ফাঁদের অন্তরালে পর্ব ৩

ফাঁদের অন্তরালে পর্ব ৩
লেখকঃ আবীর হোসেন।

ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আয়ান ও মারিয়া বিবস্ত্র অবস্থায় একে অপরকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে একটা বিছানায়। অর্ধনগ্ন বলা চলে কারণ দুজনেরই শরীর কোমর পর্যন্ত পাতলা কম্বলে ঢাকা।
মজনু ভ্রু কুঁচকে আয়ানকে বললো– ছিঃ তোর ব্যক্তিত্ব এতটা জঘন্য আগে বুঝিনি, তুই বন্ধু নামের কলঙ্ক আয়ান। এক মেয়ের পেটে তোর সন্তান আর অন্য মেয়ের সাথে এসব নোংরামো। সাদা চামড়া দেখলে আর কন্ট্রোলে থাকা যায়না তাইনা?

আয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো– দেখলি এবার, তুই আমার সবথেকে ভালো বন্ধু হয়েও আমাকে বিশ্বাস করতে পারলি না। এই ছবি দেখে অন্যরা কীভাবে বিশ্বাস করবে তুই বল।
মজনু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো– হাহ, তার মানে তুই বলতে চাচ্ছিস ছবিতে ওটা তুই না, তোর ফটোকপি। মানে একদম হুবহু শতভাগ তোর মতো দেখতে অন্য কেউ? যদি তাই হয় তবে গাড়ি এক্সিডেন্ট করে কাপালের সেই কাটা দাগটাও হুবহু মিলে যাচ্ছে কেন ছবির সাথে?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

– মজনু ওটা আমিই– বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেবিলের ওপর রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে এক চুমুকে পুরোটা খেয়ে আয়ান আবার বললো– ওটা আমিই মজনু, তবে সজ্ঞানে নয়। কীভাবে কি হয়েছে তা-ও আমি জানিনা। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে গভীর ভাবে। আমি আমার জন্মদাতা বাবা এবং জন্মদাত্রী মায়ের কসম করে বলছি সজ্ঞানে আমি কিছু করিনি এবং আমার কোনকিছু মনে নেই।

মজনুর কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো। যদি এমনই হয় তাহলে সত্যিই আয়ানকে খুব খারাপ ভাবে ফাঁসানো হয়েছে।
– আচ্ছা ঐদিন সন্ধ্যায় তুই কোথায় গছিয়েছিলি মনে কর তো– মজনু বললো।
আয়ান বললো– অফিস টাইম শেষে আমি মাই-মোমেন্ট কফিশপে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে রাত আটটার দিকে গিয়েছিলাম পার্টি-টাইম নাইট ক্লাবে।
– তারপর ওখানে গিয়ে কি ঘটলো– মজনু জিজ্ঞেস করলো।

আয়ান বললো– আমি বিয়ারের অর্ডার করি এবং বসে বসে একজন ক্লায়েন্টকে একটা বিজনেস মেইল পাঠাই। এরপর হঠাৎ দেখি আমি যে টেবিলে বসা তার অপর প্রান্তে হাসিমুখে বসে আছে মারিয়া। আমি অবাক হয়ে বললাম মারিয়া তুমি এখানে? মারিয়া হেসে জবাব দেয়– কেন আমার এখানে আসতে বারণ নাকি মিস্টার আয়ান।
– তারপর তারপর – কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে মজনু।
আয়ান বলে– টেবিলে বিয়ারের বোতল রেখে যাওয়া হয়, এরপর আমরা দুজনেই বিয়ার পান করতে করতে গল্পগুজবে মেতে উঠি।

– তারপর– মজনু জিজ্ঞেস করলো।
আয়ান বললো– তারপর আর কিছু মনে নেই। তারপর সকালে সকালে ওসব ছবি দেখিয়ে মারিয়া আমাকে বলে আমি নাকি মাতাল হয়ে ওকে নিয়ে কোন একটা হোটেলে গিয়ে রাতভর ওর দেহ ভোগ করেছি। তারপর বলে অবনীকে ছেড়ে দিয়ে ওকে বিয়ে না করলে এসব ছবি ভাইরাল করে দিবে, কেস মামলা করে আমার ক্যারিয়ার বরবাদ করবে এই আরকি।
মজনু জিজ্ঞেস করলো– আচ্ছা দুজনে কি একই বোতলের বিয়ার পান করেছিলি নাকি আলাদা আলাদা?

– উম! আলাদা আলাদা সম্ভবত, সঠিক খেয়াল নেই মজনু– আয়ান বললো।
আয়ানের ফোনে কল বেজে ওঠে, ফোন তুলে মারিয়া কল দিয়েছে দেখে আয়ান মজনুকে বললো– দোস্ত এবার উঠতে হবে, নয়তো বুঝিসই তো।

– ওকে তাহলে আমিও উঠি আজকের মতো– বলে মজনু উঠে দাড়িয়ে আয়ানের কাঁধে চাপড় দিয়ে আবার বললো– সাবধানে থাকিস, আর আমি আছি তো দেখবি আমরা মিলেমিশে ঠিক একটা না একটা সমাধান খুঁজে বের করবোই।
মজনু ও আয়ান একত্রে লিফটে চড়ে নিচে নেমে এসে মজনু চলে গেল, আয়ান এসে গাড়িতে বসলো।
ড্রাইভিং সিটে মারিয়া বসা এবং তার পাশের সিটে আয়ান বসলো। মারিয়া মুচকি হেসে বললো– আয়ান আজকে আমি তোমাকে শহরের বাইরে নিরিবিলি নিরজন এলাকায় ঘুরতে নিয়ে যাবো।
গাড়ি চলতে শুরু করলো, গিয়ার চেঞ্জ করে গাড়ির গতি আরও বাড়ালো মারিয়া। সাই-সাই করে ছুটে চলছে গাড়ি ব্যস্ত শহর পেছনে ফেলে নীরব পথের দিকে।

আয়ান মনমরা হয়ে আছে দেখে মারিয়া বললো– আয়ান তোমার মনমরা হবার কারণ হয়তো এতক্ষণে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে, তোমার তো হ্যাপি ফিল করার কথা তবু কেন মনমরা?
মারিয়ার কথায় বড়সড় একটা ধাক্কা খেল আয়ান, অবাক হয়ে বললো– মানে? কি বলছো তুমি মারিয়া?!
মারিয়া বললো– তুমি তো কোনভাবেই চেষ্টা করে অবনীকে তোমার জীবন থেকে সরাতে পারলে না। তাই তোমার কাজটা সহজ করতে আমিও অবনীকে সরানোর ব্যবস্থা করেছি চিরতরে।
আয়ানের সমস্ত শরীর যেন শীতল হয়ে গেল মুহূর্তে, পৃথিবীটা যেন থমকে গেছে এখানেই। গাড়ি থামাও বলে চিৎকার করলো আয়ান।

মারিয়া কষে ব্রেক চাপতেই গাড়ি থেকে গেল। বিদ্যুৎ গতিতে গাড়ি থেকে নামলো আয়ান। মারিয়াও নামলো।
ঘুরে এসে মারিয়ার গালে কষে থাপ্পড় মেরে মারিয়ার গলা চেপে ধরে আয়ান বললো– কেন আমার জীবন বরবাদ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছো, কেন কিসের লোভে? একটা মেয়ে হয়ে একটা গর্ভবতী মেয়ের জীবন নিয়ে খেলতে একটুও বুক কাঁপেনি তোমার? তুমি নারী জাতির কলঙ্ক। বলো কোথায় আমার অবনী বলো এক্ষুনি।
কথা শেষে মারিয়ার গলা ছেড়ে দিতেই মারিয়া নিচে বসে পড়ে নিশ্বাস নিয়ে ভাঙা গলায় বললো– কোথায় আছে তা-ও জানিনা, হয়তো এতক্ষণে ওরা অবনীকে মেরে ফেলেছে।

– ওরা! ওরা কারা– আয়ান জিজ্ঞেস করলো।
মারিয়া বললো– যাদেরকে কন্ট্রাক্ট দেয়া হয়েছে অবনীকে হ*ত্যা করার।
মারিয়ার কথা শুনে আয়ানের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। দুই হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে রাস্তায় বসে পড়ে আয়ান বললো– কেন এমনটা করলে তুমি কিসের লোভে, তোমাকে কোম্পানিতে ভালো পোস্টে ভালো বেতনের জব দিলাম, তোমার জন্য এতকিছু করার পরেও কেন এমন করলে তুমি মারিয়া।

তুমি তো আমার পূর্বপরিচিত ছিলেনা, কখনও কোনদিন তোমার কোনো ক্ষতি করেছি বলে তো মনে হয়না, তাহলে তুমি কেন আমার জীবনটা এভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছো বলো। বলো আমার জীবনের সবকিছু স্বাভাবিক করে ফিরিয়ে দিতে কি চাই তোমার, কত টাকা চাই বলো?
মারিয়া কান্না জড়িত কন্ঠে বললো– এসব আমিও ইচ্ছে করে করিনি আয়ান, আমাকেও কেউ বাধ্য করেছে এসব করতে।
– মানে?– অবাক হয়ে আয়ান বললো।

মারিয়া আবার বলতে লাগলো– আয়ান দিন শেষে ঐ ভালোবাসা বিষয়টির কাছেই আমরা দূর্বল। জানো টাকাপয়সা অর্থ-সম্পত্তি সবকিছু এই ভালোবাসার কাছে দূর্বল। আবার টাকা পয়সা ছাড়া জীবন অচল। মানুষ ভালোবাসার জন্য নিজের জীবন যেখানে বিসর্জন দিতে পারে, তেমন জীবন নিতেও পারে। ভালোবাসা সুন্দর ও পবিত্র আয়ান কিন্তু ততক্ষণ, যতক্ষণ ভালোবাসা শুধু ভালোবাসাই থাকে।

আর ভালোবাসার মধ্যে যখন স্বার্থ ও লোভ লালসা ঢুকে পড়ে তখন ভালোবাসা মারাত্মক ভয়ংকর হয়ে ওঠে। চাঁদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা আজন্মকালের, তাকে ধরতে ছুঁতে পারবোনা জেনেও তাকে আমরা ভালোবাসি। কারণ এটাই আমার জানি যে তাকে ধরা ছোঁয়া যাবেনা কোনদিন, তাই ধরা ছোঁয়ার আকাঙ্খা বাদ দিয়েই আমরা তাকে আমৃত্যু ভালোবাসি। কিন্তু নর নারীর ভালোবাসায় থাকে প্রাপ্তির আকাঙ্খা, নিজের করে পাবার তীব্র বাসনা।

আর তাকে পেতে গিয়ে আমরা সবকিছু করতে পারি। ভালোবাসার মানুষকে পাবার তীব্র বাসনায় মত্ত হয়ে আমার ভুলে যাই কোনটা সঠিক, কোনটা বেঠিক। ঐ একজনকে পাবার জন্য আমরা ছেড়ে যায় রক্তের বাঁধন। আর তোমার এই সর্বনাশের কারণও আমার ভালোবাসা। এতদিনে আমি বুঝতে পেরেছি সে আসলে আমায় কতটুকু ভালোবাসে, সে কেবলমাত্র তার স্বার্থ হাসিল করার জন্য আমাকে লোভ দেখিয়ে এতগুলো জীবন নষ্ট করার নির্মম খেলায় মেতেছে আয়ান। আমি সত্যি লজ্জিত। আমি চাইনা এমন ভালোবাসা। এক মরণ ফাঁদে ফাঁসানো হয়েছে আমাদের, আর এবার আমি বলছি তোমাকে কে আছে সেই ফাঁদের অন্তরালে।

ফাঁদের অন্তরালে পর্ব ২

– সে কে শুধু একবার বলো মারিয়া– বললো আয়ান।
চোখের জল মুছে মারিয়া নামটা বলবে ঠিক এমন সময় একটা গু*লি এসে মারিয়ার বুকের ডানপাশে লাগে। মারিয়া লুটিয়ে পড়লো রাস্তায়…

ফাঁদের অন্তরালে পর্ব ৪