প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব ৪২

প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব ৪২
আরোহী নুর

আঁখির নাম নিয়ে চিৎকার করে করে কাঁদছে আদ্রিশ অন্ধকার কক্ষে বসে,বারান্দা হয়ে রাতের চাঁদের ছড়ানো কিছু আলো ঘরে প্রবেশ করেছে মাত্র,সেই আলোতেই আঁখি আর তার বিয়ের দিনের ছবি দেখে যাচ্ছে আর কাঁদছে।আজ চারদিন হলো ঠিকমতো খায়নি সে,ঘুম নেই চোখে,জীবন নিরর্থক হয়ে আছে তার,চারিদিকে যেন আঁখিকেই দেখতে পায়,কাজেও যায় না,

আফসোস করে আজ নিজের হাতের নিজের গুছানো জীবন শেষ করে দিল,মোহের টানে ভালোবাসাকে তুচ্ছ করল,আজ মোহ শেষ হয়ে গেলেও ভালোবাসা হীনা জীবন্ত লা*শে পরিণত হয়েছে সে।এখন যে অন্ধকারেই বসে থেকে দিন পার করা তার কাজ,কোনোকিছুতেই মনোনিবেশ করতে সক্ষম হয় না সে আর।নেই এমন কোনো আশ্রয় যেখানে গেলে পাবে মনের অল্প প্রশান্তি,সব আপনজন তো নিজ হাতেই জীবন থেকে সরিয়েছে।তাদের কাছে ক্ষমা চাইবারও সাহস জুটিয়ে উঠতে পারছে না,কান্নার সাগরে ভেসে ভেসে ডাকছে আঁখিকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

″আঁখি এই আঁখি, আসবে না ফিরে?চলে এসো না,আমি ভুল করে গেছি আঁখি দয়া করে ক্ষমা করে দাও,দেখো না আজ আমি নিঃস্ব, না খেঁয়ে থাকলে তোমার মতো কেউ জোর করে মুখে তুলে খাওয়ায় না আজ আর,মন খারাপ থাকলে কেউ এটা ওটা বলে আমাকে হাসানোর চেষ্টা করে না,ইচ্ছে করে আমার সাথে ঝগড়া বাঁধায় না আর না তো নিজে থেকে কথা বলতে আসে,আমায় ক্ষমা করে দাও,

আমি বুঝতে পারি নি,এখন যখন তোমায় অন্যের সাথে দেখলাম তখন বুঝতে পারলাম তোমার সেদিন কতটা খারাপ লেগেছে রিদিকাকে আমার জীবনে মেনে নিতে গিয়ে।দয়া করে চলে আসো আমি পারব না তোমাকে অন্যের সাথে মেনে নিতে আর,আমি যে ভুল করে গেছি,ক্ষমা করে দাও আমায়।
না আঁখি আর নয় তোমাকে তো আমার কাছে ফিরতেই হবে,এখন তুমি আসতে না চাইলে আমাকে তো অন্য পথ অবলম্বন করতেই হবে।দিনশেষে তোমাকে আমার কাছেই থাকতে হবে আঁখি।দেখে নিও।″

আজ ধুমধাম করে আঁখি আদৃতের এনগেজমেন্ট সম্পন্ন হলো,সকল গেস্টরা চলে গেলে হঠাৎ সেখানে এলেন ডা.সানিয়ার স্বামী রাকিব।রাকিব সোজা এসেই আঁখির উদ্দেশ্যে বলল।
″ডা.আঁখি সানিয়া যা করেছে ভুল করেছে আমি মানছি,তাই বলে তাকে জেলে দিয়ে দিবেন!ও তো ওর ভুলের সাজা পেয়েছে, আদৃতকে তো ও অবশেষে পায় নি,বরং কথাটা আপনি আমাকে জানালে এ নিয়ে ওর সাথে আমার অনেক বিবাদ হয়,কিন্তু ওকে কি জেলে দেওয়াটা জরুরি ছিল?আমাদের এই নিষ্পাপ সন্তানের দিকে তাকিয়ে হয়েও ওকে ক্ষমা করে দাও,প্লিজ। কেসটা তুলে নাও।″

″দেখুন মি.রাকিব আপনার ওয়াইফের জন্য দুইটা মানুষকে কতটা যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে তা আপনি কল্পনায়ও ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারবেন না,এমন ধোঁকাদারির জন্য আমার আর ডা.আদৃতের মধ্যে যে কারো প্রাণের নাশও ঘটতে পারত তার দায় কি আপনার স্ত্রী নিতেন?আঁখি ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে না,তাই প্রমাণ সহিত আপনার স্ত্রীকে জবাব দিয়েছি,তবুও আপনাদের বাচ্চাদের কথা ভেবে আমি কেস তুলে নিব কিন্তু এর আগে ওকে একটু সাজা কাটতে হবে,সবে তো কয়েকদিন হলো মাত্র,এক মাস না হয় জেলে কাটাক,এক মাস পর বাড়ি ফিরে আসবে আপনি নির্দ্বিধায় থাকতে পারেন।তা বসুন।″

″না কাজ আছে।″
মলিন মুখে চলে গেল রাকিব।
″আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করব আঁখি?″
″হুম,করুন ডাক্তার সাহেব।″
″তুমি তো কাউকেই ছাড় দেও না,তবে আদ্রিশের বিরুদ্ধে কোনো স্টেপ কেন নেও নি?″

″এমনও তো হতে পারে ওর বিরুদ্ধে এত ভয়াবহ কিছু করেছি যা কেউ জানে না।…হা হা হা″
কথাটা প্রথমে গম্ভীরত্ব নিয়ে বলল অতঃপর অল্প থেমে হেসে দিলো।
″কখনও কখনও আমার তোমাকে অনেক রহস্যময় মনে হয়।″
″এতো রহস্য খোঁজতে আসবেন না,পরে না আবার রহস্যের তলে হারাতে হয়।″
″তোমাতে হারানোর তো একটা সুযোগ চাই সুখপাখি,সুযোগ পেলে কখনও ছাড় দিতে চাই না,হোক না সে তোমার কোনো রহস্য অতলেই।″

″আর যদি রহস্য খোঁজতে এসে আমায় হারাতে হয় আবার?″
আঁখির মজার ছলে বলে যাওয়া কথাটা আঘাত করে গেল আদৃতের মনে,সাথে সাথে ঝাপটে ধরল তাকে,বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল।
″এমনটা বলো না কখনও সুখপাখি,পাগল হয়ে যাব আমি,আমি খোঁজব না কখনও এমন কিছু যার বদৌলতে আমার তোমাকে হারাতে হয়।″
″সত্যিই আপনি পাগল,কোথাও যাচ্ছি না আমি,এই তো আছি আর সারাজীবন থাকব আপনার হয়ে।″

আঁখিকে তা পরিবার তাদের কাছে নিয়ে এসেছেন।আঁখি এখন খান ম্যানশনেই থাকে।
আঁখি রেডি হচ্ছিল, আদৃত হঠাৎ করেই জেদ ধরল রেডি হয়ে থাকতে ওকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাবে।তখন আঁখি জানতে পারল আশরাফ রায়হান খান আদ্রিশের নামে কেস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।হুটহাট গেল আঁখি তার বাবার কাছে।
″বাবা তুমি আদ্রিশের নামে কেস করতে যাচ্ছো?″

″হ্যাঁ,এতোদিন ওর বিরুদ্ধে স্টেপ নেইনি কারন আমি তোর উপর রেগে ছিলাম কিন্তু এখন তো নই,আমার মেয়ের সাথে এমন করা কেউ কখনও পার পেয়ে যেতে পারবে না।″
″না বাবা আমি কেস করে এতো ছোট সাজা ওকে দিতে চাই না,আমি চাই ও নিজের কাজে আফসোস করুক,ফিরে পেতে চাক হারিয়ে যাওয়া সব কিন্তু খালি হাতে ফিরে যাক,আর এমনটা হচ্ছে ও,তুমি জানো ও রিদিকাকে ছেড়ে দিয়েছে,ঘর থেকেও বের করে দিয়েছে আর এখন নিজে সারাদিন পথভ্রষ্ট হয়ে ঘোরাফেরা করে,আর কি চাই বলো।প্লিজ তুমি এবার কেসটেস করতে যেও না।″

″তবে তুই এতসব জানিস কি করে?″
″ওসব তুমি না জানলেও হবে বাবা,তোমার মেয়েকে কোনোদিক থেকে কম মনে করো তুমি?″
″হুম, এটা তো আমারই মেয়ে।আমার পাগলি প্রমত্ত অঙ্গনা।″
″আস্তে বলো বাবা পরে না পুলিশ আমায় ধরতে আসে,প্রমত্ত অঙ্গনা কিন্তু মানুষের খু*ন করে বেড়ায়,পুরো বাংলাদেশের পুলিশ ওকে খোঁজে বেড়াচ্ছে। হা হা।″

″আরে হ্যাঁ, আমি কখনও কখনও ভাবি,তোকে আমি আদর করে প্রমত্ত অঙ্গনা ডাকতাম,কারণ তুই সারাদিন দুষ্টুমি পাগলামি করতি আর রেগে গেলে তো আর কথা নেই সে কি রূপ,তাই এমনটা ডাকতাম।কিন্তু একই নামে কেউ এভাবে মানুষ খু*ন করে বেড়াবে কে জানত।″
″আচ্ছা ওসব ছাড়ো বাবা,তুমি এখন আর কোনো কেস করছ না,ঘরে বসে রিলাক্স করো।″

আঁখি আজ আদৃতের দেওয়া সেই কাতান শাড়িটা পরেছে,সাথে মেচিং করে হালকা কিছু জুয়েলারি পরে চুল ছেড়ে দিয়েছে,চোখে কাজল দিয়েছে আজ গাঢ় করে,হালকা করে লিপস্টিকও দিয়ে দিলো ঠোঁটে,ব্যাস আয়নাতে নিজেকে দেখে নিজেই যেন মুগ্ধ হলো।পিছন থেকে মাইশা বলে উঠল।
″কি রে,ডা.সাহেবকে মারার ফন্দি করছিস না কি?এতো সাজসজ্জা,বেচারা তোর রুপে মগ্ন হয়ে না প্রাণ হারায়।″
″তোর মুখেই যতসব অলক্ষুণে কথা।″

″হুম, এখন থেকে স্বামীর অমঙ্গলের ভয় দেখছি।″
″তো হবে না কেন।স্বামী পরে হলেও আগে উনি আমার ভালোবাসা,আর আমি কখনও চাই না উনার সাথে বাজে কিছু হোক।″
″হুম,তা আমার কথাই লাগল তো দেখলি?″
″কি কথা?″

″এই তো বলেছিলাম না,একদিন এই পরিবার তোকে আবারও মেনে নিবে।″
″আমিও জানতাম আমার বাবা– মাম্মাম,আমার পরিবার কখনও আমাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারবে না।আর তোর দেওয়া আশ্বাসটা থেকেই তো শক্তি পেতাম।″
″মাইশার দেওয়া আশ্বাস মানে?″

আহিলের হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হয়ে ভ্রু উঁচিয়ে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে বলা কথাটায় হকচকিয়ে উঠল মাইশা আঁখি দু’জনই,সাথে সাথেই দু’জনই জিহ্বায় কামড় দিয়ে দিল।এবার আহিলের কাছে পরিষ্কার হলো সবটা।
″বুঝতে পেরেছি আমাদের দ্বন্দ্ব থাকলেও বান্ধবী দু’জনের আলাপচারিতা বজায় ছিল।আর ওই বদের হাড্ডি মাইশা এতদিন আমার সাথে মিথ্যা বলছিল যে আঁখির সাথে ওর কোনো যোগাযোগ নেই।″

″তো কি হয়েছে?তোরা বাপ ছেলে যার তার সাথে ঝগড়া করবি আর তোদের হয়ে সবাই মা*রা*মা*রি*তে এগিয়ে যাবে না কি?হ্যাঁ আমাদের যোগাযোগ ছিল।এমনকি আমরা দেখাও করতাম প্রায়ই,আর এই যে বাপ হতে চলেছিস তা সবার আগে আমিই কনফার্ম করেছি।″

অবাক হয়ে আহিল মাইশার দিকে তাকালে মাইশা দাঁত কেলানো একটা হাসি দিয়ে দেয়।
″হয়েছে এখন গোয়েন্দা গিরি ছেড়ে রাস্তা থেকে সর তো আমায় এখন যেতে হবে আমার দেরি হচ্ছে।″
″হ্যাঁ,তোর মহারাজা সেই কখন থেকে এসে বসে আছেন।″
″ওকে তবে যাই।সর সর।″

গাড়িতে বসে আছে আঁখি আদৃত, আদৃত ড্রাইব করছে আর বার বার আঁখির দিকে তাকাচ্ছে।
″এই যে মিস্টার,হয়ত ড্রাইব করুন নয়ত গাড়ি আটকিয়ে আমাকে দেখুন,কারণ আপনি যা শুরু করেছেন একটা দূর্ঘটনা তো ঘটিয়েই ছাড়বেন।″
″দূর্ঘটনা তো তুমি ঘটিয়েছ সুখপাখি এমন রূপে আমার সামনে এসে,কালো শাড়িতে তোমার এই মোহনীয় রূপ কতটা যে হৃদয়কারা তা তোমাকে বুঝিয়ে তোলার সক্ষমতা এই অধমের নেই।শুধু বলব আজ আঁখিদ্বয় বাধা মানবে না,দেখে যাবে তোমাকে অপলকে।″

″দেখুন নজর লাগবে আমার,চোখ সরিয়ে রাখুন।″
″তোমাতে নজর লাগালোর অধিকারটুকু তো আমারই,কেন তার সুযোগ যেতে দিই?″
″আপনার গায়ে আমেরিকার বাতাস লেগেছে,নয়ত নিরামিষ ডাক্তার হঠাৎ এতো রোমান্টিক কেমনে হবে!তা এখন মনোযোগ সামনে দিলে খুশি হবো জনাব।আমাকে দেখার জন্য পুরো জীবন পাবেন।″
আঁখি আদৃতের গালে হাত দিয়ে চেহারা সামনের দিকটায় করল,আদৃত আলতো হেসে ড্রাইব করতে শুরু করল।আঁখিও হেসে বলল এবার।

″তা যাচ্ছি কোথায় বললেন না?″
″গেলে দেখতে পাবে,স্যারপ্রাইজ কাউকে বলে দেয় না কি?″
রিদিকা হুডি পরে মাস্কটাও পরে নিল,একদম তৈরি সে,আজ ছাড় দিবে না আদ্রিশকে,সেই ভাবনায় গেল আদ্রিশের বাড়ির দিকে তবে তখন আদ্রিশকে গাড়ি নিয়ে কোথাও বেরুতে দেখল।রিদিকা হুডি আর মাস্কটা খুলে এবার সাধারণ মানুষরূপে একটা সিএনজিতে উঠল।আদ্রিশের গাড়ির পিছু করতে শুরু করল।

প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব ৪১

আসসালামু আলাইকুম,আগামী পর্বে আসল প্রমত্ত অঙ্গনাকে সামনে আনার যথেষ্ট চেষ্টা করব আমি,ইনশাআল্লাহ।

প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব ৪৩