প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৮

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৮
Writer Mahfuza Akter

তরী বারান্দায় বসে দাদীর মাথায় তেল লাগিয়ে দিচ্ছে। ওনার নাকি মাথা ধরেছে। দাদী এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। ওনার আচরণ তরীকে বেশ ভাবাচ্ছে।
-“নাতবৌ! আমার না ক্যান জানি বিশ্বাস হইতেছে না।”

তরী ভ্রু কুঁচকালো। ইনি এতো ভাবছে কেন বিষয়টা নিয়ে? কী নিয়ে সন্দেহ করছেন কে জানে! আর অবিশ্বাস করার মতো ঘটেছে-ই বা কী? তরী বিভ্রান্তিকর একটা পরিস্থিতিতে পড়েছে। ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। দাদী ওর হাত টেনে বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–“সামনে আয় না, বৌ! তোর মুখখানা দেইখা একটু চোখ জুড়াই আমার।”
তরীকে নিজের সামনে টেনে এনে বসিয়ে দিলো দাদী। ওর মুখে হাত বুলিয়ে টলমলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তরীর মনে হচ্ছে, দাদী বারবার ছুঁয়ে ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করছে।

বিশ্বাস করতে চাইছে যে, সামনে বসা মেয়েটা তার কোনো ভ্রম না। তার সামনে থাকা সবকিছু সত্যি এবং বাস্তব। দাদী তার শুভ্র-মলিন শাড়ির আঁচল টেনে চোখ মুছলেন। নাক টেনে বললেন,
-“জানিস, আমার মনে আমি অনেক কষ্ট চেপে রাখছি। অনেক অভিযোগ, হাহাকার আমি নিজের মধ্যে দমাইয়া রাখছি। তোর মুখ দেখলেই ক্যান জানি প্রচুর বুকের ভেতরটা ঠান্ডা হইয়া যায়। মনে হয়, এক যুগ ধইরা জ্ব*লা আ*গুন নিভলো হঠাৎ করে।”

তরী চোখ ছোট ছোট করে হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”
দাদী হাসলো। তরীর গালে হাত রেখে আকাশের দিকে ইশারা করে বললো,

-“ঐ যে আকাশটা দেখেছিস? দেখ, কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে আজকে! একদম ভরা পূর্ণিমা। তোর মুখটাও চাঁদের মতো সুন্দর। রবীন্দ্রনাথ ‘সোনার তরী’ লিখেছিলেন। জানি না, তিনি সোনার তরী দেখেছিলেন কি না! তবে তোকে দেখলে তোকে নিয়ে ‘রূপের তরী’ লিখতেন নিশ্চিত।”
তরী চোখ বড় বড় করে তাকালো। দাদীর মুখে এতো সুন্দর গোছানো কথা শুনে অবাক হওয়ার পাশাপাশি নিজের প্রশংসা শুনে লজ্জা পেল খানিকটা। ঠোঁট এলিয়ে হাসতেই দাদী বললেন,

-“বসময় এমন কইরা-ই হাসিস! তোর হাসি আর নীরবতা দুইটা-ই অন্য রকম সুন্দর!”
আড়াল থেকে সৌহার্দ্য আর সুজাতা ওদের বলা সব কথাই শুনলো। সুজাতা অবাক হলেও কোনো ঝামেলা হয়নি এটা ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

-“খেতে চল! অনেক রাত হয়েছে।”
সুজাতা কথাটা বলে চলে গেলেও সৌহার্দ্য গেল না। তরীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো কিছুক্ষণ। কী আছে এই মেয়ের মধ্যে? কী দেখে তার দাদী এভাবে গলে গেল? শুধু-ই সৌন্দর্য দেখে? হতেই পারে না! দাদীকে সে ভালো করে চেনে। শুধু রূপ দিয়ে তার মন গলানো কখনোই সম্ভব নয়। তাহলে এর পেছনে কারণটা কী?

রাতের খাওয়া-দাওয়ার আরেক ঝামেলার সূচনা হলো। তরী বর সৌহার্দ্য আলাদা ঘরে ঘুমায়, এটা শুনতেই সৌহার্দ্যের দাদী আবার চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। তিনি বিস্মিত চোখে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“মানে কী? তুই আর নাতবৌ আলাদা ঘরে ঘুমাস? কালকে রাতে তো ব্যাপারটা খেয়াল করি নাই! তোদের না বিয়ে হইছে? বিয়ের পর জামাই-বউ আলাদা ঘরে ঘুমায় কোনোদিন?”

সৌহার্দ্য মহা বিপদে পড়ে গেল। এখন কী বলে বুঝাবে দাদীকে? ইনিয়ে-বিনিয়ে বললো,
-আসলে… দাদী… হয়েছে কী… মানে তরীর তো পড়াশোনা আছে! ও রাত জেগে পড়ে। আর আমি সারাদিন পর হসপিটাল থেকে ক্লান্ত হয়ে বাসায় আসি। আমারও ঘুমের দরকার। তাই দুজনের সুবিধার জন্য….. ”
সৌহার্দ্যের কথায় ঘোর আপত্তি জানিয়ে দাদী বললেন,

-“না, এটা কোনো কথা হইলো? কি অলক্ষুণে কাজ-কারবার শুরু করছোস তোরা?”
সুজাতার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“আর বউমা, তুমিও কেমন কইরা এসব ব্যাপারে সায় দিতেছো? ওরা আলাদা ক্যান থাকবো? বলি, তোমার মাথায় কি ভালো বুদ্ধি-সুদ্ধি কিছু নাই? এমন কইরা চললে কেমনে হইবো বলো তো! তোমার কি নাতি-নাতনির মুখ দেখার ইচ্ছা নাই?”

আবার সৌহার্দ্যের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“কীরে, নাতি! তোর কি মনে চায় না তোর বাপ-মাকে নাতি-নাতনির মুখ থেকে দাদা-দাদী ডাক শুনানোর?”
সৌহার্দ্য হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। দাদী যে এমন সব কথা বলবে, সৌহার্দ্য সেটা ভাবতেও পারেনি। তরী গোল গোল চোখে একবার দাদীর দিকে, আরেকবার সৌহার্দ্যের দিকে তাকাচ্ছে।

দাদী আবার বলা শুরু করতে নিবেন, এমন সময় সৌহার্দ্য ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-“থামো। তোমার মুখে আর আজেবাজে কথা শোনার ইচ্ছে আমার নেই। বয়স তো কম হলো না! তবুও মুখে লাগাম টানার কোনো চেষ্টা-ই করো না তুমি। ও এখন থেকে আমার ঘরেই থাকবে।”
দাদী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

-“ও? এই ও-টা কে? সবসময় খালি মেয়েটারে ‘ও’ বলওস ক্যান? ওর কি কোনো নাম নেই?”
সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে বললো,
-“আচ্ছা, ঠিক আছে। তরী। এখন থেকে তরী বলেই ডাকবো। এবার খুশি?”

-“না। ওকে নিজের সাথে কইরা তোর ঘরে নিয়া যা। একসাথে যাবি তোরা। আর বউমা, তরীর সব জিনিসপত্র সৌহার্দ্যের ঘরে পাঠানের ব্যবস্থা করো। আজকের পর থেইকা ওদের দুইজনরে দুই ঘরে যেন আমি না দেখি!”
সৌহার্দ্য নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেও তরী চিন্তায় পড়ে গেল। এই গম্ভীর মানুষটার সাথে এক ঘরে থাকবে কী করে ও? কাঁদো কাঁদো চোখে সুজাতার দিকে তাকাতেই দেখলো, উনি মিটমিটিয়ে হাসছেন। তরী হতাশ হলো। সৌহার্দ্যের পেছনে পেছনে হেঁটে চলে গেল ওর ঘরে।

-“এই দুইজনের মধ্যে ঝামেলা আছে এইটা তুমি আমারে আগে কইবা না, বউমা? এইবার দেখো, আমি ওদের কেমনে এক করি!”
সুজাতা কথাটা শুনে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। তার ছেলেকে তিনি বেশ ভালো করেই চেনেন। তবুও তার মনে হয়, কিছু একটা ঘটবে যা সৌহার্দ্যকে একদম বদলে দেবে।
তরী সৌহার্দ্যের ঘরে ঢোকার পাঁচ মিনিটের মধ্যে সার্ভেন্টরা ওর ঘর থেকে সব ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও বইখাতা সৌহার্দ্যের ঘরে রেখে গেল। সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-“আলমারির এক সাইড খালি-ই আছে। সৈখানে তোমার কাপড়গুলো রাখো। আর এই টেবিলটা এখন থেকে তোমারও।”
সৌহার্দ্য বারান্দায় চলে গেল। তরী নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখলো। বারান্দা থেকে ধোয়া আসছে। এর আগে অনেকবার সৌহার্দ্যকে সিগারেট টানতে দেখেছে তরী। মনে মনে বললো,

-“কী অদ্ভুত! ডাক্তাররা কখনো সিগারেট খায় নাকি? আজব মানুষ তো! গোমড়ামুখো!”
তরী সকল চিন্তা মাথা থেকে ফেলে পড়তে বসলো। এ কয়দিনে পড়াশোনায় অনেক গ্যাপ পড়েছে। পুরোনো পড়াগুলো টানতে হবে আজকে রাতে।

সৌহার্দ্য ঘরে এলো রাত দুটোয়। বারান্দার বাতাস ভালো লাগলেও এখন একটু ঘুমানো দরকার। কালকে দুটো সার্জারী আছে। এসবের জন্য হলেও একটু ঘুমিয়ে নিজের মাথা ঠান্ডা রাখা জরুরি। কিন্তু ঘরে ঢুকতেই ভ্রু-জোড়া আপনাআপনি কুঁচকে গেল সৌহার্দ্য। তরী পড়ার টেবিলে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে। কী আশ্চর্য? এই মেয়ে এভাবে ঘুমাচ্ছে কেন?

সৌহার্দ্য এগিয়ে গিয়ে তরীকে ডাকতে গিয়েও ডাকলো না। মেয়েটার ঘুম ভাঙানো ঠিক হবে না। ফ্লোরে গড়িয়ে থাকা শাড়ির আঁচলটা তুলে কোলে রাখলো সৌহার্দ্য। মাঝরাতের দিকে হালকা শীতল বাতাস বইছে। হয়তো বৃষ্টি হবে! ওর নিজেরই ঠান্ডা-ঠান্ডা লাগছে। তাই তরীর গায়ে একটা পাতলা চাদর দিয়ে দিলো।

বাতি নিভিয়ে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বা*লিয়ে দিলো সৌহার্দ্য। বিছানার একপাশে শুতেই তরীর মুখের দিকে চোখ পড়লো ওর। মেয়েটা মায়াবী! দাদী ঠিকই বলেছে। একেবারে চাঁদের মতো। কিন্তু তবুও এই মেয়েটার প্রতি সৌহার্দ্যের এখনো কোনো অনুভূতি সৃষ্টি হয়নি। আদৌ কখনো হবে কি না জানা নেই।

তরী ভোরেই কোনো রকম নাস্তা করে ক্লাস করতে চলে গেছে। সৌহার্দ্য একেবারে রেডি হয়ে খেতে এলো। ব্রেকফাস্ট কমপ্লিট করতেই দাদী আড়চোখে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“কাল রাতে তো ভালোই বৃষ্টি হইলো। আমি আরো ভাবলাম আমার নাতি নতুন বিয়ে করছে! রাতের বেলা বৃষ্টিতে ভিজবো, প্রেম করবো। তা করছো নাকি কিছু?”

সৌহার্দ্য বিরক্ত হলো। ভাগ্যিস এখানে তরী নেই। নয়তো কী একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতো সৌহার্দ্যকে!
-“বয়স তো কম হয়নি! মাথায় তো ভালো কিছু ঘোরে না। এখন একটু ধর্মকর্মে মন দাও, বুঝলে?”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৭

বলেই সৌহার্দ্য তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। মেইনডোরের কাছাকাছি যেতেই প্রহরকে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখলো সে। অবাক হলো সৌহার্দ্য। প্রহর? এতো বছর পর! হঠাৎ এখানে? কিন্তু কেন?

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৯