প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৭০

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৭০
নিশাত জাহান নিশি

মেহেন্দির অনুষ্ঠান সাদামাটাভাবে সম্পন্ন হলেও হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলো বেশ জমজমাটভাবে! হলুদের এলাহি অনুষ্ঠানে কোনোকিছুর খামতি রাখেনি মেয়েপক্ষ এবং ছেলেপক্ষ। সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব সবাই ততটুকু দিয়েই সম্পন্ন করেছে হলুদের অনুষ্ঠান। হলুদের দিন সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও চার বধূর হাতের মেহেন্দি সব ঘটে ‘ঘ’ হয়েছিল! যদিও তিথীর হাতের মেহেন্দি সবার দৃষ্টি কেড়েছিল। তবে এর বিপরীতে নূর, আয়মন এবং সাদমানের অনেক লানত সহ্য করতে হয়েছিল!

বিয়ের দিন সকাল হতেই নূর লুকিয়ে ছুপিয়ে চাঁদকে পুরো রিসোর্টে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ঘুম ভেঙে ওঠেই যেন চাঁদকে এক পলক চোখের দেখা তার চাই-ই চাই। নয়তো পুরো দিনটাই মাটি যাবে তার। অভ্যেসটা দিন দিন গাঢ় গভীর হয়ে উঠছে তার। যদিও সেই অভ্যেসটা বিন্দুমাত্র বদলানোর ইচ্ছে নেই তার।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মনে কোনো খচখচানি ছাড়াই শুভ দিনটা সে শুভ কাজের মাধ্যমে শুরু করতে চায়। অর্ধখোলা চোখে-ই নূর কাজের বাহানায় মেয়ে পক্ষের সীমানায় চলে গেল। মুখ ঢেকে চাঁদের রুমে প্রবেশ করতেই দেখল পুরো রুম ফাঁকা! বিয়ের শাড়ি, গয়না, জুতো, কসমেটিকস এবং বিভিন্ন ধরনের অরনামেন্টস বিছানায় উপর অনেকখানি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

তবে এসব জিনিসপত্রের মালিক লাপাতা। অবাক হলো নূর। খরতরভাবে কপাল কুঁচকে রুমের ভেতর প্রবেশ করল। পুরো রুমটিতে আবারও পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ওয়াশরুমের দরজাটিও আধখোলা অবস্থায় দেখতে পেল। বেলকনিটাও ফাঁকা! কোথাও কেউ নেই। ইতোমধ্যেই পাশের রুম থেকে তিথী, তাশফিয়া এবং জায়মার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

নূর কান খাঁড়া করে তাদের কথা শুনছিল। তবে এদের মধ্য থেকে চাঁদের গলার আওয়াজ শোনা গেল না! হয়রান হয়ে উঠল নূর। অযাচিত কিছু ভয় মনে বাসা বাঁধতে লাগল। দ্রুত পায়ে হেঁটে নূর রুম থেকে বের হয়ে গেল। তড়িৎ বেগে পাশের রুমের দরজা খুলে গোল হয়ে বিছানার উপর বসে থাকা জায়মা, তিথী এবং তাশফিয়ার দিতে ভয়াল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“চাঁদ কোথায়?”
জায়মা, তিথী এবং তাশফিয়া জায়গা থেকে খানিত নড়েচড়ে বসল। নূরের হঠাৎ আগমনে তারা ঈষৎ বিব্রতবোধ করল! গাঁয়ের ওড়নাটা ঠিক করে জায়মা গলাটা খানিক ঝাকালো। ইতস্তত গলায় বলল,,

“খালামনির রুমে হয়তো। চাঁদ তো এতক্ষণ এখানে-ই ছিল ভাইয়া।”
“শিওর?”
“হ্যাঁ ভাইয়া। কেন?”
“না এমনি। আচ্ছা তোমরা থাকো। আমি আসছি।”

প্রস্থান নিলো নূর। শূণ্য হৃদয়ে সামনের চুলগুলো টানতে টানতে মেয়েপক্ষের সীমানা থেকে বের হয়ে গেল। কেন জানিনা ভেতরটাতে বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে তার! কোনোকিছুই স্বাভাবিক মনে হচ্ছেনা। কেমন যেন একটা ভীতিকর অনুভূতি কাজ করছে।

শান্তি পাচ্ছেনা কোনোকিছুতে-ই৷ চাঁদকে একটা নজর চোখের দেখা দেখলে হয়তো বা তার ভালো লাগত। কিন্তু এখন তো তা আর সম্ভব নয়! কোনো বাহানাতেই চাঁদের কাছে যাওয়া আদোতেই সম্ভব নয়। কেউ চাঁদের সাথে তাকে দেখা করতে দিবেনা। বরং তাকে নিয়ে সবাই হাসি-তামাশা করবে। চাঁদও অস্বস্তিতে পড়ে আছে।

যার সমস্ত দায়ভার এসে তার ঘাড়ে পড়বে! চাঁদের ভয়ে নূর বিষণ্ণ মনে রুমে এসে ঢুকে পড়ল। বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে অর্ধ হওয়া ঘুমটিকে পরিপূর্ণ করার প্রস্তুতি নিলো! ঘুমের অভাবে হয়তোবা তার এমন অস্থিরতা কাজ করছে। ঘুমটা পূর্ণ হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে ধারণা করছে।

সেই ঘুম ভাঙল নূরের তার চারিপাশে হতে থাকা হাঁকডাকে! নূরের নাম ধরে সবাই উচ্চশব্দে তাকে ডাকাডাকি করছে। সবার কণ্ঠস্বরেই কেমন উদ্বিগ্নতার ছাপ। অনর্থ কিছু একটা হয়েছে বোধ হয় যার আভাস নূর ঘুমের মধ্যেই টের পাচ্ছে। যা পুরো পৃথিবীটাকে লণ্ডভণ্ড করে দেওয়ার যথেষ্ট। জল্পনা কল্পনা ছেড়ে নূে ধড়ফড়িয়ে শোয়া থেকে ওঠে বসল। অমনি আয়মন উত্তেজিত গলায় নূরকে বলল,,

“চাঁদকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা নূর!”
ফট করে মাথাটা ধরে এলো নূরের! আতঙ্কিত দৃষ্টি ফেলল আয়মনের দিকে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়ার জো হলো তার। সকালের আতঙ্কটা যে এমনি এমনি ফলে যাবে বুঝতে পারেনি সে। ঘুম থেকে হঠাৎ ওঠার দরুন তার মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। ঠাণ্ডা মাথায় কিছু ভাবতে পারছিলনা। সব যেন কেমন গুলিয়ে গুলিয়ে যাচ্ছিল। অত শত চিন্তা না করে টালমাটাল শরীর নিয়ে নূর কম্পিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“মামামানে? কোকোকোথায় যাবে চাঁদ?”
“জানিনা কিছু। সকাল থেকেই চাঁদকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। সবাই ভাবছিল হয়তো রিসোর্টের কোথাও আছে। এখন মেয়েরা পার্লারে যাবে খুঁজে দেখে চাঁদ কোথাও নেই।”

তড়িৎ বেগে বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো নূর। বিস্তীর্ণ মুখমণ্ডল জুড়ে নিগূঢ় অস্থিরতার ছাপ ফুটে উঠল তার। শুভ্র মুখের আদলটা যেন মুহূর্তের মধ্যেই টগবগে লাল রূপ ধারণ করল। চোখের কোটর জুড়ে বোধ হয় অবাধ্য সুনামির পূর্বাভাস দেখা দিচ্ছিল! সামনের পেছনের চুলগুলো টেনে ধরে নূর খাটের কার্ণিশে জোরে এক লাথ মারল৷ আর্ত গলায় বলল,,
“ডেম ইট। কেন আমি ঘুমুতে গিয়েছিলাম হ্যাঁ? খারাপ কিছুর ইঙ্গিত পাওয়ার পরেও কেন আমি মরার মত ঘুমুতে গিয়েছিলাম? কেন?”

দিক-বিদিক ভুলে হন্ন হয়ে নূর রুমের দরজার দিকে মোড় নিতেই হঠাৎ জামান আহমেদের মুখোমুখি হয়ে গেল সে। হাঁপিয়ে ওঠা অবস্থায় তিনি ঘোর আতঙ্ক সমেত নূরের দিকে তাকালেন। উত্তেজিত গলায় বললেন,,
“একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এসেছিল নূর। উনারা বলছেন চাঁদের নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে! সাভার হসপিটালে ভর্তি। একটা বিকাশ নাম্বার পাঠিয়ে। বলেছে পঞ্চাশ হাজার টাকা এখনি ঐ নাম্বারে বিকাশ করতে।”

মাথা ঘুরে আসতেই নূর দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো! ঘামে পুরোপুরি সিক্ত হয়ে বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলতে লাগল। শ্বাসটা যেন ক্রমশ ভেতর থেকে টেনে এনে বাইরে ফেলতেও তার বড্ড কষ্ট হচ্ছিল। কখন না দম আটকে মারা যায় সেই চিন্তায় ভুগছিল। ক্ষণিকের মধ্যেই দুনিয়াটা তার অসহ্যকর হয়ে উঠল। কী থেকে কী ঘটতে চলল এসব?

আজকের মত একটা শুভ দিনে এত বড়ো একটা বিপদ? তবে কী সুখের শুরুতেই এসে এই দুর্দশা লিখা ছিল তার ভাগ্যে? চাঁদ তাকে এভাবে ঠকাতে পারল? তার কোমল হৃদয়ে এতটা আঘাত করতে পারল? কিছু না জানিয়েই তাকে ছেড়ে কোথায় গিয়েছিল চাঁদ? না বলে কয়ে তো গেলই গেল তার উপর এত বড়ো একটা দুঃসংবাদ নিয়ে এলো?

যে দুঃসংবাদ তার জীবনটাকে লণ্ডভণ্ড করে দিলো? কীভাবে, কী উপায়ে সে নিজেকে সামাল দিবে এখন? নূরের বর্তমান দুর্বিষহ অবস্থা দেখে আয়মন, মাহিন এবং সাদমান ছুটে এসে নূরের পাশে দাঁড়ালো। নূরকে সামাল দেওয়ার শতভাগ চেষ্টা করল তারা। যদিও এই মুহূর্তে তা বৃথা তবুও তারা হাল ছাড়লনা।

তারা নিজেরাও ভেতর থেকে ভেঙেচূড়ে গেছে। তবে নূরের তুলনায় এর কিছুই না। জামান আহমেদ কান্নায় ভেঙে পড়লেন! সামিয়া আহমেদকে কীভাবে এই দুঃসংবাদটা জানাবেন তাই যেন ভাবতে লাগলেন। মেয়ের এক্সিডেন্টের কথা শুনে তিনি না আবার স্ট্রোক করে বসেন সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলেন! এই মুহূর্তে চাঁদের জন্যে হলেও নূর নিজেকে স্থির করার চেষ্টা করল। ভেতর থেকে বড়ো বড়ো রুদ্ধশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করতে লাগল। দেয়াল থেকে হেলান ছেড়ে দাঁড়ালো। জামান আহমেদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শুকনো গলায় বলল,,

“নানাম্বারটা দিন আঙ্কেল।”
“বিকাশ নাম্বার?”
“না। যে আপনাকে কল করেছিল তার নাম্বারটা দিন।”
“দিচ্ছি।”

তাড়াহুড়ো করে জামান আহমেদ উনার কললিস্ট থেকে ঐ অপরিচিত লোকটির নাম্বার তুলে নূরকে দিলেন। কম্পিত হাতে নূর নাম্বারটিতে ডায়াল করল। প্রথমবার কিছুসময় রিং বেজে যেতেই লোকটি ঐ প্রান্ত থেকে ফোনটি তুললেন। সঙ্গে সঙ্গেই নূর অধৈর্য গলায় লোকটিকে বলল,,

“হ্যালো।”
“হ্যাঁ হ্যালো। কে?”
“আপনি একটু আগে যে নাম্বারটিতে কল করে বলেছিলেন তার মেয়ে হসপিটালে ভর্তি আমি সেই মেয়েটির-ই হাজবেন্ড হই। কাইন্ডলি একটু বলবেন মেয়েটি কোথায় এখন? আমি কি তার সাথে একটু কথা বলতে পারব? বা আপনি যে হসপিটালে আছেন ঐ হসপিটালের ঠিকানাটা দিন প্লিজ। পাঁচ মিনিট লাগবে আমার আসতে। যদি এর আগে আসা সম্ভব হয় তো আমি চেষ্টা করব এর আগে আসতে।”

“ওহ্ হ্যাঁ। আপনাদের তো বলেছিলাম এক্ষণি এই নাম্বারটিতে পঞ্চাশ হাজার টাকা বিকাশ করতে! করেছেন কী? মেয়েটির অবস্থা কিন্তু খুব-ই ক্রিটিকাল এই বলে দিলাম। আইসিও তে ভর্তি করাতে হবে। টাকা ছাড়া কিন্তু ডক্টররা আইসিও তে নিবে না মেয়েটিকে। ভেবে দেখুন কী করবেন!”

আবারও দুর্বল হয়ে পড়ল নূর। উত্তেজিত হয়ে অতি বিচ্ছিরিভাবে মুখমণ্ডল কুঁচকে নিলো। চোখের কোটর জুড়ে আবারও অবাধ্য জলের ছুটোছুটি শুরু হলো। আশা-ভরসা তার ক্ষীণ হতে লাগল। আর্ত গলায় বলল,,

“আপনি প্লিজ হসপিটালের ঠিকানাটা দিন ভাই। আমি আসছি। বললাম তো পাঁচ মিনিটও সময় লাগবেনা আমার আসতে। জাস্ট হসপিটালটার নামটা বলুন ভাই। আমি আপনার কাছে হাত জোর করছি ভাই প্লিজ বলুন। যেকোনো অবস্থাতেই আমি আমার ওয়াইফকে সুস্থ দেখতে চাই।”

“সব বলব আগে এই নাম্বারটিতে পঞ্চাশ হাজার টাকা বিকাশ করুন। জীবনের মূল্যের থেকে নিশ্চয়ই টাকার মূল্য বেশি নয়? টাকাটা হাতে পাওয়ার পরই আমি বলছি আমি আপনার ওয়াইফকে নিয়ে কোন হসপিটালে আছি।”

বলেই কলটা কেটে দিলেন লোকটি! কান থেকে ফোনটা নামিয়ে নূর আর এক মুহূর্তও দেরি করলনা। আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রীনে তাকালো। কোনোকিছু যাচাই-বাছাই না করেই গরম মাথায় তার বিকাশ অ্যাকাউন্ট থেকে ঐ নাম্বারটিতে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকার মত বিকাশ করে দিলো! এই ত্রিশ হাজার টাকাই ছিল তার অ্যাকাউন্টে। এটাও এখন খুঁইয়ে দিলো। নূরের বোকামো দেখে পাশ থেকে মাহিন এবং আয়মন ঝাড়ি তুলল। দুজনই সমস্বরে নূরকে শাসিয়ে বলল,,

“এই এটা তুই কী করলি তুই? কিছু যাচাই বাছাই না করেই টাকাটা পাঠিয়ে দিলি? লোকটা তো ফ্লডও হতে পারে!”
“যা ইচ্ছে হোক। এই মুহূর্তে যে আমাকে যাই বলবে আমি ঠিক তাই করব। যদি কেউ এসে বলে নিজের কিডনিটা এখন বিক্রি করে দিতে আমি এই মুহূর্তে ঠিক তাউ করব! যেকোনো মূল্যেই হোক চাঁদকে আমার জীবিত চাই-ই চাই।”

হন্ন হয়ে নূর পুনরায় নাম্বারটিতে কল করল। সঙ্গে সঙ্গেই ফোনটি সুইচ অফ এলো! বিমূষর্তায় নূর চুল টেনে ধরে রুম থেকে বের হয়ে গেল। উতলা হয়ে লাগাতার নাম্বারটিতে ডায়াল করতে লাগল। দুঃশ্চিন্তায় একপ্রকার ছটফট করতে লাগল সে। ভেতর থেকে গোঙানির আওয়াজ নিঃসৃত হতে লাগল। উপায় বুদ্ধিতে ভুগছিল সে। কী করবে না করবে ভেবে পাচ্ছিলনা।

ক্রমশ পাগল হয়ে যাচ্ছিল নূর। জ্ঞানবুদ্ধি কিছুই কাজ করছিলনা। বরাবরই নাম্বারটি বন্ধ আসছিল। হতাশার ঠিক শেষ পর্যায়ে পৌঁছাতেই নূর নাম্বারটিকে ট্রেস করার সিদ্ধান্ত নিলো। তার একজন কাছের বন্ধুর নাম্বারে কল করে নাম্বারটিকে ট্রেস করতে দিলো। সেও বাইক নিয়ে রিসোর্ট থেকে বের হয়ে গেল!

বাড়ির অনেকেই এখনও চাঁদের নিঁখোজের খবরটি জানেনা! বিশেষ করে চাঁদের মা। তিনি বাড়ির বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত৷ তাই মেয়ের তেমন খোঁজ-খবর রাখা হয়নি তার। দুপুর এগারোটা বাজতে চলল মেয়েরা এখনও বাড়িতেই রয়ে গেল। পার্লারে আর সাজতে যাওয়া হলোনা তাদের।

সবার মধ্যে ক্রমশ ভয়, অস্থিরতা এবং উৎকণ্ঠা কাজ করতে লাগল। বাড়িভর্তি মেহমানদেরও আসা যাওয়া বাড়ছিল। সবাই বিয়ে দেখার জন্য প্রস্তুত। সামিয়া আহমেদকে সোহানী কথায় কথায় ভুলিয়ে রেখেছে! কিছুতেই বুঝতে দিচ্ছেনা চাঁদ বাড়িতে নেই।

বিধ্বস্ত হয়ে নূর রিসোর্টের রাস্তা পাড় হয়ে তার বন্ধুর বাসার দিকে অগ্রসর হবে এমন সময় চাঁদও এসে রিকশা থেকে নামল! রিসোর্টের গেটের সামনে রিকশা দাঁড় করিয়ে সে ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল! সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থাতেই চাঁদ দ্রুত পা চালিয়ে তাদের রিসোর্টের সীমানার দিকে পা বাড়ালো। বিড়বিড় করে বলল,,

“ইশশ! কতটা দেরি হয়ে গেল। আজ আমার খবর আছে জানি! নূর ভাইয়া আমাকে আজ আস্ত রাখবেনা। কেটেকুটে একদম গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিবে। পার্লারে যেতেও কতটা লেট হয়ে যাবে।”

রিসোর্টের সদর দরজার দিকে পা বাড়াতেই চাঁদ তোপের মুখে পড়ে গেল। জায়মা, তিথী, তাশফিয়া, আয়মন, মাহিন এবং সাদমান চাঁদকে চারিপাশ থেকে ঘিরে ধরল। তেজস্ক্রিয় চাহনির পাশাপাশি তারা বেশ অবাক দৃষ্টিতেও চোখ বুলিয়ে চাঁদকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখতে লাগল। শাড়ির আঁচল খামচে ধরে চাঁদ ভয়ে জনাজীর্ণ হয়ে সবার মাঝখানে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আতঙ্কে বশীভূত হয়ে সে একপ্রকার কাঁপা-কাঁপি করছিল। মাঝেমধ্যে আবার মাথা উঁচিয়ে আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে নূরকেও খুঁজতে লাগল। নূরের অস্তিত্ব বিশেষ কোথাও দেখতে না পেয়ে চাঁদ খানিক ঘাবড়ে উঠল। থমথমে গলায় বলল,,

“আচ্ছা। নূর ভাইয়াকে কোথাও দেখতে পারছিনা কেন? কোথায় গেছেন উনি? জিজ্ঞেস করব ওদের?”
উপস্থিত সবার অবাক করা মৌনতাকে কঠোর ভাবে ভেঙে দিলেন জামান আহমেদ। ক্ষিপ্র হয়ে এসে তিনি চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। চোখ রাঙিয়ে তিনি চাঁদের শিথিল চাহনিকে মাঠে মেরে দিলেন! চোয়াল উঁচিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন ছুড়লেন,,

“এই কোথায় ছিলি তুই হ্যাঁ? তোর না এক্সিডেন্ট হয়েছিল?”
আকাশ থেকে যেন টুপ করে মাটিতে পড়ল চাঁদ। নির্বোধের ন্যায় ফ্যাল ফ্যাল চাহনিতে জামান আহমেদের দিকে দৃষ্টি ফেলল সে। মাথা চুলকে জবাবে বলল,,
“কী? আমার এক্সিডেন্ট হয়েছিল?”

“হ্যাঁ। কেউ একজন ফোন করে বলেছিল তোর নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে। হসপিটালে ভর্তি তুই। পঞ্চাশ হাজার টাকা বিকাশ করতে তাকে।”
“এসবের মানে কী বাবা? কেউ যা তা বলবে আর তোমরাও বিশ্বাস করে নিবে হ্যাঁ? টাকাটা কি পাঠিয়েছিলে তোমরা?”

“হ্যাঁ নূর পাঠিয়েছে! ছেলেটা পাগল হয়ে গিয়েছিল তোর এক্সিডেন্টের খবরটা পেয়ে। বোকার মত এক কথাতেই ত্রিশ হাজার টাকা বিকাশ করে দিয়েছে। এখন আবার কোথায় কোথায় খুঁজে বেড়াচ্ছে তোকে কী জানি। সব তোর কারণে হয়েছে বুঝলি? কোথায় গিয়েছিলি তুই আমাদের কিছু না জানিয়ে হ্যাঁ? তোর কারণেই প্রতারকরা সাহস পেয়েছে আমাদের ঠকাতে।”
ভড়কে উঠল চাঁদ। অবাক দৃষ্টিতে তার বাবার দিকে তাকালো। মুখে লেগে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম গুলোকে দু’হাত দ্বারা মুছল। ধরাশায়ী গলায় বলল,,

“আমি তো ঐ কাছের পার্কটাতেই গিয়েছিলাম বাবা। রোজ আপুর সাথে দেখা করতে! ভাবতে পারিনি এতটুকু সময়ের মধ্যে এতকিছু ঘটে যাবে। কেউ তোমাদের এভাবে বোকা বানাবে।”
কাঁদো কাঁদো হয়ে চাঁদ আয়মনকে বলল,,

“নূর ভাইয়াকে একটু জানিয়ে দাওনা ভাইয়া আমি ফিরে এসেছি। না জানি কোথায় কোথায় খুঁজে বেড়াচ্ছেন উনি আমাকে।”
তাড়াহুড়ো করে আয়মন নূরের নাম্বারে কল করল। আয়মনের ফোন পাওয়া মাত্রই নূর বাইক ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। বাড়িতেও এতক্ষণে খবরটা জানাজানি হয়ে গেল। চাঁদকে সবাই ইচ্ছেমতো ঝাড়তে লাগল।

সামিয়া আহমেদ তো রেগে মেগে বোম হয়ে চাঁদের গালে ঠাটিয়ে একটা চড়ও মেরে দিয়েছিলেন! সেই রাগে চাঁদ দরজা আটকে তার রুমে বসে রইল। পার্লারে সাজতে যাবেনা বলে বাহানা ধরল। চাঁদকে রেখেই জায়মা, তিথী এবং তাশফিয়া চলে গেল পার্লারে সাজতে। তাদের বিশ্বাস ছিল নূর এসে চাঁদকে ঠিক মানিয়ে নিবে।

ছন্নছাড়া হয়ে নূর দৌঁড়ে এসে চাঁদের দরজার সামনে দাঁড়ালো। হাঁপাতে হাঁপাতে তার জানটা বের হয়ে যাচ্ছিল! একজায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছিলনা সে। বাধ্য হয়ে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। পাঁচ থেকে দশ মিনিট পর নিজেকে স্থির করে চাঁদের রুমের দরজায় টোকা মারল সে।

অমনি চাঁদ কান্নাকাটি ভুলে দৌঁড়ে এসে রুমের দরজাটা খুলে দিলো। ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে চাঁদ নূরের দিকে সরল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অমনি নূর চোখ মুখ সাংঘাতিক রকম লাল করে চাঁদের গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিলো! চড় খেয়ে চাঁদ বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। জংলী বাঘের ন্যায় নূর হিংস্র দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। ধারালো গলায় চিৎকার করে বলল,,

“কিছু বলিনা দেখে তুই মাথার উপর ওঠে গেছিস না? নিজেকে স্বাধীন ভাবতে শুরু করেছিস? এই প্রতিদিন বলিনা তোকে? কোথাও যাওয়ার আগে অন্তত একবার আমাকে বলে যাবি? প্রতিবারই তুই আমার কথার বল খেলাফ করিস। আজ তো শুধু কথার খেলাফ-ই করিসনি। বরং কুত্তার মত আমাকে হয়রান করেছিস!

জানটা বের হয়ে যাচ্ছিল আমার তোকে হারানোর ভয়ে। কিছু মুহূর্তের জন্য ভেবে বসেছিলাম এই বুঝি তোকে হারিয়েই ফেললাম। মজা পাস আমাকে কষ্ট দিয়ে না? একবার তো এসব করে করে আমাকে মেরেই দিচ্ছিলি আজ আবার সেই একই মজা নিলি। আমি কি মানুষ না হ্যাঁ? আমার ধৈর্য শক্তির বাঁধ ভাঙেনা?”

হেচকি তুলে কেঁদে উঠল চাঁদ। নিজের ভুল বুঝতে পারল সে। চাঁদ জানত রোজের সাথে দেখা করার কথা বললে নূর কখনো রাজি হতনা তাকে যেতে দিতে! কোনো কথা না শুনেই বরং রেগে যেত। চাঁদের যাওয়া আটকে দিত। কিন্তু যাওয়াটা যে তার অতি প্রয়োজন ছিল।

রোজের সাথে একবার দেখা করে তাকে অন্তত একবার ধন্যবাদ জানানোটা প্রয়োজন ছিল! রোজ চেয়েছিল বলেই নূর ঐদিন জেলহাজুত থেকে বের হতে পেরেছিল। বিষয়টা চাঁদ কিছুদিন আগেই জানতে পেরেছিল। সুযোগ খুঁজছিল বের হওয়ার। রোজের সাথে দেখা করার। আজ যখন সেই সুযোগটা পেল তাই এই শুভদিনেই রোজের সাথে দেখা করাটাকে সে গুরুত্বপূর্ণ ভেবে নিলো। কাউকে কিছু না জানিয়েই বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। তবে এবার আর চুপ থাকতে পারলনা চাঁদ। কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে মাথা নুইয়ে বলল,,

“রোজ আপুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম আমি। দেখা করাটা ভীষণ জরুরি ছিল তাই। আপনি তো জানেন না ঐদিন রোজ আপুর জন্যই আপনি জেলহাজুত থেকে বের হতে পেরেছিলেন। আমাদের মাঝে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। আগে বললে হয়তো আপনি যেতে দিতেন না। তাই আপনাকে না বলেই যাওয়া।”

“হোয়াট? রোজের কারণে আমি জেলহাজুত থেকে বের হতে পেরেছিলাম মানে? কী বলছ কী এসব তুমি?”
“রোজ আপুর মামা হলেন আমাদের কুমিল্লা জেলার এমপি। উনার সুপারিশেই পুলিশ আপনাকে ঐদিন ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।”

“কই কেউ তো তখন আমাকে এই বিষয়ে কিছু বলেনি।”
“আপনি রেগে যাবেন বলে কেউ কিছু বলেনি।”

নূর ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। দ্বিধা কাজ করতে লাগল তার ধ্যানজুড়ে। রোজের প্রতি কিছুটা হলেও সফট কর্ণার কাজ করতে লাগল তার! তবে বেশি গুরুত্ব দিলো না সেই সহানুভূতির জায়গাটিকে। ছ্যাত করে রেগে উঠল! তুখোর জেদী কণ্ঠে বলল,,
“রোজ আমার জন্য যা করেছে আমি এখন থেকে সত্যিই তার কাছে থ্যাংকফুল হয়ে থাকব।

যদিও তার সাথে দেখা করার বা তাকে থ্যাংকস বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার! তবে তুমি তার সাথে দেখা করে এসেছ কথা বলে এসেছ এতেই সব চুকে বুকে গেল! তোমার ভুল শুধু এই জায়গাতেই ছিল তুমি যাওয়ার আগে কাউকে কিছু জানিয়ে যাওনি। আমার কথা না হয় বাদ দিলাম। আমি হলাম বারোমাসি পাগল! তুমি থাকলেও আমি তোমার জন্য পাগলামি করি আর না থাকলেও করি! বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা তো আমার মত পাগল নয়। তুমি অযথা তাদের প্রত্যেককে হয়রানি করেছ চাঁদ। বিশেষ করে আঙ্কেলকে কাঁদিয়েছ।”

“এর শাস্তি তো আমি পেয়েছি তাইনা? বাড়ির প্রত্যেকে আচ্ছেমতো ধুলো। আম্মু মারধর করল। শুধু আপনিই বাকি ছিলেন। অবশ্য এখন আর এটাও বাকি নেই। চড় মেরে সব শোধ বোধ করে দিলেন।”
মুখ ফিরিয়ে নিলো চাঁদ। অভিমানে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো সে। কাঁদতে কাঁদতে পেছনের দিকে মোড় নিতেই নূর রাগ ভুলে চাঁদকে পেছন থেকে জাপটে ধরল। ভগ্ন গলায় বলল,,

“কতটা ভয়ে পেয়েছিলাম জানো? ভেবেছিলাম এবারের মত বোধ হয় সত্যি সত্যিই তোমাকে হারিয়ে ফেললাম। কেন করো এত পাকামো বলো তো? সবসময় অযথা আমাকে রাগিয়ে দাও। কষ্ট পেয়েছি বলেই আঘাত করছি। নয়তো আমার কোনো ইন্টেনশান ছিলনা আমার চাঁদপাখির গাঁয়ে হাত তোলার।”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৯

নূরের কোনো কথাতেই চাঁদের তেমন কোনো ভাবান্তর হলোনা। মুখ চেপে ধরে সে কাঁদতেই লাগল। মিনিট পাঁচেক সময় ধরে নূর চাঁদকে জাপটে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। আচমকা চাঁদের ঘাড়ে দীর্ঘ এক চুমু খেয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,,
“কান্নাকাটি সাইডে রাখো এখন। তোমাকে পার্লারে পৌঁছে দিয়ে আমাকে একটু থানায় যেতে হবে। কে আমার সাথে এই প্রতারনাটা করল তাকে ধরতে হবে।”

প্রেমময়ী তুমি শেষ পর্ব