প্রেমসাগরের উত্তাল ঢেউ পর্ব ৯ || লেখিকা-লাবিবা নুসরত

প্রেমসাগরের উত্তাল ঢেউ পর্ব ৯
লেখিকা-লাবিবা নুসরত

বাইরে ঝুম ঝুম বৃষ্টি পরছে। সেই দুপুর থেকেই বৃষ্টি। থামার কোনো নাম নেই।
নিজের ঘরে বসে আছে প্রাচী। রাতের আকাশ খুব ভালো ভাবেই দেখা যাচ্ছে জানালা দিয়ে। আজ কেন যেন একটুও মন খারাপ লাগছে না। সবকিছুতেই খুশির ছোয়া পাচ্ছে প্রাচী৷ জাহিনের কথা ভাবছে। আজ একদম নতুন রূপ দেখেছে সে। জাহিন একদম কথা কম বলে। আর আজ কতোকিছুই না বলল! আর কথা বলার ধরন যেন আরও বেশি অবাক করেছে প্রাচীকে।
প্রাচীর এই বিষয়টা ভালো লেগেছে যে জাহিন অতিত নিয়ে কিছু বলে নি৷ কোনো আলোচনা করে নি৷ এমনকি প্রাচী রাজি কিনা সেটাও জিজ্ঞেস করে নি। ব্যাপারটা অনেক রহস্যজনক লাগছে প্রাচীর কাছে। কিভাবে কি হয়ে গেলো তা সে বুঝতে পারছে না। তবে কি করা উচিৎ তার? বিয়েতে কি রাজি হবে? নাকি আরেকটু সময় নেয়া উচিৎ? এসব নিয়ে ভাবতে গেলেই আগের কথা মনে পরে। প্রাচী জানে যে সব ছেলেরা এক না। তাও মন সায় দেয় না।

আয়ুস ঘরে বসে আছে। ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সামনে সপ্তাহের ছুটি নিয়েছে সে। আরোহিকে নিয়ে ঘুরতে যাবে।
হঠাৎ আরোহির ফোন বেজে ওঠে। আরোহি ঘরে ছিল না। আয়ুস ফোন হাতে নিয়ে দেখে আননোন নাম্বার। সে কল রিসিভ করে।
“হ্যালো কে বলছেন?”
অপরপাশ থেকে কেউ বলে ওঠে,
“এটা কি নিয়াজের নাম্বার?”
আয়ুস~”জ্বি না। এখানে এই নামের কেউ নেই।”
অপরপাশ থেকে উত্তর আসে,
“ওহ! তাহলে রং নাম্বারে চলে গিয়েছে। আচ্ছা রাখি। মাফ করবেন।”
আয়ুসকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে যায়। তখনই আরোহি আসে৷ আয়ুসকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,
“কি ব্যাপার? এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আয়ুস~”তোমার নাম্বারে একটা কল এসেছিল। আমি রিসিভ করতেই বলে নিয়াজ নামে কেউ আছে কিনা। আমি বলেছি নেই৷ এরপর কল কেটে দিল রং নাম্বার বলে। ব্যাপারটা কেমন যেন লাগলো।”
আরোহি আয়ুসের হাত থেকে ফোন নিয়ে নাম্বারটা একবার দেখলো। দেখার পরে কিছুটা অস্বাভাবিক ভাবেই বলল,
“আআরে রং নাম্বার বোধ হয়। বাদ দাও। আসো তো ঘুমাতে।”
আরোহি আয়ুসকে বিছানায় নিয়ে আসে। আয়ুসকে বসিয়ে নিজে ওর পাশে বসে বলে,
“আগামী পরশু আমরা শপিংয়ে যাবো ওকে? কারন ঘুরতে যাওয়ার একটা প্রস্তুতি লাগে তো তাই না?”
আয়ুস~”হুম। ওহ একটা কথা তো বলতে ভুলেই গিয়েছি। আগামী সপ্তাহের ছুটি পেয়েছি। বুঝেছো?”
আরোহি~”হুম বুঝেছি।”

আয়ুস~”আচ্ছা। কাল অফিসে যেতে হবে। আমি ঘুমালাম।”
আয়ুসের রুমের দরজায় কেউ কড়া নারে। আরোহি গিয়ে দেখে আলতাফ হোসেন এসেছেন। আরোহি ওনাকে খুব একটা পছন্দ করে না। কিন্তু আয়ুসের জন্য কিছু বলতে পারে না। তিনি ভিতরে আসেন। আয়ুসের কাছে গিয়ে বসেন।
আয়ুস~”কি ব্যাপার আব্বু? তুমি এতো রাতে?”
আলতাফ~”হুম আসতে হলো বাবা। শোন আমার তো সামনে মাসে রিটায়ার্ড হওয়ার ডেট। সরকারি চাকরি এমনই। তা পেনশনের টাকা দিয়ে এই সংসারে জায়গা হবে তো?”
আয়ুস~”এটা কি ধরনের কথা বলছো বাবা? আমি আল্লাহর রহমতে কম ইনকাম করি? অন্তত যা কামাই এটা দিয়ে তোমার পেনশনের টাকা লাগবে না। সংসার চলে যাবে।”
আলতাফ~”আচ্ছা বাবা! তাহলে আমি যাই? নাকি! ঘুমাও।”
আলতাফ চলে যেতেই আয়ুস আরোহিকে বলে,
“তুমি আব্বুকে কিছু বলেছো?”

আরোহি আয়ুসের কথায় ক্ষেপে যায়।
“তোমার কি মনে হয়? আমি কিছু বলেছি বলে উনি এসব বলছেন? লাইক সিরিয়াসলি আয়ুস? এখন তুমি আমাকে দোষারোপ করছো?”
আয়ুস~”আরে না না! আমি কিন্তু তা বলি নি একদম। জিজ্ঞেস করলাম।”
আরোহি~”তুমি যেভাবে বললে যেন তোমার বাবাকে আমি বাসা থেকেই বের করে দেব।”
আয়ুস~”দেখো বেশি বুঝবে না। আমি সেটা বলি নি। মা মারা যাওয়ার পর থেকেই আব্বু আমাকে মানুষ করেছে একা। সব কিছু সামলেছে নিজেই। তাই ওনাকে অসম্মান করবে না একদম।”
আরোহি~”শুধু তো আমার সাথেই পারো।”
লাইট অফ করে এক পাশে শুয়ে পরলো আরোহি। আয়ুসও অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পরে। এতে আরোহি আরও রেগে যায়। সে ভেবেছিল যে আয়ুস হয়তো তার রাগ ভাঙাবে।
এখন সবথেকে বেশি রাগ হচ্ছে আলতাফ হোসেনের উপর। আরোহি বেশ কয়েকবার বিভিন্ন কথার মাধ্যমে তাকে হেনস্তা করেছে। যদিও সরাসরি কিছু বলে নি৷ কিন্তু উনি যে ছেলের কাছে এসে এমন করবেন তার কে জানতো!

সকালে,,,,,,,,,
প্রাচী ঘুম থেকে ওঠে। ফ্রেশ হয়ে নিচে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে অবাক হয়৷ কারন আইরিন ছিলেন। সে প্রাচীর বড় ফুপি। আনোয়ার আর ইজাজ দুজনের সাথেই খুব বেশি ভালো সম্পর্ক না। এর একমাত্র কারন হলো তার খিটখিটে মেজাজ। আর ব্যবহারে রুক্ষতা। কারো সাথে একটু হেসে কথা বলেন না। যখন যা মুখে আসে সেটাই বলে দেন। এই কারনে প্রাচী তাকে পছন্দ করে না। অনেকদিন পরে সে এই বাড়ি এসেছে৷ প্রাচীকে দেখেই বললেন,
“এই যে আইছে বাপের রাজকন্যা। তা এতো বেলা করে ওঠোস কেন ঘুম থেকে? নবাবি শিখে গেছে সবাই! যত্তসব! আমাদের সময় মেয়েরা সকালে ওঠে ঘরের কাজ করতো। আর এখন তো সেইসব আদি কালের কথা হয়ে গেছে।”
প্রাচী কি বলবে বুঝতে পারলো না। ইনি সবসময় এমনই করেন। সেটা প্রাচীর অভিজ্ঞতার মধ্যে আছে।
মিসেস লারা~”এভাবে কেন বলছেন আপা? আমি তো শুনেছি আপনার মেয়েও অনেক দেরি করে ওঠে। সেই যে আপনার বাসায় বেরাতে গেলাম? বছর দুয়েক আগে? মনে আছে তো।”

লারার কথা আইরিনের টনক নরে। কথা ঘুরাতে বলে,
“হইছে হইছে৷ এখন জলদি আমারে নাস্তা দাও তো মনি।”
লারা মুচকি হেসে একজন সার্ভেন্ট কে বলে,
“আপার জন্য নাস্তা আনো।”
আইরিন ক্ষেপে যায়। লারাকে বলে,
“হায়রে এখন তো দেখি কাজের লোকের হাতে খাবার খাওয়া লাগবে।”
মিসেস লারা~”কেন আপা? কি হয়েছে?”
আইরিন~”শোন বাপু, তোমরা হইলা গিয়া বিশাল বড়লোক মানুষ। নিজেরা কোনো কাজ করো না। আমরা ওমন না। এখন নিজে গিয়া আমার জন্য খাবার আনো।”
লারা~”সমস্যা নেই আপা। আমিও মাঝে মাঝে রান্না করি। কাজও টুকটাক করি৷ আমি খাবার আনছি আপনার জন্য।”
মিসেস লারা খাবার আনতে যায়৷ প্রাচী চলে যেতে নিলে আইরিন ডাক দেয়।
“এই মেয়ে? কোনো আদব-কায়দা শিখায় নাই কেউ? মুরুব্বি আইছে। কাছে আইসা বসবা। যত্ন-আত্তি করবা। ঘরে দৌড়াও কেন?”

প্রাচীর কাছে কথাটা বেজায় খারাপ লাগলো। কিন্তু এরপরও কিছু না বলে আইরিনের পাশে এসে বসে। ছোট বেলা থেকেই ইনি প্রাচীকে আর প্রহরকে দেখতে পারেন না৷ প্রাচীর মনে আছে একবার সবার সামনে ইনি বলেছিল যে প্রাচী আর প্রহর নাকি মিস্টার ইজাজের সম্মান নষ্ট করবে। মেয়ে না হয়ে ছেলে হলে ভালো হতো। এমন সব কথা উনি সবসময় বলতে থাকেন। এটা তার অভ্যাস।
“এই মেয়ে?”
আইরিনের কর্কষ কণ্ঠে প্রাচী ধ্যান ভাঙে। প্রাচী বলে,
“জ্বি? কিছু বলবেন?”
আইরিন~”তোমার বাপে কই? ইজাজ? বাসায় নাই?”
প্রাচী~”আসলে বাবা বাইরে গিয়েছে৷ অফিসে যেতে হয় তো।”
আইরিন~”ওহ! ভালো ভালো। তা আরোহির বিয়াতে গেছিলা?”
প্রাচী আবারও ওই বিষাক্ত অতিত মনে করে। নিজেকে সামলে বলে,
“জ্বি না।”

আইরিন~”হ হ জানা আছে।….”
আইরিন আর কিছু বলার আগে মিসেস লারা খাবার নিয়ে আসেন।
“আপা? এই নিন৷ এখন কি টেবিলে দিব?”
আইরিন~”না না। এইখানেই খাবো। আর শোন তোমার জামাইরে আজকে জলদি আসতে বইলো।”
লারা~”আচ্ছা।”
আইরিন~”হুম। আমি আবার আনোয়ারের বাড়ি গেছিলাম। সেই বিয়াতে আসতে পারি নাই। তাই দুইদিন ওইখানে ছিলাম। আমার ভাইডা তো খোঁজ নেয় না। বশ করে রাখছো।”
আইরিন খেতে শুরু করে। প্রাচীর রাগ হচ্ছে প্রচুর। এই মহিলা ভাবে কি নিজেকে। প্রাচীকে রাগতে দেখে লারা ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলে।
আইরিন খাওয়া শেষ করে গেস্ট রুমে চলে যায়। প্রাচী লারাকে বলে,
“মা? এসব কি? সে বেশি কথা বলে ফেলছে।”
লারা~”আহা! প্রাচী, তুই তো জানিস উনি এমনই। একদম বেয়াদবি করবি না ওনার সাথে। তোকে আমি সেই শিক্ষা দেই নি।”

প্রেমসাগরের উত্তাল ঢেউ পর্ব ৮

প্রাচী~”ওনার খোঁজ কেউ রাখে না ওনার নিজের বিহেভিয়ারের জন্য। আর সে তোমাকে দোষ দেয় কিভাবে?”
লারা~”আচ্ছা কি হয়েছে বলতো? উনি দোষ দেয় বলে আমার দোষ হয়ে গেলো?”
প্রাচী~”কিন্তু মা?”
লারা প্রাচীকে থামিয়ে বলে,
“উহু বাদ দে। চল ব্রেকফাস্ট করবি৷ দেখেছিস কয়টা বাজে?”
প্রাচী মিসেস লারার সাথে ব্রেকফাস্ট করতে চলে গেলো।
এইদিকে,,,,,,,
জাহিন কেবিনে ছিলো। মাথার হাত দিয়ে কিছু একটা ভেবে চলেছে সে। এরমধ্যেই কালো কোট পরিহিত একজন ব্যক্তি তার কেবিনে ঢুকলো।

জাহিন তাকে খেয়াল করে নি৷ সে জাহিনকে বলল,
“স্যার? আপনি কি চিন্তিত?”
জাহিন উপরে তাকিয়ে লোকটাকে দেখে একটা হাসি দিয়ে বলে,
“হুম কিছুটা। কিন্তু কেমন খবর এনেছো?”
লোকটা সামনের চেয়ারে বসলো।
“স্যার! বড় সাহেব তো একদম ফাটিয়ে দিয়েছে। কি নিখুঁত অভিনয় তার।”
জাহিন খুশি হয়ে বলে,
“হুমম। স্ক্রিপ্ট আমি লিখেছি বুঝেছো। আচ্ছা শোন সব ঠিকঠাক?”
অপরলোকটি~”জ্বি। সব ঠিকঠাক। এখন এভাবেই সব হয়ে গেলে বাঁচি।”
জাহিন~”আচ্ছা তুমি এখন যাও। এখানে কেউ যেন না দেখে তোমায়৷ আমি পেশেন্ট দেখতে যাব।”
লোকটি দ্রুত জাহিনকে সালাম দিয়ে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পরে জাহিনের কাছে খবর আসলো একজন পেশেন্টের অবস্থা ক্রিটিকাল। সে দ্রুত সেখানে গেলো।

প্রেমসাগরের উত্তাল ঢেউ পর্ব ১০