প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ১২

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ১২
Writer Mahfuza Akter

তরী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্যের দিকে। সৌহার্দ্য তরীর চোখের দিকে জহুরি নজরে তাকিয়ে আছে। তরীর চোখে যেন সে খোঁজার চেষ্টায় আছে! হয়তো চেনা কিছু, নয়তো অচেনা। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সৌহার্দ্য বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। তরীর সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো বিমর্ষ ভঙ্গিতে।

-“কীসব হচ্ছে আমার সাথে, নিজেও বুঝতে পারছি না! যে পৃথিবীর মাটি থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে, তাকে বারবার খুঁজি আমি। জানো তো, তরী? মানুষের মন কখনো কোনো যুক্তি মানতে চায় না। হাহ!”
সৌহার্দ্য নিজের হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে কথাগুলো বললো। তরী অবুঝের মতো সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে আছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সৌহার্দ্য ওর দিকে আর তাকালো না। মানসিক ক্লান্তিগুলো আবার সারা শরীরে জেঁকে বসেছে। কি অসহ্যকর অনুভূতি!
সৌহার্দ্য ওয়াশরুমে ঢুকতেই তরী বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। একটু বাইরে যাওয়া প্রয়োজন। দু পা বাড়াতেই পাশে টেবিলের ওপর থাকা সৌহার্দ্যের ফোন ও ওয়ালেটের ওপর নজর পড়লো ওর।

সৌহার্দ্যের ফ্রেশ হয়ে আসতে বেশ ভালোই সময় লাগবে। তাই তরী সবদিকে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে সৌহার্দ্যের ফোনটা হাতে নিলো। ফোন অন করে দেখলো, স্ক্রিনে পাসওয়ার্ড-লকড্ অপশন এনেবল করা। তরী হতাশ হলো। ওয়ালেটটা একবার চেক দেওয়ার জন্য হাতে নিলো, যদি কোনো ক্লু পাওয়া যায়! কিন্তু ওয়ালেট খুলতেই একসাইডে একটা ছবি দেখে তরী বিস্ময়ের শেষ ধাপে পৌঁছে গেল। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে রইলো ছবিটার দিকে। মানে কী এসবের? সৌহার্দ্য তো অরুণীকে ভালোবাসে! তাহলে ওয়ালেটের ভাজে এই ছবিটা কেন রেখেছে? কী চলছে সৌহার্দ্যের মনে?

সৌহার্দ্যের দাদী সবেমাত্র নামাজ শেষে উঠে দাঁড়িয়েছেন। কুঁজো হয়ে যাওয়া দেহটাকে নিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে বিছানায় বসলেন আয়েশি ভঙ্গিতে। তসবীটা হাতে নিবেন এমনসময় দরজার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে গেল দাদীর। সৌহার্দ্য দাঁড়িয়ে আছে। এতোক্ষণ যেন ওনার নামাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষাতেই ছিল!

-“কী হইসে রে, নাতি? ঐখানে অমন কইরা দাঁড়াইয়া আছোস ক্যান? কিছু বলবি?”
সৌহার্দ্য কেশে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
-“তোমার সাথে কথা ছিল!”
-“বলে ফ্যাল! কী বলবি?”
সৌহার্দ্য ভেতরে প্রবেশ করলো। হাতের তালুতে হাত ঘষতে ঘষতে বললো,

-“তুমি এখন ফ্রি-ই আছো, তাই না?”
দাদী বিরক্ত হলো। হাতের ইশারায় নিজের পাশের খালি জায়গাটা দেখিয়ে বললেন,
-“এখানে বয়! আর এতো ঘুরাইয়া কথা না বলে একটু ঝেড়ে কাশো তো দেখি!”

সৌহার্দ্য দাদীর কথা শুনে মেরুদণ্ড সোজা করে বসলো। মনে মনে আশা করলো, দাদী যেন তাকে সবটা বলে! মানসিক অশান্তি থেকে পরিত্রাণের প্রথম উপায় হলো ইতোমধ্যে যেসব ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে, সেসব ক্লিয়ার করা। আর সেটা করার জন্য সৌহার্দ্যকে সবটা জানতে হবে। দাদী সবটা জানে কিনা, সে ব্যাপারে সৌহার্দ্য নিশ্চিত নয়। কিন্তু দাদী যে অনেক কিছু জানে, এটা নিয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। তাই সে বেশ গুরু*তর ভঙ্গিতে বললো,

-“দাদী, আমি তরীর ব্যাপারে তোমার কাছ থেকে সবটা জানতে চাই। সবটা মানে তুমি যা যা জানো!”
দাদী মুখের কৌতূহল নিমেষেই মিলিয়ে গেল। তিনি মুখ মলিন করে ফেললেন। বললেন,
-“তোরা যা জানোস, আমিও তো তা-ই জানি! সুজাতা আমারে যতটুকু বলছে, ততটুকুই তো জানি। এর বাইরে…….”

-“দাদী, প্লিজ! আমার সামনে এসব বলে কোনো লাভ নেই, তুমি জানো। তোমাকে আমি এর আগে সবটা বলেছি না? অরুণীর সাথে আমার সম্পর্ক, ভালোবাসার অভিনয় এসব সবটা তুমি জানতে আর কেউ না জানলেও! তুমি-ই আমাকে বলেছিলে অরুণী আর মিস্টার আরমান কি কি করেছিল! আমি যে সবটা জানি, এটা বাবা-মাও জানে না। ওনাদের না জানিয়ে তুমি আমাকে সবকিছু বলেছিলে না? বলো?”

সৌহার্দ্যের কন্ঠস্বর দৃঢ় ঠেকছে৷ দাদী মাথা নাড়িয়ে বললো,
-“আরে, ঐ ব্যাপার আর এই ব্যাপার তো পুরাই আলাদা! ঐসব তো আমি জানতাম, তাই তোরে জানাইছি! এইখানে তরীরে নিয়া তো জানার মতো কিছু নাই! ও তো সাধারণ একটা মেয়ে।”
সৌহার্দ্য বিরক্ত হলো। মুখ দিয়ে বিরক্ত সূচক শব্দ করে বললো,

-“তুমি সত্যিটা বলবে না, তাই না? তুমি নিজেও জানো, আমার সাথে মিথ্যে বলে কোনো লাভ নেই। আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়।”
দাদী অবাক হয়ে বললেন,
-“এতোটা নিশ্চিত কেমনে তুই? ”
-“চোখ দেখেছি। তরীর চোখ! খুব কাছ থেকে দেখেছি। আর দেখে এটাই বুঝেছি যে, এমন কোনো সত্যি আছে যা আমি আজও জানি না।”

সৌহার্দ্যের ওপর থেকে নজর সরিয়ে দাদী বললেন,
-“সব তোর মনের ভুল। ওসব কিছু না!”
সৌহার্দ্য দাদীর ওপর পূর্ণদৃষ্টি স্থাপন করে বললো,
-“আচ্ছা? সবটা আমার মনের ভুল? তাহলে তুমি যেদিন প্রথম তরীকে দেখলে, সেদিন কেন বলেছিলে যে, তরীর মুখের আদল তোমার অনেক চেনা?

-“ওটা আমার মনের ভুল ছিল?”
সৌহার্দ্য তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
-“হাহ্! আচ্ছা? তাহলে আমাকে এটা বলো যে, ও কথা বলতে পারে না জেনেও কেন ওকে মেনে নিলে? এখন এটা বলো না যে, ও অসম্ভব সুন্দরী বলে তুমি ওকে মেনে নিয়েছো। ওসব বলে কোনো লাভ নেই। তোমাকে আমি বেশ ভালো করেই চিনি। রূপ দিয়ে আর যা-ই হোক, তোমার মন জয় করা সম্ভব নয়।”

দাদী নীরব রইলেন। অযৌক্তিক কথাবার্তা বলে সৌহার্দ্যের মনের সন্দেহ দূর করার চেয়ে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি। সৌহার্দ্য উঠে দাঁড়ালো। সে বুঝে গেছে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। দাদী ওকে কিছুই বলবেন না।

আজ তরীর ভর্তি পরীক্ষা। এবারই তার প্রথম ও শেষ সুযোগ। যদিও সে অনিশ্চিত এটা ভেবে যে, তার স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা!
পরীক্ষা দিতে সৌহার্দ্য-ই নিয়ে এসেছে তরীকে। মিস্টার রায়হান এখনো হুইলচেয়ার ছেড়ে উঠতে পারেননি। তাই সৌহার্দ্যের-ই আসতে হলো। পরীক্ষা শেষে তরী বিমর্ষ ভঙ্গিতে গেইট দিয়ে বের হলো। সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকালো তরীর মলিন মুখের দিকে। বললো,

-“এক্স্যাম ভালো হয়নি!”
তরী মাথা নাড়ালো। বোঝালো ভালো হয়নি। একেবারে যে ভালো হয়নি এমনও না! কিন্তু তরীর মনে হচ্ছে, খুব খারাপ-ই হয়েছে। সৌহার্দ্য তরী মাথায় হাত রেখে বললো,
-“টেনশান করো না। যা হবে, ভালোই হবে। চলো, কিছু খেয়ে নেবে।”

আর কেউ কিছু জানুক, আর না-ই বা জানুক, সৌহার্দ্য তো বেশ ভালো করে জানে যে কথা বলতে না পারলে ডাক্তার হওয়া যায় না। তরীর পক্ষে কোনোদিন ডাক্তার হওয়া সম্ভব না। তার মা না-হয় ততোটা না ভেবে তরীর কথা মেনে নিয়েছে। সুজাতার ব্যাপারটা আলাদা। কিন্তু মিস্টার রায়হান? তিনি কীভাবে তরীর ডাক্তার হওয়ার সিদ্ধান্তে সায় জানালেন? এটা তো কখনোই সম্ভব না। তিনি তো সবটা জানেন ও বুঝেন! ভেবে পায় না সৌহার্দ্য।

তরী খাওয়া শেষে হোয়াটসঅ্যাপে একটা টেক্সট পাঠালো মধুকে। একই কেন্দ্র পড়েছে তাদের দুজনের। তাই মধুর সাথে একবার দেখা করা যায়।
-“কোথায় তুমি, মধু? দেখা করবে না আমার সাথে?”
মধু সাথে সাথেই সিন করলো। রিপ্লাই দিয়ে বললো,

-“আর দেখা করা! আমি পরীক্ষা দেই নি।”
তরী অবাক হয়ে লিখলো,
-“কেন?”
-“আরে ইচ্ছে করেনি শুধু শুধু প্যারা নিতে। চান্স হবে না কিছু না, সেটা আমি ভালো করেই জানি। অহেতুক পরীক্ষা দিয়ে কী লাভ?”
তরী বিরক্ত হলো। এই মেয়েটা এমন কেন? নিজের মন মতো কাজ করে শুধু। নিজের ভালো মন্দটাও বুঝে না। তরী রাগ দেখিয়ে লিখলো,

-“আমার তোমার সাথে কোনো কথা নেই।”
-“আরে ইয়ার! রাগ করছিস কেন? তোর পরীক্ষা কেন হলো বল!”
তরী কোনো রিপ্লাই না দিয়ে অফলাইন হয়ে গেল। তরীর নাকমুখ কুঁচকানো চেহারার দিকে তাকিয়ে সৌহার্দ্য অবাক হলো। তরী এতো বিরক্ত হয়ে আছে কেন? এই প্রথম সৌহার্দ্য ওকে বিরক্তিমাখা মুখে দেখলো। নয়তো সবসময়ই বোকার মতো চাহনিতে, নয়তো অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখেছে। তরীর মুখে বিরক্তিটা বেশ মানায় তো! পরমুহূর্তেই নিজের অদ্ভুত ভাবনায় সৌহার্দ্য নিজেই অবাক হলো।

চোখ ঘুরিয়ে বাইরের দিকে তাকাতেই দৃষ্টি থেমে গেল সৌহার্দ্যের। প্রহর বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে হয়তো কাউকে খুঁজছে! এখানে কেন এসেছে প্রহর, সেটা জানতে খুব ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করার পরিস্থিতিতে তারা এখন নেই। পরিস্থিতি কোথা থেকে মানুষকে কোথায় নিয়ে ফেলে, বোঝাটা আসলেই কঠিন। নয়তো আজ এতো ইতস্ততবোধ তার মধ্যে এসে পড়বে ভেবেছে সে কখনো? সৌহার্দ্য প্রহরের দিকে তাকিয়ে-ই রইলো।

তরী মুখ তুলে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বাইরে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে গেল তরীর। এটা সেদিনকার ঐ ছেলেটা না? এখানে কী করছে ইনি? তরীকে ফলো করছে না তো?
-“এই ছেলেটাকে দেখেছো এর আগে তুমি? একদিন আমাদের বাসায় এসেছিল।”

সৌহার্দ্যের কথা শুনে তরী মাথা নাড়িয়ে জানালো, সে দেখেছে। সৌহার্দ্য কথা বাড়ালো না। তরীকে নিয়ে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। প্রহরের মুখোমুখি হওয়ার কোনো ইচ্ছে তার নেই।
গাড়িতে পাশাপাশি বসলো দুজন। সৌহার্দ্য ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি দ্রুত গতিতে-ই এগোচ্ছে।

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ১১

লুকিং গ্লাসে সৌহার্দ্য তরীর দিকে মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছে। তার মন এটাই বলে যে, তরীকে যতোটা সাধারণ মনে হয়, সে বাস্তবে ততোটা নয়৷ অন্যদিকে তরী আড়চোখে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, সৌহার্দ্যের ওপরের রূপ আর ভেতরের রূপ দুটোই আলাদা। মানুষটা একটা রহস্য, যাকে ভেদ করাটা দুঃসাধ্য হলেও অসাধ্য নয়।

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ১৩