প্রেম পরিণয় পর্ব ১৬

প্রেম পরিণয় পর্ব ১৬
রাজশ্রী মজুমদার রাই

দিয়া ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়লোও উপর থেকে নিজেকে অনেক স্ট্রং রেখেছে, চোখ গরম করে তাঁকায় রনিতের দিকে,
দিয়া- এভাবে পাগলের মতো হাসছেন কেন?
রনিত- তোমার কথা শুনে হাসছি,
দিয়া- আমি কি হাসার মতো কিছু বলেছি, আপনি এক্ষুনি বের হয়ে যান আমার রুম থেকে, আর বাবাইকে বলবেন আপনি আমাকে বিয়ে করবেন না।
রনিত- কেন বলবো,

দিয়া- কেন বলবেন মানে, আমি বিবাহিত, আমার স্বামী আছে। আপনার কি বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা, বিশ্বাস করুন আমি সত্যি বলছি, আমি একজনের স্ত্রী, দুই বছর সংসার করেছি আমরা।
রনিত- দুই বছর সংসার করেছো তো কি হয়েছে, তোমার দুটো বাচ্চা থাকলেও আমি তোমাকে বিয়ে করতাম, সেখানে তো এখন ওই ঝামেলা নেই। আর তুমি আগে যতোটা সুন্দর ছিলে এখন তার চেয়ে ও বেশি সুন্দর হয়ে গেছে, চোখ ধাঁধানো সুন্দরী, আমার তো দেখেই নেশা লেগে যাচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রনিতের এমন কথা শুনে ঘৃনায় দিয়ার গা গুলিয়ে উঠলো, রনিত দিয়ার চারপাশে ঘুরে ঘুরে ওকে দেখতে লাগলো, অস্বস্তিতে দিয়া নিজের গায়ের ওড়না টা খামচে ধরলো,
রনিত- অগ্নি শালা নিয়ে না গেলে আরো আগেই তুমি আমার হতে। যাকগে যা হয়ে গেছে তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। এবার তুমি আমার হবে। বিশ্বাস করো, অগ্নির থেকে বেশি আদর দিবো তোমাকে, একবার আমার হয়ে গেলে আর কখনোই অগ্নির কথা মনে ও পড়বে না তোমার।

দিয়া- আপনি ভাবলেন কি করে, আমি আপনার মতো একটা নোংরা মানসিকতার মানুষকে বিয়ে করবো? আমার স্বামীকে যখন চিনেন তাহলে তো আমার দাদাভাই কে ও চিননে, আমার দাদাভাই জানতে পারলে আপনাকে মেরেই ফেলবে।
রনিত- অভির কথা বলছো, ও আসার আগেই তুমি আমার হয়ে যাবে। তুমি মনে হয় জানো আমাদের বিয়ে কাল, আর তোমার দাদাভাই আসবে পরশু। তোমার দাদাভাই আসার আগেই আমি তোমাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো। অভির যা করার তোমার বাবাকে করবো, সেটা আমার ভাবার বিষয় না

রনিতের কথা শুনে চমকে তাকালো দিয়া,, দিয়াকে চমকাতে দেখা আবারও হাসলো রনিত,
রনিত- আরে এখনি চমকালে হবে, আরো অনেক চমক অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। তুমি ভাবতেই পারবেন না, কতোটা মাথা খাটিয়ে এ পরিকল্পনা করেছি আমি।

আমাকে এতোটা কষ্ট করতেই হতো না যদি অভি আগেই তোমার সাথে আমার রিলেশন করিয়ে দিতো, তা না করে আমাকে উরাধুরা মেরেছে, সেই থেকেই আমার জিদ চেপে যায়, তোমাকে আমার লাগবেই, যখন তোমার বিয়ে ঠিক হলো তখন ভেবেছি তোমাকে তুলে নিয়ে যাবে, কিন্তু হঠাৎ করেই হাওয়া হয়ে গেলে, তারপর যখন কিছু মাস আগে তোমাকে আর অগ্নিকে একসাথে দেখলাম তখনি ঠিক করলাম, কিভাবে তোমাকে নিজের করা যায়। সেদিন তোমাকে দেখে আমার চোখে আবার ও নেশা লেগে গেছে, আগুন সুন্দরী, কি রুপ, কি ফিগার জাস্ট,
পুরো কথা শেষ করতে না দিয়েই একটা কষিয়ে থাপ্পড় বসালো দিয়া,

দিয়া- আপনি একটা অসভ্য, জানোয়ার লোক, এক্ষুনি বের হন আমার রুম থেকে।
রনিত দিয়ার হাতে থাপ্পড় খেয়ে, রেগে গিয়ে দিয়ার হাত মুচড়ে ধরলো, হিসহিসিয়ে বললো
রনিত- অসভ্যের কি দেখছো তুমি? এখন দেখাবো আমি,

বলেই দিয়ার হাত ছেড়ে ওড়নায় টেনে ধরলো, রনিত ওড়না টানতে টানতেই এগিয়ে যাচ্ছে দিয়ার দিকে,
দিয়া- ছাড়ুন বলছি, আমাকে স্পর্শ করার দুঃসাহস করবেন না, আমি একজনের বিবাহিত স্ত্রী, আমার সাথে এমন জঘন্য কাজ করবেন না।
কাঁদতে কাঁদতেই সৃষ্টিকর্তা কে ডাকছে,
দিয়া- ঈশ্বর সহায় হও,

এমন সময় হিয়া রুমে আসলো, রনিতকে দিয়ার ওড়না ধরে টানতে দেখেই, দৌড়ে এসে দিয়াকে ধরে
হিয়া- কি করছেন আপনি?
রনিত ছেড়ে দিলো দিয়ার ওড়না, রাগী চোখে তাকায় হিয়ার দিকে, দিয়া জড়িয়ে ধরে বোনকে,
হিয়া- আপনাকে বাবাই ডাকছে, এক্ষুনি বের হন এ রুম থেকে।
রনিত যাওয়ার আগে দিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,,
রনিত- আজ বেঁচে গেছে, কাল তোমাকে কে বাঁচাবে। হাহা
দিয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো, ধপ করেই ফ্লোরে বসে পড়লো,ফ্লোর হাত দিয়ে আঘাত করতে থাকতে,, হিয়া ও বোনের পাশে বসে পড়ে,

হিয়া- কি করছো দিদিয়া? ব্যাথা পাবে তো, শান্ত হও।
তনুশ্রী দেবী সে বিকাল থেকে দু- মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে, দিয়ার কান্নার আওয়াজে ছুটে এসেছে। মেয়ের মুখ থেকে রনিতের কথা শুনে হতবাক হয়ে গেছে, শেষমেশ একটা জানোয়ার খুঁজে এনেছে নিজের মেয়ের জন্য দীপক। তনুশ্রী দেবীর নিজেকে অনেক বেশি অসহায় মনে হচ্ছে। আভা দেবী এসে জোর করে তনুশ্রী দেবী আর হিয়াকে রুম থেকে বের করে দিলো, কিছুখন বাঁকা চোখে দিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর বাইরে থেকে দরজায় তলা দিয়ে চলে গেলো, দিয়া উঠে দাঁড়ালো এলোমেলো পায়ে রুমের কর্নার থাকা ব্যাগটা কাছে গেলো, বের করে আনলো অগ্নির ট্রি-শার্ট, বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো,

দিয়া- আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, কোথায় আপনি।
দেওয়ালে দেওয়ালে প্রতিধ্বনি হচ্ছে দিয়ার কান্নার আওয়াজ৷ দীপক সাহা সোফায় বসে আছে, দিয়ার কান্নার আওয়াজ তার কানে ও আসছে, তিনি মনে মনে ভাবছেন,
দীপক সাহা – আমি কি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার কি আরো ভেবে দেখা উচিৎ ছিলো। না না, যা করছি সেটাই ঠিক, একবার বিয়েটা হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

তনুশ্রী দেবী এসে দাড়ালো তার সামনে, তিনি একপলক স্ত্রী দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলো, এ মুখ দেখলে দীপক সাহার নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়, ভালোবেসে নিজের কাছে আনলেও ভালো রাখতে পারে নি, চেহারায় আগের মতো উজ্জ্বলতা নেই, কেমন জানি ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। নিজের চিন্তা ভাবনা মধ্যেই খুব মৃদু স্বর কানে আসলো

তনুশ্রী দেবী – শুনেছি পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ থাকলেও কোন খারাপ বাবা নেই। সেটা কথাটা আপনি ভুল প্রমাণ করেছেন। শুনতে পারছেন আমার মেয়ের আর্তনাদ, চিৎকার, কানে যাচ্ছে না আপনার? আসলে বাবার হওয়ার কোন যোগ্যতা নেই আপনার,এমন বাবা থাকার চেয়ে পিতৃহীন থাকে অনেক ভালো।
তনুশ্রী দেবীর কথা শুনে চিল্লিয়ে উঠলো দীপক সাহা
দীপক সাহা- তনুুু,,

তনুশ্রী দেবী – একদম চিৎকার করবেন না, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো আপনাকে ভালোবাসা। যার ফল আমি ভোগ করেছি, এখন আমার মেয়েরা করছে।
দীপক সাহা -কি বললে আমাকে ভালোবেসে ভুল করেছো তুমি,তাহলে মনে রেখে এ ভুলের শাস্তি তোমাকে সারাজীবন ভোগ করতে হবে।
বলেই সেখান থেকে উঠে গেলো, তনুশ্রী দেবী ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো,,
সারারাত দরজা সামনে বসে পাগলের মতো কেঁদেছে অগ্নি, শান্তি দেবী কলিজা ফেটে গেছে, কতো কথা বলে ছেলেকে থামানোর চেষ্টা করেছেন কিন্তু পারে নি, সকাল নয়টার দিকে আদিত্য রায় এসে দাড়ালো শান্তি দেবীর সামনে,

আদিত্য রায় -বোঝাও নিজের ছেলেকে। কান্নাকাটি বন্ধ করতে বলো। সত্যিটা যতো তাড়াতাড়ি মেনে নিবে ততোই ওর জন্য ভালো।
শান্তি দেবী- কি ভালো করছেন আপনি?? নিজের ছেলের বৌ কে অন্য কারো সাথে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন৷ একটুও বিবেকে বাঁধছে না আপনার।
আদিত্য রায় – নাহ্।
শান্তি দেবী – ছি,,

আদিত্য রায় চলে যেতে নিলে শান্তি দেবী পিছন থেকে ডেকে বললো,
শান্তি দেবী – আমার ছেলে কালকে থেকে না খেয়ে আছে, দরজা টা একটু খুলে দেন,
আদিত্য রায় – দিয়ার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত এ দরজা খোলা হবে না।
শান্তি দেবী – যতোদিন দিয়ার বিয়ে না হবে ততোদিন কি আমার ছেলে না খেয়ে থাকবে?
আদিত্য রায় – শুধু আজকের দিনটা, কালকে সকালেই দরজা খুলে দিবো।
শান্তি দেবী আবাক হয়ে বললো
শান্তি দেবী – আজ দিয়ার বিয়ে?
আদিত্য রায় – হুম।

হতভম্ব হয়ে গেলো শান্তি দেবী, এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে ঠিক করে ফেলবে তিনি ভাবতেও পারেন নি, উনি মনে মনে অভির অপেক্ষা করছিলো, অভি আসলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো, আদিত্য রায় যেতেই অগ্নি আরো জোরে চিল্লাচিল্লি শুরু করলো,
অগ্নি – মা, আমাকে যেতে দাও দিয়ার কাছে। মা, আমি একবার দিয়াকে দেখতে চাই।খুলে দাও দরজা মা, আমার দিয়াকে এনে দাও,

অগ্নি এমন বিলাপে শান্তি দেবী ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। তিনি মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছেন, যাতে কোন ভাবে বিয়ে টা আটকানো যায়।
সকাল সাড়ে দশটায় দিয়ার রুমের দরজা খুলে ভিতরে আসলো আভা দেবী আর বিভা দেবী। বিভা দেবীর হাতে একটা হলুদের বাটি, দিয়া রুমের এক কোণায় জড়সড় হয়ে বসে আছে, হিয়া ও পিছন পিছন আসলো, সে এতোখণ বাইরে দাড়িয়ে ছিলো, বোনের রুমের দরজা খোলার অপেক্ষায় ছিলো, দিয়া এভাবে বসে থাকতে দেখে দৌড়ে গেলো দিয়ার কাছে,

হিয়া- দিদিয়া ঠিক আছো তুমি??
দিয়া সেভাবেই বসে রইলো, কিছুই বললো না, আভা দেবী টেনে হিঁচড়ে দাঁড় করালো দিয়াকে, হলুদ ছোঁয়ানো জন্য হাত বাড়াতেই, হাত ঝাড়া দিয়ে হলুদের বাটি ফেলে দিলো দিয়া,
দিয়া- অন্য কারো গায়ে ছোঁয়ানো হলুদ একদম আমাকে দিবে না।আমার স্বামী ব্যতিত অন্য কারে রঙে রঙ্গিন হবো না আমি।

বিভা দেবী – গোধুলি লগ্নেই রনিতে রঙে রঙ্গিন হয়ে যাবি,
বলেই দু-বোন হাসতে লাগলো,
দিয়া- কখনোই না, তোমরা ভাবলে কি করে আমি ওই জানোয়ার টা কে বিয়ে করবো। আমার জীবন থাকতে আমি ওকে বিয়ে করবো না।
আভা দেবী – তোর জীবন থাকতে যেমন জোর করে, তোর সিঁদুর মুছে দিয়েছি, তেমনি জোর করেই বিয়েও দিয়ে দিবো।

বলেই থেকে বেরিয়ে তারা সাথে হিয়াকে ও টেনে নিয়ে গেলো, দিয়া এবার নিঃশব্দে কাঁদছে,
দিয়া- আপনি ছাড়া আমি কারো হবো না,, কারো না।
অভি অফিসে কাজ করছে, সুপ্তি ফোন দিয়ে পাগল বানিয়ে দিচ্ছে, দিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না, তাই অভির মাথা খারাপ করে দিচ্ছে, চিন্তা তো অভির ও হচ্ছে, অভি তো কারো সাথেই যোগাযোগ করতে পারছে না, হঠাৎ করে সকালের নাম্বার বন্ধ পাচ্ছে। তাই ঠিক করলো আজকে রাতেই বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিবে। এসব ভাবনার মাঝেই আবার ফোন বেজে উঠলো, ঠিক করলো একটা কড়া ধমক দিবে সুপ্তিকে, এমনিতে নিজেই টেনশনে আছে তার উপর এ মেয়ে পাগল বানিয়ে ছাড়ছে, ফোন হাতে নিয়ে দেখলো সুপ্তি না জুবায়ের কল দিয়েছে, হঠাৎ এ সময়ে জুবায়ের কল আশা করে নি অভি,

অভি- হ্যালো,
জুবায়ের – কই তুই, এলাকায় আছিস।
অভি- না,,
জুবায়ের – কি রে, তোর বোনের বিয়ে আর তুই নেই।
অভি কিছুটা অবাক হলে ও, অগ্নি বলেছে ভেবে তেমন পাত্তা দিলো না,
অভি- আজকে রাতে আসছি।

জুবায়ের – বিয়ে সন্ধ্যার সময় তুই রাতে এসে কি করবি।
অভি- কি আবোল তাবোল বকছিস, বিয়ে তো পরশুদিন।
জুবায়ের- ওই ব্যাটা গাঁজা খেয়ছিস নাকি, রনিত বললো বিয়ে আজ সন্ধ্যায় আর তুই বলছিস পরশু দিন। সন্ধ্যায় যাওয়ার জন্য দাওয়াত দিয়ে গেলো। রনিত তো সে লেভেলের খুশি, তোর হাতে উরাধুরা কেলানি খেয়েও ব্যাটা হাল ছাড়ে নি।

হঠাৎ করেই অভির মস্তিষ্ক সজাগ হলো, পুরো বিষয় টা বুঝতে বেশি সময় লাগলো না, দপ করেই আগুন জ্বলে উঠলো মাথায়, গম্ভীর কণ্ঠে বললো
অভি- বিয়ে কয়টায় বললি??
জুবায়ের – সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় যেতে বললো।
অভি- আচ্ছা কল রাখ, আমি আসছি।

অভি হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিলো, দুপুর দুই টা সাড়ে চার ঘন্টা সময় আছে, কাউকে কিছু না বলেই হনহনিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলো, আবারও ফোনে ট্রাই করলো, দিয়া, অগ্নি, হিয়া, শান্তি দেবী, তনুশ্রী দেবী সবার ফোনই বন্ধ। আদিত্য রায়ের নাম্বারে বার কয়েক কল দিলো কিন্তু কল রিসিভ করছে না।
দিয়াকে সাজানো হচ্ছে, দীপক সাহা মেয়ের জন্য দামি একটা বেনারসি এনেছে, তাতে অবশ্যই তার বোনেদের ভীষণ আপত্তি ছিলো, শান্ত হয়ে বসে আছে দিয়া, দেখেই মনে হচ্ছে অনুভূতি শূন্য কোন রোবটকে সাজানো হচ্ছে। সাজানো শেষে রুম থেকে চলে যেতে নিলো, হিয়ার হাত টেনে ধরলো দিয়া, হিয়ার এক হাত আভা দেবী ধরে রেখেছে,
আভা দেবী – কি হলো কি, ওর হাত ধরেছিস কেন।

দিয়া- হিয়াপাখি কে একটু রেখে যাও, ওর সাথে আমার কথা আছে।
আভা দেবী – রেখে যাওয়া যাবে না, যা বলবি আমাদের সামনে বল।
দিয়া উঠে এসে আভা দেবী হাত থেকে হিয়াকে ছাড়িয়ে নিজের সামনে দাঁড় করলো, কিছুখন বোনের মায়বী মুখশ্রী দিকে চেয়ে থেকে, ওকে জড়িয়ে ধরলো, ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো হিয়া, আশ্চর্যজনক ভাবে একটুও কাঁদলো না দিয়া।
দিয়া- কাঁদিস না হিয়াপাখি, যা ভাগ্য আছে তাই হবে। তুই মাকে দেখে রাখিস আমি তো আর থাকবো না, আর তোর দাদাইকে বলে দিস আমাকে যাতে ক্ষমা করে দেয়।

হিয়া মুখ তুলে চাইলো বোনের দিকে এতো শান্ত কেন হয়ে আছে, কিন্তু কিছু বলার আগেই হিয়াকে টেনে নিয়ে গেলো আভা দেবী, দিয়ার যখন বুঝতে পারলো দরজায় তালা লাগিয়ে চলে গেছে, তখন নিয়েও ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো, ছিটকানি লাগিয়ে দিলো ভেতর থেকে। তারপর আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজের গায়ের বেনারসি টা টেনে খুলে ফেললো, শাড়িটা হাতে নিয়ে আপন মনেই বললো
দিয়া- দামি বেনারসি, বাবাই তোমার দেওয়া শেষ শাড়ি। এতো দামি শাড়ি যে আমার শরীরের সুচের মতো ফুটছে। তবে এ শাড়ির অমান্য আমি করবো না।

চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো, নিজেই সেটা মুছে নিলো দিয়া।
দরজায় থাপ্পড় দিয়ে কাঁদছে অগ্নি, ও নিজের মাঝেই নেই, চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে গলা ভেঙে গেছে তাও থামছে না সে।
অগ্নি – মা, ও মা, মা গো তোমার দুটো পায়ে পড়ি, দরজা টা খুলে দাও। আমার দিয়া যে খুব ছেলেমানুষ, ও যদি নিজের কোন ক্ষতি করে ফেলে। মা, বাবাকে বলো না, আমার দিয়া আমাকে ছাড়া বাঁচবো না। পিচ্চি টা ভীষণ ভালোবাসে আমাকে।

শান্তি দেবী নিজের বুক নিজে চাপড়াছে, ছেলের এ আহাজারি আর সহ্য করতে পারছে না, কাল থেকে উনি একইভাবে দরজার সামনে বসে আছে। তখনি ঈশ্বর প্রদত্ত দূত হয়ে আগমন ঘটলো অভির। মাকে দাঁড় করিয়ে দরজায় কয়েকটা লাথি দিলো, কিন্তু ভাঙ্গতে সক্ষম হলো না, দরজার এমন আওয়াজে রুম থেকে বেরিয়ে এলো আদিত্য রায়, অভিকে দেখেই ফাঁকা ঢোক গিললো তিনি, অভিকে এখন তিনি মোটেও আশা করে নি। ভিতরে ভিতরে ভয় পেলেও স্বাভাবিক স্বরেই বললো

আদিত্য রায় – শত চেষ্টা করলেও ভাঙতে পারবে না এ দরজা।
অভি – চাবি দেন, দরজা খুলবো।
আদিত্য রায় – কালকে সকালে আমি খুলে দেবো।
অভি বাঁকা হাসে, তার হাসি দেখে ঘাবড়ে যায় আদিত্য রায়, অভি তাকে আরেক ধাপ অবাক করে দিয়ে হুট করেই দেওয়াল সাথে চেপে ধরলো আদিত্য রায় কে, হাতের ধারালো চাপাতি টা গলা বরাবর রাখলো, আসার সময় কিনে এনেছে এটা,আবারও ঠোঁটে হাসি রেখেই বললো

অভি- কি রায় বাবু, দিবো নাকি এক টান, আপনার একটুও কলিজা কাঁপলো না এ কাজটা করার আগে? কি ভেবেছেন আমার দাদাই আর বোনের জীবন নিয়ে দাবা খেলবেন আর আমি ছেড়ে দিবো আপনাকে?
আদিত্য রায় কাঁপা কাঁপা গলায় বলে

আদিত্য রায় – কি করছো তুমি, আমি বাবা হই তো তোমার, এটা কি রকম অসভ্যতা??
অভি- কিসের বাবা, লজ্জা করছে নিজেকে বাবা বলে দাবি করতে, আর্তনাদ শুনতে পারছেন, আমার ভাইয়ের আর্তনাদ। ওদের একেক ফোঁটা চোখের জলের চরম মূল্য দিতে হবে আপনাদের। এখন কি চাবি টা দিবেন নাকি, শরীর থেকে মুন্ড টা আলাদা করে দিবো।

আদিত্য রায় আর কথা বাড়ালো না, তাড়াতাড়ি পকেট থেকে চাবিটা বের করে দিয়ে দিলো, অভি দৌড়ে গিয়ে দরজা টা খুলে দিলো, বিধ্বস্ত অবস্থায় অগ্নি ফ্লোরে বসে আছে, অভিকে দেখেই উঠার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না, ধপ করে পড়ে গেলো, ভাইয়ের এমন অবস্থা দেখে অভির বুকের ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে গেলো, নিজেই ধরে উঠালো অগ্নিকে।

অগ্নি – তুই এসেছিস, আমাকে নিয়ে চল দিয়ার কাছে, আমি না দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছি না অভি। আমাকে একটু শক্ত করে ধর।
অভি চোখ থেকে হঠাৎ করে জল পড়ছে, সন্তোপনে নিজের চোখের জল মুছে নিলো,
অভি- এই তো দাদাই আমরা এখনি যাবো, তুমি চিন্তা করো না,আকাশ,কবির আর জুবায়ের গেছে বিয়ে আটকাতে।
অগ্নি – দিয়া ঠিক আছে তো।
অভি- চিন্তা করো না, সব ঠিক আছে।

অভি অগ্নিকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আদিত্য রায়ের উদ্দেশ্য বললো
অভি- আমার ভাইয়ের বিবাহিত স্ত্রীকে আবার বিয়ে দেওয়ার মতো দুঃসাহস যারা দেখিয়ে তাদের প্রত্যেকের কলিজা আমি ইঞ্চি টেপ দিয়ে মেপে মেপে দেখবো কতো বড় হয়েছে। না দীপক সাহাকে ছাড়বো না আপনাকে, ভাববেন না বাপ বলে ছাড় পেয়ে যাবেন।

অগ্নিকে নিয়ে অভি দিয়াদের বাসায় যাচ্ছে, অগ্নির বুকের ভেতর টা জ্বলে যাচ্ছে, ওর মনে হচ্ছে দিয়া ঠিক নেই। বাসার সামনে যেতেই দেখলো আকাশ দাঁড়িয়ে আছে, অগ্নি সামান্য পথ টুকু আসতে অনেক বার হোঁচট খেয়েছে। আকাশের সামনে দাড়িয়ে কাঁপা গলায় বললো,
অগ্নি – বিয়ে কি হয়ে গেছে,,
আকাশ অগ্নির মুখের দিকে তাকিয়ে ছোট করে উওর দিলো
আকাশ – নাহ্

এ কথা শুনে ও অগ্নির মন শান্ত হলো না, অভি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো, হাতের চাপাতি টা শক্ত করে ধরলো, আজ দীপক সাহাকে কুপিয়ে শান্ত হবে সে। আকাশের কোন কথা না শুনেই দুই ভাই বাসার ভিতরে ছুটলো, আকাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওদের পিছনেই হাঁটা দিলো, ভিতরে যেতেই পা থেমে গেলো দুজনের, অভির হাত থেকে চাপাতি টা পড়ে গেলো, সে শব্দে সবাই তাকালো ওদের দিকে।

অগ্নিকে দেখেই শব্দ করেই কেঁদে দিলো তনুশ্রী দেবী, অগ্নি এলোমেলো পায়ে এগিয়ে গেলো ধপ করে বসে পড়লো, কাঁপা কাঁপা হাতে স্পর্শ করলো দিয়ার হাত, হিম শীতল হয়ে আছে দিয়ার শরীর। চোখ বন্ধ করে নিলো অগ্নি, চোখ দিয়ে দুফোঁটা নোনা জল পড়লো। ভাঙ্গা গলায় বললো,
অগ্নি – দিয়া এই দিয়া, দেখো আমি চলে এসেছি। চোখ খুলো আমি তোমাকে নিয়ে যাবো। আর কখনোই এখানে আসবো না আমরা। চলো,,,

তনুশ্রী দেবী কাঁদতে কাঁদতে বললো,
তনুশ্রী দেবী – বাবু তুই যে অনেক দেরি করে ফেলেছি,, ও আর উঠবে না।
অগ্নি – ও কি বেশি রাগ করেছে পিসিমনি, দিয়া তো আমার সাথে রাগ করে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না, দেখবে এক্ষুনি উঠে যাবে।
তনুশ্রী দেবী চিৎকার করে বললো

তনুশ্রী দেবী – উঠবে না ও আর, আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, আর উঠবে না দিয়া,,
অগ্নি – ও আমাকে ছেড়ে যেতে পারে না পিসিমনি, আমরা আমৃত্যু আমাদের “আমরা” হয়ে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, এই দিয়া তুমি ভুলে গেলে নাকি। এমনটা কিন্তু কথা ছিলো না,

অভি ধীর পায়ে এগিয়ে এসে পিসিমনির পাশে বসলো, এক হাতে পিসিমনিকে জড়িয়ে ধরে বললো,
অভি- ও কি আর একটু অপেক্ষা করতে পারলো না পিসিমনি৷ আমার উপর কি ওর একটু বিশ্বাস করতে পারলো না,
অগ্নি – দিয়ার কোন দোষ নেই সব আমার দোষ, তুই বলেছিলি না ওর এ হাত আমি জেনো কোন দিন না ছাড়ি কিন্তু আমি তো ছেড়ে দিয়েছি, আমার দোষ সব।

তনুশ্রী দেবী বিধ্বস্ত অগ্নির দিকে চেয়ে আছে এখনো সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিচ্ছে। এ ছেলেটা কিভাবে বাঁচবে দিয়াকে ছাড়া।অগ্নি দিয়ার সারা মুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর বিড়বিড় করে কিছু বলছে,শক্ত মনের অভিও শব্দ করে কাঁদছে, দূরে দাড়িয়ে সবটা দেখছে দীপক সাহা, মেয়ের মৃত দেহের কাছে আসার সাহস পাচ্ছে না উনি। বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ওনার তারপর ও শক্ত খোলসে নিজেকে আবৃত করে দাঁড়িয়ে আছে। ওনার দিকে চোখ পড়তেই অভির মাথায় খুন চেপে বসলো, চারদিকে তাকিয়ে চাপাতি টা খুঁজলো, উঠে গিয়ে সেটা হাতে নিয়ে তেড়ে গেলো দীপক সাহার দিকে, যখনি কোপ দিবে ঠিক তখনি পিছন থেকে হিয়া ডেকে উঠলো,

হিয়া- দাদাভাই,
থেমে গেলো অভির হাত, মনে হলো দিয়া ওকে ডাকলো তড়িৎ গতিতে পিছনে ফিরতেই হিয়াকে দেখতে ফেলো, দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো অভিকে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা, কি বলে শান্তনা অভি,যেখানে ও নিজের ভেঙে গিয়েছে। নিজেকে সামলে বললো
অভি- ছাড় আমাকে, আজ এ দীপকের বাচ্চাকে মেরেই ফেলবে। তোর কোন কথায় শুনবো না আমি, ছাড় হিয়া আমাকে, আমার বোনের আত্মা শান্তি পাবে না একে বাঁচিয়ে রাখলে।

হিয়া- আমি চাই না এ লোকটাকে দাদাভাই৷ আজ থেকে আমার বাবাই নেই৷আমি আজ থেকে নিজেকে পিতৃহীন বলেই জানবো। কিন্তু দিদিয়ার শেষ কথা গুলো তোমাকে রাখবে হবে দাদাভাই।
হিয়ার কথা শুনে চমকে তাকালো দীপক সাহা, কি বললো হিয়া এসব, এক মেয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে, আরেক মেয়েও কি মুখ ফিরিয়ে নিবে তার থেকে।

হিয়া অভির দিকে একটা চিঠি বাড়িয়ে দিলো। দিয়া লেখা যাওয়া চিঠি,
চার বছর পর, এক বিকালে পার্কের একটা বেঞ্চে বসে আছে দীপক সাহা, তার পাশেই এসে বসেছে আদিত্য রায়। বাচ্চারা ছুটাছুটি করে খেলছে, সেদিকেই তাকিয়ে আছে দীপক সাহা। দিয়াকে ছোটবেলা এ পার্কে নিয়ে আসতো তিনি, দিয়া আর অগ্নিকে রেখে কাজে চলে যেতেন। ঘন্টা দুয়েক পর এসে আবার নিয়ে যেতেন, মাঝে মাঝে অগ্নি একাই নিয়ে আসতো দিয়াকে।

প্রেম পরিণয় পর্ব ১৫

আদিত্য রায় – আমাদের পাপের শাস্তি পাচ্ছি আমরা, এভাবে নিঃসঙ্গ জীবন আর বয়ে বেড়াতে পারছি না দীপক।
দীপক সাহা – আমার পাপের শাস্তি আপনাকে ভোগ করতে হচ্ছে দাদা, আপনি তো মেনে নিতে চেয়েছেন, কিন্তু আমি রাজি হয় নি,দোষ আমার।
আদিত্য রায় – আমি তোমায় সমর্থন করেছি, নিজের ছেলের করুণ হাহাকার শুনছি। এই পাপের ভাগিদার আমি ও।

প্রেম পরিণয় শেষ পর্ব