প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৯

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৯
নিশাত জাহান নিশি

“এই জায়মা? তোমার জন্যও আজ বিরাট বড়ো এক সারপ্রাইজ আছে! তৈরী থেকো কিন্তু।”
অবিলম্বেই জায়মা মাথা উঁচিয়ে নূরের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি ফেলল! ‘সারপ্রাইজ’ শব্দটি শোনা মাত্রই যেন তার বুকে অজানা কিছু অতি রঞ্জিত আশা বাঁধতে লাগল!

নানান কিছু জল্পনা কল্পনা মাথায় বেশ সময় নিয়ে ঘুরপাক খেতে লাগল। সামনে কী হবে তা ভেবে অদ্ভুত কিছু সুখ দোলা দিতে লাগল। নূর সহসা জায়মার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। চাঁদের দিকে মোহিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। গভীর প্রেমে আবিষ্ট হয়ে খপ করে চাঁদের ডান হাতটি তার বুকের বাঁ পাশে চেপে ধরল! আশেপাশে কে আছে না আছে কোনোকিছুর-ই পরোয়া করলনা সে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে নিষ্পলক চাহনিতে চাঁদকে দেখতে লাগল। বেগহীন গলায় বলল,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“দেখেছ? বুকের ভেতরটা কেমন বেসামাল হয়ে আছে কেবল তোমার একটুখানি স্পর্শে? এই অস্থিরতা আমি অতি দ্রুত কাটাতে চাই চাঁদপাখি। আর মাত্র দুটো দিনের অপেক্ষা। এই দুটো দিনই যেন আমার কাছে দুই দশকের মত মনে হচ্ছে। কী এক মহা মুশকিল বলো তো? এই অধীর অপেক্ষা কি আমাকে দম ফেলে বাঁচতে দিবেনা? এত কেন নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন, তিক্ত এই অপেক্ষা?”

ঝট করে চাঁদ নূরের বুক থেকে হাতটি সরিয়ে নিলো। ক্রমশ নূরের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। নূরের গভীর ভালোবাসায় মোড়ানো এই মিষ্টি স্বীকারোক্তিগুলোও যেন চাঁদের কাছে হেয়ালী মনে হচ্ছে এখন! কেন লোকটা সবসময় এমন বেহায়াপনা করতে আসে?

স্থান বুঝেনা, কাল ভেদে, পাত্র বুঝেনা! দাঁত দাঁত চেপে চাঁদ কুঁচকানো স্বরে বলল,,
“আচ্ছা আপনার কি কোনো আক্কেল জ্ঞান নেই? দেখছেন না এখানে সবাই আছে? সবার সামনে এমন অসভ্যতামো করছেন? যান বলছি এখান থেকে। আগামী ২৪ ঘণ্টাও যেন আপনার মুখটা না দেখি আমি।”

নূরকে বেশ শক্তপোক্তভাবে হুমকি দিলো চাঁদ! একপ্রকার ধাক্কাতে ধাক্কাতে নূরকে রুম থেকে বের করে দিলো। নূরের অবাধ্যতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে চোখের পলকেই ভেতর থেকে দরজার খিলটা আটকে দিলো। নূর বিষণ্ণ মনে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। খানিক রেগে ওঠে পা দুটো ঝেড়ে উঠল। মাথার সামনের চুলগুলো শক্ত হাতে টেনে ধরল। নাজেহাল গলায় বলল,,

“ধ্যাত। একটু মন খুলে কথাও বলতে পারলামনা! কত রিস্ক নিয়ে একটু দেখা করতে এসেছিলাম চাঁদ পাখিটার সাথে। প্রেম করার আগেই প্রেমের দরজা বন্ধ করে দিলো! এখন এই পাগলিটাকে কী করে বুঝাই তাকে দেখলেই আমার কেমন যেন প্রেম পেয়ে যায়। অবচেতন হয়ে পড়ি। স্থান, কাল, পাত্রের কথা মনে থাকেনা তখন।”
এরমধ্যেই পেছন থেকে জামান আহমেদের উঁচু গলার স্বর পাওয়া গেল! নূরের ঠিক পেছনটায় দাঁড়িয়ে তিনি সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,,

“এই তুমি নূর না? এখানে কী করছ হ্যাঁ?”
থতমত খেয়ে গেল নূর! কপাল চাপড়ে নিজেই নিজেকে বকতে আরম্ভ করল। এখন তার শ্রদ্ধেয় শ্বশুড় আব্বাকে কীভাবে ফেস করবে সেই চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কী দুঃসহ এক পরিস্থিতি। কাউকেই যেন এড়িয়ে চলা যাচ্ছেনা। বুকে প্রবল সাহস সঞ্চার করে নূর সামনে ঘুরে দাঁড়ালো।

মাথা চুলকে আড়ষ্ট দৃষ্টি ফেলল জামান আহমেদের দিকে। বিপরীতে জামান আহমেদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। নূরের উদ্দেশ্য যেন তিনি খুব চতুরতার সাথেই আন্দাজ করতে পারছেন! তবে মুখ ফুটে প্রকাশ করতে চাইছেন না। অপেক্ষায় আছেন নূর কী বলে! গলায় শব্দরা আসছেনা তবুও নূর জোর গলায় বলল,,

“একচুয়েলি আংকেল। আমি একটু আপনাদের এরেঞ্জমেন্টটা দেখতে এসেছিলাম! দেখতে ভালোই লাগছে। খুব সুন্দর হয়েছে এরেঞ্জমেন্টটা।”
“কিন্তু বাবা। আমরা তো মেয়েদের রুমের সামনে কোনো ডেকোরেশন বা এরেঞ্জমেন্ট করিনি। তো তুমি এখানে কী দেখতে এসেছ হ্যাঁ?”
“আংকেল আমি একটু পানি খেয়ে আসি? গলাটা কেমন শুকিয়ে গেছে!”

জান নিয়ে নূর জায়গা থেকে একছুটে পালালো! ভেতরটা যেন শুকিয়ে কাঠে রূপান্তরিত হলো তার। দৌঁড়ে হলেও জানে বাঁচা চাই। গভীর মনোযোগের সহিত নূরের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলেন জামান আহমেদ। কিয়ৎক্ষণ পর হঠাৎ ফিক করে হেসে দিলেন তিনি! রসিক গলায় বললেন,,

“নূর হয়েছে একদম আমার মতন। আমার মেয়েকে ছাড়া কিছুই বুঝে-না। আমিও তো এখনো সাবরিনাকে ছাড়া কিছু বুঝিনা! ভালোই হলো শ্বশুড়-জামাইয়ে এক হলাম।”

গাঁ ঢাকা দিয়ে মেয়ে পক্ষের সীমানা থেকে দৌঁড়ে পালালো নূর। হাঁপাতে হাঁপাতে মাহিন, সাদমান এবং আয়মনের রুমে এসে ঢুকল। বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলতে লাগল। বুকে হাত রেখে নিজেকে স্থির করার চেষ্টা করল। সঙ্গে সঙ্গেই মাহিন, আয়মন এবং সাদমান তিনজনই উৎসুক হয়ে নূরকে ঘিরে বসল চারিপাশ থেকে। মাহিন বেশ কৌতূহলী হয়ে নূরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই কী রে? ব্যবস্থা করে এলি?”
চোখ বুজে নূর হেস্তনেস্ত গলায় বলল,,
“কোনো চান্স নাই রে ভাই। শ্বশুড় আব্বার দৌড়ানি খেয়ে আসছি!”
আয়মন বিরক্তি প্রকাশ করল। তিক্ত গলায় বলল,,
“শিট। এখন কী হবে?”

নূর ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। ব্যর্থ স্বরে বলল,,
“কী আর হবে? মেহেন্দি আর্টিস্টরাই মেয়েদের মেহেন্দি পড়াবে। প্ল্যান ক্যান্সেল আমাদের।”
সাদমান রাগে জায়গা থেকে ওঠে-ই পড়ল! সবুজ পাঞ্জাবির কলার টেনে ধরে দাঁতে দাঁত চাপল। রুম জুড়ে পায়চারি করে রুষ্ট গলায় বলল,,

“তো এখন জায়মাকে সারপ্রাইজটা দিব কীভাবে হ্যাঁ? যা ও এতদিন পরে একটু মন ফিরল তাও আবার বাঁধা পড়ল! এত কষ্ট করে যে আমরা মেহেন্দি পড়ানো শিখলাম তার কী হবে এখন? গোটা পাঁচদিন সময় দিয়েছি এই ভাজুংভুজুং প্র্যাক্টিস করতে করতে!”

কিছু একটা ভেবে মাহিন হঠাৎ দাঁত কেলিয়ে হাসল। দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় এটে দ্রুত গলায় বলল,,
“চল এক কাজ করি আমরা। মেহেন্দি আর্টিস্টদের আসাটা আটকে দিই!”
ধড়ফড়িয়ে নূর শোয়া থেকে ওঠে বসল। মাহিনের দিকে তুষ্টির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ব্যগ্র হেসে মাহিনের কাঁধে হাত রাখল। সম্মতি জানিয়ে বলল,,

“মন্দ বলিসনি। চল এপ্লাই করি!”
চার প্রেমিক পুরুষ তাদের এই দুষ্টু বুদ্ধিতে একত্রিত হলো। ডর ভয় দেখিয়ে মেহেন্দি আর্টিস্টদের আসা আজকের জন্য পুরো দমে ভেস্তে দিলো! সুবিধা বুঝে সোহানীকে রাজি করালো ছেলেরা আজ মেয়েদের মেহেন্দি পড়িয়ে দিবে! একদম মেহেন্দি আর্টিস্টদের মত। যা ইতিহাসে বিরল! তারাই আজ নতুন ইতিহাস গড়বে। ভিন্ন কিছু মেয়েদের উপহার দিবে।

অন্যদিকে মেয়েরা সব রুমে বসে হাসিতে লুটোপুটি খাচ্ছে! ছেলেদের এই অদ্ভুত পদক্ষেপে তারা যেন হাসি থামাতেই পারছেনা! পেটে জাস্ট খিল ধরে যাচ্ছে। চাঁদ তো এদিকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েই আছে ছেলেদের মেহেন্দি পড়ানোর মুহূর্তটা ভিডিও করার।

ছেলেদের ভাইরাল করার মতলব তার মাথায় ঘুরছে! আবার এদিকে বেশ ভয়েও আছে মেহেন্দি পড়ানো যদি নিঁখুত না হয়? তবে তো মেহেন্দি পড়ার আনন্দটাই নষ্ট হয়ে যাবে। চার/পাঁচদিনের প্র্যাক্টিসে কোন ছেলেরা পারে মেয়েদের মত ভালো মেহেন্দি পড়াতে? এছাড়া এসব তো মেয়েদের কাজ। ছেলেরা পারবে কীভাবে? অষ্টম আশ্চর্য তো!

রাত আটটা বাজতেই মেহেন্দির অনুষ্ঠান শুরু হলো। মেহেন্দি পড়ানোটাই যেন একটা অনুষ্ঠান। স্টেজে না বসে রুমের ভেতরে বসে-ই মেহেন্দি পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। গেস্টদের সামনে ছেলেরা অস্বস্তি বোধ করবে তাই। যদিও ছেলেরা শুধু অস্বস্তির জন্যই রুমে যেতে চাইছেনা বরং মেয়েদের সাথে একান্তে সময় কাটানোর জন্যও রুমে যেতে চাইছে!

তাদের পাহারা দেওয়ার জন্য নাদিয়া, সাদিয়া, রুহি এবং সোহানীকে রাখা হয়েছে! সোহানীর কোলে নিদও রয়েছে। দুষ্টুমি করে সোহানীকে খুব জ্বালাচ্ছে। একজায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দিচ্ছেনা তাকে। নীড়ের কোলেও যেতে চাইছেনা। কেবল সোহানীর কোলে থেকেই দুষ্টুমি করতে চাইছে।

মেহেন্দি হাতে নিয়ে নূর, মাহিন, সাদমান এবং আয়মন মেয়েদের রুমে ঢুকল। নাদিয়া, সাদিয়া, রুহি এবং সোহানীকে দেখামাত্রই তাদের মেজাজটা বিগড়ে গেল! চুল টেনে ধরে তারা বিরক্তি প্রকাশ করল। তাদের ধরাশয়ী অবস্থা দেখে চাঁদ, তিথী, তাশফিয়া এবং জায়মা মিটিমিটি হাসতে লাগল। তাদের হাসি দেখে ছেলেদের আরও জ্বলন হতে লাগল। তাদের দিকে তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগল। নূর তো সোহানীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে খরখরে গলায় বলেই ফেলল,,

“ভাবি তুমি এখানে কী করছ বলো তো? নিদ এখানে থাকতে চাইছেনা বুঝতে পারছনা? তাছাড়া নীড় ভাইয়াও তোমাকে খুঁজছে। কুইকলি যেতে বলেছে। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তোমার কোনো কাজ নেই। যাও তো তুমি।”
নূরের কান টেনে দিলো সোহানী। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“বুঝিনা ভাবছ হ্যাঁ? কিছু বুঝিনা আমি? বিয়ের আগে এসব ফস্টিনস্টি একদম চলবেনা ওকে? আরও দুটো দিন অপেক্ষা করো। চুপচাপ বসে মেহেন্দি পড়াও। আমি এবং আমরা এখানেই থাকব।”
মাহিন অবুঝের মত সোহানীর পাশে এসে দাঁড়ালো। রাগ ভুলে সোহানীকে মানানোর চেষ্টা করল। স্বাভাবিক স্বরে বলল,,
“আরে ভাবি বুঝতেছ না কেন? আমরা লজ্জা পাই তো!”

“এ্যাঁ! আইছে লজ্জা নিয়া। লজ্জা পেলে তো মেয়েদের মেহেন্দি পড়ানোর বিষয়টা তোমাদের মাথাতেই আসত না!”
আয়মন চটে গেল! সোজাসুজি সোহানীকে হুমকি ধামকি দিয়ে বলল,,
“এই আপু তুমি যাবা কিনা বলো? হ্যাঁ বা না।”
“যাব! তবে একটা শর্তে!”

নূর, মাহিন, আয়মন এবং সাদমান যেন না চাইতেও আশার আলো খুঁজে পেল! চারজনই বেশ উত্তেজিত হয়ে সোহানীকে ঘিরে দাঁড়ালো। আমোদিত হয়ে সমস্বরে শুধালো,,
“কী শর্ত?”
সোহানী বেশ ভাব নিয়ে বলল,,

“আমাকে একটা স্বর্ণের লকেট কিনে দিবা৷ তোমরা চারজনে মিলে!”
“আরেহ্ হয়ে যাবে। এ আবার কঠিন কী জিনিস?”

বলেই চারজন মিলে সোহানীকে আস্তে ধীরে রুম থেকে বের করে দিলো। আর বাকি রইল নাদিয়া, সাদিয়া এবং রুহি। তারা তিনজনই চিপকু হয়ে চাঁদ, তিথী, তাশফিয়া এবং জায়মার সাথে আটার মত লেগে বসে আছে। জায়গা থেকে নড়বেনা সেই সিদ্ধান্তেই অটল তারা। তাদের এই উচ্চ মন-মানসিকতা দেখে নূর বেশ ভাব নিয়ে পাঞ্জাবির কলারটা দাঁড় করালো। নাদিয়া, সাদিয়া এবং রুহিকে শুনিয়ে শুনিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল,,

“শুনেছি গার্ডেনে নাকি একটা টিকটক করার স্পট আছে! বড়ো বড়ো সেলিব্রেটিরা নাকি এখানে এসে টিকটক করে৷ আই হোপ সো আমাদেরও একটা টিকটক করা উচিৎ!”
আর এক মুহূর্তও জায়গায় বসলনা নাদিয়া, সাদিয়া এবং রুহি! তিনজনই বেশ আগ্রহী হয়ে জায়গা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ফিসফিসিয়ে একজন অন্যজনকে বলল,,

“আরে চল চল আমরা কয়েকটা টিকটক করে আসি। ভিউজ বাড়বে আমাদের। রাতারাতি সেলিব্রেটি হয়ে যাব।”
শলা পরামর্শ করে তিনজন-ই রুম থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো! মিচকে হেসে তিনজন-ই উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“আচ্ছা আমরা একটু বাইরে থেকে আসছি হ্যাঁ? তোমরা মেহেন্দি পড়তে পড়তেই আমরা ব্যাক করব।”
নূরের দুষ্টু বুদ্ধি উপস্থিত সবাই বুঝতে পারল৷ ছেলেরা সব বাঁকা চাহনিতে নূরের দিকে তাকালো। মেয়েরা সব তাজ্জব দৃষ্টিতে ছেলেদের কাণ্ড কীর্তি দেখতে লাগল। একান্তে একটু সময় কাটানোর জন্য কত কী না করছে তারা! এদের পাগলামির মাত্রা যেন বেগতিক বাড়ছে। বিয়ের দিন যত ঘনিয়ে আসছে তাদের অবাধ্য পাগলামি যেন ততই বাড়ছে। ঝেড়ে কাশলো মাহিন। নাদিয়া, সাদিয়া এবং রুহিকে লক্ষ্য করে ব্যস্ত স্বরে বলল,,

“হ্যাঁ হ্যাঁ যাও যাও। রাত বেড়ে যাচ্ছে। কখন কী করবা? সবকিছুর একটা সময় থাকেনা?”
তিনজনই তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বের হয়ে গেল। ছেলেরা যেন দেহে প্রাণ খুঁজে পেল! স্বস্তির শ্বাস ফেলে ভেতর থেকে রুমের দরজাটা তারা লক করে দিলো। মেয়েরা সব কেঁপে উঠল।

মাথা নুইয়ে চারজন নখ কামড়াতে লাগল! সাদমানের বিষয়টা খুব-ই অপ্রত্যাশিত জায়মার কাছে। সে যেন বিশ্বাস-ই করতে পারছেনা সাদমান তার হাতে মেহেন্দি পড়িয়ে দিবে! তাকে কাছে পাওয়ার জন্য সবার সাথে মিলে এতকিছু করবে! সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে তার। সবার আগে নূ্র ছুটে এসে চাঁদের পাশে বসল! মেহেন্দি হাতে নিয়ে হাঁসফাঁস করে বলল,,

“এই? তুমি শাড়ি নিয়ে দৌঁড়াতে পারবা না?”
চাঁদ মাথা উঁচিয়ে নূরের দিকে তাজ্জব দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। নাক-মুখ কুঁচকে সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“মানে?”

“মানে আবার কী? এই এক রুমে চারজোড়া কপোত-কপোতি বসব কীভাবে? হিজিটিশানের ব্যাপার আছেনা?”
“তার মানে আমরা এখন এই রুম থেকে দৌঁড়ে পালাব?”
“হ্যাঁ। চারজন চার রুমে যাব! হাতে একদম সময় নেই চলো।”

প্রতিউত্তর করার সময়টা অবধি দেওয়া হলোনা চাঁদকে! হাত ধরে জিদ্দি চাঁদকে জায়গা থেকে উঠিয়ে নূর পাশের রুমে চলে গেল। তেমনিভাবে মাহিন এবং আয়মনও গাঁ বাঁচিয়ে যে যার ফিক্সড করা রুমে পালাক্রমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজার খিল আটকে দিলো! শুধু জায়মা এবং সাদমান-ই আগের রুমে রয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে সাদমান ও তার রুমের দরজাটা আটকে দিলো। পিছু ঘুরে মাথা নুইয়ে বসে থাকা জায়মার দিকে সূক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।

বুকটা কেমন যেন দুড়ুদুড়ু করে কাঁপছিল জায়মার! দমবন্ধকর পরিস্থিতির শিকার হয়ে উঠল। মাথা উঁচিয়ে এদিক-ওদিক তাকানোর সাহসটা অবধি পেলনা। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই মাথাটা কেমন ঘুরে ঘুরে আসছিল তার। এই প্রথম সাদমানের সাথে এক ঘরে বন্দি সে। স্বাভাবিক ভাবেই হাঁসফাঁস করার কথা।

জায়মার বেগতিক অসহনীয় অবস্থা দেখে সাদমান গলা ঝাঁকালো। জায়মাকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করল। খুবই নরমভাবে জায়মাকে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করল। ধীর পা ফেলে সাদমান জায়মার পাশে এসে বসল। অমনি জায়মা তড়তড়িয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো! অস্থিরতায় বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলতে লাগল। একছুটে জায়গা থেকে পালাতে নিলেই সাদমান পেছন থেকে জায়মার বাঁ হাতটি আঁকড়ে ধরল। অসহিষ্ণু গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই ভালোবাসো আমাকে হ্যাঁ? আমার থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানোর নাম-ই কি তবে ভালোবাসা?”
বুকে হাত রেখে জায়মা তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। অতিশয় বিপাকে পড়ে হঠাৎ পিছু ঘুরে সাদমানের বুকে লুটিয়ে পড়ল! সাদমানের বলিষ্ঠ বুকে মুখ লুকিয়ে শুকনো গলায় বলল,,
“আমার মাথাটা কেমন যেন ঘুরাচ্ছে সাদমান ভাইয়া! প্লিজ আমাকে ছাড়বেন না।”

ঘটনার আকস্মিকতায় সাদমান হতভম্ব হয়ে গেল! এই প্রথম কোনো মেয়েকে তার বুকে আবিষ্কার করল! তাও আবার এতটা কাছ থেকে, এতটা নিঁখুতভাবে ভালোবেসে তাকে জাপটে ধরল৷ সুখকর এক অনুভূতি হতে লাগল তার দেহ এবং মনজুড়ে। না চাইতেও সে জায়মাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। হঠাৎ পাওয়া সুখকে হাত ছাড়া হতে দিলোনা। হৃদয় মাঝে তাকে আঁকড়ে ধরল। শিথিল শ্বাস ফেলল জায়মার কর্ণতলে। গভীর প্রেমে সিক্ত হয়ে মিষ্টি মধুর গুঞ্জন তুলে বলল,,

“উঁহু। ছাড়ার কোনো চান্স-ই নেই। তুমি আমার। শুধু-ই আমার!”
সুখের নেশায় অকাতরে চোখের জল ছেড়ে দিলো জায়মা! সাদমানকে আরও শক্ত বাঁধনে আঁকড়ে ধরল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,,
“আমাকে খুব বেশি ভালোবাসতে হবেনা সাদমান ভাইয়া। শুধু স্ত্রী হিসেবে যতটুকু ভালোবাসার প্রয়োজন, ততটুকু ভালোবাসলেই হবে।”

“কিন্তু আমি যে তোমাকে আমার সবটা দিয়ে ভালোবাসাতে চাই জায়মা! আমার আকাশ সমান ভালোবাসায় তোমাকে রাঙিয়ে দিতে চাই। যে যার প্রাপ্য, তার প্রাপ্যটা তাকে মন থেকে বুঝিয়ে দিতে চাই।”
ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো জায়মা! প্রশান্তিতে মরণ দেখছিল দু’চোখে। নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল তার। আদোতে কী তার ভাগ্যে এতটা সুখ সইবে? লিখা ছিল এত সুখ তার ভাগ্যে? সাদমান কি শুধুই তাকে শান্তনা দিতে এসেছে নাকি সত্যি সত্যিই তাকে ভালোবেসে মন থেকে মেনে নিতে এসেছে?

নূরের হাত থরথর করে কাঁপছে! প্রথমদিকে ছোট্ট দেখতে একটি গোলাপ ফুল হাতের মাঝখানে আর্ট করলেও শেষের দিকে এসে নূর পুরো দমে থেমে গেল! হাত যেন আর চলছে-ই না। একে তো হাতে ব্যথা করছে দ্বিতীয়ত, ডিজাইন সব ভুলে গেছে! কীভাবে পারে মেয়েরা এত ধৈর্য্য নিয়ে এত সময় ব্যয় করে হাতে মেহেন্দি পড়াতে?

এত সহ্য ধৈর্য্য পায় কোথা থেকে এরা? ডিজাইন করতে করতে ভুলে টুলে যায়না নাকি কিছু ডিজাইন? পরে মনে করে কীভাবে? এসব ভাবতে ভাবতেই নূর আধো আঁকা ফুলটিকে আরও বিচ্ছিরি করে তুলল! ভেতর থেকে চাঁদের রাগমিশ্রিত ফোঁস ফোঁস শব্দ নূরের কান এড়াচ্ছিলনা! ভয়ে তার যা আচ্ছে তা অবস্থা! অন্তর্আত্তার ভয়ঙ্কর এক অবস্থা।

চাঁদকে এখন কীভাবে সামলাবে সে? চাঁদ যে এখনি তার ঘাড় গর্দান কেটে সব একাকার করে দিবে! পারলে বিয়েটাই ভেস্তে দিবে। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে নূর যেইনা চাঁদের দিকে একবার চোখ তুলে তাকালো অমনি চাঁদ অন্য হাত দ্বারা নূরের টুটি চেপে ধরল! চন্দ্রমুখীর মত ভূতুড়ে রূপ ধারণ করে দাঁতে দাঁত চাপল। নূরকে বেশ শাসিয়ে বলল,,
“এই কী করলি এটা তুই হ্যাঁ? আমার পুরো হাতটা নষ্ট করে দিলি? যে কাজ পারিস না সে কাজ করতে যাস কেন? কে বলছিল তোকে এত পা’ক’নামি করতে?”

ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানেনা নূর ঠিক এমন ভাব নিলো! ঠোঁট উল্টিয়ে পরিপূর্ণ অবুঝ ভান ধরল। চাঁদের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। পূঙ্খানুপুঙ্খভাবে মুখমণ্ডলে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলল। চাঁদের সহানুভূতি পাওয়ার জন্য শতভাগ চেষ্টা করল। ভোলাভালা গলায় বলল,,

“তোমাদের মেহেন্দির প্রোগ্রামটা একটু স্পেশাল করতে চেয়েছিলাম! তাইতো এতকিছু করা। ঘরে বসে মেহেন্দি দেওয়া প্র্যাক্টিস করা।”
“এই তোর স্পেশালের নমুনা হ্যাঁ? এই নমুনা? মেহেন্দিটাই খারাপ করে দিলি আমার। এখন কী করব আমি হ্যাঁ? এই বিচ্ছিরি হাত নিয়ে হলুদে, বিয়েতে, রিসিপশানে হাতের ছবি তুলব কীভাবে?”

“আরে তুমি এত হাইপার হচ্ছ কেন হ্যাঁ? আমি আছিনা? ইউটিউব দেখে দেখে হলেও সারারাত বসে বসে তোমার হাতে মেহেন্দি পড়িয়ে দিব। হলুদ বিয়ে, রিসিপশান কিছুই স্পয়েল হবেনা তোমার।”
নূরের টুটি ছেড়ে চাঁদ শান্ত হয়ে বসল। সীমাহীন জেদকে প্রশ্রয় দিয়ে নূরের দিকে হাত দুটো বাড়িয়ে দিলো। ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,,

“নে এবার পড়িয়ে দে। সারারাত বসে বসে আমার হাতে মেহেন্দি পড়িয়ে দিবি। যতক্ষণ অবধি না দু’হাতের দু’পিঠে পরিপূর্ণভাবে মেহেন্দি পড়িয়ে দিতে পারবি ততক্ষণ অবধি তোর কোনো ছাড় নেই!”
ডানপিটে হাসল নূর। চাঁদের দিকে বেখেয়ালী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আকাঙ্ক্ষিত হয়ে দুষ্টু স্বরে বলল,,
“আমার তো এটাই চাওয়া জানেমান! সারারাত নিরিবিলি বসে তোমাকে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা! তোমার মায়াবী চোখের প্রতিটি পলকে পলকে হারিয়ে যাওয়া।”

“আরে আরে, আমাকে দেখার জন্য তো সারারাত বসে থাকতে বলিনি তোকে! হাতে মেহেন্দি পড়ানোর জন্য সারারাত বসে থাকতে বলেছি। যদি আমার কথার অন্যথায় হয়না? তো আমিও বিয়েটা ভেঙে দিব এই বলে দিলাম।”
“হুশ। এসব কী বলো হুম? মেহেন্দি আমি তোমাকে নিঁখুতভাবে-ই পড়িয়ে দিব। তবে এই মুহূর্তে একটু এনার্জির প্রয়োজন আমার! সহ্য হচ্ছেনা আর! উফফ তুমি আমি এক ঘরে বন্দি! ভাবতেই কেমন ফিলিংস হচ্ছে!”

চাঁদকে প্রতিউত্তর করার কোনো সুযোগ দিলোনা নূর। ঝাপিয়ে পড়ল চাঁদের রসালো ওষ্ঠদ্বয়ে! ক্ষণিকের মধ্যেই আদরে ভালোবাসায় সিক্ত করে তুলল চাঁদের নরম এবং মোলায়েম ওষ্ঠদ্বয়কে। চাঁদকে বাঁধা দেওয়ার সুযোগও দিলোনা। পুরুষালি সুঠাম দেহে সাথে বলে মহিলাদের পারারও কথা না।

অনুরূপভাবে আয়মনও তাশফিয়ার হাতে হাবিজাবি এঁকে দিচ্ছিল! তাশফিয়া অত্যধিক রাগে জর্জরিত হয়ে আয়মনকে ঝাড়ছিল। ভয়ে আয়মন কোণঠাসা হয়ে রইল। তাশফিয়াকে কীভাবে মানাবে তাই ভাবতে লাগল। নূরের মত আয়মনও তাশফিয়াকে গুজা মিল দিলো! ইউটিউব দেখে দেখে মেহেন্দি পড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলো। তাশফিয়া যদিও বুঝতে পারল আয়মন তাকে ভুজুংভাজুং বুঝাচ্ছে তবুও কেমন চুপ করে রইল! আয়মনকে বাহানাকে আশকারা দিতে লাগল।

এতেই যেন অদ্ভুত রকম ভালো লাগছে তার! আয়মন সুযোগ পেলেই তাশফিয়ার হুটহাট আদর করে দিচ্ছে! রেগে হলেও তাশফিয়া বিষয়টাকে খুব উপভোগ করছে। চাঁদের মত লুকিয়ে লুকিয়ে মেহেন্দি পড়ানোর ভিডিও করছে।
সবার তুলনায় মাহিন খুব পটু ভাবেই তিথীর হাতে মেহেন্দি পড়িয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন এই বিষয়ে বহু পারদর্শী সে! তিথী অবাক দৃষ্টিতে মাহিনকে দেখছে। কীভাবে পারছে মাহিন এতটা নিঁখুতভাবে মেহেন্দি পড়িয়ে দিতে? নীরবতা ভেঙে গলা ঝাড়লো তিথী। একদৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকিয়ে থেকে শূণ্য গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আচ্ছা? আপনি কি আগে থেকেই পারতেন মেহেন্দি পড়াতে?”
“উঁহু! এই প্রথম কাউকে মেহেন্দি পড়াচ্ছি। তাও আবার আমার ভালোবাসাকে, আমার প্রিয়তমাকে, আমার বউকে!”
“বাহ্। তাহলে আমি তো খুব ভাগ্যবতী। আমার জামাই এত সুন্দর মেহেন্দি পড়াতে পারে!”
“ইয়াহ্ অফকোর্স!”

মাহিনের ঠোঁটের কোণে কুসুম কোমল হাসি ফুটে উঠল। সেই হাসি তিথী নিষ্পলক চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে অজানা ঘোরে তলিয়ে গেল। হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে টাইট করে মাহিনের বাঁ গালে দীর্ঘ এক চুমু এঁকে দিলো! ঘটনার আকস্মিকতায় মাহিন তাজ্জব দৃষ্টি ফেলল তিথীর দিকে।

লজ্জায় রাঙা হয়ে তিথী অবিলম্বেই মাথা নুইয়ে নিলো। হেঁতো হাসল মাহিন! আশকারা পেয়ে এগিয়ে গেল তিথীর আরও কাছে। বেখবর হয়ে তিথীর ঠোঁটের কোণে চুমু এঁকে দিলো। অতি মাত্রায় লজ্জা চেপে বসল তিথীর। উত্তেজনায় চোখজোড়া বুজে নিতেই মাহিন ছোটো ছোটো চুমুতে তিথীর ঠোঁটের আশপাশটা ভরিয়ে দিলো। তিথীও মৌন হেসে মাহিনকে প্রশ্রয় দিতে লাগল।

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৮

মেহেন্দির অনুষ্ঠান সাদামাটাভাবে সম্পন্ন হলেও হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলো বেশ জমজমাটভাবে! হলুদের এলাহি অনুষ্ঠানে কোনোকিছুর খামতি রাখেনি মেয়েপক্ষ এবং ছেলেপক্ষ। সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব সবাই ততটুকু দিয়েই সম্পন্ন করেছে হলুদের অনুষ্ঠান। হলুদের দিন সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও চার বধূর হাতের মেহেন্দি সব ঘটে ‘ঘ’ হয়েছিল! যদিও তিথীর হাতের মেহেন্দি সবার দৃষ্টি কেড়েছিল। তবে এর বিপরীতে নূর, আয়মন এবং সাদমানের অনেক লানত সহ্য করতে হয়েছিল!

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৭০