প্রেমময়ী তুমি গল্পের লিংক || নিশাত জাহান নিশি

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ১
নিশাত জাহান নিশি

“মা’কে বলেছিলাম গার্লফ্রেন্ড প্রেগনেন্ট! তার বাচ্চার বাপ আমি! তবুও মা বিশ্বাস করল না! বলল নিজের পায়ে দাঁড়াও এরপর বিয়ে করবে! এই দিকে আমার সব বন্ধু-বান্ধবরা বিয়ে শাদি করে তিন-চার বাচ্চার বাপ হয়ে গেল। কিন্তু আমার বিয়েটা আর হলো না। গোটা শীতকালও চলে গেল ভাই! এই দুঃখ আমি কাকে দেখাই?”

“আমিও দুই বাচ্চার বাপ হয়ে গেলাম। তবুও বিয়ে শাদি হলো না! তৃতীয় বাচ্চার প্ল্যানিং চলছে! মা আর কবে আমাদের দুঃখ বুঝবে ভাই? আর এক গ্লাস বিয়ার হবে প্লিজ? আর এক গ্লাস গিললে হয়তো আরও একটু শান্তি পেতাম।”
“ভাই? তোর কী মনে হচ্ছে না আজ আমরা একটু বেশিই নেশা করে ফেলেছি? মদের বদলে মেয়ে দেখছি কেন? তাও আবার দু’দুটো! আচ্ছা ভাই? এদের এমন লাল নীল দেখাচ্ছে কেন? চোখে কী আমার তাঁরা বাত্তি জ্বলছে?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আরেহ্ ভাই.. তোর চোখের রং তো এমনিতেই নীল! তাই সব নীল নীল দেখছিস!”
“না ভাই! সত্যিই আমি নীলচে রঙের মেয়ে দেখছি! আচ্ছা এরা আমাদের দিকে এভাবে তেড়ে আসছে কেন ভাই? কী করেছি আমরা?”

দুই নেশাখোর এবার ফ্যাল ফ্যাল চাহনিতে আমাদের দুই বোনের দিকে পিছু ফিরে তাকাল! খালাতো ভাইয়ার বিয়েতে এসে রাস্তার মাঝখানে এভাবে দুই নেশাখোরের খপ্পরে পড় যেতে হবে বুঝতে পারি নি আমার দুই বোন! প্রথমে ভেবেছিলাম এক্সিডেন্টটা বোধ হয় হয়েই গেল! পরে আকস্মিক চোখ খুলে দেখলাম রিকশার সাথে বাইকটির সংঘর্ষ হওয়ার পূর্বেই মদের নেশায় বুদ হয়ে থাকা দুই নেশাখোর বাইক নিয়ে বাঁ পাশে ছিটকে পড়ল! কোনো রকম ব্যথা, বেদনা, হায়-হুতাশ ছাড়াই দুই নেশাখোর নিজেদের মতো বকবক করেই চলছে। মূলত যেসব বকবকানি একজন সুস্থ মস্তিষ্কধারী মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়।

সোহানী আপুকে পেছনে রেখে অতি ক্রুদ্ধ হয়ে আমি কোমড়ে দু’হাত বেঁধে নেশাখোরদের দিকে অগ্রসর হলাম। সোডিয়ামের টিমটিমে আলোতে তাদের দুজনের মুখের আদল স্পষ্টত বুঝা যাচ্ছে না। তবে খালি চোখে যতটুকু ঠাওড় করতে পেরেছি তাদের দুজনের মুখটিই আমার কিছুটা পরিচিত মনে হচ্ছে! বিষয়টিকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে আমি দুই নেশাখোরের দিকে কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“এই? বাড়িতে কী মা-বাবা বা ভাই-বোন নেই আপনাদের? পরিবার থেকে শিক্ষা পেয়ে আসেন নি রাতে-বিরাতে এভাবে নেশা ভান করে অন্যের গাড়ির সামনে পড়তে নেই?”
হুড়মুড়িয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল এক মাতাল! টলমল শরীর নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো। পিটপিট চাহনিতে কম্পিত গলায় বলল,,

“হেই মাইন্ড ইউর লেঙ্গুইজ। আমরা কোনো নেশা-ভান করি নি! আমরা তো ড্রিংকস করেছি, ড্রিংকস। ড্রিংকস মানে বুঝেন? ড্রিংকস মানে হলো বিয়ার! বিয়ার খুব এক্সপেন্সিভ জিনিস। এই জিনিস খেলে নেশা হয় না! মুখ থেকে ফটাফট সত্যি কথা বের হয়, সাহস বাড়ে, শক্তি বাড়ে! আর এখন এই সাহস নিয়েই আমি মাকে গিয়ে বলব, ‘মা আমি বিয়ে করতে চাই! গার্লফ্রেন্ডের কাছ থেকে ব্রেকাপ চাই না!”

মুখ থেকে বিচ্ছিরি গন্ধ বের হয়ে আসছিল ছেলেটির! তৎক্ষনাৎ নাক সিটকে আমি ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে নিলাম। ছেলেটিকে দেখে হচ্ছিল, ‘জাতে মাতাল, তালে ঠিক।’ এর মধ্যেই পাশ থেকে অন্য ছেলেটি উঠে দাঁড়াল। আমার সাথে তর্ক করা ছেলেটির কাঁধে হাত রেখে চাপা গলায় বলল,,

“চল ভাই আমরা বাড়ি ফিরে যাই। এসব মেয়েদের সাথে বিশ্বাস নেই! কখন আমাদের কীভাবে ফাঁসিয়ে দেয়! এরা নিশ্চয়ই নিষিদ্ধ পল্লির কেউ হবে! ভদ্র পরিবারের মেয়েরা এতো রাতে বাড়ি থেকে বের হয় না!”
পাশ থেকে আমি এবং আপু তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলাম। রাগান্বিত হয়ে আমি কিছু বলার পূর্বেই সোহানী আপু গর্জে উঠল! ছেলেটির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“হেই ইউ? আমাদের দেখতে কী নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়েদের মতো দেখতে? আমরা কী কোনো ভাবে আপনাদের জোর করেছি আমাদের সাথে কোথাও যেতে? মুখ সামলে কথা বলুন বলছি। ভদ্রতা বজায় রাখুন। ঢাকায় নতুন এসেছি বলে ভাববেন না, আমরা ভয় পেয়ে যাব অথবা আমরা এখানে বানের জলে ভেসে এসেছি। আমরা একটি ভদ্র পরিবার থেকেই বিলং করি। আপনাদের মতো অভদ্র এবং অশিক্ষিত পরিবার থেকে নয়!”

এবার ঐ পাশ থেকে দুই মাতাল ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল! মাতলামী ভুলে সমস্বরে বলে উঠল,,
“কে অভদ্র পরিবার থেকে এসেছে হ্যাঁ? কারা অশিক্ষিত পরিবার থেকে এসেছে? মেয়ে মানুষ বলে কিন্তু ছাড় পাবেন না আপনারা। প্রতিবাদ সমানে সমানে হবে। আর একটি বার শুধু আমাদের পরিবার সম্পর্কে বলে দেখুন না জাস্ট পুঁ”তে রেখে দিব! এই এলাকা আমাদের বুঝেছেন? এই এলাকার বাপ আমরা।”

রাগ যেনো মুহূর্তের মধ্যেই নিয়ন্ত্রাধীন হয়ে উঠল আমার! তাই তেজী গলায় হাঁক ছেড়ে বললাম,,
“ন”লা ভেবেছেন আমাদের হ্যাঁ? ন”লা ভেবেছেন? আমরা কী এখানে বানের জলে ভেসে এসেছি? আপনারা জানেন? আমাদের এলাকায় আমাদের ঠিক কতো খানি দা”পট? আপনাদের মতো ছেলেদের পুঁ”তে রাখার টেকনিকও আমাদের খুব ভালো ভাবে জানা আছে! শুধু মাতাল বলেই আজ আপনাদের ছাড় দিচ্ছি কিন্তু।”
ছেলে দুটো টালমাটাল শরীর নিয়ে তেজী দৃষ্টিতে আমার দিকে তেড়ে আসতেই সোহানী আপু ভয়ে ঘাবড়ে উঠল! দু’হাত দিয়ে আমাকে টানতে টানতে রিকশার দিকে অগ্রসর হতে হতে বলল,,

“ছেড়ে দে ‘চাঁদ!’ এদের সাথে আমরা জোরে পারব না। ঢাকা শহরে আমরা নতুন এসেছি। তাও আবার একা দুটো মেয়ে। রাত এখন অনেকটাই বেড়ে গেছে। তাছাড়া এখানের পথ-ঘাট, মানুষ-জন কিছুই আমাদের জানা শোনা নেই। ঠিকানা অনুযায়ী খালামনির বাড়িতে পৌঁছাতে পারলেই হলো। এদের সাথে শ”ত্রুতা বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই।”

“আপু ছাড়ো প্লিজ! এদের তো আমি দেখেই ছাড়ব। কতো বড় সাহস আমাদের পরিবার নিয়ে কথা তুলে। শুধু তাই নয়, আবার থ্রে”ড দিয়ে বলে আমাদের পুঁ”তে রেখে দিবে। শা”লা মাতালের দল!”
ছেলে দুটো অগ্নিশর্মা হয়ে আমাদের রিকশার দিকে তেড়ে আসতেই আপু তাড়াহুড়ো করে রিকশাওয়ালাকে বলল রিকশা ছেড়ে দিতে! আমার সাথে তর্ক করা ছেলেটি পা থেকে জুতো খুলে আমাদের রিকশার পেছনে ছুড়ে মারল! বজ্রকন্ঠে বলে উঠল,,

“হেই ইউ? চাইলে কিন্তু আমিও স্লাং ইউজ করতে পারতাম! কিন্তু করি নি। কেন বলুন তো? কারণ, আমরা ভদ্র পরিবার থেকে বিলং করি। আপনার মুখটি না? আমি খুব ভালো ভাবেই চিনে রেখেছি। পরের বার দেখা হলে রাস্তায় ঠিক পুঁ”তে রেখে দিব। আমাকে শা”লা বলা না? এই ‘নূরকে’ মাতাল বলা?”
আমিও রিকশার হুড তুলে ব্যগ্র গলায় চিৎকার করে বললাম,,

“মাতালদের মাতাল বলব না তো কী বলব হ্যাঁ? সাধু পুরুষ বলব? ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে যেনো পবিত্র জল খেয়ে এসেছে! আপনিও শুনে রাখুন মিস্টার মাতাল, পরের বার দেখা হলে কিন্তু আমিও আপনাকে ছাড় দিব না। এলাকা আমার না হলেও, আমি কিন্তু একজন মেয়ে! মেয়ে মানুষদের ক্ষমতা সম্পর্কে আশা করি ধারণা আছে আপনার?”
“শুধু একটি বার বাড়ির ঠিকানাটা দিয়ে যান! দেখুন কী অবস্থা করি আপনার। শুধু একটু ড্রিংকস করেছি বলে আজ বেঁচে গেলেন। পরের বার দেখা হলে কিন্তু রেহাই নেই!”

রিকশাটি এতো দ্রুতই জায়গা পরিত্যাগ করল যে মাতাল দুটোকে আর দৃষ্টির সীমানায় দেখতে পেলাম না! শীঘ্রই রিকশার হুড উঠিয়ে নিলাম আমি। স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে আপুর দিকে তাকিয়ে বললাম,
“রাত-বিরাতে এসব লাফা”ঙ্গার-রা যে কোথা থেকে ছুটে আসে মাতলামো করে আল্লাহ্’ই জানে। এদের মতো দু-একজন ছেলের জন্যই রাস্তা-ঘাটে মেয়েদের নানা রকমের হ্যারাস”মেন্টের শি”কার হতে হয়। কবে যে এসব ছেলেদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাবে স্বয়ং আল্লাহ্’ই ভালো জানেন।”

“হুম। এখন ছাড় এসব। খালামনির বাড়ির ঠিকানা অনুযায়ী হয়তো আমরা পৌঁছেও গেছি। এবার শুধু খালামনির সাথে দেখা করার পালা।”

রাত এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট প্রায়! আপু এবং আমি কিছুক্ষণ আগেই খালামনির বাড়ি এসে পৌঁছেছি! দীর্ঘ দশ বছর পর খালামনি এবং আংকেলের সাথে দেখা! তাঁরা যেনো পারছিল না আমাদের কলিজায় ঢুকিয়ে নিতে! আনন্দে আত্নহারা প্রায়। কুমিল্লায় শিফট হওয়ার পর থেকেই খালামনিদের সাথে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আমাদের! আম্মু এবং খালামনির মধ্যে কিছু ব্যক্তিগত সমস্যা থাকার কারণে আমরা অনেকটাই আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম!

আত্নীয়ের সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন হওয়ার অবস্থায় ছিলাম। তবে এতো গুলো বছর পর হঠাৎ আমার বড়ো খালাতো ভাইয়ার বিয়ে উপলক্ষ্যে সমস্ত মান-অভিমান, ঝগড়া-বিবাদ, দ্বিধা-দ্বন্ধ ভুলে খালামনি আমাদের সাথে যোগাযোগ করেই ফেলল! মিনতি করে বলল ভাইয়ার বিয়েতে সহ-পরিবার এসে এটেন্ড করতে। আম্মু প্রথমে নাকোচ করে দিলেও পরবর্তীতে আমি, আপু, আব্বু এবং ছোটো খালামনির জোরাজুরিতে আম্মু প্রায় বাধ্য হয়েছিল বড়ো খালামনির কথা রাখতে।

সেই কথার জের ধরেই আমি এবং আপু বিয়ের পনেরো দিন আগেই খালামনির বাড়ি চলে এলাম! তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, যার বিয়েতে আমরা এসেছি তার চেহারাটিই স্পষ্ট মনে নেই আমাদের! ছবিতে শুধু একবার দেখেছিলাম “নীড়” ভাইয়াকে। দ্বিতীয় বার দেখলে হয়তো বা চিনতে সুবিধে হতো।
এর মধ্যেই খালামনি দুধের গ্লাস নিয়ে আমাদের শোবার ঘরে প্রবেশ করল! আনন্দে আপ্লুত হয়ে তিনি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের দু’বোনের মুখোমুখি দাঁড়াল। দুধের গ্লাস দুটো আমাদের দু’ বোনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় শুধালো,,

“কেমন হয়েছে রান্না? তোরা পেট ভরে খেয়েছিস তো?”
আমি এবং আপু মিষ্টি হেসে সমস্বরে বললাম,,
“খুব ভালো হয়েছে খালামনি। অনেক বছর পর তোমার হাতের রান্নার স্বাদ পেলাম। মাঝখানে তো তোমার হাতের রান্নার স্বাদ প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম!”

দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন খালামনি! কিঞ্চিৎ মুহূর্ত মৌণতা বজায় রেখে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,,
“আচ্ছা রুমটা তোদের পছন্দ হয়েছে তো? পছন্দ না হলে কিন্তু বলতে পারিস৷ নূরের বেড রুমটায় তোদের শিফট করে দিব! ওর রুমটা আমাদের সবার রুমের তুলনায় প্রায় অনেকটাই বড়। আই থিংক ঐ রুমেই তোরা কমফোর্টেবল ফিল করবি।”

তাৎক্ষণিক আপু ব্যতিব্যস্ত গলায় জবাবে বলল,,
“না খালামনি। এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। আমি এবং চাঁদ এই রুমেই ঠিক আছি। অযথা নূরকে হেনস্তা করতে হবে না। তবে খালামনি, আসার পর থেকে নূর এবং নীড় ভাইয়াকে কোথাও দেখছি না। কোথায় তারা?”
“আর বলিস না। ছেলে দুটো দিন দিন বেয়াড়া হয়ে উঠছে! ইদানিং খুব রাত করে বাড়ি ফিরে। শুনেছি কোনো ফ্রেন্ডের বার্থডে পার্টিতে গিয়েছে। পার্টি শেষ করে আসছে হয়তো।”

ইতোমধ্যেই আমার দৃষ্টি পড়ল বেলকনির গ্রীল ভেদ করে বাড়ির মেইন গেইটের দিকে। চাঁদের মৃদু আলোয় সেই আধো অস্পষ্ট মুখ দুটো দৃষ্টির সীমানায় ভেসে উঠল! তাৎক্ষণিক দৃষ্টি আমার চড়কগাছ হয়ে উঠল! প্রকান্ড চক্ষুজোড়ায় আমি আপুকে দু’হাত দিয়ে ঠেলে ভয়ার্ত গলায় বললাম,,

“আপু দেখ মাতাল দুটো আমাদের ফলো করতে করতে এই বাড়িতেও চলে এসেছে! আমি তখন ঠিকই ধরেছিলাম, “এরা জাতে মাতাল, তালে ঠিক! দেখ, এখনও ওরা মাতলামি করেই চলছে। মেইন গেইট খোলা দেখেও দেয়াল টপকে বাড়ি ঢুকছে!”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২