প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ১১

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ১১
Writer Mahfuza Akter

ঘড়ির কা’টা তিনটার কিছুটা ওপারে। মধ্যরাতে ঝিঁ ঝিঁ পোকার গুনগুন শব্দ শুনতে পাচ্ছে সৌহার্দ্য। কিন্তু পৃথিবীর কোনো আওয়াজ এই মুহুর্তে সৌহার্দ্যের কর্ণকুহরে ধ্বনিত হচ্ছে না। আকাশের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে সে। এই আকাশের দিকে তাকালেই তার কষ্ট হয়।

বিষাক্ত বেদনায় ছেয়ে যায় মন। তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান দুটো জিনিস হারিয়ে গেছে অনেক দূরে। হয়তো আকাশ যেখানে মিলিয়ে গিয়েছে, তার থেকেও অনেকটা দূরে! সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চোখের জলগুলো শুকিয়ে গিয়েছে অনেক আগেই।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“যা হারিয়ে যায়, তা আর ফিরে আসে না। কিন্তু যার জন্য হারিয়ে গিয়েছে, তার জীবনটা নরক করে দেবে এই সৌহার্দ্য রায়হান। ”
বিষাদ ও বিরক্তি নিয়ে মনে মনে কথাটা আওড়ালো সৌহার্দ্য। সি’গা’রে’ট ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরে লাইটার জ্বা*লাতেই তরীর কথা মাথায় এলো তার। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ঘরের ভেতরের দিকে। ফোঁস করে তপ্ত শ্বাস ফেলে সি’গা’রে’টটা ফেলে দিলো সৌহার্দ্য।

তরীর কপালের ওপর হাত দিয়ে জ্বর চেক করে আরেকবার বিরক্ত হলো সৌহার্দ্য। জ্বরের মাত্রা কমার পরিবর্তে আরো এক ধাপ বেড়েছে। প্রেশার ফল করায় তরীকে স্যালাইন দিয়েছে সৌহার্দ্য। মেয়েটার জ্ঞান ফেরার পর কেমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে ছিল! সৌহার্দ্যের এখনো মনে পড়ে সেই মুহুর্তটা।

তরীর চাহনি মাঝে মাঝে অনেক কথা বলে। আচ্ছা, যারা কথা বলতে পারে না, তাদের সবার ক্ষেত্রেই কি এমন হয়? নাকি তরীর ক্ষেত্রে বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন? সবচেয়ে বড় কথা হলো, তরী অরুণীকে দেখে এমন প্রতিক্রিয়া কেন দেখালো? হয়তো অরুণীকে দেখে এমনটা করেনি ও। শরীর খারাপ লাগছিল, তাই অজ্ঞান হয়ে গেছে।

সেটা ভেবে না-হয় মনকে মানিয়ে নিলো সৌহার্দ্য! কিন্তু দাদী যে তরীকে দেখে বলেছিল, ওর চেহারার আদল তার অনেক চেনা! সেটা কি শুধুই দাদীর একটা সামান্য ধারণা ছিল? নাকি অন্য কিছু? অনেক কিছু জানা বাকি, এটা সৌহার্দ্য বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে।

-“তোমার-আমার বিয়েটা মোটেও কাকতালীয় নয়, তরী। সবটা সেভাবেই হয়েছে এবং সেরকম ভাবেই ঘটেছে, যেভাবে আমি চেয়েছি। তবে এটা আমি কনফেস করতে পারি যে, আমি তোমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছি। কিন্তু তোমাকে তোমার পরিবার নামক নরক থেকে বাঁচিয়েও এনেছি। মুখে যত যা-ই বলি না কেন?

তোমায় আমার প্রয়োজন। অনেক প্রয়োজন! তাই তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে। তোমায় আমি ছাড়ছি না। হয়তো স্ত্রীর সম্পূর্ণ মর্যাদা তোমায় কোনো একসময় দিবো, কিন্তু ভালোবাসতে পারবো না কোনোদিন। আমি একজনকে-ই ভালোবাসি আর সেই একজনটা তুমি নও!”

তরীর মাথায় হাত বুলিয়ে কথাগুলো বললো সৌহার্দ্য। তরী কিছু শুনলো কি শুনলো না, সেটা তার জানা নেই। তরীর ঘনঘন নিঃশ্বাস জানান দিচ্ছে, সে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন।

-“কেসটা দিন দিন প্রচুর কমপ্লিকেটেড হয়ে যাচ্ছে, বুঝলে রিয়াদ।”
নিজের কেবিনে বসে কপালে আঙুল ঘষতে ঘষতে কথাটা বললো প্রহর।

-“মিস্টার রায়হানের এক্সিডেনটটা যেভাবে হয়েছে, তাতে বুঝা-ই যায় যে, ওনাকে মেরে ফেলাটা-ই উদ্দেশ্য ছিল ওদের। ভাগ্য ভালো হওয়ায় বেঁচে গিয়েছেন উনি। কিন্তু ওনাদের সবার জীবন-ই তাহলে বি*পদ*সংকুল আই গেইস!”
রিয়াদ নিজেও চিন্তিত কেসটা নিয়ে। তবে প্রহর কেসটা নিয়ে অনেক বেশি ঘাটাঘাটি করছে। এটা রিয়াদের কাছে স্বাভাবিক লাগছে না। ভাবনাটা হঠাৎ মুখ ফসকে বের হয়ে গেল রিয়াদের,

-“স্যার, আপনি এই কেসে এতো প্রায়োরিটি কেন দিচ্ছেন আমি বুঝতে পারছি না।”
প্রহর রিয়াদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। রিয়াদ হকচকিয়ে গেল যখন অনুধাবন করতে পারলো যে, সে কী বলেছে। আমতা আমতা করে বললো,

-“আব্ সরি, স্যার! একচুয়েলি, বলতে চাইছিলাম যে, আ…..”
-“এখানে জড়িত প্রতিটা মানুষ আমার জীবনের সবচেয়ে দূর্বল পয়েন্ট, রিয়াদ। মানুষ নিজের দূর্বলতা কখনো প্রকাশ করে না। করাটা উচিতও নয়। কিন্তু আমি নিজের এই দূর্বলতা লুকিয়ে কোনো বেনিফিট পাবে না, কারণ যাদের কাছ থেকে লুকানো উচিত তারা অনেক আগে থেকেই জানে সৌহার্দ্য আমার হৃদস্পন্দন।”

প্রহর রিয়াদের সাথে এতো কিছু শেয়ার করায় রিয়াদ যেন একটু সাহস পেল। তাই সুযোগ বুঝে জিজ্ঞেস করলো,
-“তাহলে মাধুর্য ম্যামকে নিয়ে আপনি এতো সেনসিটিভ কেন?”
প্রহরের আনমনা ও গাম্ভীর্য মিশ্রিত মুখে হঠাৎ হাসি খেলে গেল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে আবার আনমনে সে বললো,

-“কারণ সে মধু। প্রহরের মধু! নাহ্, এটা মিলছে না।উম… মধুর প্রহর! হ্যাঁ, এটা সুন্দর।”
বলতে না বলতেই প্রহরের ফোনে টেক্সটের নোটিফিকেশন এলো। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা ওয়ালপেপারে মধুর ছবি দেখে রিয়াদ মনে মনে হাসলো। বিরবির করে বললো,
-“আসলেই মধুর প্রহর!”

রিয়াদ চলে গেল। প্রহর সেদিকে নজর না দিয়ে ফোনে মধুর মেসেজটা দেখলো,
-“আজকে বিকেলে দেখা করবি। কথা আছে। স্ট্রিট পার্ক, সময়-৫ টা!”
প্রহর ভ্রু কুঁচকালো। মেয়েটা কি এরকম সরাসরি কথা বলা ছাড়া আর কিছুই পারে না? নাম মধু হলে কী হবে? নামের সাথে বৈশিষ্ট্যের কোনো মিলই নেই।

প্রহর বের হয়ে গেল নিজের বাইক নিয়ে। গাড়িটা নিলো না। যেতেই ঘন্টাখানেক লাগবে। বাইকে দ্রুত যাওয়া যাবে, গাড়িতে গেলে যেটা সম্ভব নয়।

প্রহর পৌঁছালো সাড়ে পাঁচটায়। মধু পার্কের বেঞ্চে বসে বাদাম চিবুচ্ছে। হাতে দুটো হাওয়াই-মিঠাই। প্রহর গিয়ে মধুর পাশে বসলো। মধু কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে একমনে বাদাম খাচ্ছে যেন তার আশেপাশে পরিচিত কোনো মানুষ-ই নেই। পৃরহর মধুর হাত থেকে একটা হাওয়াই মিঠাই নিতে গেলে মধু নিজের হাত সরিয়ে ফেললো। বাদাম চিবোতে চিবোতে প্রহরের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো মধু। বললো,

-“এটা নিচ্ছিস কেন? তোর জন্য কিনেছি নাকি?”
প্রহর হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে বললো,
-“দুটো কিনেছো যে!”

-“তো! দুটো কিনলেই তোকে একটা দিতে হবে? কেন বে? আমি দুটোই আমার নিজের জন্য কিনেছি। দুটোই আমি খাবো। টাকা এতো বেশি হয় নাই আমার যে তোকে খাওয়াবো!”
চোখ রাঙিয়ে কথাগুলো বললো মধু। প্রহর বিরক্ত হলো। কপাল কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,

-“এই তুমি ভদ্রতা কবে থেকে শিখবে বলো তো? আমি তোমার থেকে বয়সে বড়, তারওপর আমার পরিচয় শুনে আমাকে তোমার সম্মান করা উচিত, ভয় পাওয়া উচিত!”
মধু কিটকিটিয়ে হাসলো। বললো,

-“ভদ্রতা? আমার থেকে এতো বেশি কিছু আশা করিস না, বস! এসব লোক দেখানো ভদ্রতা-সম্মান আমার মধ্যে জন্মের পর থেকে জিরো লেভেলে না, বরং মাইনাস ফি’গা’রে আছে, বুঝলি?”
প্রহর ব্যর্থতা নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নাহ্! এই মেয়েকে বুঝিয়ে লাভ নেই। তবুও মনের একটা ইচ্ছে প্রকাশ করতে খুব করে চাইলো প্রহর। মধুর এদিক ওদিক তাকানো চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে বললো,

-“আমার একটা কথা রাখবে?”
মধু নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
-“জানি না।”
-“মানে?”
-“মানে হচ্ছে কী কথা রাখতে হবে, বল। মনে চাইলে রাখবো, না মনে চাইলে রাখবো না। তুই তো জানিস, আমি নিজের মনের বিরুদ্ধে কিছু করি না।”

-“একবার আগের মতো সেজে আসবে একদিন? মেয়েলি সাজ!”
মধু নিজের পোশাকের দিকে তাকালো একবার। একটা টিশার্টের ওপর নরমাল শার্ট আর একটা ঢিলেঢালা জিন্স পরেছে সে। চুলগুলো কাঁধের একটু উপরের দিকে একদম ছোট করে কেটে ছেড়ে রেখেছে। মধু নিজের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,

-“সম্ভব না।”
-“একবার-ই তো! আমার এই একটা অনুরোধ রাখবে না।”
মধু উঠে দাঁড়ালো। স্কুটারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
-“মধু অনেক স্বার্থপর একটা মেয়ে। সে নিজের মনের কথা ছাড়া কারো কথা শুনে না, কারো অনুরোধও না। এটা মাথায় ভালোমতো সেট করে নে। চললাম, বস!”

প্রহর কষ্ট পেল কথাটা শুনে। তবুও সেটা প্রকাশ না করে বললো,
-“কী বলার জন্য ডেকেছিলে, সেটা তো বলে যাও!”
-“দেরী করে এসেছিস। ততক্ষণে প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে আমার।”
বলেই ঝড়ের বেগে স্কুটার নিয়ে চলে গেল মধু। প্রহর ওর যাওয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো। যতক্ষণ মধুকে দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল, ততক্ষণ। এবং তার পরেও!

বাতাসের বেগে স্কুটার ছুটছে। চুলগুলো হাওয়ার তালে চোখেমুখে এসে পড়ছে মধুর। আজ বহুবছর পর মধু কাঁদছে। চোখের পানি নিজের গতিতে ঝরে পড়ছে। তার মধ্যে আজ কোনো চেষ্টা নেই। না ঠোঁ*ট কামড়ে কান্না নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা, আর না চোখের পানিগুলো নিজের হাতে মুছে ফেলার চেষ্টা!

সপ্তাহ ঘুরেছে। তরী এখন অনেকটাই সুস্থ! বিছানায় বসে নোটস গুলোতে চোখ বুলাচ্ছে সে। সৌহার্দ্য ঘরে প্রবেশ করলো। তরী তাকে দেখেই শাড়ির আঁচল ঠিকঠাক করে বসে চুলগুলো হাত খোপা করে নিলো। সৌহার্দ্য এগিয়ে এসে তরীর গালে-কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা পরখ করলো। প্রসন্ন হাসি দিয়ে বললো,

-“যাক, ঠিকঠাক আছে।”
তরী অবাক হলো না। এ আর নতুন কী? অসুস্থতার এ কয়দিন সৌহার্দ্যের এমন যত্ন দেখে তরী অবাক হতে হতে এখন আর অবাক হতে ভালোই লাগে না ওর। স্বাভাবিক ভাবেই বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে চাইলো তরী। কিন্তু সৌহার্দ্য ওর দুই বাহুতে হাত দিয়ে বসিয়ে দিতে দিতে বললো,

-“দাদীর কথা এতো কানে তুলতে হবে না। দাদী আজ তোমাকে আমার জন্য লেমনেড বানাতে ব….”
তরীর ভীত চোখের দিকে তাকিয়ে সৌহার্দ্য থেকে গেল। অপলক তাকিয়ে রইলো তরীর চোখ জোড়ায়। সৌহার্দ্যের কপালে ভাজ পড়লো।

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ১০

ধীরে ধীরে সেই ভাজ গভীর হচ্ছে। সৌহার্দ্যের চাহনি দেখে তরী সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলো। সৌহার্দ্য তরীর দুই গালে হাত রাখলো। ওর মুখটা নিজের দিকে তুলে ধরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-“আমার দিকে তাকাও। ঠিক সেইভাবেই তাকাবে, যেভাবে কিছুক্ষণ আগে তাকিয়েছিলে।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ১২