প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৩

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৩
তানজিলা খাতুন তানু

অতসী ছোটু কে বাইরে নিয়ে এসে হাসতে শুরু করল। আচ্ছা করে শাহানাদের জব্দ করতে পেরে ও খুব খুব খুশি। এর পরে ঠিক কি কি হবে সবটাই ওর জানা। তাই ক্লাসরুমে না গিয়ে চুপচাপ ক্যান্টিনে বসে থাকল।
৩০ মিনিটের মধ্যেই পিয়ন এসে অতসী আর ছোটু কে বলল.

– প্রিন্সিপাল স্যার তোমাদের ডেকেছেন তাড়াতাড়ি যাও।
অতসী যেন এটারই অপেক্ষা করছিলো,পিওনের কথা শুনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছোটু কে ইশারা করলো যাবার জন্য কিন্তু ছোটু কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না যাবার জন্য।
– আহ ছোটু বলছি তো যেতে।
– না দিদি আমি যাবো না আমার ভয় লাগছে।
– তুই তোর এ দিদিকে বিশ্বাস করিস তো।
– হুম।
– তাহলে চল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ছোটু অতসীর হাতটিকে জড়িয়ে ধরল। ছোটুর বয়স ১৩+, কলেজ ক্যান্টিনে বেয়ারার কাজ করে। বাবা হারা, মা আর ছোট দুই ভাই বোনকে নিয়ে পরিবার। মা সংসার চালানোর জন্য লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করে,আর ছোটু ক্যান্টিনে বেয়ারার কাজ করে সংসার চালায়। স্কুলেও যাওয়া হয়ে উঠে না।
অতসী প্রিন্সিপালের রুমে পারমিশন নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দেখল, শাহানার গ্রুপ একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিন্সিপাল স্যার ওর দিকে তাকিয়ে বললেন….

– শাহানা’রা যেই গুলো বলছে সেইগুলো কি সত্যি অতসী?
ছোটু ভয়েতে অতসীর হাতটাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। অতসী ছোটুর দিকে তাকিয়ে, শাহানার দিকে একপলক তাকাল,শাহানার চোখে মূখে শয়তানির হাসি। ও সাধারণ ভাবেই বলে উঠল….
– কি কথা স্যার।।
– শাহানা বলছে তুমি নাকি ওদেরকে লবন আর লঙ্কাগুড়োর মিক্সড কফি খাইয়েছ।
– স্যার আপনি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেবেন
– কি প্রশ্ন(ভ্রু কুঁচকে)
– আমি এই কলেজের কে হয়?

এইরকম প্রশ্ন শুনে শাহানা, প্রিন্সিপাল‌ স্যার সহ বাকি স্যারগুলো অবাক হল।
– এইটা আবার কি ধরনের প্রশ্ন অতসী।( অন্য একটা স্যার)
– প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অন্য দিকে কথা চলে যাচ্ছে, এতে কিন্তু কোনো কিছুই পরিস্কার হবে না স্যার। তাই আমি অনুরোধ করছি আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার।
অন্য একটা স্যার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু প্রিন্সিপাল স্যার বলতে না দিয়ে বললেন…

– অবশ্যই তুমি এই কলেজের একজন স্টুডেন্ট।
– স্যার আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন। এই কলেজটা কি কারোর পারিবারিক সম্পত্তি?
– কখনোই না এটা একটা সরকারী প্রতিষ্ঠান এইখানে সবার সমান অধিকার।( প্রিন্সিপাল স্যার উত্তর দিলেন)
– তাহলে স্যার কি দাঁড়ালো, আমি একজন সরকারী কলেজের স্টুডেন্ট। যেখানে একজন স্টুডেন্ট স্বাধীনভাবে পড়াশোনা করতে পারবে তাই তো।

– হ্যা।
– তাহলে স্যার শাহানা কিভাবে আমাকে দিয়ে নিজের পার্সোনাল কাজগুলো করানোর অধিকার পাই?
অতসীর এইরকম কথা শুনে শাহানার মুখটা থমথমে হয়ে যায়। প্রিন্সিপাল স্যার কিছুই বুঝতে পারলেন না,তাই প্রশ্ন করলেন…
– মানে?

– শাহানা আর তার গ্রুপ ক্লাসের প্রত্যেকটা স্টুডেন্টকে প্রতিদিন নানান ভাবে অপদস্থ করতে থাকে, আজকেই আমাকে নিজেদের জন্য ক্যান্টিন থেকে কফি নিয়ে আসতে বলেছিলো,আমি শাহানার কেনা কোনো গোলাম নয় আর না ওর কথা শুনতে বাধ্য তাই আমি ছোটুর সাহায্য নিয়ে স্পেশাল কফি খাইয়েছি ওদের।
শাহানা ভয়ে শেষ এইভাবে হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে যাবে এটা আন্দাজ করতে পারেনি।। প্রিন্সিপাল স্যার রাগী কন্ঠে বললেন…
– এসব কি সত্যি?

– স্যার আপনি চাইলে যে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। ওদের হাতে অপদস্থ হবার ভয়েতে কেউই এই কথাটা আপনাদের কাছে বলতে পারেনি। টাকার অহংকারে এরা অন্যদের মানুষ মনে করতে ভুলে গেছে।
প্রিন্সিপাল স্যার ক্লাসের কয়েকজনকে ডেকে পাঠালেন,প্রথমে তারা কিছু না বললেও পরে সত্যি গুলো বলে। শাহানা কিভাবে ওদের উপরে টর্চার করতো, সবটাই বলে দেয়। সবটা শুনে প্রিন্সিপাল স্যার খুব রেগে যায় এবং ওদের বাড়ির লোককে আস্তে বললেন।

– অতসী আমি সবটাই মানলাম। কিন্তু তুমি আর ছোটু যে কাজটা করেছো সেটা একদম ঠিক করনি। এইভাবে কিছু না করে আমার কাছে আসলেই পারতে।
অতসী তাচ্ছিল্যের হাসল। মুখের কোনাতে রহস্যময়ী হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল…
– তাহলে কখনোই এইকথাগুলো আপনি কানে তুলতেন না,আর না সবটা ক্লিয়ার হতো।
– মানে কি সব বলছো তূমি।

– আমার মতো সাধারন একটা মেয়ের কথা আপনারা কেউই বিশ্বাস করতেন না, আর না শাহানাদের আসল সত্যিটা প্রকাশে আসত। শাহানাদের সাথে আমি কাজটা করেছিলাম বলেই, ওরা আমার নামে বিচার দিয়েছে আর আমি আর ওরা মুখোমুখি হয়েছি। এই একই কাজটা যদি আমি করতাম তাহলে ওদের দলের কাছে আমাকে হার মানতেই হতো অর্থ আর শক্তির কাছে সত্যিটা হেরে যেত।

সকলেই চুপ করে গেছে। কেউ একটাও কথা বলছে না। অতসী একটু চুপ করল, তারপরে ছোটুর দিকে তাকিয়ে বলল…
– স্যার আপনারা তো আমাদের শিক্ষাদান করেন। সমাজের বুকে নানা প্রতিবাদ চলছে, ১৮ বছরের আগে কোনো বাচ্চাকে দিয়ে কাজ করানো আইনগত অপরাধ। সেখানে ছোটু কেন এই অন্যায়ের স্বীকার হচ্ছে। স্যার ছোটুর বাবা নেয়,, মা লোকের বাড়িতে কাজ করে, ছোট ভাই বোনদের নিয়ে সংসার। অর্থের অভাবে এই ১৩ বছরের বাচ্চাটা আমাদের কলেজ ক্যান্টিনে কাজ করছে এইখানে কি শিশুশ্রম হচ্ছে না?

সকলেই হতবাক। অতসী সকলের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ভুলটা। প্রিন্সিপাল স্যারের মাথাটা লজ্জায় নীচু হয়ে গেলো। ওনারাই তো সমাজের অগ্রদূত,সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কাজ তো শিক্ষকদের সেটা আবারো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল অতসী।
ছোটুর চোখের কোনে পানি জমা হয়েছে। কলেজ ক্যান্টিনে অনেক মানুষের আনাগোনা কিন্তু অতসীর মতো মানুষ খুব কমই দেখেছে। ও ছোটুকে ভাইয়ের্ মতো ভালোবাসে। আর অতসীর প্রতিও ছোটুর একটা আলাদা রকমের ভালোবাসা কাজ করে, মানুষটাকে বড্ড বেশি বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে ছোটুর।

– স্যার আমি চাই না, কেউ আমাদের কলেজের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলুক ওই কলেজে শিশুশ্রম করানো হয়। আমাদের কলেজে এতগুলো টিচার তারা যদি প্রতিমাসে মাত্র ১০০ টাকা করে এই ছেলেটার হাতে তুলে দেয় তাহলে আর ওকে এই কাজ করতে হবে না,ক্যান্টিনে থাকা সময়টা স্কুলে দিতে পারবে,সমাজের বুকে আরো একটা ভবিষ্যত তৈরি হবে।
প্রিন্সিপাল স্যার মুগ্ধ‌ হলেন অতসীর চিন্তাভাবনা দেখে। সত্যি এই যুগে কতজন মানুষ এইভাবে ভাবে।

– অতসী তুমি আজকে আমার চোখ খুলে দিয়েছ। সত্যি প্রকৃত শিক্ষা বইয়ের পাতাতে নয় বিবেকে থাকে, সেটা আবারও তুমি প্রমান করে দিলে। আমি তোমার থেকে বয়সে অনেক বড়ো হলেও,আমার বলতে কোনো অসুবিধা নেয় তুমি কোথাও না কোথাও আমার থেকে বেশি শিক্ষিত। তোমার বাস্তব জীবনের শিক্ষাটা আমার থেকে কয়েকগুণ বেশি।
– স্যার এইভাবে আমাকে লজ্জা দেবেন না।‌আমার যেটা মনে হয়েছে আমি সেটাই করেছি ঠিক কি ভুল আপনারাই ঠিক করুন।

– শাহানা তোমাদের অভিভাবকদের শীঘ্রই আমার সাথে দেখা করতে বল। আর তারা যদি দেখা না করে আমার সাথে কথা বলে, তাহলে আমি তোমাদের কলেজ থেকে বের করে দেব কথাটা মাথাতে রেখ। তোমরা এখন আসতে পারো, যাও।
শাহানার দলবল‌ স্থান ত্যাগ করলো, যাবার আগে অতসী কে নিজেদের চোখ দিয়ে আগুনে দগ্ধ করতে ভুলল না। অতসী ওদের দৃষ্টির মানে খুব ভালো করেই বুঝতে পারল, ওর জীবনটা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে সেটা ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো ভেতর থেকে।
প্রিন্সিপাল স্যার ছোটুর দিকে তাকিয়ে বললেন…

– ছোটু ক্যান্টিন থেকে যে টাকাটা পাই ওই টাকাটাই পাবে তবে তার জন্য ওকে আর কাজ করতে আসতে হবে না। ক্যান্টিনের বদলে ছোটুর জায়গা হবে স্কুল। আর কোনো শিক্ষক যদি আলাদা ভাবে ছোটুকে সাহায্য করতে চাই তাহলে করতে পারে সমস্যা নেয়। আমি ওর সহ ওর ভাইবোনের পড়াশোনার খরচ বহন করবো কথা দিলাম।
ছোটু আর অতসী দুজনেই খুব খুশি হয়ে যায়। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছোটু অতসীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। ছোটুর আনন্দ মাখা চোখের পানি দেখে উপস্থিত সকল শিক্ষকদের চোখের কোনাতে পানি জমা থাকল। ছোটু প্রিন্সিপাল স্যার কে সালাম করতে যায় কিন্তু উনি করতে দেন না।

– বাবু না, কখনও নিজের মাথা নীচু করবে না। আর কেন করবে বলো তো, যার এইরকম একটা দিদি আছে সে কি আর কারোর কাছে ছোট হতে পারে।
প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে সহমত হয়ে একজন হরতাল বললেন…
– অতসী সত্যি একজন ভালো মনের মানুষ।

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ২

– কিন্তু অতসী অন্যায় করেছে এর শাস্তি তো ওকে পেতেই হবে।( প্রিন্সিপাল)
– স্যার আমার কোন ভুল হলে আমি শতবার শা’স্তি পেতে নিতে রাজি। আমি সত্যি ভুল করেছি তাই আপনি আমাকে যা শাস্তি দেবেন তাই মেনে নেব।

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৪