প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩১

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩১
Writer Mahfuza Akter

আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। চারদিকে শিরশিরে বাতাস বইছে। আকাশেও অদ্ভুত ঘুরঘুর ধ্বনি। বৃষ্টি হবে নাকি? এই শীতল মৌসুমে বৃষ্টি জিনিসটা বড়ই অদ্ভুত। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন সৌহার্দ্য শীতকালে তুষারপাত দেখত। কিন্তু এখানে তো সেরকম কিছু হবে না। শীতের প্রকোপ হয়তো কয়েকগুণ বেড়ে যাবে হুট করেই।

সৌহার্দ্য চিন্তিত ভঙ্গিতে জানালার গ্লাস টেনে পর্দা টেনে দিলো। বাহির থেকে শীতল হাওয়ারা যেন এতোক্ষণ হুরহুরিয়ে ভেতরে ঢুকছিল। এখন একটু শীত কম লাগছে। সৌহার্দ্য কালক্ষেপ করলো না। দ্রুত পায়ে আবারও গিয়ে তরীর পাশে বসে পড়লো। তরীর গালে-কপালে হাত ছোঁয়ালো। গায়ের তাপ ধীরে ধীরে বাড়ছে। মেয়েটার কি এখনো জ্ঞান ফেরেনি? সৌহার্দ্য ব্লাড প্রেশার চেক করেছে। আশ্চর্যজনকভাবে তরীর ব্লাড প্রেশার মাত্রাতিরিক্ত লো। এতোটা লো হওয়ার তো কথা নয়! সৌহার্দ্যের কপালে গভীর চিন্তার ভাজ। স্যালাইন লাগাতে হবে। জ্বর কমার ইনজেকশন দিতে হবে। আজ রাতে তরীর জন্য কমপ্লিট রেস্ট দরকার।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ঝিরঝিরে বৃষ্টি, সাথে শো শো বাতাস। আধভেজা হয়ে অনেকটা কাঁপতে কাঁপতে মুগ্ধ বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। হাতঘড়িতে চোখ বুলালো। ঘড়ির কাটা দশটার ওপারে। এই বাড়িতে সবকিছুর সময়ই নির্দিষ্ট। রাতের খাবার সবাই ঠিক রাত দশটায় একসাথে বসে খায়। যদিও ড. শাহরিয়ার ইমার্জেন্সি পড়ে গেলে মাঝে মাঝে এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটান। তবে বাকিরা এই নিয়ম বেশ কঠোরভাবে মেনে চলে, শুধু মুগ্ধ বাদে। এজন্যই বাবার বকাঝকা ও ধমক শিনতে হয় তার। কিন্তু এতে মুগ্ধর তেমন হেলদোল নেই।

ডাইনিংয়ে বসে খাবার খাওয়ার সময় প্রহর খেয়াল করলো, মুগ্ধ আধভেজা গায়ে হাতে হাত ঘষতে ঘষতে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে। খাবার টেবিলের এপাশ থেকে প্রহর সেই দৃশ্যটা স্পষ্ট অবলোকন করছে। মুগ্ধ চলে যেতেই প্রহর নিজের বাবার দিকে তাকালো। ড. শাহরিয়ার মনযোগী ভঙ্গিতে একমনে খাবার খাচ্ছেন, আর মিসেস শিরিনও খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত। প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেললো! তারমানে তারা কেউই মুগ্ধকে এখনো দেখেনি। ভেবেই স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রহর।

“খাবার সামনে নিয়ে বসে আছো যে? খাচ্ছো না কেন?”
ড. শাহরিয়ারের ঠান্ডা গলায় করা প্রশ্নটা শুনে প্রহর কিছুটা চমকে তাকালো। হকচকিয়ে গিয়ে বললো,
“হ্যাঁ! খাচ্ছি, বাবা।”
খাওয়া শেষে টেবিল থেকে উঠে যাওয়ার সময় ড. শাহরিয়ার মিসেস শিরিনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“তোমার ছোট ছেলেকে খাবার খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিও। এই ঠান্ডার মধ্যে বৃষ্টিতে আধভেজা হয়ে বাড়ি ফিরেছে। নির্ঘাত অসুখ বাঁধাবে ছেলেটা।”

ড. শাহরিয়ার কালক্ষেপ না করে থমথমে মুখেই চলে গেলেন। প্রহর হা করে নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। মানুষটার মাথার চারপাশে-ই কি চোখ আছে নাকি? এতোটা বিচক্ষণ কী করে হতে পারে মানুষ?
মিসেস শিরিন গোমড়ামুখে মুগ্ধর জন্য খাবার নিতে নিতে বললেন,
“আমার ছেলেটা কী থেকে কী হয়ে গেল? আগে সারা বাড়ি মাথায় তুলে রাখতো, আর এখন একটা কথাও বলে না কারো না সাথে!”

“আহা, মা! এখন বড় হয়েছে ও। বুঝতে শিখেছে। দিন দিন যত ম্যাচিউর হবে, ততই বাচ্চামো কমতে থাকবে ওর। ইট’স নরমাল। সো, টেইক ইট ইজি।”
“তবুও ওর হঠাৎ বদলে যাওয়ার পেছনে কোনো কারণ তো নিশ্চয়ই আছে! সেটা-ই ভাবাচ্ছে আমাকে।”
প্রহর বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
“কোনো কারণই নেই। তুমি বেশি বেশি ভাবছো। এখন দাও, ওর খাবার আমি নিয়ে যাই। ওর সাথে দু’দিন ধরে দেখাও হয় না আমার।”

প্রহর মুগ্ধর খাবারের ট্রে নিয়ে মুগ্ধর ঘরের দিকে চলে গেল। মিসেস শিরিন চিন্তিত ভঙ্গিতে খাবার টেবিল গোছানোর কাজে হাত দিলো।

তরীর পাশে আধঘুমে ঝিমচ্ছিল সৌহার্দ্য। হঠাৎ কারো তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে ফট করে চোখ মেলে তড়িৎ গতিতে উঠে বসলো সে। তরীর দিকে তাকাতেই দেখলো, সে বসে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। তরীর ভীতসন্ত্রস্ত, ঘর্মাক্ত মুখ দেখে সৌহার্দ্য অবাক হলো,

“কী হলো, চাঁদ? এভাবে চিৎকার দিলে কেন? কোনো বাজে স্বপ্ন দেখেছো?”
তরী অদ্ভুত চোখে সৌহার্দ্যের দিকে তাকলো। সেই চাহনিতে ভয়, বিস্ময়, অসহায়ত্ব নাকি অন্য কিছু ছিল, সৌহার্দ্য বুঝে উঠতে পারলো না। আচমকা তরী সৌহার্দ্যের বুকের ওপর ঝাপিয়ে পড়লো। সৌহার্দ্যের শার্ট খামচে ধরে বললো,

“আমাকে মে*রে ফেলবে ও। ঐ জ*ঘ*ন্য লোকটা আমাকে বাঁচতে দেবে না। ও সব করতে পারে! সব!”
তরী বারবার একই কথা বলতে লাগলো। সৌহার্দ্য ওর কথার আগামাথা কিছুই ভালোভাবে বুঝতে পারলো না। তরীর গায়ের তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ছে যেন। মেয়েটা তার বুকে থেকেও অতিমাত্রায় কাঁপছে। সৌহার্দ্য স্যালাইনে চোখ বুলালো। অর্ধেক স্যালাইন শেষ। নলে জ্বরের ইন*জেক*শন পুশ করতে করতে বললো,

“চাঁদ, ভয় পেও না। আমি তো আছি তোমার সাথে! আমি থাকতে কারো ছায়াও তোমার ওপর পড়বে না।”
তরীর দেহের কম্পন হঠাৎই থেমে গেল। সে মুখ তুলে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। তার লালাভ, ভেজা চোখ জোড়া দেখে সৌহার্দ্যের মনে অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি হচ্ছে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তরীর গাল মুছে দিতে দিতে বললো,
“ডোন্ট বি এফ্রেইড। তুমি একা নও। আই’ম অলওয়েজ উইথ ইউ। ইউ ট্রাস্ট মি না?”
তরী অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সৌহার্দ্য আবারও বললো,

“তোমার পথে অভেদ্য ঢাল আমি। আমাকে ভেদ করে তোমার কাছে কেউ পৌঁছাতে পারবে না।”
সৌহার্দ্য তরীকে বিছানায় শুইয়ে গায়ে চাদর টেনে দিলো। তরীর চুলের ভাজে হাত ডুবিয়ে বিলি কেটে দিতে লাগলো। তরী চোখ বুঁজে নিভৃতে শুয়ে রইলো। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সন্ধ্যার সেই ঘটনাটা-

“চাঁদ! মুনলাইট! হুট করে গ্রামের চাঁদ আজ শহরে আলো ছড়াচ্ছে যে? এখানে একা-ই এসেছো, সুইটহার্ট?”
তরী ফট করে চোখ খুলে ফেললো। কিন্তু সামনে যাকে দেখলো, তাকে দেখে তরীর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। চোখ-মুখ ভীত ও পাংশুটে হয়ে এলো মুহুর্তেই। কিছু বলতে চেয়েও তরী মুখ ফুটে একটা শব্দও বলতে পারলো না। দমবন্ধকর অবস্থা অতিকষ্টে একটা ভারী ঢোক গিললো।
সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটা তরীর ভীত মুখশ্রী দেখে বেশ আনন্দ পাচ্ছে। তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে অদ্ভুত পৈ’শা’চি’ক হাসি,

“হা! হা!! আমাকে দেখে তো ভয়ে একেবারে নেতিয়েই পড়ছো দেখছি! বাট আই লাইক ইট। ইউ’র লুকিং সো কিউট ইন সাচ আ স্কেরি ফেইস।”
তরী ঢোক গিললো। নড়তে চেয়েও সে একপা-ও নড়তে পারছে না। উঠে দাঁড়াতে পারছে না। চিৎকার দিতে পারছে। তরীর মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। লোকটার হাসি তার মস্তিষ্কে বারংবার আঘাত করছে যেন!
“আপনি? আপনি এখানে কী করছেন, আরমান আঙ্কেল?”
তরী তড়িৎ গতিতে পেছন ফিরে তাকালো। সৌহার্দ্য এসেছে। তার চোখ মুখ গম্ভীর, থমথমে। আরমান সাহেব সশব্দে হেসে উঠলেন,

“আরেহ্, সৌহার্দ্য! তুমি এখানে কী করছো? আর এই মেয়েটা তোমার সাথেই এসেছে নাকি?”
সৌহার্দ্য এগিয়ে এসে তরীর পাশে দাঁড়ালো। তরী সৌহার্দ্যের বাহু দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো। সৌহার্দ্য কঠোর গলায় বললো,

“এই মেয়েটা আমার বউ, আঙ্কেল! আপনার ভাইয়ের ছেলের বউ।”
আরমান সাহেব অবাক চোখে তরীর ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকালেন। পুনরায় হেসে উঠে বললেন,
“রিয়েলি!! তোমার ওয়াইফ? দ্যাট মিনস, শি ইজ এজ লাইক মাই ডটার-ইন-ল!”
সৌহার্দ্য ভরাট গলায় বললো,
“ইয়েস, শি ইজ।”

আরমান সাহেব তরীর দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত হেসে বললেন,
“শি ইজ রিয়েলি ভেরী প্রিটি। এজন্য আমি ওর নাম দিয়েছি মুনলাইট। সুন্দর না? একদিন আমার বাসায় এসো তোমরা। বেশ সমাদর ও আড্ডা হবে তখন। নাও ইউ গাইস এনজয়। আমি বরং আসি। হ্যাভ আ নাইস টাইম, মুনলাইট!”

তরীর দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে চলে গেলেন ড. আরমান। সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে চেয়ার টেনে দিলো তরীকে,
“এইবার বসো। লোকটার জন্য মুড নষ্ট করতে চাইছি না আমি।”
তরী সৌহার্দ্যের কথা উপেক্ষা করে ওর হাত চেপে ধরে বললো,
“আমি বাসায় যাবো।”
“কিন্তু, চাঁদ! আমি তো অলরেডি খাবার অর্ডার দিয়ে ফেলেছি।”
“ক্যান্সেল করে দিন। আমি বাসায় যাবো। আমার মাথা ব্যথা করছে।”
“ওকে, চলো তাহলে।”

সৌহার্দ্য দ্রুত বিল পে করে তরীকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। তরী পুরোটা সময় সৌহার্দ্যের হাত চেপে ধরে রইলো। সৌহার্দ্য অবাক হলেও কিছু বললো না। গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই অকস্মাৎ তরী সৌহার্দ্যের গায়ে ঢলে পড়লো। সৌহার্দ্য প্রথমে না বুঝতে পেরে অবাক হয়ে তরীর দিকে তাকালো। যখন বুঝলো তরী অজ্ঞান হয়ে গেছে, তখন তাড়াতাড়ি করে তরীকে গাড়িতে বসিয়ে বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

এরপর আর কিছু মনে নেই তরীর। তরী চোখ মেলে একবার সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। সৌহার্দ্য সামনের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে!! তরী নিজের মাথা থেকে সৌহার্দ্যের হাত সরিয়ে দু’হাতে সেই হাত নিজের মুঠোয় পুরে শুয়ে রইলো।
সৌহার্দ্য তরীর এমন কাজে কিছুটা অবাক হলেও তার মুখে এক অমূল্য প্রাপ্তির হাসি খেলে গেল। সে চিন্তিত ভঙ্গিতে ভাবতে থাকে ড. আরমানকে দেখার পরপরই তরীর দুইবার প্যানিক অ্যাট্যাক কেন হলো?

মুগ্ধ ওয়াশরুম থেকে মাথা মুছতে মুছতে বের হয়ে দেখলো, প্রহর তার ঘরের সোফায় বসে তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। মুগ্ধ তোয়ালে চেয়ারে মেলে দিতে দিতে বললো,
“আরেহ্! তুমি কবে এলে?”
“ওহ! তুমি এখনো জানোই না যে, আমি চলে এসেছি।”
মুগ্ধ বিছানায় বসতে বসতে বললো,

“কেউ আমাকে বললে তো জানবো!”
“তোমার জানার আগ্রহ থাকলে তো তোমাকে জানাবে!”
মুগ্ধ নিরুৎসাহিত ভঙ্গিতে বললো,
“হোয়াটেভার!”
প্রহর রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,
“খাবার এনেছি তোর জন্য।”

মুগ্ধ চোখ ছোট ছোট করে প্রহরের সামনে থাকা টি-টেবিলে তাকালো। টেবিলটার ওপর খাবাও আর ওষুধের বক্স। মুগ্ধ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“মেডিসিন বক্স কেন?”
“অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজেছেন, তাই আপনার প্রয়োজন হতে পারে।”
মুগ্ধ বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বললো,

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩০

“আমার জীবনের সবকিছু অসময়েই ঘটে। রেখে যাও। প্রয়োজন হলে খাবার খেয়ে নেব।”
প্রহর বিরক্তিতে ‘চ’-সূচক শব্দ করে বললো,
“তোর মতো গাধা আমি জীবনে দু’টো দেখিনি। প্রেমে পড়লে মানুষ এতোটাও গাধা কীভাবে হয়? তোর ফোনে একটা অডিও মেসেজ পাঠিয়েছি হোয়াটসঅ্যাপে। সেটা চেক করার পর যদি ক্ষিদে লাগে, তাহলে খেয়ে নিস।”
প্রহর চলে গেল। মুগ্ধ অবাক হয়ে ভাবলো, অডিও মেসেজের সাথে ক্ষিদে লাগার কী সম্পর্ক? সে দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ চেক করলো।

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পুনরাগমনী পর্ব