ফেরারি প্রেম পর্ব ৪৪

ফেরারি প্রেম পর্ব ৪৪
নিশাত জাহান নিশি

“বি কুল নীহু। আমি থাকতে কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা। প্লিজ ট্রাস্ট মি।”
রূপলের বিশ্বস্ত ও শিথিল দু-চোখের দিকে তাকিয়ে নীহারিকা হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে রূপলের বুকে এসে লুটিয়ে পরল! এই মুহূর্তে পিয়াসা, মারজিনা বেগম ও আফজাল হকও ছুটে এলেন নীহারিকার রুমে।

রূপলের বুকে শায়িত অবস্থায় নীহারিকাকে দেখা মাত্রই ফট করে পিয়াসার মাথাটা গরম হয়ে গেল! আগ্রাসী দৃৃষ্টিতে সে পেছন থেকে রূপলের দিকে তাকালো। পরিস্থিতি খারাপের দিকে অগ্রসর হচ্ছে ভেবে নিহাল ঝট করে রূপলের বুক থেকে নীহারিকাকে টেনে এনে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো! পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল! নিহাল যে বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিবে। পিয়াসা ঠিক এই জিনিসটাকেই অস্বাভাবিক ভাবে নিবে তা নতুন করে জানার কিছু নয়। হাঁটু মুড়ে নিহাল ফ্লোরে বসল। উদ্বিগ্ন হয়ে সে জ্ঞানশূণ্য নীহারিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কী থেকে কী হয়ে গেল বোন? আমার মাথায় তো কিছুই কাজ করছেনা।”
নীহারিকার এই শোচনীয় অবস্থা দেখে মারজিনা বেগম এবার কান্না জুড়ে দিলেন। ছুটে এসে তিনি নীহারিকার পাশে বসলেন। আফজাল হকের দিকে তাকিয়ে তিনি আহাজারি গলায় বললেন,
“কী হলো মেয়েটার? প্লিজ তুমি এক্ষণি ডক্টর ডেকে আনো। সন্ধ্যার পর থেকেই আমার মেয়েটা কেমন করছে।”
আফজাল হক এবার মরিয়া হয়ে উঠলেন কল করে ডক্টরকে বাড়িতে ডেকে আনতে। তখনি রূপল আফজাল হককে থামিয়ে দিলো! নম্র এবং সুস্থির গলায় আফজাল হককে বুঝিয়ে বলল,

“আঙ্কেল প্লিজ এখন কোনো ডক্টর ডাকার প্রয়োজন নেই। কাল না হয় জিজু একবার সময় করে নীহারিকাকে নিয়ে মেডিকেলে যাবে। আমার মনে হচ্ছে না বাড়ির ডক্টর এই মুহূর্তে নীহারিকার কোনো ভালো চিকিৎসা করতে পারবে বলে।”
নিহালও তখন রূপলের কথায় একমত পোষণ করল। চিন্তিত গলায় সে তার বাবাকে বলল,

“হ্যাঁ বাবা। রূপল ভুল কিছু বলেনি। আমার মনে হচ্ছেনা এই বিষয়টা খুব নরমাল। সিরিয়াস কিছু মনে হচ্ছে! সন্ধ্যার পর থেকেই আমি নীহারিকার হাবভাব নোটিশ করছিলাম। কাল অফিস মিস করে হলেও আমি বোনকে নিয়ে মেডিকেলে যাব। প্রয়োজনে রূপলও আমাদের সাথে যাবে। কী রূপল? কাল সময় দিতে পারবে তো আমাকে?”

“অভেয়সলি জিজু। হোয়াই নট? হসপিটালে পৌঁছে একটা কল করবেন জাস্ট। আমি হাজির হয়ে যাব।”
রূপলের ভালো মানুষি পিয়াসার একদমই পছন্দ হচ্ছেনা! রাগে রি রি করছে সে। আর সুযোগ খুঁজছে কখন সে রূপলকে একান্তে পাবে! অজ্ঞান হয়ে থাকা নীহারিকার দিকে একবার ধীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রূপল জায়গা থেকে ওঠে গেল। এবং জোরপূর্বক হেসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আচ্ছা আমি এখন আসছি তাহলে। নীহারিকাকে এই মুহূর্তে ডাকার কোনো প্রয়োজন নেই। তাকে বরং ঘুমুতে দিন। আর অবশ্যই তার যত্ন নিবেন।”
ভরাট গলায় তখনি মারজিনা বেগম রূপলকে কৃতজ্ঞতার স্বরে ডেকে বললেন,
“রূপল বাবা। তোমাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দিব আমার জানা নেই। তুমি না থাকলে হয়ত আমরা জানতেও পারতাম না যে আমার মেয়েটা একা রুমে থেকে এতটা কষ্ট পাচ্ছে।”

“এখানে তো আপনাদের কোনো দোষ নেই আন্টি। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে আমরা রাতটাই তো সময় পাই একটু ঘুমানোর জন্য। এই সময়ে গভীর ঘুমে থাকাটাই স্বাভাবিক। বাই দ্যা ওয়ে আন্টি। আমি আসছি।”
প্রস্থান নিলো রূপল। নিহাল পুনরায় রূপলকে পিছু ডেকে বলল,
“হাত থেকে র’ক্ত পরছে রূপল। কা’টা জায়গা গুলোতে ঔষধ লাগিয়ে নিও। আর তোমাকে যে আমি তুমি তুমি করে ডাকি তুমি মাইন্ড করো না তো?”

“আরে না জিজু। বয়সে আমি আপনার ছোটো। নাম ধরে তুমি তুমি করে ডাকতেই পারেন। ইট’স কুল।”
“ওকে। আর যা বললাম হাতে ঔষধ লাগিয়ে নিও।”
মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে রূপল রুম থেকে বের হয়ে গেল। অমনি আগে থেকেই দরজার বাইরে দাড়িয়ে থাকা পিয়াসা রূপলের মুখোমুখি দাড়ালো! বুকের উপর দু-হাত গুজে রূপলকে শাসিয়ে বলল,
“এসব কী ভাইয়া? তুমি এত রাতে এই বাড়িতে কী করছ? আর কেনই বা এলে এই বাড়িতে? নিশ্চয়ই নীহারিকা তোমাকে কল করে এনেছে?”

পিয়াসার গাঁ জ্বলা কথাতেও শান্ত রইল রূপল! বরং ধীর স্থির গলায় সে পিয়াসাকে বুঝিয়ে বলল,
“নীহারিকা নয় বরং আমিই নীহারিকাকে কল করেছিলাম! সেই হিসেবেই জানতে পারা সে ঠিক নেই।”
“কেন কেন? তুমি এত রাতে তুমি নীহারিকাকে কেন কল করতে গেলে?”
“বয়সে তুই আমার ছোটো পিয়াসা। তাই তুই যখন তখন আমার উপর হুটহাট প্রশ্ন তুলতে পারিসনা! যা এখন রুমে যা। ননদের সেবা কর।”

“তুমি কী ভেবেছ ভাইয়া? আমি কিছু বুঝিনা? কেন তুমি নীহারিকার পেছনে এত ঘুরঘুর করছ আমি সব বুঝি!”
“ওকে কী বুঝিস বল? আমিও জানতে চাই কেন আমি তার পেছনে এত ঘুরঘুর করছি!”
“তুমি ঐ মেয়েটার প্রেমে পরে গেছ ভাইয়া! যা তোমার চোখমুখ দেখলেই স্পষ্ট বুঝা যায়! কেন বুঝতে পারো না তুমি ভাইয়া? সে তোমার যোগ্য নয়!”

“ওহ্ রিয়েলি? আমি সত্যিই তার প্রেমে পরে গেছি? তুই না বললে তো বুঝতেই পারতাম না!”
ব্যঙ্গ করে রূপল পিয়াসাকে কথাগুলো বলল। অতঃপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে পিয়াসার দিকে তাকালো। শার্টের হাতা ভাজ করে চোয়াল উঁচিয়ে বলল,

“যতসব ফালতু কথা তোর। যা সামনে থেকে সর। ননদের সেবা কর। সংসারে মন দে।”
হনহনিয়ে রূপল পিয়াসার সামনে থেকে প্রস্থান নিলো। বেকুব হয়ে পিয়াসা রূপলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। মুখটা হা করে সে নির্বোধ গলায় নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল,
“ভাইয়া কী সত্যিই নীহারিকার প্রেমে পরেনি? তবে কী আমিই একটু বেশী বেশী ভাবছি?”

কিছুক্ষণের মধ্যেই রূপল বাড়ি ফিরে গেলো। বাইকের চাবিটা টেবিলের উপর রেখে সে রুমের এসিটা ছেড়ে দিলো। ঘামে ভেজা ক্লান্ত শরীর থেকে শার্টটা খুলে হ্যাঙারে ঝুলিয়ে দিলো। ডান হাত থেকে গড়িয়ে পরা রক্তগুলো সে বাঁ হাত দ্বারা মুছে নিলো। অস্থির হয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসল। চোখ বুজে সে কিছু অমিমাংসিত গভীর ভাবনায় ডুব দিলো। একটু আগের দেখা নীহারিকার সাথে সে অতীতের দেখা নীহারিকার যোগ বিয়োগ করতে লাগল। নীহারিকাকে মোটেও তার স্বাভাবিক মনে হচ্ছেনা। খুবই চুপচাপভাবে কিছু একটা ঘটছে নীহারিকার সাথে। যা কেউ টেরই পাচ্ছেনা।

একে একে আগের কথাগুলো মনে পরতে লাগল রূপলের। সেই স্কুটি থেকে শুরু থেকে ফেইক কল এমনকি আজকের ঘটনাটিও! সব কিছু একসাথে মিলাতে গিয়ে রূপল মহা বিভ্রাটে তলিয়ে গেল। এই সময়টাতে এসে নীহারিকার একটা কথাও তার অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছেনা। তবে নীহারিকার মধ্যে কোনো একটা রহস্য লুকিয়ে আছে! যা ভেদ করতে হলে রূপলকে সরাসরি নীহারিকার মুখোমুখি হতে হবে। হুমকি ধমকি দিয়ে হোক বা বুঝিয়ে শুনিয়ে হোক নীহারিকার কাছ থেকে সত্যিটা জানতে হবে। আর এসব ভাবতে ভাবতেই রূপল সোফার উপর ঘুমিয়ে পরল।

সেই ঘুম ভাঙল তার পরের দিন সকাল ঠিক দশটায়। তাও আবার নিহালের অনেকগুলো কল পেয়ে। ফ্রেশ হয়ে রূপল গাঁয়ে কোনো রকমে একটা শার্ট জড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। সকালের নাশতা করার সময়টাও পেলনা সে। বাইক নিয়ে ছুটল হসপিটালের দিকে।

সময়মতই রূপল হসপিটালে এসে পৌঁছালো। ডক্টরের চেম্বারের সামনে এসে রূপল দেখল ব্লাড টেস্টের জন্য নীহারিকাকে ল্যাবে নেওয়া হচ্ছে। রূপল আসার উপস্থিতি টের পেয়ে নীহারিকা হুট করে পিছু ফিরে তাকালো! যেন তার আগে থেকেই জানা ছিল রূপল আসবে! ঢুলুঢুলু চোখে সে একবার রূপলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকানোর চেষ্টা করল। তবে চোখ দুটো তার মিইয়ে আসছিল। রূপলকে বেশ অস্থির দেখা যাচ্ছে। রূপলের সেই অস্থিরতা নীহারিকার চোখ এড়ালো না। অমনি ডক্টররা নীহারিকাকে ল্যাবে ঢুকিয়ে নিলো। ল্যাবের বাইরে দাড়িয়ে আছে নিহাল। রূপলকে দেখে সে স্বস্তি পেল। দু-কদম এগিয়ে এসে রূপল ব্যস্ত গলায় নিহালের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“কোথায় নিয়ে গেল উনাকে?”
“ব্লাড টেস্টের জন্য।”
“ওহ্। তাহলে আমরা ওয়েট করি।”
“হুম।”

দু-এক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট বের হলো। সেই রিপোর্ট নিয়ে ডক্টরের চেম্বারে রূপল এবং নিহাল ঢুকল। নীহারিকাকে তারা বাইরে রেখে এলো। ডক্টরের সামনে চেয়ার টেনে বসল দুজন। রিপোর্টটা হাতে নিয়ে ডক্টর সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিপোর্টটি কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল। রিপোর্ট থেকে চোখ সরিয়ে তিনি গম্ভীর দৃষ্টিতে নিহাল এবং রূপলের দিকে তাকালেন। ভাবুক গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,
“রোগী কী ড্রাগস নেয়?”

অমনি হতবাক হয়ে রূপল এবং নিহাল ডক্টরের দিকে তাকালো। অস্থির হয়ে নিহাল ডক্টরকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলল,
“মানে? রক্তে কী ড্রাগস পাওয়া গেছে?”
“হুম। তাও আবার খুব হাই পাওয়ারের ড্রাগস। যা মুহূর্তেই একজন মানুষকে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য করে ফেলে। তার মস্তিষ্ককে অটোমেটিকলি কাবু করে ফেলে। তখন কাল্পনিক চিন্তাধারা তার মাথায় ঘুরতে থাকে। দিন কী দিন তাকে ড্রাগস এডিক্টেড করে ফেলে। তখন রোগী নিজেকে মানসিক টর্চার করতে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার তা শারীরিক টর্চারেও পরিণত হয়।”

“কিন্তু আমার বোন তো ড্রাগস নেয়না ডক্টর। আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছিনা।”
অমনি রূপল ইশারায় নিহালকে থামিয়ে দিলো! তাকে চুপ থাকতে বলল। গলা ঝাকিয়ে রূপল শান্ত গলায় ডক্টরকে বলল,
“আচ্ছা ডক্টর। এখন এর থেকে বের হয়ে আসার উপায় কী?”

“ড্রাগস নেওয়া বর্জন করতে হবে। যদিও এই প্রথম বার ড্রাগস নিয়েছে সে! খেয়াল রাখবেন যেন পরবর্তীতে সে আবার ড্রাগস না নেয়। এছাড়াও আমরা একটা ইনজেকশন পুশ করে দিব তাকে। যেন ড্রাগসের প্রভাব তার শরীরে না টিকে।”
“ওকে ডক্টর। আপনি আপনার চিকিৎসা চালিয়ে যান। আমরাও রোগীকে শোধরানোর চেষ্টা করব!”
এই বলে নিহালকে নিয়ে রূপল ডক্টরের চেম্বার থেকে বের হয়ে গেল। নিহাল তো রেগেমেগে ফায়ার! রূঢ় গলায় সে রূপলের দিকে প্রশ্ন তুলে বলল,

“ডক্টরকে তুমি এসব কী বললে রূপল? আমার বোন ড্রাগস নেয়? আর ইউ মেড?”
নিহালের রাগ হওয়ার যুক্তিসম্মত কারণ রূপল বুঝতে পারল। তাই সে নিহালকে শান্ত করার চেষ্টা করল। স্থির গলায় নিহালকে বুঝিয়ে বলল,

“দেখুন জিজু। পরিস্থিতি সামলানোর জন্য অনেক সময় অনেককিছু ছাড় দিতে হয়। কিছু কিছু জায়গায় মিথ্যেও বলতে হয়। কিছু গোপন সত্যি লুকিয়ে রাখতে হয়। অনেক কিছু আবার সঠিক সময়ের হাতে ছেড়েও দিতে হয়। আমি জানি আপনার বোন ড্রাগস নেয়না। তবে কেউ হয়ত তার অজান্তে তাকে ড্রাগস দিয়েছে! তাই এই বিষয়টা আমাদের আগে ক্লিয়ার করতে হবে। এর জন্য আমাদেরকে নীহারিকার মুখোমুখি হতে হবে। এই কয়েকদিনে সে কোথায় গিয়েছে, কার সাথে মিশেছে, কী খেয়েছে সব পার্ট বাই পার্ট আমাদের জানতে হবে। ডক্টরের কাছে তো এতকিছু খুলে বলা যাবেনা। তাই আমি বলেছিলাম আপনাকে বিষয়টা এড়িয়ে যেতে।”

রূপলের উপস্থিত বুদ্ধি মন্দ মনে হলোনা নিহালের কাছে। ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে পরিস্থিতি কন্ট্রোল করার গুন অবশ্যই আছে রূপলের মধ্যে! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নিহাল। রূপলের কথা মেনে নিলো সে। এর মধ্যেই নীহারিকাকে কেবিনে নিয়ে ডক্টর একটি ইনজেকশন পুশ করে দিলো! ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তারা হসপিটাল থেকে বের হয়ে গেল। অফিস থেকে দু-ঘণ্টার জন্য ছুটি নিয়েছিল নিহাল। অফিসের কাজের চাপ ইদানিং বেড়েই চলছে। তাই সে চেয়েও গোটা দিনের জন্য অফিস থেকে ছুটি নিতে পারছেনা। সেজন্য নিহাল রূপলের কাছে নীহারিকার দায়িত্ব দিয়ে তার অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।

দুপুর বারোটা তখন। নদীতে পা ঝুলিয়ে বসে পানি নিয়ে খেলছে নীহারিকা! ঠোঁটের কোণে তার প্রাণোচ্ছ্বল হাসি। বেশ চনমনে দেখাচ্ছে তাকে। নেশাগ্রস্ত ভাবটা প্রায় দূরে হয়ে গেছে। আকাশ তখন মোটামুটি মেঘলা। মনে হচ্ছে খুব জোরে বৃষ্টি নামবে। দমকা হাওয়া উড়িয়ে দিচ্ছে নীহারিকার ওড়নার আঁচল। সেই আঁচল উড়ে এসে রূপলের চোখেমুখে পরছে! উদাসীন হয়ে রূপল পলকহীন দৃষ্টিতে নীহারিকার উচ্ছ্বলতা দেখছে!

নীহারিকাকে দেখতে এখন খুব শান্ত, স্থির এবং চিন্তামুক্ত মনে হচ্ছে। এতদিন পর রূপল খেয়াল করল হাসলে নীহারিকার বাঁ গালে টোল পরে! এতে যেন তার হাসির সৌন্দর্য দ্বিগুন বেড়ে যায়! চোখ দুটোও খারাপ না নীহারিকার। বড়ো বড়ো টানা চোখ। চোখের পাপড়িও ঘন কালো। আলাদাভাবে কাজল না পরলেও চলে! মুখটা তার লম্বাকৃতির হলেও গাল দুটো ফোলকো লুচির মত। যে কারো টেনে দিতে ইচ্ছে করবে।

পানি নিয়ে খেলার সময় এক ছটা জল এসে রূপলের চোখের পাপড়িতে পরল। অমনি রূপল তার ধ্যান ভেঙে নড়েচড়ে স্বাভাবিক হলো। আবার ও সে নীহারিকার দিকে মনোযোগ দিলো। মন মেজাজ বেশ ভালো দেখাচ্ছে নীহারিকার। এখন অনায়াসেই তার ভেতর থেকে কথা বের করা যাবে। মোক্ষম সুযোগ পেয়ে রূপল গলা ঝাকিয়ে নীহারিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। অমনি নীহারিকা হেসে হেসে রূপলের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“নদীটা খুব সুন্দর তাইনা?”
“হুম। ঠিক আপনার মত!”
বেকুব হয়ে নীহারিকা রূপলের দিকে তাকালো! রূপলের মাথা টাথা খারাপ হয়ে না-কী তার বুঝার চেষ্টা করল। নীহারিকাকে আরও একদফা অবাক করে দিয়ে রূপল দুটো সিঁড়ি টপকে এসে নীহারিকা যে সিঁড়িটিতে বসেছে সেই সিঁড়িটিতে বসল। স্থির দৃষ্টিতে সে নীহারিকার দিকে তাকালো। কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
“বাই দ্যা ওয়ে নীহারিকা। গতকাল আপনি টিউশন থেকে কোথায় গিয়েছিলেন?”
কোষভর্তি পানি নিয়ে নীহারিকা অবুঝ দৃষ্টিতে রূপলের দিকে তাকালো। নির্বোধ গলায় শুধালো,

“কোথায় যাব আবার?”
“এইতো কোনো ফ্রেন্ডের বাড়িতে বা কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলেন?”
“না তো। আমিতো কাল টিউশনিও করাই নি। সোজা বাড়িতে ফিরে এসেছিলাম। হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?”
“ডু ইউ নো নীহারিকা? আপনার ব্লাডে ড্রাগস পাওয়া গেছে?”
অমনি অস্থির হয়ে উঠল নীহারিকা! শুকনো মুখে সে রূপলের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ রূপলের দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কাঠ কাঠ গলায় পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,

“হোয়াট? আমার রক্তে ড্রাগস পাওয়া গেছে?”
“হুম। কেউ হয়ত আপনাকে খাবারের সাথে অথবা অন্য কোনোভাবে ড্রাগস দিয়েছে। মনে করার চেষ্টা করুন তো কাল রাতে আপনি কী কী করেছিলেন কিংবা আপনার সাথে কাল কী কী ঘটেছিল।”
কাল রাতের সমস্ত ঘটনা নীহারিকা বেশ মনোযোগ দিয়ে ভাবতে লাগল। কিছুদূর ভাবার পর সে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল। বিস্ফোরিত গলায় বলে উঠল,

“যেই লোকটার সাথে কাল ধাক্কা খেয়েছিলাম সেই লোকটা নয় তো?”
মরিয়া হয়ে উঠল রূপল। নীহারিকার দিকে ঝুঁকে এলো সে। অধীর গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“কোন লোকটা? কার সাথে আপনি ধাক্কা খেয়েছিলেন বলুন?”
“কাল যখন আমি রাস্তায় আনমনা হয়ে হাঁটছিলাম ঠিক তখনি মনে হয়েছিল আমি কারো সাথে ধাক্কা খেয়েছি! শিট আমি তখন লোকটার দিকে ফিরে তাকালাম না কেন?”

সন্দেহের দৃষ্টিতে রূপল নীহারিকার দিকে তাকালো। ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে এলো তার।তৎপর গলায় নীহারিকার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“আপনি কী আমাদের থেকে কোনোকিছু আড়াল করছেন নীহারিকা? আপনি এভাবে চুপচাপ থাকলে কিন্তু সমস্যার কোনো সমাধান হবেনা। নির্ভয়ে আপনি আমাকে সব খুলে বলতে পারেন। আপনি তো ব্রেইভ গার্ল তাইনা? কীসের এত ভয় আপনার?”

রূপলের দু-চোখে নীহারিকা ভরসা খুঁজে পেল। স্নিগ্ধ চোখ জোড়া তার ক্রমশ ভরাট হয়ে এলো। রূপলের আশ্বস্ত দুচোখের দিকে তাকিয়ে সে অভয় পেয়ে বলল,
“আমার মনে হচ্ছে ঐ লোকটা আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে রূপল! সেদিন আমার স্কুটির নিচে যে লোকটি চাপা পরেছিল সেই লোকটি! আমার আরও মনে হচ্ছে এর পেছনে কোনো না কোনো ভাবে সবিতা আপুও জড়িত আছে! আপনি কী এই রহস্য উদঘাটনে আমাকে সাহায্য করবেন রূপল?”

ফেরারি প্রেম পর্ব ৪৩

“হোয়াই নট? আপনি যেমন আমার দুঃসময়ে পাশে ছিলেন, আমি কেন আপনার দুঃসময়ে পাশে থাকব না? থ্যাংকসটা আমি এই সময়ের জন্য হয়ত তুলে রেখেছিলাম! ইকুয়েল ইকুয়েল করব বলে।”

ফেরারি প্রেম পর্ব ৪৫