প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৩০

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৩০
তানজিলা খাতুন তানু

অতসী নিজের ভাবনার মাঝে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সেই খেয়াল নেয়। সকালে মিষ্টি রোদ ওর চোখে পড়াতে ঘুম ভেঙে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ৬টা বাজে। অতসী আর আলসেমি না করে উঠে পড়ল। গোছগাছ করতে হবে,আজকেই সবাই ফিরে যাবে।
অতসী ফ্রেশ হয়ে নীচে নামতে দেখল কতকগুলো মুখ ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সবার এইরকম কান্ডে ওর ভ্রু কুঁচকে গেল, নিলয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

– কি হয়েছে এইভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
– তুই ঠিক আছিস তো।
– কেন?
– না এমনি।
সকলেই আশা করেছিল কালকের ঘটনা অতসীর মনে একটা দাগ কাটব, হয়তো অতসী ভেঙে পড়বে কিন্তু সকলের ভাবনাকে ভুল বলে প্রমানিত করে অতসী স্ট্রং হয়ে দাঁড়িয়েছে সকলের সামনে।
অতসী টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট খেতে লাগল। রুদ্রর অতসীর দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– বোন বাড়ি ফিরে চল।
– কার বাড়ি? কিসের বাড়ি দাদাভাই।
– আর কতদিন জেদ করে থাকবি ফিরে চল।
অতসী কিছু বললো না। অতসী কে নিঃশ্চুপ থাকতে দেখে নিলয় বলল,
– আমি রুদ্রের কাছে সবকিছু শুনেছি আমি জানি যেটা হয়েছে সেটা ঠিক হয়নি। তবুও তুই ফিরে যা প্লিজ।
– সবটা জেনেও এই কথাটা বলছো?
অতসী ভ্রু কুঁচকে নিলয়ের উদ্দেশ্য কথাটা বলল। নিলয় কি উত্তর দেবে ভেবে পেলো না। জিনিয়া এতক্ষন চুপ করে বসে সবটা শুনছিল, এইবার মুখ খুলল,

– অতসী আমি জানি না তোর লাইফে ঠিক কি কি হয়েছিল যার জন্য তুই পরিবার থেকে আলাদা থাকিস,তবে অতীতের জন্য নিজের বর্তমান ভবিষ্যতটাকে নষ্ট করিস না।
জিনিয়ার কথার উত্তর না দিয়ে অতসী চুপ করে উঠে চলে গেল। সকলেই হতাশ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রুদ্র মনে মনে বলল,
– এই জেদটাই আমাদের পরিবারটাকে ছাড়খাড় করে দিলো।
২দিন পর,
রির্সোট থেকে ফিরে আসার পর অতসী দুইদিন নিজেকে ঘরবন্ধি করে রেখেছে। কলেজেও যায়নি আর না আরুকে পড়াতে গেছে। আরুকে দুইদিন অতসী পড়াতে আসছে না দেখে আদৃত মিতুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

– অতসীর খবর কি? পড়াতে আসছে না কেন?
– জানি না
– ওহ।
আদৃত চলে যেতে যাবে তখনি মিতু পেছন ডাকল,
-দাভাই।
– কি বল।
– তোকে একটা কথা জানানোর ছিল।
– কি কথা।
– জানি কথাটা শুনে অনেকটা অবাক হবি, কিন্তু এটাই সত্যি।
– কি কথা।
– অতসী রুহি ভাবির বোন।

আদৃত চমকে উঠল। এইটা কখনোই আশা করেনি। আদৃত জানত রুহির বোন আছে তবে তাকে কখনোই দেখেনি, নামটাও শুনেছিল কিন্তু এতগুলো বছরে ভুলে গিয়েছে।
– তুই এইটা জানলি কিভাবে। আর অতসী যদি রুহির বোন হয় তাহলে ও টিউশনি পড়ায় আর ভাড়া বাড়িতে থাকে কেন?
জিনিয়ার বৌভাতের দিনের সবকিছু মিতু আদৃতকে খুলে বলল। সবটা শুনে আদৃত চমকে উঠল।

– এই আকরাম খাঁনের জেদের কারনে আজকে এতগুলো মানুষের জীবন এলোমেলো হয়ে আছে। কে জানে এখনো আগের মতোই জেদি আছে কিনা।
– দাভাই আমার মনে হয় ওনাদের মুখোমুখি হওয়া দরকার তোর। ওনাদের ও তো জানার অধিকার আছে যে ভাবি আর বেঁ/চে নেই।
– বাদ দে এইসব। তুই নিজের ঘরে যা।
মিতু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল। আদৃত নিজের মনে বিরবির করে বলল,
– কিসের জন্য ওই মানুষটার মুখোমুখি দাঁড়াব আমি। ওনার কারনেই তো রুহি আজকে আমার কাছে নেই। ওই মানুষটাকে আমি কখনোই ক্ষমা করব না।

মিতু নিজের ঘরে গিয়ে পুরানো কথাগুলো ভাবতে থাকে। রুহির সাথে মিতুর সম্পর্ক ছিল বোনের মতো, বড্ড ভালোবাসত রুহিকে। যেদিন রুহির প্রেগন্যান্টের কথা শুনেছিল সেইদিন মিতুর লাফালাফি দেখে কে। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই সবকিছূ এলোমেলো হয়ে গেল।
বাড়িতে মিতু আর রুহি একাই ছিল। আদৃত ওর মাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে গিয়েছিল। হঠাৎ করেই রুহি যন্ত্রনায় চিৎকার করে উঠে। মিতু বড্ড ভয় পেয়ে যায়, তখন মিতু অনেকটাই ছোট এইসবের কিছুই বুঝত না। রুহির কান্না দেখে নিজেও কেঁদে দেয়।

– ভাবি কি হয়েছে তোমার, কাঁদছ কেন? ভাবি তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে ওহ ভাবি বলো।
রুহির অবস্থা ধীরে ধীরে আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মিতু উপায় না পেয়ে আদৃত কে ফোন করে সবটা বলে। কাছাকাছি থাকাতে আদৃত তাড়াতাড়ি এসে রুহিকে হসপিটালে ভর্তি করায়।
ডাক্তার এগিয়ে এসে বলল,
– প্রেশেন্টের বাড়ি লোক কারা।
– আমি রুহির হাসবেন্ড। কি হয়েছে রুহি ঠিক আছে তো।

– প্রেশেন্টের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। পুরানো একটা চোটের কারনে ওনাকে আগেই বলা হয়েছিল বেবিটাকে না রাখতে। কিন্তু উনি শোনেননি এখন পরিস্থিতি হাতের বাইরে। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করব তবে আপনারা যেকোন কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকুন। যা কিছূ হয়ে যেতে পারে।
ডাক্তার চলে গেল। আদৃত চিন্তিত হয়ে এদিক ওদিক চলাফেরা করতে লাগল।
২ঘন্টা পর।
ওটির আলো বন্ধ হয়ে গেল। ভেতর থেকে ডাক্তার হতাশ মুখে বেরিয়ে আসেন। আদৃত ওনাকে দেখেই জিজ্ঞেস করল,

– ডক্টর রুহি ঠিক আছে তো।
– আই অ্যাম সরি মিষ্টার। প্রেশেন্টকে আমরা
বাঁ/চা/তে পারিনি তবে আপনার একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে।
একদিকে স্ত্রীয়ের মৃ/ত্যু আর অন্যদিকে ফুটফুটে মেয়ে। আদৃত আরুকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করল। আরুশীই আদৃতের সবকিছু হয়ে উঠল। যতটুকু পারত মেয়েটাকে সময় দিত, মিতু আর মায়ের সহযোগীতায় একাই মেয়েটিকে এতটা বড়ো করে তুলেছে।
রুদ্র কাজে দুইদিন বাড়ি ফিরতে পারেনি। আজকে বাড়ি ফিরে রাতে মা আর স্ত্রীর সামনে বলে উঠল,

– বাবা আমার সাথে বোনের দেখা হয়েছিল।
রুদ্রের কথা শুনে সকলেই চমকে উঠল। রুদ্রের মা বললেন,
– তাহলে মেয়েটাকে নিয়ে আসলি না কেন? কতদিন মেয়েটাকে দেখিনি।
– মা তোমার মনে‌ হয় বোন এত সহজে সবকিছু ভুলে আসবে।
রুদ্রের মা ঢুকরে কেঁদে উঠলেন।
– মেয়েটার যে বড্ড আত্মসম্মান বোধ আর বাবার মতো প্রচন্ড জেদি হয়েছে। এতগুলো বছর আমাদের চোখের আড়ালে থেকে কিভাবে দিন কাটাচ্ছে কে জানে।

রুদ্র ওনাদের সবকিছু খুলে বললো। রুদ্রর মায়ের কান্নার মাত্রা আরো বেড়ে গেল। সামিয়া ওনাকে শান্ত করে ঘরে দিয়ে আসলো। ফিরে এসে রুদ্রের কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
– অতসীকে কি কোনো ভাবে ফিরিয়ে আনা যাবে না।
– জানি না গো।‌ আমার আদরের দুইবোন আমার থেকে কত দূরে আমার নিজেকে ব্যর্থ মানুষ মনে হয়।‌ দাদা হয়েও বোনদের দেখে রাখতে পারিনি।

রুদ্রকে সামিয়া শান্তনা দিতে লাগল। রাতে আকরাম খাঁন ফিরে এসে দেখলেন ওনার স্ত্রী বিছানায় শুয়ে আছে। এগিয়ে এসে মাথাতে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। এই ২বছরে অনেকটাই বদলে গেছেন উনি। অতসীর জেদ ওনাকে বদলে যেতে বাধ্য করেছে। কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে রুদ্রের মা চোখ খুলে তাকালেন।
স্ত্রীকে চোখ খুলে তাকাতে দেখে বলল,

– কি হয়েছে এখন শুয়ে আছো কেন? শরীর খারাপ নাকি!
কোনো উত্তর না দিয়ে উঠে বসলেন। তারপরে আনমনে বলে উঠলেন,
– তোমাদের জেদের কারনেই আমার দুই মেয়েই আমার থেকে দূরে। তবুও রুহি তো তার ভালোবাসার মানুষটির কাছে আছে, কিন্তু আমার ছোট্ট অতসী!

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ২৯

ঢুকরে কেঁদে উঠলেন উনি। আকরাম খাঁনের চোখেও পানি চিকচিক করছে। অতসী এই বাড়ি ছাড়ার পর উনি বুঝেছিলেন কতটা ভুল উনি তবে তখন সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছিল। রুদ্রর মা কাঁদতে কাঁদতে সবকিছু স্বামীকে খুলে বললেন। সব শুনে আকরাম খাঁন নিজেকে দোষারোপ করতে লাগল,
– আমার কারনেই আমার অতসী কে এত অপমান সহ্য করতে হচ্ছে।‌ আমিই অ/পরাধী। আমি একজন ব্যর্থ বাবা, ব্যর্থ স্বামী।

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৩১