় নষ্ট না করে সৌহার্দ্যের দেওয়া ড্রেসটা পরে ফেললো।
গাড়িতে পাশাপাশি বসা অবস্থায় তরী প্রশ্ন করলো,

“আপনি তো এই জামা কেনার সময় আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোও কিনে ফেলতে পারতেন! আমাকে নিয়ে বের হওয়ার কোনো দরকার ছিল না।”
সৌহার্দ্য গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে ভরাট গলায় বললো,
“তোমার আমার সাথে টাইম স্পেন্ড করায় কোনো প্রবলেম থাকলে বলো, তোমায় বাসায় রেখে আসি।”
তরী হকচকিয়ে গেল বললো,
“নাহ্, কোনো প্রবলেম নেই।”

“তোমায় নিয়ে বেরিয়েছি, কারণ তুমি এখানকার কিছুই ভালো মতো চেনো না। বাইরে বের হলে ধীরে ধীরে চিনে ফেলবে।”
তরী আর প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না। আসলেই তো! এই ব্যাপারটা তো তার মাথায়ই আসেনি। সে এখানকার কিছুই চেনে না। চেনার জন্য অন্তত বাইরে বের হওয়া দরকার। এই মুহুর্তে সৌহার্দ্যের সামনে নিজেকে ভীষণ বোকা মনে হচ্ছে তরীর।

তরীর ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটলো সৌহার্দ্যের ফোনের রিংটোন বেজে ওঠায়। সৌহার্দ্যের ফোন তরীর হাতেই ছিল। আননৌন নাম্বার! সৌহার্দ্য একপলক দেখে কানে লাগানো এয়ারপড্’স-এ এক আঙুল স্পর্শ করে কল রিসিভ করলো। অপর পাশ থেকে কে কথা বলছে, তরী জানে না। সৌহার্দ্যও নিজেকে থেকে কিছু বলছে না। শুধু উত্তরে হুম, হ্যাঁ, ওহ্, ওকে এসব বলছে। কল ডিসকানেক্ট হতে সৌহার্দ্য বললো,

“আগামী রবিবার রেজাল্ট পাবলিশড হবে তোমার।”
তরী চোখ বড় বড় করে বললো,
“এইচএসসির রেজাল্ট।”
“হু।”
“আল্লাহ্!”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে বললো,
“এরকম করছো কেন? এক্স্যাম তো খারাপ দাওনি! তাহলে এতো টেনশান করার কী আছে?”
তরী মুখ গোমড়া করে বললো,

“পরীক্ষা যতই ভালো হোক, একটু চিন্তা তো হবেই!”
“তুমি তোমার দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা তো করেছো! এখন অহেতুক দুশ্চিন্তা না করে আগামী দিনের কথা ভাবো আর পড়াশোনায় মন দাও।”
“হুম।”

সৌহার্দ্য শপিং মলে পৌঁছে-ই তরীর জন্য কাপড়-চোপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিলো। তরী সেটা দেখে মুখ গোমড়া করে বললো,
“আপনি শুধু আমার জন্য-ই কেনাকাটা করবেন? নিজের জন্য কিছু কিনবেন না?”
সৌহার্দ্য হেসে বললো,
“আমি তো তোমাকে যা যা লাগে সব কিনে দিলাম। এখন আমার প্রয়োজনীয় সবকিছু তুমি কিনে দেবে।”
তরী অবুঝের মতো তাকিয়ে বললো,

“কিন্তু আমার কাছে তো কোনো টাকা নেই!”
সৌহার্দ্য পকেট থেকে একটা ডেবিট কার্ড বের করে তরীর হাতে দিয়ে বললো,
“এটা তোমার।”
তরী কার্ডটার দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। এটাতে আসলেই তার নাম লেখা। সে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললো,
“কিন্তু আমার তো কোনো ব্যাংক একাউন্ট নেই!”
“সপ্তাহ খানেক আগে তোমার নামে একটা একাউন্ট খুলেছিলাম। তোমার কাছ থেকে সিগনেচারও নিয়েছিলাম। মনে আছে?”

“ঐটা একাউন্টের ফরম ছিলো?”
“হ্যাঁ। এই কার্ডটা তোমার সেই একাউন্টের-ই! এখন চলো, আমাকে কী কী কিনে দিতে পারো তুমি, দেখি! কাল থেকে আমার ডিউটিও আছে হসপিটালে। তাই অনেককিছু কিনতে হবে।”
তরী ঘনঘন পলক ফেলে সৌহার্দ্যের কথা মতো মাথা নাড়ালো।

কেনাকাটা শেষ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। তরী হাপিয়ে উঠেছে এতক্ষণে। এভাবে কেনাকাটার অভ্যাস তার নেই। নতুন অভিজ্ঞতা। এই জনবহুল শহর, ব্যস্ততা, মানুষের নিরন্তর ছুটোছুটি ও কোলাহল একদমই নতুন তার চোখে। এই চোখজোড়া আজ নতুন কিছু দেখছে, নতুন ও এক অজানা পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছে।
“সামনে একটা কফিশপ আছে৷ চলো, সেখানে গিয়ে কফি খেয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নেই। আই গেস, অনেক বেশি টায়ার্ড তুমি। পরে যাওয়ার পথে তোমার বইপত্র কিনে ফেলা যাবে।”

সৌহার্দ্যের কথায় তরী শুধু মাথা নাড়ালো। সে সত্যিই বেশ ক্লান্ত। কিছু বলার মতো শক্তি তার মধ্যে নেই।
কফিশপের সামনে সৌহার্দ্য গাড়ি থামালো। তরীর হাত ধরে তাকে নিয়ে কফিশপে ঢুকলো। তারা এক কোণের নিরিবিলি একটা টেবিলে বসলো। তরীকে বসিয়ে সৌহার্দ্য গেল অর্ডার দিতে। তরী কপালে হাত দিয়ে বন্ধ চোখে চেয়ারে গা এলিয়ে বসে রইলো। হঠাৎ কানে কারো ভারী ফিসফিসে আওয়াজ ভেসে এলো,

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৯

“চাঁদ! মুনলাইট! হুট করে গ্রামের চাঁদ আজ শহরে আলো ছড়াচ্ছে যে? এখানে একা-ই এসেছো, সুইটহার্ট?”
তরী ফট করে চোখ খুলে ফেললো। কিন্তু সামনে যাকে দেখলো, তাকে দেখে তরীর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো।

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩০(২)