যদি তুমি বলো পর্ব ৬১

যদি তুমি বলো পর্ব ৬১
আফনান লারা

সেই এলার্ম ঘড়িটার দিকে চেয়েই রিদম চলে গেছে।পান্নাকে শেষবার দেখারও ইচ্ছা পোষণ করে নাই,একই অনুভূতি কাজ করছিল ওপার থেকেও।পান্না বুঝি জেনে গেছিলো,রিদম ও তার মতই শেষবার দেখা করা নিয়ে ভীত!
পিংকি তার বাবার সাথে ঠিকই এয়ারপোর্ট অবধি পৌঁছে গেছে।রিদম,তিথি,ইশানকে বিদায় ও জানিয়েছে।রিদমের মা অনেক কেঁদেছিলেন,দেশে তার কাছে থাকলো শুধু তানিয়া।বুকের দুটো ধনই একসাথে চলে গেলো বিলেত।

তিথির প্রথমবার যেতে কষ্ট লাগছিল এবার আর সে কষ্ট লাগেনি,তবে রিদমকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল এই বিদায়বেলার এফেক্ট তার উপর পড়েছে সব চাইতে বেশি।মা বাবা বুঝলেন তাদের ছাড়া যেতে বুঝি ওর কষ্ট হচ্ছে,কিন্তু নাহ,তার মন অন্য কিছু বলছিল।সে জানে এই যাওয়া অনেক দীর্ঘ হবে!
মা বলেছেন দু তিন বছর পর পর এসে দেখা করতে তিথি ইশানের সাথে।কিন্তু রিদম মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে যাচ্ছে সে ঠিক সেইসময়ে ফিরবে যে সময়ে তার ফেরা দরকার।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

জাপানে পাড়ি জমানোর পর তিথি আর ইশান তাদের সংসারটাকে গুছিয়ে নেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।রিদমের এডমিশন হয় তাদের বাসা থেকে অনেক দূরে।স্কুলটা অনেক নাম করা হওয়ায় ইশান সিদ্ধান্ত নেয় রিদমকে সেখানে ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দিবে।রিদম এখন আর বাচ্চা নয় যে এত ভাবার কিছু আছে,তাছাড়া এ বয়স থেকেই তাকে শক্ত হতে হবে।সব জানতে হবে,শিখতে হবে।ঐ স্কুলে বোর্ডিং নেই বলেই ঝামেলাটা বেড়ে গেলো।
তার পরেও ইশান নিজ দায়িত্বে সবটা করে ওকে সেখানে ভর্তি করায়,তার পেছনে একমাত্র কারণ ছিল রিদমের সম্মতি।সে চেয়েছিল একা থাকতে।

রিদমকে একা ছেড়ে দিয়ে আসতে কষ্ট হচ্ছিল তিথি আর ইশানের,কিন্তু তাদের তো এটা করতেই হতো।
সেইদিনটা ইশানের জন্য এত ব্যস্ততার একটা দিন ছিল যে সে বাসায় এসেই বিছানায় শুয়ে পড়েছিল।খাবার ও খায়নি।পরেরদিন সকাল সকাল তিথি প্লেটে করে কি যেন একটা এনে ইশানের বেডের সামনে টেবিলে রেখে চলে যায়।তিথির ডাক শুনে ইশান উঠে বসে,মনে পড়ে যায় আজ তার ফ্যাক্টরিতে যাবার কথা।তাই দেরি না করে দ্রুত উঠে বসে সে।এরপর পায়ে জুতোটা পরে দু কদম ফেলতেই তার চোখ গেলো টেবিলের উপর রাখা প্লেট টার উপর। সেটাতে প্রেগনেন্সি কিট রাখা।ইশান শুরুতে বুঝতে পারেনি এটা আসলে কি ছিল।সে চোখ ডলে ভাল করে ঘুরিয়ে দেখে এরপর তার হুশ আসলো এটা আসলে কি।

দুটো দাগ দেখে তার চোখ কপালে উঠে গেছে।
পাশের রুম থেকে খিলখিল করা হাসি শোনা যাচ্ছে।ইশান পেছনে ফিরতেই তিথি দিলো এক দৌড়।
ইশান ওমনি বাহিরে এসে বলে,’গুড নিউজ জানিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন?ধরা দিবিনা?’
তিথি হাসি আটকিয়ে দূরে থেকে বলে,’শেষ প্রতিশোধ এমন হবে তা ভেবেই হাসি পাচ্ছে অনেক,কি করি বলুন?’

হাসির ছটা দিয়ে কেটে গেছে পনেরোটা বছর।ইশান আর তিথির কোলজুড়ে এখন দুজন সন্তান।লেজিন ও ইকরা।
দুজন রাজকন্যা তাদের।তাদের স্কুল, তাদের লেখাপড়া, বিনোদন সব মিলিয়ে ব্যস্ত সময় কাটে ইশান আর তিথির।
তানিয়ার সংসারে টানা এক বছর টক ঝাল লেগে থাকলেও দু বছরে পা রাখার পর মিষ্টির দেখা মিলেছে। তার একটি রাজকন্যা আর একটি রাজপুত্র ও আছে।

তার সেই রাজকন্যার নাম আবার মিষ্টি রাখা হয়েছে।আর রাজপুত্র সে তো সবার ছোট সদস্য। বয়স চার বছর, নাম তার ভুলু।সে সব ভুলে যায়।ডাক্তার বলেছে আস্তে আস্তে এ রোগ সেরে যাবে,ছোট কালে এমনটা হতেই পারে,এই টুকুন ছেলের কি এরিস্টটলের তত্ত্ব মনে থাকবার কথা?
ভুলুর ভাল নাম আদিত্য।আদর করে তাকে সবাই আদি বলে ডাকে।যাই হোক শুরু করা যাক ইশান আর তিথির সংসার থেকেই।

ইশান অফিসের কাজ হোল্ডে রেখে লেজিনকে আনতে ওর স্কুলে গেছে,ওর এখনই ছুটি হবে।বাহিরে গেটের কাছে দাঁড়িয়েই সে অপেক্ষা করছিল ঠিক ঐ সময়ে তার ফোনে কল আসে অফিস থেকে।
ব্রাঞ্চ ম্যানেজার জানায় সিনিয়র ম্যানেজার কাল থেকে অফিস আসছেনা,আজও আসেনি।
ইশান ঠিক আছে বলে অবসর সময়টাকে কাজে লাগাতে কল করে সিনিয়র ম্যানেজারকে।এই সিনিয়র ম্যানেজারই হলো রিদম।

সে এখন অনেক বড় হয়ে গেছে,গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে সে ইশানের ফ্যাক্টরিতে ভাল বেতনের চাকরি করছে।
রিদম ফোন ধরছেনা,তার ফোন বন্ধ,চারদিন আগে তার রিদমের সাথে কথা হয়েছিল,তখনও রিদমের কথায় মনে হয়নি সে ফোন বন্ধ করতে পারে, হঠাৎ কি এমন হলো যে ফোনই বন্ধ করে দিলো?

রিদম বাংলাদেশে চলে এসেছে,তাকে একজনে খবর দিয়েছে আজ নাকি পান্নার বিয়ে।সে এসেই পান্নাদের বাসার সামনে হাজির হয়েছে।তাকে দেখে এখন কেউই চিনবেনা।
থ্রি কোয়াটার আর হাফ হাতা শার্ট পরা ছেলেটা এখন সাহেব হয়েছে,পরনে তার জিন্স আর টি শার্ট।হাতে ঝুলিয়ে রেখেছে ব্লেজার।আসার সময় কোনো ব্যাগও সে আনেনি।
শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে।মনের ভেতর আগুন জ্বলছে তার।

বিদেশ থেকে কত টাকা খরচ করে সে পান্নার জন্য কার্গোতে পার্সেল পাঠিয়েছিল,যাতে গিফট ছিল আর লেখা ছিল ‘আমার জন্য অপেক্ষা করবা পান্তুয়া’
আর সেই মেয়ে কিনা আর কটা দিন অপেক্ষা করতে পারলোনা!এর জন্য এত সুন্দর সুন্দর মেয়ে সে রিজেক্ট করে আসছিল!নাহ!এভাবে সে ঠকাতে পারেনা!
রিদম ভেতরে ঢুকে যায়,এরপর পান্নাদের বারান্দা আর সুপারি গাছটা দেখতে থাকে।

‘আম্মু,গাঁদা ফুলের পলিথিনটা আমি ফ্রিজের উপরে রেখেছি, জিসান ভাইয়াকে বলো’
‘ইশ আমি শাড়ীটা যে পরলাম খুলতেই ভুলে গেছি কাজের চাপে,নতুন বউয়ের শাড়ী পরে দেখার শখ ছিল বলে পরেছি আর খোলার কথাই মনে থাকলোনা,বউ দেখলে আমার উপর খুব রাগ করবে’
এই বলে শাড়ীর আঁচলের উপর থেকে সেফটিপিন খুলতেই পেছন থেকে কেউ একজন জড়িয়ে ধরে মুখ চেপে ধরেই মুখে কিছু একটা বেঁধে দিয়ে রুমের দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে ফেললো।এটা রিদমই ছিল।

রিদমের চোখে আগুন জ্বলছে।।সে দরজা লাগিয়ে এক হাতে মেয়েটার গলা আর অন্য হাতে দুহাত একত্রে চেপে ধরে বললো,’এই রিদমের জন্য অপেক্ষা করলে মরে যাইতা তুমি?’
রিদম নাম শুনে মেয়েটার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো।আজ বিয়ে হচ্ছে সেটা ঠিক হবে সেটা আসলে পিংকির,পান্নার নয়।রিদমকে যে খবর দিয়েছে সে ভুল খবর দিয়েছে,সে ভেবেছে এই বাড়ির মেয়ে মানেই পান্না,পিংকির কথা সে জানেনা,পিংকিকে চিনেও না।

পান্না চুপচাপ রিদমকে দেখছিল, বিদেশে থেকে সুন্দর হয়ে গেছে রিদম,আর কত যে লম্বা হয়ে গেছে সে!
পান্না মুগ্ধ হয়ে রিদমকে দেখেই যাচ্ছে,পান্নার শাড়ীর সেফটিপিন খোলা ছিল বলে ওর গায়ের থেকে আঁচল সরে যেতেই রিদম ওর হাত ছেড়ে অন্য দিকে ফিরে দাঁড়ায়,এরপর চোখের পানি মুছে বলে,’কি লাভ হলো এত অপেক্ষা করে?এই প্রতিদান পেলাম আমি?’

পান্না আঁচল ঠিক করে উঠে দাঁড়িয়ে মুখের বাঁধনটা খোলে।তার খুশির হাসি থামছিলই না।
রিদম আবার পেছনে ঘুরে বলে,’এটা ঠিক করলেনা!’
ওমনি ওপাশ থেকে পিংকি দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বললো,’পান্না দরজা খোল!আমার বিয়ের শাড়ীটা পাচ্ছিনা,তুই নিয়েছিস?যদি এখন তোর গায়ে দেখি তবে খুব খারাপ হয়ে যাবে!’

এ কথা শুনে রিদম যেন আকাশ থেকে পড়লো।পান্না মুচকি হাসি দিয়ে বলে,’না বুবু!পরি নাই।এই তো গুছিয়ে দিচ্ছি’
রিদম ওমনি ছুটে এসে পান্নাকে খুব শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে।যতটা শক্ত করে ধরলে তার পনেরো বছরের বাসনার অবসান ঘটবে ততটা শক্ত।

যদি তুমি বলো পর্ব ৬০

পান্নার মুখ ডুবেছিল রিদমের বুকে।পান্নার শরীর আগে যেমন তুলতুলে ছিল এখনও তাই।রিদমের ইচ্ছে করছিল তখনই ওকে বিয়ে করে কোলে তুলে নিয়ে আসতে আর সব ভালবাসা আজই ওকে বুঝিয়ে দিতে। পান্না যখন দেখলো পিংকি দরজাটাই ভেঙ্গে ফেলছে চেঁচামেচি করে, তখন সে রিদমকে নিজ থেকে সরানোর চেষ্টা করে ।কিন্তু রিদম ছাড়ার পাত্র নয়।সে পান্নাকে আরও শক্ত করে ধরে বললো,’ইংকি পিংকি,পংকি দূর হয়ে যাক,বিয়ে হয়ে যাক,বাচ্চা হয়ে যাক!আর আমার পান্তুয়ার বিয়ের সিরিয়াল শুরু করে যাক!’

যদি তুমি বলো পর্ব ৬২