ফাঁদের অন্তরালে শেষ পর্ব

ফাঁদের অন্তরালে শেষ পর্ব 
লেখকঃ আবীর হোসেন।

আয়ানের গাড়ী ছিটকে গিয়ে রাস্তার বাইরে উল্টে পড়ে কিন্তু লড়ী ধাক্কা মারার সঙ্গে সঙ্গে আয়ানের গাড়ীর এয়ার ব্যাগগুলো সঠিক ভাবে মুহুর্তের মধ্যে খুলে যাওয়ায় অল্পস্বল্প আঘাত পায় এবং প্রাণনাশের হাত থেকে বেঁচে যায় দুজনেই। অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে দুজনেই।
জ্ঞান ফেরার পরে মজনু নিজেকে আবিষ্কার করে ঘুটঘুটে অন্ধকারে। তারমানে কি এক্সিডেন্ট এর পরে সোজা মহাকাশে পাড়ি জমিয়েছে তার প্রাণ?

আয়ানও তো সঙ্গে ছিল তাহলে ও কোথায়?!
ভাঙা গলায় মজনু বললো– কেউ আছো এই মহাযাত্রার সঙ্গী আমার।
সামনে থেকে আয়ানের কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো– কিসব ভুলভাল বকছিস মজনু।
মজনু বললো– ভুলভাল নয় রে, এত অন্ধকার হয়তো কবরে নয়তো মহাশূন্যে।
– হা হা হা– তোর ঘিলুতে প্যাঁচ লেগে গেছে মজনু এক্সিডেন্ট করে মনে হয়– আয়ান বললো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

: আয়ান দুজন দুজনের কথা শুনতে পাচ্ছি কাছাকাছি থেকে, কিন্তু দেখতে পাচ্ছিনা। হয়তো আমরা মরে ভূত হয়ে গেছি তাই শরীরহীন আত্মা, নয়তো মহাশূন্য পাড়ি দিয়ে স্বর্গের পথে যাচ্ছি আমরা, জানোসই তো মহাশূন্যে অন্ধকার।
: হা হা হা, ব্যাটা মহাশূন্যে অন্ধকার কে বললো, সেখানেএ আলোর চলাচল থাকে শুধুমাত্র বাধাপ্রাপ্ত হয়না বলে বোঝা যায়না। আমরা মহাশূন্যে থাকলে আমাদের শরীরে ঠিকই আলো বাধাপ্রাপ্ত হতো এবং আমরা একে অপরকে দেখতে পেতাম। আলোর উপস্থিতি টের পেতাম।

: তাইলে আমরা কোথায় আয়ান?
: তোর শ্বশুর বাড়িতে, আমাদের এখানে আদর আপ্যায়ন করার জন্যই এনে বেঁধে রাখা হয়েছে এখনও বুঝিসনি?
: বুঝেছি আগেই আয়ান, মনে হলো তুই ভয় পেয়ে গেছিস কিনা তাই স্বাভাবিক করার জন্য হাস্যরসের কথা বললাম।
: হাস্যরসের কথা বাদ দিয়ে সিরিয়াসলি ভাব আমাদের কি হবে। আমাদের রস বের করার জন্যই হয়তো এখানে আনা হয়েছে।

: কে এনেছে?
: ফাঁদের অন্তরালে যে, সে ছাড়া আর কে?
: তাহলে এখন?
: আপাতত চুপ থাক।
দুজনের কথাবার্তা শেষ হবার কিছুক্ষণ পরেই তৃতীয় একজনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল– তাহলে মিস্টার আয়ান এবং মজনু আপনাদের মূল্যবান বাজে কথাবার্তা শেষ হলো।

সঙ্গে সঙ্গে আলো জ্বলে উঠলো। একটা পুরনো গোডাউন টাইপের ঘর। আয়ান দেখলো একটু দূরে একটা সিঙ্গেল সোফায় পায়ের ওপর পা তুলে হাতে পিস্তল নিয়ে বসে আছে আয়ানের একসময়ের ভালো বন্ধু হৃদয়।
আয়ান অবাক হয়ে বললো– হৃদয় তুই? সবকিছুর পেছনে তাহলে তুই ছিলি।
মজনু আয়ানকে বললো– এ কিছুতেই তোর বন্ধু হতে পারেনা, এ তো হৃদয় নয়– হৃদয়হীন।
হৃদয় উঠে এসে আয়ানের নাক বরাবর একটা ঘুষি মেরে বললো– কিছু মনে পড়ে আয়ান? তুই ভুলতে পারলেও আমি তো আর পারিনা, কারণ আমারই তো বোন।

আয়ানের নাক ফেটে রক্ত ঝরছে। আয়ান বললো– হৃদয় তোর ধারণা সম্পুর্ন ভুল, তোর বোন কেয়া আগে থেকেই বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগছিল, তাই সামান্য বিষয়টিকে মেনে নিতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিল।
কলেজ লাইফে আয়ান ও হৃদয়ের বোন কেয়া একই কলেজে পড়তো। কেয়া ভীষণ পছন্দ করতো আয়ানকে সেটা ধীরে ধীরে সবাই জেনে গিয়েছিল, কিন্তু আয়ানের মনে কখনো ওরকম কোনো অনুভূতি ছিলনা কেয়ার প্রতি। কেয়াকে খুব করে বোঝানোর পরেও কেয়া কখনও বোঝার চেষ্টা করেনি। কেয়া একমাত্র মেয়ে বলে খুব আহ্লাদী ও জেদি ছিল।

একদিন ক্লাশরুমে আয়ান বসা ছিল ঐ সময় কেয়া ঢুকে ক্লাসরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে কেয়া বলে– আজকে আমার ভালোবাসা তোমার গ্রহণ করতেই হবে আয়ান নয়তো পরিনতি কি হবে আমি নিজেও জানিনা।
আয়ান ভীষণ অবাক হয়ে বললো– কেয়া শান্ত হও প্লিজ, তুমি আমার বন্ধুর বোন, আমি সেই চোখে তোমাকে দেখি এর বেশি কিছু না। আমি স্যরি কেয়া প্লিজ বুঝতে চেষ্টা করো।
কেয়া হুট করে আয়ানকে জড়িয়ে ধরে আয়ানের ঠোঁটে চুমু খেয়ে বললো– আমি এতকিছু বুঝিনা আমি তোমাকে চাই আয়ান, তোমাকেই চাই।

বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে আয়ান ঠেলে কেয়াকে সরিয়ে দিতে চাইছে কিন্তু কেয়া ছাড়ছে না, এরকম ধস্তাধস্তি করতে করতে হঠাৎ কেয়া ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যেতে যেতে টেবিলের কোণায় লেগে মাথা ফেটে অজ্ঞান হয়ে যায়।
ততক্ষণে ক্লাস রুমের বাইরে স্যাররা এবং শিক্ষার্থীরা এসে জড়ো হয়ে যায়। কেয়াকে হাসপাতালে পাঠানো হয় এবং ঐদিনই আয়ানকে কলেজ থেকে বের করে দেয়া হয়। হৃদয়ের বোন বলেই আয়ান সমস্ত দোষ নিজের ঘাড়ে নেয়, যাতে অন্যান্য সবাই কেয়াকে বাজে মেয়ে না ভাবে।

আয়ান ঢাকায় চলে আসে এবং ওদিকে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। কেয়া বাসায় ফিরে মানসিক ভাবে এতটাই ভেঙে পড়ে যে একসময় আত্মহত্যা করে বসে। আর হৃদয়ের পরিবার কেয়ার মৃত্যুর জন্য আয়ানকেই দায়ী করে।
সেই থেকেই হৃদয়ের মনে আয়ানের প্রতি ঘৃণা আর ক্ষোভ গভীর হতে থাকে। হৃদয়ের বাবাও চট্টগ্রামের প্রথম কাতারের একজন বিজনেস ম্যান। বাবার ব্যাবসার দায়িত্ব নিজে নেবার পর থেকেই হৃদয়ের একটাই মিশন, আর সেটা হলো আয়ান ও তার বিজনেসকে মাটিতে আছড়ে ফেলা। শেষ করে দেয়া।

মজনু হৃদয়কে বললো– হৃদয় আয়ান তো ভুল কিছু করেনি, বন্ধুত্বের সম্পর্কের সম্মান বজায় রাখতে গিয়ে একটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি, আর তারপর এই দূর্ঘটনা।
হৃদয় রহস্যময় হাসি হেসে বললো– বোনের চেয়ে বন্ধু কখনও বড়ো হয়না, আর এই কবছর যাবৎ দেশের সেরা ইয়াং বিজনেসম্যান এওয়ার্ডটা আয়ান নিয়ে যাচ্ছে, ওকে সরাতে পারলে এ বছরেরটা নিশ্চিত আমার। এই বারবার দ্বিতীয় হবার বিষয়টা ভীষণ বিরক্তিকর। প্রথমে আয়ান গ্রুপের নাম তারওর খান গ্রুপ। ভীষণ বাজে লাগে এটা। তাই এক ঢিলে দুই পাখি, বোনের প্রতিশোধ এবং নাম্বার ওয়ান পজিশন।

মজনু ভীষণ অবাক হয়ে বললো– বড়ো মাপের ভয়ংকর খেলোয়াড় তুমি হৃদয়।
হৃদয় অট্টহাসি হেসে বললো– মারিয়া আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে জেনেই সেই ভালোবাসার ফয়দা তুললেই আয়ানের কোম্পানিতে পাঠালাম বিয়ে করার লোভ দেখিয়ে। আর মারিয়ার কিছু নগ্ন ভিডিও ক্লিপস এবং ছবিটবি তো ছিলোই প্রেশার দেবার জন্য।

ওর মাধ্যমেই আমেরিকার ক্লায়েন্টের জন্য আয়ানের স্বযত্নে তৈরি করা প্রজেক্ট প্ল্যানটা হাতিয়ে নিলাম। আর আগে থেকেই আয়ানকে একটার পরে একটা ফাঁদে ফেলে ধরাশায়ী করে রেখেছিলাম তাই মারিয়াকে সন্দেহ করার সুযোগ পায়নি। কিন্তু মারিয়া যখন ইমোশনাল হয়ে আয়ানকে আমার সম্পর্কে বলতে গেল তখন বুঝলাম এবার ওর পরপারে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। পাঠিয়ে দিলাম। আয়ান হাসপাতালে নিলেও মারিয়ার পক্ষে আর বেঁচে থাকা সম্ভব হবেনা। আর আয়ানের অবনীকেও এখানেই শেষ করে হবে, আমার লোকজনকে এখানের লোকেশন পাঠিয়েছি ওরা অবনীকে এখানেই নিয়ে আসবে, দেরি হচ্ছে কিন্তু আসবেই। হয়তো আয়ানের মৃত্যুর পরে, শেষ দেখাটাও আর হবেনা দুজনের। বড়ো আফসোস।

মজনু ও আয়ান হৃদয়ের কথা শুনে হা হয়ে আছে।
হৃদয় দুই হাতে দুটো পিস্তল ধরে আয়ান ও মজনুর দিকে তাক করে বললো– ঘোল খাইয়ে গোল দিতে না পারলে এই জগতে সফল হওয়া সম্ভব নয়। বল তোদের শেষ ইচ্ছা কি?
মজনু বলে উঠলো– হৃদয় ভাই বিপদে পড়ে ভুলেই গিয়েছিলাম কিন্তু আপনার মুখে “গোল” শব্দটা শুনে মনে পড়লো আজকে বস লিওনেল মেসির জন্মদিন। শেষ ইচ্ছা হিসেবে কেক কেটে বসের জন্মদিন পালন করে যেতে চাই, একটা কেকের ব্যবস্থা হবে ভাই।

হৃদয় অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো– শালা মরার আগেও মেসি!
মজনু বললো– ভাই মেসি মানেই ইমোশন মেসি মানেই ভালোবাসা। মেসি ভক্তদের কাছে মেসি যে কি তা তারাই ভালো জানে।

– ওকে কেক নয় পিস্তলের গুলি খেয়ে স্বর্গে গিয়ে মেসির জন্মদিনের উৎসব পালন কর– বলে আবারও পিস্তল তাক করে হৃদয় গুলি করবে এমন সময় খটাৎ করে দরজা খুলে গেল, বিদ্যুৎ গতিতে অবনী সহ কয়েকজন পুলিশ প্রবেশ করলো। ইন্সপেক্টর হৃদয়ের হাতে একটা গুলি করতেই হাত চেপে ধরে বসে পড়লো হৃদয়।
পুলিশ এসে হৃদয়কে হাতকড়া পরালো।

অবনী হৃদয়ের সামনে এসে বললো– গুন্ডাগুলোর ফোনে পাঠানো লোকেশনই তোমার বিপদ ডেকে আনলো হৃদয়। পাপ বাপকেও ছাড়েনা। জেলে গিয়ে নিজেকে শুধরে নিয়ো।
জঙ্গলে বসে গুন্ডাগুলোর হাত পা বেঁধে রাখার সময় একটা গুন্ডার মোবাইল নিয়ে এসেছিলো অবনী। সেই মোবাইলের হোয়াটসঅ্যাপে হৃদয়ের পাঠানো লোকেশন দেখে থানা থেকে পুলিশ নিয়ে সোজা এখানে চলে আসে অবনী। কিন্তু অবনী জানতো না আয়ান এখানে আছে।

হৃদয়কে নিয়ে যায় পুলিশ।
অবনী আয়ান ও মজনু ঢাকায় ফিরে আসে।
আয়ান সবকিছু খুলে বলে অবনীকে। পারিবারিক আনুষ্ঠানিক ভাবে অবনীকে গ্রহণ করে নেয় আয়ানের পরিবার।
মারিয়া সুস্থ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার পরে মজনু ও মারিয়ার বিয়ে হয়ে যায়।

ফাঁদের অন্তরালে পর্ব ৫

সব বাধা বিপত্তি পেড়িয়ে এখন আয়ান আর অবনীর সুখের সংসার, এই সংসারের কোণায় কোণায় হাসিখুশি আনন্দে ভরিয়ে দিতে এখন শুধু বাকি ওদের সন্তান পৃথিবীতে আসার।

সমাপ্ত