ফেরারি প্রেম পর্ব ১৫

ফেরারি প্রেম পর্ব ১৫
নিশাত জাহান নিশি

“সুহাসিনী আর নেই! আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমি আসতে বড্ড দেরী করে ফেলেছি যে।”
হাত-পা ছুড়ে নীহারিকা কান্নায় ভেঙে পড়ল। উদ্ভ্রান্তের মত চ্যাচিয়ে বলল,
“সে ইচ্ছে করে আপনাকে ছেড়ে যায়নি রূপল। কেউ তাকে বাধ্য করেছে যাওয়ার জন্য!”
মুহূর্তেই যেন শোকাহত অবস্থা থেকে সক্রিয় হয়ে উঠল রূপল! বসা থেকে ফট করে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। চোখের কোটর থেকে অবলীলায় গড়িয়ে পড়া জল গুলোকে হাতের উল্টেপিঠ দ্বারা মুছে নিলো। নীহারিকার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে শুকনো গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“হোয়াট? কী বলতে চাইছেন আপনি?”
এরই মধ্যে নীহারিকার কান্নাকাটির আওয়াজে এনজিওর প্রতিটি সদস্য হন্ন হয়ে দৌঁড়ে এলো সুহাসিনীর রুমে! ঘটনাচক্রে উপস্থিত হয়ে তারা তাজ্জব বনে গেল। সুহাসিনীর হঠাৎ মৃত্যু তারা কিছুতেই মানতে পারলনা! বিশেষ করে মিস চারুলতা সেন! সকালেও তিনি সুহাসিনীকে ফিট এন্ড ফাইন দেখে গেছেন। কিছুক্ষণ আগে অবধিও সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। তাহলে হঠাৎয়ের মধ্যে কীভাবে এত বড়ো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে? তবে কী উপর ওয়ালা সুহাসিনীর কপালে এভাবেই মৃত্যু লিখে রেখেছিলেন? পাথর রূপ ধারণ করলেন চারুলতা সেন। দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। জ্ঞান হারাতে বোধ হয় বেশী সময় লাগবেনা তার!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সুহাসিনীর মৃত্যুর খবরটা এতক্ষণে সবিতা অবধিও পৌঁছে গেল। রান্নাবান্না ফেলে রেখে সে ছোট্টো হৃদিকে নিয়ে ছুটে এলো মৃত সুহাসিনীর কাছে। সুহাসিনীর মরা মুখটা এক ঝলক দেখা মাত্রই সবিতা পুরো এনজিওটা তুলে ফেলল কাঁদতে কাঁদতে! দিশেহারা হয়ে গেল সে। এসবের মাঝে রূপলও আবার শোকে তলিয়ে গেল। নীহারিকাও সুযোগ খুঁজে পেলনা তার মনের শঙ্কাটা রূপলের কাছে খুলে বলার! তবুও মনের সন্দেহ থেকে রূপল সুহাসিনীকে ট্রিটমেন্ট করা ডক্টরকে ডেকে আনল। ডক্টরও সুহাসিনীকে মৃত ঘোষণা করল! দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি রূপল এবং সবিতাকে শান্তনা দিয়ে বললেন,

“দেখো, তোমরা কেঁদো না। আজ না হয় কাল তো তাকে যেতেই হতো। সারাদেহ আগুনে ঝলসে গিয়েছিল তার! এসব রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। শতকরা একশ ভাগের মধ্যে বিশ ভাগ। তোমরা বরং এটা ভেবে শুকরিয়া আদায় করো যে এতটা বিভৎসভাবে পুড়ে যাওয়ার পরেও সে ছয়টা মাস সময় পেয়েছে বেঁচে থাকার জন্য! তোমাদের জন্য এই খবরটা সুখের হলেও সুহাসিনীর জন্য তা খুবই যন্ত্রণার ছিল! কারণ, এভাবে কষ্ট পেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে বরং মরে যাওয়াই দ্বিগুন ভালো! শুধু নামাজ পড়ে তার জন্য দোয়া করো আল্লাহ্ যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন। বেঁচে থেকে তো কম কষ্ট পেলনা মেয়েটা।”

বিষণ্ন মন নিয়ে ডক্টর জায়গা ত্যাগ করলেন। বিষাদে ভরপুর শিথিল দুটি চোখে রূপল কেবল একদৃষ্টিতে সুহাসিনীর দিকে তাকিয়ে রইল। নিথর দেহতে প্রাণের সঞ্চার খুঁজছিল সে! সুহাসিনীর কালসিটে এবং কুঁচকে যাওয়া মুখটি থেকে যেন নূরের জ্যোতি ঠিকরে পরছিল! সেই জ্যোতি রূপলের চোখ দুটিকে শান্ত করে তুলছিল। সবিতা বুক চাপড়ে কাঁদছে। আর্তনাদ করে বলছে,

“কেন আমাকে একা রেখে চলে গেলি বোন? এই পৃথিবীতে তো তুই ছাড়া আমার আপন কেউ ছিলনা! এত এত খারাপ মানুষদের ভীড়ে তুই আমাকে একলা রেখে চলে গেলি বোন?”
চোখে জল নিয়ে ছোট্টো হৃদি রূপলের হাত ধরে দাঁড়ালো! অবুঝ মন নিয়ে সে রূপলের নিবিড় দু’চোখে ভরাট দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“বাবা বাবা? সুহা মা কথা বলছেনা কেন? আমার মা তো অনেকক্ষণ ধরে সুহা মাকে ডাকছে। কেন কোনো জবাব দিচ্ছেনা মা?”

সুহাসিনীর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রূপল ছোট্টো হৃদির দিকে তাকালো। হৃদির মাথায় হাত বুলিয়ে সে আ’হ’ত গলায় বলল,
“তোমার সুহা মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে হৃদু। তাই আর কথা বলছেনা!”
“কোথায় চলে গেল মা?”
“আল্লাহ্’র কাছে।”
কান্নার মাঝেও ফিক করে হেসে দিলো হৃদি! খুশি হয়ে সে উদ্বেলিত গলায় বলল,

“এটা তো খুব ভালো জায়গা বাবা। চলো আমরাও তবে আল্লাহ’র কাছে যাই। ওখানে যাওয়া তো খুব ভালো কাজ।”
হৃদিকে ফেইস করতে মোটেও ভালো লাগছিলনা রূপলের! ছন্নছাড়া হয়ে সে সুহাসিনীর রুম থেকে বের হয়ে গেল। বারান্দায় এসে সে হাঁটু ভাজ করে বসে পড়ল! ভেতরের অসহ্য যন্ত্রণাটা সে আর চেপে রাখতে পারলনা। মৃদু আর্তনাদ করে বলল,

“কেন সুহাসিনী কেন? মৃত্যুর আগেও তুমি কেন আমাকে তোমার পাশে থাকলে দিলেনা? কেন আমাকে বার বার কোনো না কোনো অজুহাতে থামিয়ে দিতে? কেন আমাকে বাধ্য করতে তোমার থেকে দূরে থাকতে? আমার জীবনটাকে নষ্ট করে দিয়ে গেলে তুমি! বেঁচে থাকতেও তুমি আমাকে শান্তি দাওনি। মরে গিয়েও আমার জীবনটাকে নরক করে দিয়ে গেল! বেঁচে থাকতে তবুও তো একটা শান্তনা ছিল যে তুমি আছো। আজ না হয় কাল তুমি আমার হবে। কিন্তু এখন? এখন আমি নিজেকে কীভাবে শান্তনা দিব? কীভাবে নিজের মনকে সামলে রাখব? আমি যে আর পারছিনা সুহাসিনী। কিছুতেই নিজেকে সামলে রাখতে পারছিনা।”

দূর থেকে চুপটি করে দাঁড়িয়ে নীহারিকা সব শুনছিল! তার চোখেও অবাধ্য জলের ছড়াছড়ি। কী থেকে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারলনা সে। মন থেকে সেও তো চেয়েছিল রূপল আর সুহাসিনীর বিয়েটা হোক। দুটি মন এক হয়ে যাক। কিন্তু হঠাৎ করে যে এতকিছু হয়ে যাবে ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি সে। ভীরু পায়ে হেঁটে নীহারিকা রূপলের পেছনে এসে দাড়ালো। ভরাট গলায় রূপলকে ডেকে বলল,

“শান্ত হোন রূপল প্লিজ। সুহাসিনীর দাফন কাফনের ব্যবস্থা করুন। মৃত্যুর পর বেশিক্ষণ মৃত ব্যক্তিকে ফেলে রাখতে নেই।”
“আমি পারবনা নীহারিকা! সুহাসিনীকে আমি অন্ধকার কবরে রেখে আসতে পারবনা! আমার ভেতরটা যে ফেটে যাচ্ছে। আমি এই যন্ত্রণা কাউকে বুঝাতে পারছিনা।”
মনে খচখচানি নিয়ে নীহারিকা সন্দেহজনক গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“আচ্ছা? সুহাসিনীর মৃত্যুটা কী আপনার স্বাভাবিক মনে হচ্ছে?”

“ডক্টর তো অস্বাভাবিক কিছু বললেন না! তবে সাফোয়ানকে আমি ছাড়বনা! তার জন্যই তো আজ আমার সুহাসিনীর এই অবস্থা হলো। এতদিন সুহািসনী মুখ খুলে সত্যিটা না বললেও এবার তার মৃত্যুর জন্য আমি সাফোয়ানকেই দায়ী করব! আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড না দিলেও আমি নিজ হাতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিব।”
“আচ্ছা আমরা এই বিষয়ে পরে কথা বলব। এখন প্লিজ সুহাসিনীর দাফন কাফনের ব্যবস্থা করুন। আপনি ছাড়া সুহাসিনীর আর কে আছে বলুন?”

ক্ষণিকের জন্য মন শক্ত করে ওঠে দাড়ালো রূপল। সন্ধ্যার মধ্যেই সুহাসিনীর দাফনের ব্যবস্থা করা হলো। পাশাপাশি রূপল পুলিশ প্রশাসনকেও নিয়ে এলো কবরস্থানে! আগুনে পুড়ে যাওয়ার কারণে যে সুহাসিনীর মৃত্যু হয়েছে তা পুলিশকে সরাসরি ঘটনাচক্রে এনে দেখালে। সাফোয়ানের বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করল। তবে হয়রানের ব্যাপার হলো সাফোয়ানকে গতকাল রাত থেকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা! সে পুরে নিঁখোজ! হুট করে সে কোথায় গেল, কেন গেল তার কিছুই জানেনা সবিতা। সাফোয়ান কখনও তাকে জানিয়ে কোথাও যায়নি। তাই এই বিষয়ে তার বিশেষ কিছু জানা নেই। নিখোঁজ সাফোয়ানকে খুঁজতে বেরিয়ে গেল পুলিশ ফোর্স। তাকে পেলেই ডিরেক্টলি রিমান্ডে নিয়ে যাবে!

সুহাসিনীর দাফন কাফন সম্পন্ন হওয়ার তিন/ চার ঘণ্টা হয়ে যাওয়ার পরেও রূপলকে সুহাসিনীর কবরের পাশ থেকে টেনে আনা যাচ্ছিলনা! কবরের পাশে বসে সে কেবল চোখের জল ফেলছিল। কাঁদা, মাটি লেগে সাদা পাঞ্জাবিটা নোংরা হয়ে যাচ্ছিল। রূপলের মা-বাবা অধৈর্য্য হয়ে পরছিল রূপলের আচরণে! সবিতা তো প্রায় অজ্ঞানই হয়ে যাচ্ছিল। তাদের এই করুন অবস্থা দেখে নীহারিকা ও কেঁদে ভাসাচ্ছিল। কান্নারত রূপলের পাশে বসে সে ভরাট গলায় রূপলকে বলল,

“রূপল প্লিজ চলে আসুন। সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”
পাথর গলায় রূপল বলল,
“অন্ধকারে সুহাসিনী ভয় পায়! প্লিজ আপনারা যান।”
“এখন থেকে সুহাসিনীকে অন্ধকারেই থাকতে হবে রূপল! আপনি নিশ্চয়ই রোজ রোজ এসে সুহাসিনীকে পাহারা দিবেন না?”

“দিব! প্রয়োজনে এখানেই আমার বাসস্থান তৈরী করব।”
“খামোখা সময় নষ্ট করবেন। কবরের উপরে থেকে কবরের নিচের পরিবেশ জানা যায়না।”
ক্ষেপে গেল রূপল! রাগী দৃষ্টিতে সে নীহারিকার দিকে তাকালো। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
“আপনাকে আমার বিরক্ত লাগছে। প্লিজ এখান থেকে যান!”

ভয় পেয়ে গেল নীহারিকা। সঙ্গে সঙ্গেই সে রূপলের পাশ থেকে ওঠে দাড়ালো। রূপলকে একা রেখেই রূপলের মা-বাবা এবং নীহারিকা জায়গা ত্যাগ করতে বাধ্য হলো! শোকে পাথর হয়ে যাওয়া সবিতাকে কিছুতেই যেন মানাতে পারছিলেন না চারুলতা সেন। বাড়ি ফিরে সবিতার অবস্থা যেন পূর্বের তুলনায় আরও খারাপ হয়ে গেল। হৃদির যত্ন নেওয়ার কথাও সে ভুলে গেল!

মধ্যরাত তিনটে কী চারটে তখন। বিছানায় শুয়ে ঘুমের অভাবে কাতরাচ্ছিল নীহারিকা। মাথাটা যেন ব্যথায় ফেটে যাচ্ছিল তার। পানির তেষ্টাও পেয়ে গেল জোরে। মাথায় যন্ত্রণা নিয়ে সে রুম থেকে বের হলো। উদ্দেশ্য রান্নাঘরে গিয়ে পানি খেয়ে আসবে। যেহেতু রূপলদের বাড়িতে সে আজকের রাতটা থাকবে সেহেতু রুমে তার আলাদা করে পানি আনা হয়নি। দরজা খুলে নীহারিকা যেইনা সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হলো অমনি করিডরে থাকা লাইটের আলোয় দেখতে পেল রূপল এবং একজন অপরিচিত ভদ্রলোককে! যাকে নীহারিকা এর আগে কখনও দেখেনি। তবে ভদ্রলোকটি বিধ্বস্ত রূপলকে কিছু বুঝিয়ে শুনিয়ে তার ঘরের দিকে নিয়ে আসছিল।

ফেরারি প্রেম পর্ব ১৪

লোকটির মাথায় আলাদা করে একটি কালো ক্যাপ রয়েছে। ক্যাপটি দেখে নীহারিকা কেমন যেন ভাবনায় ডুবে গেল! ক্যাপটি তার পরিচিত মনে হলো। ঘণ্টা খানিক আগেও সে ক্যাপটি কোথাও দেখেছে। তবে মনে পরছেনা কোথায় দেখেছে! হয়ত সুহাসিনীর দাফনের সময় লোকটি কোথাও ছিল তাই মানুষের চেয়ে ক্যাপটিকে তার বেশি পরিচিত মনে হলো!

ফেরারি প্রেম পর্ব ১৬