প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ২

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ২
তানজিলা খাতুন তানু

অতসীর শরীরটা ঠিক ভালো লাগছে না, সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে জীবনটাই কিরকম একটা গোলক ধাঁধার মাঝে রয়েছে, মাঝে মধ্যে নিজেকে শে’ষ করে দিতে মন করে কিন্তু কিছু একটার জন্য পারে না।
জিনিয়ার মেজাজ খুব হাই হয়ে আছে, অতসীর কাছে থাপ্পর খাওয়াটা ঠিক হজম করে উঠতে পারেনি। অতসীর সাথে প্রায় একবছর আছে কখনোই ওকে এইভাবে রেগে যেতে দেখেনি যদিও আজকের মতো ঘটনা পূর্বে ঘটেনি। অতসীর দেওয়া চড়টা জিনিয়ার ইগোতে লেগেছে।

পরেরদিন, অতসীকে কলেজে আসতে দেখে অনেকেই খুব অবাক হল। অতসী কোনো কিছুকে পাত্তা না দিয়ে ক্যান্টিনে গিয়ে চা অর্ডার করল। এদেরকে পাত্তা দেওয়া মানেই ছোট হওয়া,তাই সোজাসুজি ইগনোর কর।
ক্যান্টিনের ছেলেটা অতসীকে চা দিয়ে গেল, অতসীর সেইদিকে খেয়াল নেয়, চুপচাপ ফোনের ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে আছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– এক্সকিউজ মি।
কারোর কন্ঠস্বর শুনে অতসী মাথা তুলে তাকিয়ে দেখল একজন সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
– জ্বি আমাকে বলছেন?
– হ্যা। আমি কি এইখানে বসতে পারি।
– শিওর।
মেয়েটা অতসীর পাশে বসল। অতসী ফোন থেকে মাথা তুলে নিজের অর্ডার করা চায়ের কাপটা মুখে দিতে যাবে তখনি ওইপাশের মেয়েটা বলল…..

– আমি মিতু তোমার কি ফ্রেন্ড হতে পারি।
অতসীর কাছে কথাটা একটু অবাক লাগল। হুট করেই একজন এসে ফ্রেন্ডশীপ করার মানেটা বুঝে উঠতে পারল না। এর পেছনে মেয়েটার কি স্বার্থ লুকিয়ে আছে কে জানে?
– কি হলো কিছু বলছ না কেন?
– কিছু মনে‌ করবেন না,,তবে নতুন করে কাউকে বন্ধু করে ছ্যাকা খাওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেয়।
– তুমি হয়ত আমাকে চেনো না, কিন্তু আমি তোমাকে চিনি আর কালকের ঘটনাটা সবটাই আমি দেখেছি।
অতসী কিছু বলল না। কলেজে আসলেও ক্লাস, লাইব্রেরীতেই সময় কেটে যায়, বাইরের কারোর সাথেই তেমন কোন একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেনি জিনিয়া ব্যতিত।

– আমিও সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট তবে তোমার আর আমার ডির্পামেন্ট আলাদা তাই হয়ত তুমি আমাকে চেনো না।
– হয়ত।
– কি আমার সাথে বন্ধুত্ব করবে?
– সত্যি কথা বলছি কিছু মনে করবেন না দয়া করে, আমি আর ক্ষত বিক্ষত হতে চাই না। আপনি যখন কালকের ঘটনাটা দেখেছেন,হয়তো ঘটনা সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানেন। মানুষের প্রতি বিশ্বাসটা না আমার উঠে গেছে।
অতসীর এইরকম কথা শুনে মিতুর মুখে আঁধার নামল। এইরকম কিছু আশা করেনি,হ্যা সে জানত অতসীর মন ভেঙেছে কিন্তু ভেঙে যে শক্ত হয়ে গেছে এটা বুঝে উঠতে পারেনি।
তবুও মুখের কোনে হাসি ফুটিয়ে বলল…

– সবাই কি এক হয়।
এইরকম কথা শুনে অতসীর মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল, নিজের ঠোঁটের কোনে অদ্ভুত হাসিটাকে বজায় রেখেই বলল…

– আলাদা আর কজন মানুষ হয় দিনশেষে তো আমরা সকলেই স্বার্থপর। নিজের স্বার্থ ছাড়া এক মুহুর্ত চলতে পারি না, শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থে অপর একজন মানুষকে “প্রয়োজনে প্রিয়জন” করি। প্রয়োজন মিটে গেলেই ছুঁড়ে ফেলে দিতে দুইবার ভাবি না। আমি আর কারোর প্রয়োজন বা প্রিয়জন কোনটাই হতে চাই না একা একটু ভালো করে বাঁ’চতে চাই প্লিজ আমাকে বাঁ’চতে দিন নিজের মতো করে।
কথাগুলো মিতুর কাছে কটু লাগলেও অতসী ঠিক কতটা আঘাত থেকে কথাগুলো বলেছে সেটা একমাত্র সেই জানে। প্রতিটা মানুষই নরম থাকে, পরে আঘাতে আঘাতে কঠোর হয়ে যায়।

– ঠিকাছে আমি তোমাকে জোর করব না। তবে কখন যদি তোমার মনে হয়, এই মিতু তোমার বন্ধু হবার যোগ্য। তাহলে একবার আমার কাছে এসে বলো, আমি বিনাবাক্যে তোমাকে নিজের বোন,বন্ধু করে নেব। আমার জীবনে তোমার জায়গাটা সারাজীবনের জন্য খোলা আছে। নিজের খেয়াল রেখো অতসী।

মিতু চলে যায়। অতসী মিতুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবল.. কতরকমের মানুষ হয়,কেউ স্বার্থে ব্যবহার করে আর কেউ নিঃস্বার্থ ভাবে করে যায়। আচ্ছা অতসীর জীবনে কি কেউ আসবে না যে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসবে ওকে।
জিনিয়া আর অতসীর ডিপার্টমেন্ট এক। তাই ওদের দুজনকে দুজনের মুখোমুখি হতেই হবে। অতসী সেইসব কথা পাত্তা না দিয়ে ক্লাসরুমে ঢুকতেই দেখল, সকলেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। প্রথমে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে থাকলেও,
পরে প্রচন্ড অস্বস্তি বোধ হচ্ছে সবার চাহনীতে। অতসীর চোখ পড়ল ফার্স্ট বেঞ্চে, জিনিয়া একা বসে আছে। একটা মেয়ে অতসীকে দেখা মাত্রই টিস করে বলে উঠল…

– আরে দ্যাখ দ্যাখ আমাদের ক্ষ্যাতমার্কা অতসী চলে এসেছে। (কথাটা বলে হেসে উঠল সকলে মিলে) এতদিন অনেক দেমাগ ছিলো না জিনিয়ার সাথে বন্ধুত্ব ছিলো বলে, এখন কি করবি! এখন তোকে কে বাঁ”চাবে আমাদের হাত থেকে। ( শেষের অংশটা কিছুটা রাগ দিয়েই বলল)

জিনিয়া বড়লোক বাবার মেয়ে হবার জন্য ক্লাসের কেউই ওর সাথে লাগত না। অতসী জিনিয়ার বন্ধু হওয়াতে ওর সাথেও সকলেই ভালো ব্যবহার করত।বর্তমানে ওদের মাঝে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়াতে, সকলেই সুযোগ পেয়ে গেল অতসীকে নিয়ে মজা করার।
এইসব কথা শুনে অতসীর জন্য জিনিয়ার খারাপ লাগলেও, অতসীর দেওয়া চড়ের বদলা নেয়ার জন্য চুপ করে থাকল।
– এই অতসী আজ থেকে আমরা যা বলব তাই করবি। ঠিক যেমনভাবে এই হলের সকলে আমাদের কথা শুনে চলে ঠিক এইভাবেই।

অতসী কথাটা শুনে সকলের দিকে একবার তাকাল। এইসব কথা বলা মেয়েটির নাম শাহানা। আরেক বিগড়ে যাওয়া সন্তান, মোট ৭ জন ছেলে মেয়ে নিয়ে ওদের গ্যাং। ক্লাসের সকলকেই ভয়ে তটস্থ করে রাখে, যা ইচ্ছা কাজ করে বেড়ায়। অতসীর চোখে খুব একটা এই বিষয়গুলো পড়েনি। ক্লাস শেষে কলেজে আড্ডা দেবার মত সময় ওর হাতে থাকত না,হয় টিউশনি করতে আর না হয় লাইব্রেরীতে গিয়ে পড়াশোনা করত। আর যেটুকু সময় থাকত সেটাতে জিনিয়ার সাথে থাকত।
শাহানার সাথে থাকা একটা মেয়ে বলল..

– এই অতসী যা তো আমাদের জন্য ক্যান্টিন থেকে কফি নিয়ে আয়।
– আমি কী তোদের কেনা গোলাম নাকি?
অতসীর কথা শুনে শাহানার মাথা গরম হয়ে গেলো।
– অতসী আমাদের সাথে লাগতে আসিস না, চুপচাপ যেটা বলছি সেটা কর।
– লাগতে আমি আসিনি তোরা এসেছিস তাই শেষটা আমিই করব। আর কি বললি , তোরা যেটা বলছিস সেটা করব,ওকে ওয়েট আমি কফি নিয়ে আসছি।
অতসী কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে গেল। সকলে চুপচাপ অতসীর কান্ড দেখতে লাগলো। অতসী ক্যান্টিনে গিয়ে বলল…

– ছোটু ৭ টা স্পেশাল কফি করে তো।
– স্পেশাল কফি মানে কিরকম দিদি?( ছোটু সরল মনে প্রশ্ন করল)
– কফি,দুধ,চিনির সাথে লবন আর লঙ্কাগুড়োর মিক্সড।
– কী? ( চমকে উঠে)
– হ্যা যেটা বলছি কর না।
– না দিদি আমি পারব না,আমার ভয় লাগছে খুব।
– আরে পাগলা তোর দিদি থাকতে তোর চিন্তা কিসের, আমি আছি না কিছু হবে না। তোকে যেটা বলছি সেটা কর।
– আচ্ছা।

ছোটু অতসীর কথামতো ৭ টা স্পেশাল কফি নিয়ে হাজির হল ওর সামনে।
– সাব্বাশ ছোটু। চল আমার সাথে।।
– আমি ( ভয় পেয়ে)
– হ্যা চল।
ছোটু অতসীর সাথে এসে, ওর কথামতো সকলের হাতে কফির গ্লাসগুলো ধরিয়ে দিল।
– নাও‌ খাও কফি।( বাঁকা হেসে অতসী বললো)

সকলে কফি গালে দিতেই চোখ মুখ কান দিয়ে ধোঁয়া বের হবার জোগাড়। পানি খাবার জন্য সকলে ছটফট করছে, ক্লাসের সকলেই অবাক হয়ে দেখছে ওদের কান্ড, কিন্তু কেউ কিছু বুঝতে পারছে না।
শাহানা খুব রেগে গেলো‌, ওর বুঝতে অসুবিধা হলো না কাজটা কে করেছে।
– তোর সাহস কিভাবে হল আমাদের কফিদের লবন,লঙ্কা মেশানোর।
– স্পেশাল কফি তো এইরকমই হয়।
– তোর বড্ড সাহস বেড়েছে, দেখিস তোর হাল আমি কি করবো। তোকে না যদি কলেজ থেকে বের করেছি আমার নাম শাহানা নয়।

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ১

– যা ইচ্ছা তাই কর। আর হ্যা আমাকে দূর্বল ভাবার মতো ভুল করিস না ,, আগুন নিয়ে খেলা করলে নিজের হাতটা কিন্তু আগে পুড়ে যায় কথাটা মাথায় রাখিস।
অতসী ছোটু কে নিয়ে ক্লাসের বাইরে চলে গেল ক্লাসের সকলের অতসীর নতুন রূপ দেখে অবাক হচ্ছে। জিনিয়াও হতবাক অতসীর এইরকম রূপ দেখে, নিজের মনেই বিরবির করে‌ বলে উঠল…
– এ কোন অতসীকে দেখছি আমি?

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৩