প্রেমময়ী তুমি শেষ পর্ব 

প্রেমময়ী তুমি শেষ পর্ব 
নিশাত জাহান নিশি

“কান্নাকাটি সাইডে রাখো এখন। তোমাকে পার্লারে পৌঁছে দিয়ে আমাকে একটু থানায় যেতে হবে। কে আমার সাথে এই প্রতারনাটা করল তাকে ধরতে হবে।”

নূরের এক কথায় নিজেকে ধীর করল চাঁদ। কান্নাকাটি থামিয়ে নূরের পাঞ্জাবীতে নাক মুছল! নাকের জলে স্বচ্ছ পাঞ্জাবিটিকে মুহূর্তের মধ্যেই অস্বচ্ছ করে তুলল! শেষবারের মত সে নাক টেনে হেচকি তুলল। চাঁদের এহেন বাচ্চাসূলভ আচরণ দেখে নূর হেঁতো হাসল! বিপরীতে কিছু বললনা৷ কেবল চোখ মেলে চাঁদের অদ্ভুত আচরণ দেখতে লাগল। নূরের বুকে হাত রেখে চাঁদ কম্পিত স্বরে বলল,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আচ্ছা ঠিক আছে৷ আমি রেডি হয়ে আসছি। আপনি যান।”
দীর্ঘ এক শ্বাস ছাড়ল নূর। বিগলিত হয়ে চাঁদের নিচু মুখখানি দু’হাত দ্বারা উঁচিয়ে ধরল। নাকেমুখে অস্পষ্টভাবে লেগে থাকা জল রাশিগুলোকে অতি আদরে-যত্নে-ভালোবাসায় মুছে দিলো। আহ্লাদে আটখানা হয়ে চাঁদের কপালে দীর্ঘ এক চুমু খেলো। আবেগপ্রবণ গলায় বলল,,

“কিছুক্ষণ পরেই আমরা সারাজীবনের জন্য এক হয়ে যাব চাঁদপাখি। আমাদের এক হওয়ার পথ এতটা মসৃণ ছিলনা। অসমতল, অমসৃণ, নানান খর-খাদড়ায় পূর্ণ ছিল। কিন্তু দেখো? সমস্ত প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজ আমরা এক হতে যাচ্ছি। আল্লাহ্ যেন আমাদের এই পবিত্র ইচ্ছেকে কবুল করে নেন। আর কোনোরকম বিপদ যেন আমাদের ছুঁতে না পারে চাঁদ পাখি। ভালোয় ভালোয় যেন আমাদের বিয়েটা হয়ে যায়।”

মলিন হাসল চাঁদ। নূরের আদ্র দৃষ্টিতে শিথিল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল৷ শান্ত স্বরে বলল,,
“আপনি কোনো চিন্তা করবেননা নূর। যা হবে ভালোর জন্যই হবে। আল্লাহ্’র উপর ভরসা রাখুন।”
“একের পর এক যেভাবে বিপদ লেগে আছে কীভাবে আমি নিজেকে নিশ্চিন্ত রাখব চাঁদপাখি? নিশ্বাস নিতেও এখন আমার ভয় হয় জানো? যদি সেই নিশ্বাস আর ফিরিয়ে আনতে না পারি?”

“বালাইষাট৷ এসব কী কথা বলছেন আপনি? আর কিছু খারাপ হবেনা বললাম তো। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। এখানে আর একটু দাঁড়ালেই আমাদের বিয়েটা হতে অনেকটা দেরি হয়ে যাবে নূর। আপনি প্লিজ বাইরে যান। আমি আসছি।”
চাঁদের কথা সানন্দে মেনে নিলো নূর। আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে সোজা রুম থেকে বের হয়ে গেল। জামার উপরে কোনো রকমে একটা বোরখা পড়ে চাঁদ বিয়ের ল্যাকেজটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। চাঁদের হাত থেকে ল্যাকেজটা এগিয়ে নিয়ে গেল নূর। বাইকে ওঠে দুজনই পার্লারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।

ঘণ্টাখানেক বাদে নূর খবর নিয়ে জানতে পারল জামান আহমেদের পরিচিত কেউ জেনে শুনে টাকা হাতানোর উদ্দেশ্যে ফ্রাঙ্ক কল করেছিল! নূরকে ঠকিয়ে ত্রিশ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল। সেই লোক এখন জেল হাজুতে বন্দি। পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা দেওয়ার পর জেল থেকে ছাড়ানো হবে ফ্রড লোকটাকে!

চারজোড়া বিয়ে একসাথে সম্পন্ন করতে এসে কাজী সাহেব নিজেও বেশ হিমশিম খেয়ে গেলেন! মেয়েরা কবুল বলার সময়টাতে এত বেশি কান্নাকাটি করছিল যে কাজী সাহেব নিজেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন! কবুল বলার সময়টা যে মেয়েদের জন্য কতটা কষ্টকর তা শুধু একজন মেয়ের বাবারা-ই ভালো জানতে পারেন!

বিশেষ করে চাঁদ যখন তার বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে গলা ফাটিয়ে কান্না করছিল তখন! কিছুতেই যেন সামলানো যাচ্ছিল না চাঁদকে। বাবা-মায়ের সবচেয়ে আদরের সন্তান ছিল চাঁদ। সেই হিসেবে উভয় পক্ষের-ই কষ্ট পাওয়াটা নিতান্ত স্বাভাবিক। চাঁদের কান্নাকাটির আওয়াজে নূর স্টেজ থেকে দৌঁড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল! ভেবেছিল কী না কী হয়ে গেছে চাঁদের।

এমনিতেও সকাল থেকে নূরের মনটা বড্ড কুহ্ গাইছে। তাই সামান্য বিষয়েও সে বিচলিত হয়ে উঠছে। নূর এসে কোনোমতে চাঁদকে সামলে নিলো। তাকে শান্ত করে কবুল বলাতে বাধ্য করেছিল৷ পালাক্রমে চারজোড়া বিয়ে একসাথে সম্পন্ন হলো। বিদায় পর্বে সবাইকে কাঁদিয়ে মেয়েরা তাদের সদ্য বিয়ে করা বরদের সাথে শ্বশুড় বাড়িতে পাড়ি জমালো!
অতি উষ্ণ ভালোবাসায় ঘেরা একটি জোছনা ভরা রাত এসে ধরা দিলো চার কপোত-কপোতীর নতুন জীবনে।

বাইরে চঞ্চলা চাঁদের সুশোভিত আলো। ভেতরে ভালোবাসায় তৃষ্ণার্ত নেশালো আটটি হৃদয়! সবার মনোবাঞ্ছা আজ পূর্ণ হতে চলল। তাদের মন-প্রাণ-দেহ_হৃদয় একাত্নভাবে মিশে যাওয়ার শুভ সময় ঘনিয়ে এলো। পিপাসু হয়ে উঠল তাদের আকাঙ্খারা। সমস্ত অপেক্ষার যেন অবসান ঘটল আজ। ব্যস্ত যেন সবাই তাদের অর্ধাঙ্গিনীদের আপন করে নেওয়ার ভাবনায়।

লাজে রাঙা হয়ে তিথী ড্রেসিং টেবিলের সামনে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খোঁপা থেকে ফুল ছাড়ানোর অন্তঃপ্রাণ চেষ্টা করছে। ফুলে সুসজ্জিত খাটের মাঝখানে পায়ের উপর পা তুলে মাহিন তিথীর প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে লাজে রাঙা মুখখানি দেখে ব্যগ্র হাসছে! তিথীকে আরও কিছুক্ষণ এভাবে লজ্জায় ফেলে রাখতে বড্ড ইচ্ছে করছে তার। এই সুদর্শনীয় লজ্জা ভাঙাতে একটুও ইচ্ছে করছেনা তার। যে লজ্জায় তিথীকে অপ্সরা দেখাচ্ছে! মাহিনের নিস্তব্ধতা দেখে তিথী চোখ উঠিয়ে আয়নায় মাহিনের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো। ফ্যাল ফ্যাল চাহনিতে নিরস গলায় শুধালো,,

“এভাবে তাকিয়ে কী দেখছেন হ্যাঁ? হাত লাগিয়ে একটু খোঁপাটা খুলে দিতে পারছেন না?”
“আজ তো শুধু খোঁপা খুলবনা! অন্যকিছুও খুলব। তাই একটু পরিমাপ করে দেখছিলাম কোথা থেকে শুরু করব!”
সঙ্গে সঙ্গেই হাত দ্বারা মুখ ঢেকে নিলো তিথী! লজ্জা লুকিয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,,
“ছিঃ! কতটা নির্লজ্জ আপনি। মুখে কিছুই আটকায় না।”
কদাচিৎ হেসে মাহিন বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। পেছন থেকে তিথীকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। তিথীর নরম ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে নেশালো স্বরে বলল,,

“না আটকায় না। জামাইদের কিছুই আটকায় না।”
উত্তেজনায় নিজেকে সামলে রাখতে পারলনা মাহিন! তিথীকে আপন করে নিতে তৎপর হয়ে উঠল। রুমে থাকা সমস্ত জ্বলন্ত ক্যান্ডেলগুলো নিভিয়ে তিথীকে নিয়ে ভালোবাসায় ডুব দিলো। ক্রমশ একাত্ন হয়ে গেল দুটি দেহ এবং মন।

বিয়ের শাড়ি পাল্টে ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে তাশফিয়া মাত্র ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো। আয়মন এখনও বিয়ের পাঞ্জাবি পড়ে-ই খাটের উপর বসে ল্যাপটপ টিপছে! আয়মনের এহেন বেপরোয়া ভাব দেখে তাশফিয়া রাগে রঙিন হয়ে গেল। এত আকাঙ্ক্ষিত একটা মধুর রাতেও আয়মন বসে বসে অফিসের কাজ করবে? এতদিন তার এত কাজ কোথায় ছিল হ্যাঁ?

আজ-ই কেন এত কাজ দেখাতে হচ্ছে? ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফেটে পড়লেও তাশফিয়া তা বাইরে প্রকাশ করলনা। তেজ ঝাল দেখিয়ে রুমের সব আসবাবপত্র মাটিতে ছুড়তে লাগল! ধুমধাম আওয়াজ হতে লাগল। কোনোদিকে চোখ তুলে না তাকালেও আয়মন বেশ বুঝতে পারছিল তাশফিয়ার মনের খবর!

বিষয়টাকে বেশ মজার ছলে দেখছিল আয়মন। কাজটা শেষ করেই সে তাশফিয়ার রাগ ভাঙাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো। এই প্রথম সে এত বড়ো একটা প্রজেক্ট পেয়েছে। সাত লাখ টাকার মত বাজেট। তাই বুঝে শুনেই তাকে ডিলটা করতে হচ্ছে। একটু অসর্তক হলেই প্রজেক্টটা ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এতটুকু সময় অবধি তাশফিয়াকে তার এড়িয়ে চলতেই হবে।

মিনিট পনেরো পর আয়মনের ডিল কনফার্ম হলো! খুশিমনে সে ল্যাপটপটা হাত থেকে রেখে জায়গা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। তাশফিয়া এতক্ষণে রাগে-দুঃখে ফেটে পড়ে পায়চারি করতে করতে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। অকপট হেসে আয়মন নিঃশব্দে তাশফিয়াকে পেছন থেকে জাপটে ধরল। আদুরে হয়ে তাশফিয়ার পিঠে ইচ্ছেমতো চুমু খেতে লাগল। নেশাক্ত স্বরে বলল,,

“জামাইকে পাওয়ার জন্য এতই তাড়া হ্যাঁ? পাঁচটা মিনিট সহ্য হচ্ছিলনা?”
“দেখি ছাড়ুন। আমার এত তাড়া নেই কাউকে কাছে পাওয়ার। আপনি সারাক্ষণ ঐ ল্যাপটপেই মুখ গুজে রাখুন। আমার কোনো আপত্তি নেই।”

“এ্যাঁ। দেখেই বুঝা যাচ্ছে আপত্তি আছে না নেই! তড়পাচ্ছিলে আমাকে কাছে পেতে। দেখেছি তো সব। এখন আর গলাবাজি করতে হবেনা। এবার তো। আমারও আর সহ্য হচ্ছেনা।”

তাশফিয়াকে প্রতিউত্তর করার আর কোনো সুযোগ দিলো না আয়মন! বিনাবাক্য প্রয়োগে পাঁজা কোলে তুলে নিলো তাশফিয়াকে। ড্যাব ড্যাব চাহনিতে তাশফিয়া আয়মনের দিকে তাকিয়ে রইল। বিপরীতে আয়মন চোখ মেরে দিলো। লজ্জায় তাশফিয়া মুখ ঢেকে নিলো! বিছানায় শুইয়ে দিলো আয়মন তাশফিয়াকে। ভালোবাসার উষ্ণতা গাঢ়ভাবে জাহির করতে লাগল! ভেসে যেতে লাগল ভালোবাসার অতল গহীনে।

রুমের দরজা আটকে খাটের উপর গোল হয়ে বসে আছে জায়মা! দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে সাদমান রুমের দরজা ধাকাচ্ছে। সাদমানকে কীভাবে ফেস করবে তা ভেবেই তার অন্তর্আত্তা কেঁপে উঠছে! দরজা খুলতেও ইচ্ছে করছেনা। এভাবে আর কতক্ষণ সাদমানকে বাইরে আটকে রাখতে পারবে জানেনা সে।

তবে এতটুকু জানে এই মুহূর্তে সাদমানকে কিছুতেই ফেস করতে পারবেনা সে। লজ্জায় দম আটকে মা”রা যাবে! ক্রমশ ব্যস্ত হয়ে উঠল সাদমান। জায়মা হঠাৎ দরজা কেন খুলছেনা তাই ভেবে সে অস্থির হয়ে উঠল। এক পর্যায়ে এসে সাদমান জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগল। জায়মার নাম ধরেও বেশ উচ্চশব্দে ডাকতে লাগল।

জায়মা এবার বড্ড ভয় পেয়ে গেল! ভেতরের খবর বাড়ির কেউ কিছু বুঝতে পেরে গেলে অনর্থ হয়ে যাবে। সবাই জড় হয়ে যাবে রুমের সামনে। কী না কী ভাবতে শুরু করবে। দ্বিধা ভুলে জায়মা এবার বুকে দম সঞ্চার করল। দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে রুমের দরজাটা খুলে দিলো। সঙ্গে সঙ্গেই সাদমান দরজা ঠেলে রুমের ভেতর ঢুকে পড়ল। জায়মার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। জায়মার ডান গালে হাত রেখে উদ্বিগ্ন গলায় শুধালো,,

“ঠিক আছো তো তুমি?”
জায়মা থমথমে দৃষ্টিতে সাদমানের দিকে তাকালো। কাঠ কাঠ গলায় জবাবে বলল,,
“ঠিক আছি।”
“তাহলে এতক্ষণ কেন লাগছিল দরজা খুলতে?”

সাদমানকে এড়িয়ে গেল জায়মা। বুকে হাত রেখে পিছু ঘুরে দাঁড়ালো। মাথা নুইয়ে হাত-পা কচলাতে লাগল। বেগতিক রুদ্ধশ্বাস ফেলতে লাগল। শরীর জুড়ে এক অন্যরকম উন্মাদনা কাজ করতে লাগল তার। জায়মার লুকিয়ে থাকার কারণ সাদমান এবার কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারল!

স্মিত হেসে সে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। পিছু ঘুরে দরজার খিলটা আটকে দিলো। অমনি জায়মা জায়গা থেকে দৌঁড়ে বেলকনির দিকে চলে গেল! জায়মার এহেন অবাক ছোটাছুটি দেখে সাদমান দেঁতো হাসল! দ্রুত পা ফেলে জায়মার পিছু নিলো সে। জায়মা যেইনা বেলকনির দরজা লাগাতে যাবে অমনি সাদমান দরজাটা হাত দ্বারা আটকে দিলো! জায়মার মুখোমুখি দাঁড়ালো। পুনরায় ভয় পেয়ে গেল জায়মা। অবিন্যস্ত দৃষ্টি ফেলে সাদমানের দিকে তাকালো। ডানপিটে হেসে সাদমান হেঁচকা টানে জায়মাকে তার বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। গলায় মুখ ঠেকিয়ে বলল,,

“যখন আমাকে এত ভালোবাসছিলা তখন মনে হয় নাই ভালোবাসলে টর্চারও সহ্য করতে হয়? ভালোবাসার মানুষটার কাছে নিজের সব বিলীন করে দিতে হয়? দেহ, মন, প্রাণ, লজ্জা সব?”
নিশ্চুপ জায়মা। নাক-মুখ থেকে কেবল তপ্ত শ্বাস ফেলতে লাগল। জায়মার উত্তেজনাকে আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দিয়ে সাদমান জায়মার বুকে দীর্ঘ এক চুমু এঁকে দিলো। অমনি জায়মা সাদমানকে শরীরের সমস্ত শক্তি দ্বারা আঁকড়ে ধরল! কম্পিত স্বরে বলল,,

“আমি আপনার মাঝেই সব বিলিয়ে দিতে চাই সাদমান। আমার শুধু আপনাকেই চাই। আপন করে নিন আমায় প্লিজ। আর কিছু বলার নেই আমার।”
জায়মার সম্মতি পেয়ে সাদমান আর এক মুহূর্ত বিলম্ব করলনা! পরম আবেশে আবিষ্ট হয়ে পাঁজা কোলে তুলে নিলো জায়মাকে। উন্মাদ হয়ে উঠল জায়মাকে আপন করে নিতে। পবিত্র ভালোবাসায় গাঁ ভাসালো দুজনই অকাতরে।

জানালার ধারে যেন আজ রূপোলী চন্দ্রিমার মাখামাখি চলছে। হাঁটু গলিয়ে তারা জানালার রঙিন পর্দা ভেদ করে স্নিগ্ধ আলোক রশ্মি নিয়ে হুড়মুড়িয়ে রুমে প্রবেশ করছে। মৃদুমন্দ বাতাস এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে চাঁদ এবং নূরের তৃষ্ণার্ত শরীরকে। একহাতে আলতার কৌটো হাতে নিয়ে নূর অন্য হাতে চাঁদের পায়ের পাতায় বেখেয়ালী চিত্তে আলতা পড়িয়ে দিচ্ছে!

হাঁটুতে থুতনী ঠেকিয়ে চাঁদ সেই দৃশ্য অপলক দৃষ্টিতে দেখছে। লোকটা এত ভালোবাসা পায় কোথা থেকে হ্যাঁ? এত মাধূর্যতা মিশিয়ে ভালোবাসতে পারে কীভাবে? প্রতিদিন-ই যেন তার নিত্যনতুন ভালোবাসা চোখে পড়ে! ভালোবাসায় সোনায় সোহাগী করে রেখেছে চাঁদকে। প্রতিদিন আকৃষ্ট হয় চাঁদ নূরের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায়। রোজ-ই যেন নতুন করে তাদের প্রেমের পর্ব শুরু হয়।

দু’পায়ে আলতা পড়ানোর পর নূর এবার ক্লান্ত শ্বাস ছাড়ল! পা দুটোর দিকে তাকিয়ে হাঁপ ছাড়া গলায় বলল,,
“থ্যাংকস গড। ফিনিশ হলো। আমি এত ভালো আলতা পড়াতে পারি জানতাম না তো!”
ফিক করে হেসে দিলো চাঁদ! নূরের দিকে নিমগ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আহ্লাদি হয়ে নূরের গাল দুটো টেনে ধরল। আদুরে স্বরে বলল,,

“হ্যাঁ পারেন তো। আলতাটা ভালোই পড়াতে পারেন। তবে মেহেন্দি ঘেটে ‘ঘ’ করে দিতে পারেন!”
বাঁকা হাসল নূর৷ চাঁদের আদর পেয়ে শরীরে উত্তেজনার সৃষ্টি হলো তার। হেঁচকা টানে চাঁদকে তার আরও মুখোমুখি বসিয়ে দিলো। চাঁদের দু’কাঁধে দু’হাত ঠেকিয়ে আবিষ্ট দৃষ্টি নিক্ষেপ করল চাঁদের মগ্ন দৃষ্টিতে। দিনদুনিয়া ভুলে নিষ্কলুষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল চাঁদের দিকে। বাইরের বিদ্যমান চাঁদের আলোয় ঘরে থাকা চাঁদটি যেন অতি রঞ্জিত ভাবে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল। চোখদুটো যেন ঝলসে আসছিল নূরের! তাকিয়ে থাকতে পারছিলনা মানুষরূপী এই চাঁদের দিকে! অচিরেই চোখদুটো নামিয়ে নিলো নূর। ডানে-বায়ে মাথা ঝাঁকিয়ে ধরাশায়ী গলায় বলল,,

“ইশশ! চোখদুটো ঝলসে এলো আমার। এত হাই পাওয়ার কেন তোমার রূপে হ্যাঁ? চোখের ভোল্টেজ বেড়ে যাচ্ছিল আমার! বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছিল। রূপের আগুনে মানুষ জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে শুনেছি। তবে সেই আগুনে যে মানুষ অন্ধও হয়ে যায় তা আজ স্বচক্ষে দেখেছি।”

খিলখিলিয়ে হেসে দিলো চাঁদ! হাসতে হাসতে নূরের তপ্ত বুকে লুটিয়ে পড়ল। ভালোবাসায় রঙিন হয়ে নূরের বুকে কী যেন আঁকিবুকি করতে লাগল। খানিক কেঁপে উঠল নূর। তবে চাঁদকে দুষ্টুমিকে একরত্তিও দমানোর চেষ্টা করলনা! সানন্দে গ্রহণ করতে লাগল চাঁদের আচরণকে। হঠাৎই পাঞ্জাবির প্রথম দুটো বাটন খুলে নিলো চাঁদ! সাদা ধবধবে বুকটা উন্মুক্ত করল। লাজ লজ্জা খুইয়ে বসে সেই উন্মুক্ত বুকে নির্দ্বিধায় দীর্ঘ এক চুমু খেয়ে দিলো! পরে নিজেই আবার লজ্জায় রাঙা হয়ে নূরের বুকে লুটিয়ে পড়ল। সিক্ত গলায় বলল,,

“এতদিনের সমস্ত অপেক্ষা আজ ঘুঁচে গেল নূর! আমি আপনাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য নিজের করে পেয়ে গেছি। আর কোনো বাঁধা-বিপত্তি নেই আমাদের মাঝে। এবার থেকে যা হবে সব ঠিক হবে নূর। সবার ভালোর জন্য হবে।”
চাঁদকে বুকের সাথে লেপ্টে ধরল নূর। প্রশান্তির শ্বাস ফেলে অবিলম্বেই চোখজোড়া বুজে নিলো। মলিন স্বরে বলল,,
“তোমাকে পাওয়ার মাঝেই আমার সব পাওয়া হয়ে গেল চাঁদ। এভাবেই আজীবন তোমাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চাই। মৃত্যু ব্যতীত কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবেনা চাঁদপাখি। ভাবতেই ভেতরটায় কেমন সুখকর অনুভূতি হচ্ছে। দুনিয়াটাকে স্বর্গ মনে হচ্ছে!”

প্রখর রোমাঞ্চে প্রলোভিত হয়ে উঠল নূর। চাঁদকে ভালোবাসায় রাঙিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তর যেন সইছিলনা তার! যেকোনো মূল্যেই হোক চাঁদকে এই মুহূর্তে তার চাই-ই চাই। চাঁদের লজ্জিত ভাবকে বিন্দু পরিমান প্রশ্রয় না দিয়ে নূর গাঁ থেকে একটানে শাড়িটা খুলে ফেলল!

তড়িঘড়ি করে পাঞ্জাবিটা খুলে চাঁদের দেহের উপর নিজেকে প্রতিস্থাপন করল। নেশাক্ত হয়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো চাঁদের ঘাড়ে। ভেতরে ভেতরে তপ্ত শ্বাস ফেলছিল চাঁদ। নূরের পাগলাটে ভালোবাসায় যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার। সেই দম বন্ধ করা রুদ্ধকর অনুভূতিকেও চাঁদের সুখকর অনুভূতি মনে হচ্ছিল! নূরের ভালোবাসায় ক্রমশ নিজেকে সমর্পণ করতে লাগল।

মাঝরাতে ওঠে খাবারের জন্য কান্নাকাটি করছে নিদ! নীড় মাত্রই সোহানীকে একটু আদর করার জন্য বেশ চাঙা মোডে সোহানীকে নিয়ে বেলকনিতে গিয়েছিল। এরমধ্যেই নিদ ঘুম ভেঙে ওঠে তাদের ভালোবাসায় ব্যাঘাত ঘটাল। অমনি ঘেটে গেল নীড়। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে রাগ ঝাড়তে লাগল৷ নীড়ের হিংস্রাত্নক ভাবখানি দেখে সোহানী মুখ চেপে হাসতে বাধ্য হলো! দৌঁড়ে এসে বিছানার উপর বসল।

নিদকে কোলে তুলে পিটার খাওয়াতে লাগল। ক্ষুধার্ত নিদ খাবার পেয়ে স্বস্তি খুঁজে পেল। চোখবুজে সে পিটার টানতে লাগল। রাগে ধেই ধেই করে হেঁটে এসে নীড় সোহানীর উল্টোদিক ফিরে শুয়ে পড়ল। উঁকি ঝুকি মেরে সোহানী চাপা হেসে নীড়কে দেখতে লাগল। নীড়ের নাজেহাল অবস্থা দেখে মনে মনে বেশ মজা পাচ্ছিল সে! একমাত্র ছেলেই পারে তাকে নাকানিচুবানি খাওয়াতে! তার মেজাজ বিগড়ে দিতে। তাকে আচ্ছে মত জব্দ করতে!

মোটামুটি পেট ভরে আসতেই নিদ পিটার ছেড়ে সোহানীর বুকে মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমন্ত নিদকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সোহানী ওয়াশরুমে গেল। ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দরজায় নীড়ের মুখোমুখি হয়ে গেল! উন্মুক্ত শরীরে নীড় ভালোবাসার আকুতি নিয়ে নির্মম দৃষ্টিতে সোহানীর দিকে তাকালো! বিগলিত হয়ে গেল সোহানী। একছুটে নীড়ের বুকে নিজেকে সমর্পণ করল। শক্তভাবে নীড়কে আঁকড়ে ধরে বলল,,

“আজ আর কোনো নিষেধ নেই নীড়। আমি তৈরী আপনার ভালোবাসাময় অত্যাচার সহ্য করতে।”
তৃপ্তির হাসি হাসল নীড়। সোহানীকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল৷ পাঁজা কোলে তুলে তাকে বিছানায় অতি সর্তকভাবে শুইয়ে দিলো। নিদ যেন না ওঠে যায় সেদিকে খেয়াল রাখল। প্রখর ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে লাগল সোহানীকে।

পুচিকে জড়িয়ে ধরে শান্তিতে চোখ বুজলেন সাবরিনা আবরার! পাশে-ই শুয়ে আছেন হাবিব আবরার। দুজন-ই আজ ভীষণ খুশি। উনাদের সব ছেলে/সন্তানরা আজ নিজেদের জীবনে স্যাটেল্ডড। চল্লিশ বছরের সংসার জীবন উনাদের ষোলআনায় পরিপূর্ণ। ঠোঁটর কোণে উনাদের পুলকিত হাসি। নানান রকম খোশগল্পে লিপ্ত তারা। পুরোনো সেই মধুর দিনগুলোকে স্মৃতিচারণ করছে তারা! পাশেই পুচি খানিক ক্ষণ বাদে বাদে নড়েচড়ে উঠছে। বেশ জেদ দেখিয়ে চাঁদের কাছে দৌঁড়ে যেতে চাইছে। বুঝতে-ই চাইছেনা আজ চাঁদের কাছে যাওয়া তার মানা! পুচির এহেন অবাধ্যতা দেখে সাবরিনা আবরার পুচিকে বুকের সাথে চেপে ধরলেন। গাঁ এলিয়ে হেসে বললেন,,

“কী দুষ্টু রে তুই পুচি? ফুলসজ্জার রাতেও তুই আমার চাঁদটাকে একান্তে সময় কাটাতে দিবি না? বার বার বায়না ধরবি আমার চাঁদের কাছে যাওয়ার জন্য? আমার ছেলে আর ছেলের বউয়ের রোমান্স দেখার এত শখ তোর?”
হিংস্রাত্নক হয়ে পুচি ম্যাও করে ডেকে উঠল! ছোটো ছোটো থাবায় সাবরিনা আবরারকে আঘাত করতে লাগল। বুঝাতে লাগল চাঁদকে সে একান্তে সময় কাটাতে দিবেনা। সবসময় চাঁদের পাশে থাকবে। কখনও চাঁদকে একা ছাড়বেনা!

নূর এবং চাঁদের বিয়ে নিয়ে রোজের মধ্যে বেশ উৎসাহ উদ্দীপনা কাজ করছে! রাত জেগে বসে সে তার হাজবেন্ডের সাথে নূর এবং চাঁদের প্রেম কাহিনী বর্ণনা করছে! তার হাজবেন্ডও খুব মনোযোগ সহকারে তার কথা শুনছে। মাঝে মাঝে রোজের সাথে হেসেও দিচ্ছে। কথা বলাবলির এক পর্যায়ে এসে রোজের হাজবেন্ড হঠাৎ নির্বাক গলায রোজের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আচ্ছা? এখনও ভালোবাসো নূরকে?”
থতমত খেয়ে গেল রোজ! তবুও সংকীর্ণতা ঢেকে জোরপূর্বক হেসে বলল,,
“উঁহু। এখন তো আমি আমার ছেলের বাবাকে ভালোবাসি। নিজের জীবনের চাইতেও বেশি! এক কথায় যাকে ছাড়া আমি অচল, অসহায়।”

তৃপ্তির হাসি হাসল রোজের হাজবেন্ড। বুকে চেপে ধরল রোজকে। মাথায় হাত বুলিয়ে নরম স্বরে বলল,,
“আমিও আমার ছেলের মা’কে নিজের জীবন চাইতেও বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। থাকবে তো সবসময় এভাবে আমার পাশে হ্যাঁ?”
“বালাইষাট! থাকব না কেন হুম? এমন অলক্ষুণে কথা আর কখনও বলবেন না।”
“ওকে বাবা আর কখনও বলবনা। এবার তো একটু শান্ত হও!”

মৃদু হাসল রোজ। ভালোবেসে আঁকড়ে তার স্বামীকে। নূরকে যে রোজ পুরোপুরি ভুলে গেছে রোজ কিন্তু নয়! মাঝে মধ্যেই নূরের কথা মনে পড়ে তার। যদিও তার সমসাময়িক। তবে মনে পড়াটা নিতান্তই স্বাভাবিক!

গভীর রাত। নিস্তব্ধ ধরনী। চাঁদের আলোয় সিক্ত চারিপাশ। অর্ধনগ্ন শরীরে চাঁদ নূরের বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে। হুট করেই কেন যেন তার রোজের কথা বড্ড মনে পড়ছে! মনের খচখচানি থেকেই চাঁদ আদুরে হাতে তার চুলে বিলি কাটা নূরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“আচ্ছা? রোজ আপুর কথা মনে পড়েনা আপনার?”
চাঁদের এহেন উদ্ভট প্রশ্নে বিরক্তবোধ করল নূর। মুখ ভঙ্গিমা পাল্টে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,,
“এসব আবার কী ধরনের প্রশ্ন? রোজের কথা আমার মনে পড়বে কেন?”
“বা রে! একসময় তো ভালোবাসতেন তাকে। মনে পড়েনা কখনও?”

“উঁহু! মনে পড়েনা৷ তুমি থাকলে আমার আর কাউকে চাইনা। কারো কথাই মনে পড়েনা তখন। তুমিই হলে আমার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। আমার জগৎ সংসার সব। তুমিহীনা আমার আর কিছু চাইনা।”

সন্তুষ্ট চাঁদ। উপর ওয়ালার কাছে প্রাণ ভরে দোয়া করতে লাগল তাদের ভালোবাসাময় বিবাহিত জীবন যেনো এভাবেই সুখে, শান্তিতে কেটে যায়। কারো যেন কোনো নজর না লাগে যায় তাদের ভালোবাসায়। আজন্ম যেন এভাবেই বেঁচে থাকে তাদের ভালোবাসা।

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৭০