প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৯

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৯
Writer Mahfuza Akter

-“সিক্রেট ইনভেস্টিগেটর অভীক শাহরিয়ার আজ আমার বাড়িতে হঠাৎ? আনবিলিভেবল!”
সৌহার্দ্যের মুখে নিজের আসল পরিচয়ের কথা শুনে প্রহর তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে চেয়েছে বলেই সৌহার্দ্য জানতে পেরেছে সবটা। তাই মলিন হাসলো প্রহর। সেই হাসি সৌহার্দ্যকে বুঝিয়ে দিলো যে, প্রহর তার কাছ থেকে এমন কিছুই আশা করেছিল।
প্রহর এগিয়ে এলো। ধীর গতিতে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। সৌহার্দ্যের কাছাকাছি গিয়ে ডান হাতটা তার ডান কাঁধে রাখলো।

-“সেই সময়টা আমি ভুলিনি! সেই সময়টার কথা ভুলে যাওয়া সম্ভব-ই নয়। তখন দিনে হুটহাট আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরতাম। কারণ একজন আরেকজনের হৃৎস্পন্দন শোনা ছাড়া থাকতেই পারতাম না।”
সৌহার্দ্য কথাটা শুনে কিছুটা নরম হলো। চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠলো ওর। কিন্তু সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো। নিজেকে পুনরায় শক্ত খোলসে আবৃত করে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“অতীত সবসময়ই সুন্দর। কিন্তু সেই সুন্দর স্মৃতিগুলো বর্তমানের জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই বুদ্ধিমানের কাজ হলো অতীতের সেসব স্মৃতি মুছে ফেলা। অন্তত নিজের মানসিক প্রশান্তির জন্য হলেও অতীতকে ভুলে যেতে হয়।”
-“তুই পেরেছিস ভুলতে?”
সৌহার্দ্য বিব্রতবোধ করলো। সোজা হয়ে প্রহরের মুখোমুখি দাঁড়ালো। প্রহর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য কঠিন সুরে বললো,

-“ভুলবো না তো কী করবো আমি? তুই কখনো ভাবিস আমার কথা? আমায় ছেড়ে যাওয়ার সময় একবারও ভেবেছিলি আমায় নিয়ে? যখন আমার একজন বন্ধুর প্রয়োজন ছিল, তখন তুই ছিলি না আমার পাশে। তাহলে আমি কেন তোকে মনে রেখে কষ্ট পাবো?”
বলেই বড় করে শ্বাস নিলো সৌহার্দ্য। প্রহরের দিকে আঙুল তাক করে বললো,

-“তুই একটা স্বার্থপর। আই হ্যাভ নেভার সিন সাচ আ সেল্ফিশ পার্সন লাইক ইউ!”
প্রহর প্রচুর আঘাত পেল এমন কথা শুনে। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
-“আমি জানি, আমি কেমন! তাও তোর মুখ থেকে শুনে ভালো লাগলো। তবে আমি আজ প্রফেশনাল একটা দরকারের জন্যই এসেছি।”

সৌহার্দ্য তা*চ্ছি*ল্যের হাসি দিয়ে বললো,
-“সেটা তোর বলতে হবে না। তুই যে নিজের স্বার্থ ছাড়া অকারণে এখানে আসবি না, সেটা আমার বেশ ভালো করে জানা আছে।”

সৌহার্দ্য কথাগুলো বলা শেষ করতেই সুজাতা আর দাদী ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হলেন। সুজাতা প্রহরের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। প্রহর এগিয়ে এলো। সুজাতাকে সালাম দিয়ে মলিন হেসে বললো,

-“কেমন আছো, মনি মা? তোমার ছেলে তো আমার ওপর প্রচন্ড রেগে আছে। তুমিও কি এখন রাগ করবে আমার ওপর?”
সুজাতা প্রহরের কথা শুনে হাসলেন। প্রহরের মুখে হাত বুলিয়ে দিলেন। তার চোখে পানি ছলছল করছে। সৌহার্দ্য আর প্রহরকে তো তিনি কখনো আলাদা করে দেখেননি!

সৌহার্দ্যের যেমন প্রাণের একটা অংশ ছিল প্রহর, তেমনি প্রহরেরও বন্ধুর প্রতি অদ্ভুত ভালোবাসা ছিল। হঠাৎ তিন বছর আগে প্রহর সৌহার্দ্যের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। হারিয়ে যায় সে সৌহার্দ্যের জীবন থেকে! প্রথম প্রথম সৌহার্দ্য ওর কথা ভেবে কষ্ট পেত।

কিন্তু বছর ঘুরতেই সেই কষ্ট ক্রোধে পরিণত হয়। প্রহরের কথা শুনলেই রেগে যেত সে। ওদের দুজনের মাঝে ঠিক কী ঘটেছে, সুজাতা আজও জানেন না। বুঝতে পারেননি দুজনের মধ্যকার দূরত্ব ও কলহের কারণ। তবে আজ হঠাৎ প্রহরের আগমনে অবাক হয়েছেন তিনি। এতোদিন পর হঠাৎ প্রহর কেন এলো এই বাড়িতে? তিনি নিজের চোখের কোণের জল মুছে বললেন,

-“আমি যে তোর মা! মায়েরা কখনো ছেলেদের ওপর রাগ করে থাকতে পারে? আমি তো ভেবেছিলাম, তোকে হয়তো আর কখনো দেখতেই পাবো না! কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি বল তো? আমাদের কথা একবারও মনে পড়েনি তোর?”
-“যাদেরকে মনে নিয়ে ঘুরে বেড়াই, তাদের কথা ভুলবো কী করে, মনি মা? যাইহোক, বাদ দাও সেসব কথা। আমি বাবাইয়ের সাথে একটু দেখা করবো।”
সৌহার্দ্য বিরবির করে বললো,

-“বাবা তো সেই কবে থেকে অসুস্থ হয়েছে! এতো দিনে একবারও আসেনি। কিন্তু এখন মোটামুটি সুস্থ হওয়ার পর দেখা করতে এসেছে।”
বিরবির করে বললেও কথাটা সবাই শুনতে পেল। প্রহর হালকা কেশে বললো,

-“আসতাম না আমি কখনো এ বাড়িতে। আজ শুধু ইনভেস্টিগেশনের প্রয়োজনে এসেছি। আর বাবাই যতদিন হসপিটালে এডমিটেড ছিল, ততদিন রোজ-ই আমি তার সাথে দেখা করেছি। কেউ হয়তো সেই খবর রাখে না!”

-“রাখার প্রয়োজনও বোধ করি না আমি। মা, আমি যাচ্ছি। সার্জারি আছে আজকে। ফিরতে লেইট হবে। তরীকে বলে দিও।”
দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলে হনহন করে বেরিয়ে গেল সৌহার্দ্য। সুজাতা হা করে ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। এতো দিনে এই প্রথম সৌহার্দ্য তরীকে নিয়ে এভাবে কথা বললো। দাদীকে জিজ্ঞেস করলেন মুখে বিস্ময় ভাব বজায় রেখেই,

-“ছেলেটা কি রেগে গিয়ে ভুলভাল বলে গেল, মা? নাকি আমি কানে ভুল শুনলাম?”
দাদী মুখ বাকিয়ে হেসে বললেন,
-“রাইগা গেলেই মনের ভেতর ঘুরঘুর করা কথা প্রকাশ পায়। বুঝলা, বউমা? তুমি নিজের ছেলেরে এখনও চিনে উঠতে পারলা না? যাইহোক, তুই দাঁড়াইয়া আছোস ক্যান? চল, তোর বাবাইয়ের সাথে তোরে দেখা করাই।”
বলেই দাদী হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেলেন প্রহরকে।

-“কত দিন পরে তোরে কাছে পাইছি। আজকে তোরে ছাড়তেছি না আমি। বল তো দেখি আমারে এইবার? বিয়ে করছোস?”
প্রহর একগাল হেসে বললো,

-“তুমি থাকতে আবার বিয়ের চিন্তা করতে পারি নাকি আমি? বিয়ে করলেও আমার বউ তোমার মতো সতীনের সাথে পেরে উঠবে না। তাই ভাবলাম, তোমাকেই একমাত্র বউ বানিয়ে রাখি।”
দাদী নিজের লাঠি দিয়ে প্রহরের হাঁটুতে আঘাত করে বললো,
-“বদছেলে কোথাকার!”

তরী ক্লাস শেষে বের হতেই মধু ওকে ঝাপটে ধরে খুশি হয়ে বললো,
-“কতদিন পরে এলি, ইয়ার! তোকে ছাড়া এতো এতো বোর হচ্ছিলাম! আই রিয়েলি মিসড ইউ।”
তরী হেসে ফেললো এমন কথা শুনে। মধুকে ইশারায় বললো,
-“আমি তো এমনিতেই বোরিং। আমার সাথে থাকলে বোর হতে- সেটা মানা যায়। কিন্তু আমি না থাকলে বোর হবে কেন?”
মধু তরীর গাল টেনে দিয়ে বললো,

-“আরে, তোর নীরবতাটা-ই মিস করছিলাম। তুই এমন একজন, যাকে নিজের সব কথা বলা যায়। তুই-ও আমার সব কথা মন দিয়ে শুনিস। আজকের যুগে কারো এতো সময় নেই রে, অন্যকারো সুখদুঃখের কথা শোনার!”

তরী শুকনো হাসি দিলো। তার নিজের ভেতর জমে থাকা কষ্টের পাহাড়ের একটা ধূলিকণা-ও তো সে কারো কাছে কখনো প্রকাশ করেনি! সেসব মনে পড়লে শি*রা দিয়ে প্রবাহিত র*ক্ত*স্রো*তও উ*ত্ত*প্ত হয়ে যায়। তরী চায় না বারবার নিজের মনে ক্ষ*তগুলো মনে করে সেই পুরনো ঘাঁ-গুলো তা*জা করে তুলতে। দিনকাল যেমন চলছে, চলুক না! তরী না-হয় সাধারণ তরী হয়েই পৃথিবীতে পরিচিত থাকুক!

তরী বাসায় ফিরলো দুপুরের দিকে। ক্লান্ত হয়ে নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার সময় প্রহরের সাথে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল তরীর। প্রহর বেরিয়ে যাচ্ছিলো বাড়ি থেকে। মিস্টার রায়হানের সাথে বসে অনেকক্ষণ কথা বলেছে আজ। তাই জরুরি কাজের তাগাদা দিয়ে চলে যাওয়ার পথে তরীর সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবেনি সে।

প্রহর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তরীকে পর্যবেক্ষণ করছে। এই মেয়ে অপরূপ সুন্দরী হলেও এর আড়ালে কিছু একটা আছে। কিন্তু সেটা এমনভাবে ঢেকে রাখা হয়েছে যে, কারো কল্পজগতেও তা ধরা দিবে না কোনোদিন। আজ তরীকে মুখোমুখি দেখে কেন যেন মনে হচ্ছে, তার ধারণা হয়তো এতোটাও পাকাপোক্তভাবে সত্যি নয়, যতটা সে ভাবছে। কিন্তু তবুও! তার ধারণা পুরোপুরি ভুল হবে, ততোটাও বোকা সে নয়।

-“চলে আসছোস? ভালো হইসে। বল তো, নাতি! এইটা কে?”
দাদী তরীকে দেখিয়ে প্রহরকে প্রশ্ন করলো। প্রহর রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো,
-“আরে, দাদী! কী যে বলো না তুমি! ওনাকে না চিনে পারি আমি? সৌহার্দ্যের একমাত্র বউ, আমার একমাত্র ভাবী বলে কথা!”

তরী অবাক চোখে তাকিয়ে আছে প্রহরের দিকে। ওর কেন যেন প্রহরের কথাগুলো স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না। তরী চোখে অবাকতা বজায় রেখে-ই হাসলো।
-“আজকে আসি তাহলে! আমাদের অবশ্যই আবার দেখা হবে।”

প্রহর বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। সাথেসাথেই ওর ফোন বেজে উঠলো। মধু ফোন দিয়েছে।
-“তরী কাল সারারাত বাসায়ই ছিল। ওর কাছ থেকে সবটা শুনেছি আমি। কাল ওর দাদী-শাশুড়ি নাকি ওকে জোর করে ওর বরের ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। ও সেখানেই রাত জেগে পড়াশোনা করেছে। আরও অনেক কিছু লিখে বলেছে ও আমাকে।”
প্রহর অবাক হলো। তাহলে কি তরীকে সে অহেতুক সন্দেহ করছে? কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব?

সৌহার্দ্য বেশ ভালো মন নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো। আজকে একটা পেশেন্ট ডে*ঞ্জা*রজোন থেকে ফিরে এসেছে। এতে তারও কম শ্রম দিতে হয়নি! কিন্তু শেষ মুহূর্তে সফল হওয়ায় মনটাই ভালো হয়ে গেছে ওর।

-“কইরে, নাতবৌ! আমার নাতি সারাদিন খা*ই*টা দিনশেষে বাড়ি ফিরছে। ওরে ঠান্ডা ঠান্ডা শরবত বানাইয়া দে!”
চিৎকার করে তরীর উদ্দেশ্যে দাদীর বলা এসব কথা শুনে সৌহার্দ্য বিরক্ত হলেও হেসে দিলো সে। দাদীর আসলেই মাথা-খারাপ হয়ে গেছে। তরী একগ্লাস লেমনেড এনে সৌহার্দ্যের দিকে বাড়িয়ে দিলো। মনে মনে বললো,

-“এখন নিশ্চিত গ্লাসটা ভে*ঙে ফেলবে। কেন যে দাদী বারবার ঠে*লে*ঠু*লে আমাকে এই গোমড়ামুখো-টার কাছেই পাঠায়!”
সৌহার্দ্য স্বাভাবিক ভঙ্গিতে-ই তরীর হাত থেকে গ্লাসটা নিলো। তরীর ভীত মুখশ্রী দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। পরমুহূর্তেই সৌহার্দ্য ফুরফুরে মনে নিঃশব্দে হেসে বললো,

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ৮

-“থ্যাঙ্কিউ!”
তরী ফ্যালফ্যাল করে সৌহার্দ্যের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই গোমড়ামুখো-টা হাসতেও জানে? সে তো জানতো না!

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ১০