প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ১৯

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ১৯
তানিশা সুলতানা

মৃত্যু খুব ছোট একটা শব্দ। কিন্তু এর ওজনটা ভীষণ ভাড়ি। এই যে মিতু। কাটা গলা নিয়ে ছটফট করছে। একটুও আওয়াজ করতে পারছে না৷ গলগল করে রক্ত পড়ে ফ্লোর লাল হয়ে যাচ্ছে। চোখের কোণা বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।

দীর্ঘ খন ছটফট করে অতঃপর স্থির হয়ে পড়ে রয়। থেমে যায় দেহখানা। হাত দুটো অনাদরে পড়ে যায় ফ্লোরে। মুখটা হা হয়ে রয়। জলভর্তি আঁখিপল্লব বন্ধ হয়ে যায়৷
মুহুর্তেই পরিবেশ নিশ্চুপ হয়ে যায়।
জানালার বাইরে থেকে এই দৃশ্য দেখে পূর্ণতা। হাত পা কাঁপছে তার। দুই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনাজল।
অভির নজর পড়ে পূর্ণতার দিকে। চমকায় সে। হাত থেকে পড়ে যায় রক্ত মাখা চাকুটা। এদিক ওদিক নজর ঘুরিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা চালায়৷

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অভি ছাড়াও এই রুমে উপস্থিত ছিলো আরও দুজন পুরুষ। তাদের মধ্যে একজন অভির পিঠ চাপকে বলে ওঠে
“গুড জব অভিরাজ। এই জন্যই তোমাকে এতো ভালো লাগে।
অভি এক পলক তাকায় পূর্ণতার দিকে৷ চোখে চোখ পড়ে। পূর্ণতার করুন দৃষ্টি। সে বিশ্বাস করতে পারছে না। ইফতিয়ারের কথা সে আমলে নেয় নি। কিন্তু এই মুহুর্তে চোখের সামনে সবটা পরিষ্কার ভাবে দেখবে এটাও আশা করে নি।

পূর্ণতার মন বলছে। এসব মিথ্যে। তার এমপি সাহেব এমনটা করতেই পারে না। কিন্তু চোখের সামনে সবটা দেখে অস্বীকার করবে কি করে?
অভি কাঁধ থেকে লোকটার হাত সরিয়ে দিয়ে বলে
“আপনার থেকে বাহবা পেতে আমি এমনটা করি নি। বেইমানির ফল ছিলো এটা।
লোকটা একটু অপমানিত বোধ করে। দু কদম পিছিয়ে যায়।
অন্য একটা লোক বলে

“তাহলে আমরা কি বাকিদের নিয়ে যেতে পারি?
অভি জবাব দেয় না। আবারও তাকায় জানালার পানে কিন্তু পূর্ণতা নেই। কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে অভির। কোথায় গেলো মেয়েটা? বাড়িতে তো অবশ্যই যায় নি। তাহলে?
অভির থেকে জবাব না পেয়ে লোকটা বলে

“কিছু বলুন
“একটু সময় চাই আমার।
আপনারা এবার আসতে পারেন।
লোকগুলো মাথা নারিয়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। অভি কাউকে কল করে মিতুর লাশটা নদীতে ফেলে দিতে আদেশ দেয়।

পূর্ণতা পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখে। মোট আটটা রুম রয়েছে। সব গুলো রুমেই রয়েছে বারো থেকে বিশ বছর বয়সী মেয়েরা। সব গুলো মেয়ের পোশাক খুবই নোংরা। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো এখানে কমলাও রয়েছে৷ এবং সেও হাঁটু ওবদি পোশাক পড়েছে।

বুদ্ধিমতি পূর্ণতার বুঝতে বাকি নেই এখানে আসলে কি চলে৷
হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে নেয় পূর্ণতা। হিজাব দ্বারা মুখটা ঢেকে ফেলে। অভিকে কক্ষ থেকে বের হতে দেখে গাছের আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। অভি চলে যেতেই জমিদার সাহেব প্রবেশ করে নোংরা বাড়িতে। হাসি মুখে ঢুকে পড়ে একটা রুমে। এবং মেতে ওঠে মজায়৷
ঘৃণায় চোখ বন্ধ করে ফেলে পূর্ণতা। মনে মনে কঠিন ধিক্কার জানায় জমিদার বাড়ির পুরুষদের।
অতঃপর মনে মনে আওড়ায়
“কাউকেই বাঁচতে দিবো না আমি। কাউকে না।”

নিজ কামড়ায় প্রবেশ করতেই আজকেও বিছানার ওপরে ডাইরিখানা পায় পূর্ণতা। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে চটজলদি ডাইরি খুলে। আজকে লাল কালি দিয়ে লেখা রয়েছে
“আগামীকাল মেয়েগুলোকে পাচার করা হবে বিদেশে। তোমাকে বাঁচাতে হবে সবাইকে। এমন কিছু করো পূর্ণ যাতে মেয়েগুলোও বেঁচে যায় আর কেউ তোমাকে সন্দেহ না করে।
ডাইরি বন্ধ করতে গিয়েও বন্ধ করে না। মনে হয় পরবর্তী পৃষ্ঠায় কিছু আছে। তাই পৃষ্ঠা উল্টায় পূর্ণতা। এবং পরবর্তী পৃষ্ঠায় দেখতে পায়

“নিষ্ঠুর পৃথিবীর অধম মূর্খ্য আমি।
বন্দি ওদের কাছে।
তোমাকে বাঁচাতে পাপী হয়েছি
ঘৃণিত তোমার চোখে।
ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে পূর্ণতা। হাজার প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে তার। ডাইরিটা অভির নয়ত? কিন্তু অভির হাতের লেখা পূর্ণতা দেখেছে৷ একটুও মিল নেই। কে লিখে এই ডাইরি? আর কি মানে এই কথা গুলোর?

পোশাক পাল্টে গোছল সেরে নেয় পূর্ণতা৷ অভি ফেরে নি এখনো। কোথায় গেছে জানাও নেই৷ পূর্ণতা মিষ্টির রুমে যায়। ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা। হাতের তালুতে ইফতিয়ার নাম খানা জ্বল জ্বল করছে। শুধু হাতে নয় ব্যাগ পড়ার টেবিল এবং দেয়াল জুড়েও লিখে রাখে নামটা। বড্ড ভালোবাসে মানুষটিকে।
মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় পূর্ণতা। কপালে চুমু দেয়। তারপর গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে রুম থেকে বের হয়।
মুখোমুখি হয় ইশানের। ইশান মাথা নিচু করে ফেলে।

পূর্ণতা ভনিতা ছাড়াই সোজাসাপ্টা বলে
“মিতুকে আপনার ভাই খু ন করেছে। জানেন আপনি?
ইশান ছোট করে জবাব দেয়
“হুমম

অবাক হয় পূর্ণতা। ভালোবাসার মানুষটিকে বাবা বিয়ে করে আনলো তবুও বাবার প্রতি এতোটুকুও অভিযোগ ছিলো না ইশানের। আর আজকে বড় ভাই খুন করে ফেললো ভালোবাসার মানুষটিকে। তবুও এতোটুকুও অভিযোগ নেই।
“ কষ্ট হচ্ছে না আপনার?

ইশান মৃদু হাসে। চোখে তার পানি টলমল করছে।
“হচ্ছে কষ্ট। ভুল মানুষকে ভালোবেসে ছিলাম আমি।
“এখানে মিতুর দোষ কোথায়?

“ মিতু দাদাভাইয়ের সাথে জড়িত। সবাই মিলে ফন্দি করছিলো কালকে বাকি মেয়েদের সাথে তোমাকে বিক্রি করে দেওয়ার। মিতুকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো তোমার খাবারে নেশা জাতীয় কিছু মিশিয়ে দেওয়ার।
চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে পূর্ণতা। বুকটা কাঁপছে তার। যতই সাহসী দেখাক। ভেতরে ভেতরে ভীষণ দুর্বল পূর্ণতা।
ইশান আবার বলে

“আমরা চার ভাই আছি তোমাকে বাঁচানোর জন্য। তারপরও তোমাকে সতর্ক থাকতে হবে ভাবি।
পূর্ণতা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
“আপনার ভাই কোথায়?
“ জানি না।

পূর্ণতা আর কথা বাড়ায় না। বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে যায় সাহেব এর কক্ষের দিকে। কিন্তু সেখানে গিয়ে এমন কিছু দেখে যেটা পূর্ণতার পায়ের তলার মাটি সরে যায়। আপনাআপনি হাত চলে যায় মুখে।
এই বাড়িতে পূর্ণতার একমাত্র ভরসা ছিলো শিউলি। যে পূর্ণতাকে মেয়ের মতো আদর দিয়েছে। যার চোখে পূর্ণতা অভি মিষ্টি এবং তার জন্য ভালোবাসা দেখেছে। তাকে কি সন্দেহ করা যায়?
এই যে শিউলি জমিদার সাহেবের পাশে বসে আছে। হাত টিপে দিচ্ছে। মনা আরেক পাশে বসে আছে। বেশ হাসাহাসি করে তারা কিছু নিয়ে আলোচনা করছে৷

শিউলি বরাবরই সাহেবের দেখে দুরত্ব বজায় রেখে চলে। শশুর শাশুড়ীর সামনে মাথা তুলে কখনোই কথা বলে নি সে। অন্তত পূর্ণতা কখনো দেখে নি।
বরাবরই ভীতু নম্র ভদ্র সাদাসিধে শিউলি বেগম। তবে আজকে সেই শিউলি বেগমকে চিন্তে পারছে না পূর্ণতা। এটা কেমন রূপ তার?
জমিদার দাঁড়িয়ে যায়।

“তাহলে আগামীকাল বউমা তুমি পূর্ণতাকে রেডি করাবে।
শিউলি মাথা নেরে সম্মতি জানায়।জমিদার বেরিয়ে যায়। পূর্ণতা আড়ালে দাঁড়ায়।
জমিদার যেতেই মনা বলে ওঠে
“ মামনি শুধু পূর্ণতা নয়। মিষ্টিকেও কালকে বিদেয় করা দরকার।
শিউলি বোধহয় একটু চমকালো।

“এটা করা যাবে না। সকলের চোখের মনি মিষ্টি। তার কিছু হলে সবাই ভেঙে পড়বে।
মনা মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নারায়।
“আরেহহ ধুরর
তুমি সকলের চিন্তা কেনো করছো? নিজেরটা ভাবো। মিষ্টিকে না সরালে আমাদের পরিকল্পনা কখনোই সফল হবে না।
শিউলি জবাব দেয় না। গভীর ভাবে কিছু একটা চিন্তা করে।

কান্না পায় না পূর্ণতার৷ মনে পড়ে মায়ের বলার একটা কথা। পূর্ণ যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন একটা মেয়ের সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিলো। একদিন সেই মেয়েটা পূর্ণতাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলে কচুরিপানা ভর্তি পুকুরে। মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছিলো পূর্ণতা।
সেলিনা সেদিন মাথায় হাত বুলিয়ে বুকে জাপ্টে ধরে বলেছিলো

“আম্মা নিজের ছায়াডারেও বিশ্বাস করবা না কখনো। এই দুনিয়ায় স্বার্থ ছাড়া কেউ তোমারে ভালোবাসবো না। মানুষ হচ্ছে দুনিয়ার সব থেকে বড় বেইমান প্রাণি। বাঘের মুখ থেকেও ফিরে আসা যায়। বাঘের মনেও মায়া আছে৷ কিন্তু মানুষের কবল থেকে কখনো ফিরে আসতে পারবে না।
মানুষের মনে মায়া নাই”

তাচ্ছিল্য হাসে পূর্ণ। এই মুহুর্তে অভিকে দরকার তার। অশান্ত মনটাকে শান্ত করছে পাষাণ পুরুষের স্পর্শ প্রয়োজন। লোমশ যুক্ত বুকটাতে মাথা পাতলেই মস্তিষ্ক শীতল হবে।
কিন্তু কোথায় সেই পুরুষটা?

পূর্ণতা পূণরায় নিজ কক্ষে ফিরে আসে। এবং দেখতে পায় বিছানায় ভাতের থালা নিয়ে বসে আছে অভি। পূর্ণতার মনে পড়ে সারাদিন কিছু খায় নি সে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় শখের পুরুষের দিকে।
অভি কিছু বলতে গেলে তাকে চুপ করিয়ে কোলে বসে পড়ে। মাথা রাখে লোমশযুক্ত বুকে। চৈত্র মাসের গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার অভি। পারফিউমের কড়া গন্ধ এবং ঘামের গন্ধ মিশে অদ্ভুত একটা গন্ধ নাকে লাগছে৷ পূর্ণতা নাক টেনে গন্ধ শুকে নেয়৷

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ১৮

অভি ভাত মেখে পূর্ণতার মুখে দেয়। বুকে মাথা রেখেই খেতে থাকে পূর্ণতা।
“আপনাকে আমি বড্ডবেশি ভালোবাসি এমপি সাহেব। আমাকে আগলে রাখুন আপনার বুকে। হারাতে দিয়েন না।

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ২০