ফাঁদের অন্তরালে পর্ব ৫

ফাঁদের অন্তরালে পর্ব ৫
লেখকঃ আবীর হোসেন।

একজন গুন্ডা পিস্তল বের করে অবনীর দিকে তাক করে পরপর কয়েকটা গুলি ছুড়লো কিন্তু অবনীর কোনো নড়াচড়া নেই দেখে গুন্ডারা সবাই অবাক।
লতাপাতা সরিয়ে গুন্ডারা সবকজন সেই ঝোপের ভেতর ঢুকে অবনীর গায়ের ওপর থেকে থেকে লতাপাতা সরিয়ে তারপর ওড়না টান দিয়ে নিতেই অবাক। ওড়নার নিচে কিছু লতাপাতা একত্রিত করে এমন আকৃতি দেয়া হয়েছে যেন কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখলে দেখে মনে হয় একজন মানুষ গুটিসুটি মেরে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে।

ঝোপের পাশেই একটা গাছে বিশালাকৃতির ভিমরুলের বাসা। অবনী দূরে অন্য একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। গাছের ডাল এবং লতা দিয়ে অবনী একটা ধনুক বানিয়ে রেখেছে আগে থেকেই, এবং একটা লাঠির একমাথা ঘষে সুচালো করে রেখেছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এবার মোক্ষম সময় বুঝে বের হয়ে সেই ধনুকে তীরের মতই লাঠির একপ্রান্ত লাগিয়ে পেছনে টেনে ছেড়ে দিতেই সা-সা করে উড়ে গিয়ে লাঠির সুচালো মাথা ভিমরুলের বাসায় গেঁথে গেল এবং বাসার কিছু অংশ ভেঙে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শতশত ভিমরুল বেরিয়ে এলো। আর বাসায় লাঠিটা এসে লাগার শব্দ পেয়ে গুন্ডারা ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা মাত্র ভিমরুলের আক্রমণে অস্থির হয়ে পিস্তল ফেলে এলোপাতাড়ি ছোটাছুটি করতে লাগলো।

একসাথে এত ভিমরুলের দংশনে সবার এমন অবস্থা হলো যে যন্ত্রণায় জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
পরিস্থিতি একেবারে শান্ত হবার পরে গুন্ডারা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। গুন্ডাদের পিস্তল কুড়িয়ে এনে সামনে দাড়িয়ে অবনী বললো– চাইলে এখন একজন একজন করে তোদের সবকটার খুলি উড়িয়ে দিতে পারি। কিন্তু আমিও একটি সন্তানের মা হতে চলেছি। সন্তান গর্ভে থাকার এই দিনগুলো কেমন আমি জেনেছি। কতটা ত্যাগ তিতিক্ষার পরে একজন মা তার সন্তান ভূমিষ্ট করে তার কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পেরেছি। তাই তোদের মায়ের বুকটা খালি করতে চাইনা। বেঁচে থাকলে গুন্ডামী ছেড়ে মানুষের মতো জীবনযাপন করিস।

কথা শেষ করে একটা গুন্ডার হাতে থাকা ছুরি নিয়ে মোটা ও শক্ত দেখে এক ধরনের বুনোলতা কেটে এনে সেই লতা দিয়ে সবার হাত পা বেঁধে ফেলে রাখলো অবনী।
দুদিন ধরে ঠিকমতো খাওয়া হয়নি তার ওপর এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে, ক্লান্ত শরীরে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কিছুদূর হেটে যেতেই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে রইলো অবনী।

রাহাতের গার্লফ্রেন্ড অরণীর থেকে সংগ্রহ করা রাহাতের নতুন নাম্বারে বারবার কল করে না পেয়ে মজনুর সন্দেহ হলো– ফাঁদের অন্তরালের সেই রহস্যময় অদৃশ্য ব্যক্তি সবকিছু টের পেয়ে রাহাতের কাছে আগেভাগে পৌঁছে যায়নি তো!
সরকারি বাহিনীর সহায়তায় মজনু রাহাতের সিমের লাস্ট লোকেশন ট্রেস করে তথ্য পেল রাহাতের সর্বশেষ সিম সচল ছিল শহরের নির্দিষ্ট একটা এলাকার একটা নামি-দামি হাসপাতালে।

মজনু দেরি না করে ছুটে চললো সেই হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
হাসপাতালে এসে অবশেষে দেখা মিললো রাহাতের, ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে রাহাতকে।
মজনু এগিয়ে এসে বললো– কি ব্যাপার রাহাত, মায়ের চিকিৎসার কতদূর?
রাহাত ভীষণ অবাক হয়ে বললো– এই তো কিছুক্ষণ পরেই অপারেশন, কিন্তু আপনি কে? আমার নাম জানলেন কি করে? মায়ের অসুস্থতার কথা কীভাবে জানেন?

মজনু বললো– তোমার গার্লফ্রেন্ড অরণীর থেকে জেনেছি।
মজনুর মুখে অরণীর কথা শুনে আরও অবাক হয়ে রাহাত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মজনুর মুখের দিকে।
মজনু রাহাতের কাঁধে হাত রেখে বললো– রাহাত, অপারেশনের পরে সর্বক্ষণ তোমার মায়ের কাছাকাছি থাকতে হবে, খেয়াল রাখতে হবে।

তুমি তো জানো পিতামাতার সবচেয়ে আপন তার সন্তান, আর সন্তানের আপন পিতামাতা। যদি এমন হয় তোমার মায়ের অপারেশন শেষ হবার আগেই তোমাকে পুলিশ গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে টর্চার করে সেদিন নাইট ক্লাবে ঠিক কি ঘটেছিলো সত্যটা বের করার জন্য। এদিকে অপারেশন শেষে তোমার মা’র হুশ ফিরতেই সবার আগে তোমাকে দেখতে চেয়ে, দেখতে না পেয়ে যদি শোনে তোমাকে থানায় ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ, তখন মায়ের কেমন লাগবে বলো? তোমারই বা কেমন লাগবে।

তোমার অপরাধের শাস্তি হিসেবে যদি বছরের পরে বছর জেলে কাটাতে হয় কে দেখবে মাকে? কি হবে তোমার আর অরণীর এতদিনের ভালোবাসার। মেয়েটির চোখে দেখেছি তোমার প্রতি এক পৃথিবী ভালোবাসা ও বিশ্বাসের। এসব জানতে পেরে তোমার ভালোবাসা যদি দূরে সরে যায় কি করবে তখন।

রাহাত কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে হঠাৎ মজনুর পা জড়িয়ে ধরে কেঁদেকেটে বললো– বিশ্বাস করেন স্যার আমি শুধু মারিয়া ম্যাডামের কথা মতো মিস্টার আয়ানের বিয়ারের বোতলে পাওয়ারফুল ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলাম মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে। টাকাটা আমার খুব দরকার ছিল মায়ের অপারেশনের জন্য। তাই আমি রাজি হয়েছিলাম স্যার। বিশ্বাস করেন এর বেশি কিছু আমি জানিনা আমার অসুস্থ মায়ের কসম।

মা শব্দটা আমাদের আবেগ, আমাদের ভালোবাসা। অসুস্থ মায়ের কসম করে বলায় এবং রাহাতের চোখের ভাষায় বোঝা যাচ্ছে রাহাত মিথ্যা বলছেনা। মজনু রাহাতকে তুলে বললো– জীবনে এমন কিছু করোনা যাতে অন্যের জীবন মরণের কারণ হয়ে দাড়ায়। মায়ের খেয়াল রেখো।
কথা শেষে মজনু বেরিয়ে আসলো।

মজনুর কাছে সবকিছু আবার ভীষণ গোলমেলে লাগতে শুরু করলো। ঘুরেফিরে আবার সেই মারিয়াকে ঘিরেই সব রহস্য। কিন্তু মারিয়া জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি এখন। অপেক্ষা করতে হবে মারিয়া মোটামুটি সুস্থ হওয়া পর্যন্ত।
মজনু আয়ানের কাছে কল দিয়ে জানতে চাইলো মারিয়ার কি অবস্থা। আয়ান বললো অপারেশন সাকসেসফুল কিন্তু মারিয়া এখনও কথা বলতে পারছেনা।

মারিয়া যে কেবিনে রাখা হয়েছে সেই কেবিনের বাইরে সোফায় বসে ঝিমাচ্ছে আয়ান। হঠাৎ ফোনে আসা ইমেইলের নোটিফিকেশনের শব্দ হতেই পকেট থেকে মোবাইল বের করে ইমেইলটা ওপেন করতেই আরও বড়সড় একটা ধাক্কা খেল আয়ান। মেইলটা পাঠিয়েছে আয়ানের কোম্পানির সবচেয়ে বড়ো বায়ার একটা নামি-দামি আমেরিকান প্রতিষ্ঠান থেকে। মেইলে লেখা আছে– মিস্টার আয়ান গত চব্বিশ ঘণ্টায় আপনি আমাদের দুইটা ইমার্জেন্সি মেইল ইগ্নোর করায় আমরা বাধ্য হয়ে খান গ্রুপের প্রজেক্ট প্ল্যান এপ্রুভ করে ফেলেছি কারণ এটা আমাদের খুব ইমার্জেন্সি প্রজেক্ট ছিল।

আয়ান চেক করে দেখলো আসলেই আগের দুটো মেইল চেক করা হয়নি। আর হবেই বা কি করে এত এত ঝামেলা টেনশন মানসিক চাপ নিয়ে দিশেহারা সারাক্ষণ। আয়ানের মাথায় হাত। এই কাজটা আয়ানের কোম্পানির পাবার কথা, দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রজেক্ট প্ল্যান করা, মডেল তৈরি করা, এতসব এলোমেলো হয়ে গেল এক নিমেষে। এই প্রজেক্টের পেছনে এত সময় ব্যায় করার পরেও না পাওয়ায় কোম্পানির অনেক বড়ো লস হয়ে যাবে।

ফাঁদের অন্তরালে পর্ব ৪

হঠাৎ করে আয়ানের মাথায় কিছু একটা এসে গেল। নার্স ডেকে মারিয়ার খেয়াল রাখতে বলে আয়ান বেড়িয়ে পড়লো।
পথে মজনুকে সঙ্গে করে নিয়ে আয়ানের গাড়ী ছুটে চললো, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়ে। মিরসরাই এবং সীতাকুণ্ড এর মাঝামাঝি এক যায়গায় গাড়ি থামিয়ে আয়ান ও মজনু দুজনে চা নাস্তা খেয়ে আবার গাড়িতে উঠে চলতে লাগলো। হঠাৎ একটা মালবাহী লড়ি এসে পেছন থেকে মেরে দেয় আয়ানের গাড়িতে। আয়ানের গাড়ী ছিটকে গিয়ে রাস্তার বাইরে উল্টে পড়ে…

ফাঁদের অন্তরালে শেষ পর্ব