সূর্যশিশির পর্ব ২৫

সূর্যশিশির পর্ব ২৫
ইলমা বেহরোজ

তীব্র রাগ নিয়ে রুষ্ট নয়নে জেসমিন ঘুরে তাকালেন। ফাইয়াজের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতাপ নিয়ে বললেন, “আমার ইচ্ছে করছে, থাপ্পড় দিয়ে তোমার গাল লাল করে দেই। এটা তোমার কেমন রূপ? কেন তুমি এমন করলে? তুমিতো এমন নও, কীসের বোধ তোমাকে এমন বানাল? রূপা তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তাহলে তাকে এড়িয়ে চলো, এমন ব্যবহারের কারণ কী? আমার শিক্ষা কোথায়? কেউ কতটা ক্লান্ত থাকলে এভাবে ঘুমিয়ে পড়ে তুমি জানো না?”

ফাইয়াজের চোখ বিদ্ধ সেন্টার টেবিলে। সে নিজেও নিজের আচরণে হতবিহ্বল হয়ে গেছে। জেসমিন বললেন, “তুমি রূপাকে সরি বলবে, নয়তো আমি এই বাড়ি ছেড়ে যেখানে ইচ্ছে চলে যাব।”
এবারও ফাইয়াজ প্রতিত্ত্যুরে কিছু বলল না। জেসমিন আক্ষেপের সুরে বললেন, “আমি তোমাকে চিনতে পারছি না ফাইয়াজ! তুমি কী করে কাউকে অকারণে কষ্ট দিতে পারো? তোমার মতো বিজ্ঞ মানুষ এমন কী করে করল?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফাইয়াজ নিশ্চুপ! অপমানে দগ্ধ হয়ে যাওয়া রূপার থতমত মুখশ্রী মানসপটে ভাসছে! রূপা দৈবাৎ চোখ খুলে ফেলায় সে ভড়কে গিয়েছিল। দূর্বলতা প্রকাশের ভয়ে নিজের অজান্তে তার রুঢ় আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
জেসমিন তাচ্ছিল্যের চোখে কতক্ষণ ফাইয়াজকে দেখে ড্রয়িং রুম থেকে প্রস্থান করলেন। ফাইয়াজ ধীর পায়ে রূপা যেখানে ঘুমাচ্ছিল সেখানে গিয়ে বসল। নিজের স্বকীয়তা এভাবে বিসর্জন হয়ে যাচ্ছিল! রূপা কতটা কষ্ট পেল! ফাইয়াজ হাতের দুই আঙুলে কপাল চেপে ধরল।

বন্য ঘোরার মতো রূপাকে নিজের রুমে ছুটে যেতে দেখে সুমনা পিছু নিলেন। রূপা বিছানায় বসে দুই হাতে মুখ ঢাকল। বুকের ভেতরটা অপমানের জ্বালায় জ্বলে যাচ্ছে। সে বার কয়েক ঢোক গিলল। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল।
মনে মনে ভাবল, “মরে যাব তবুও এই লোককে আমি বিয়ে করব না। কখনো না।”
“কী হলো তোর?”

মুখ থেকে হাত সরাতেই রূপার চোখমুখের বিষণ্ণতা সুমনার দৃষ্টিগোচর হয়। তবুও আদর করে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না।
রূপা চুল খোঁপা করতে করতে বলল, “কী হবে?”
“চুল খোলা রেখে এভাবে ছুটে এলি কোথা থেকে?”
সুমনার প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে রূপা বলল, “নয়নের সঙ্গে রুমি যায়নি। নয়ন ওর নানার বাড়িতে।”
“তাহলে কার সঙ্গে গেল?”

“খুঁজতে হবে। যে ছেলেটার সঙ্গে রুমির কিছুদিন আগে পরিচয় হয়েছিল সেই ছেলেটাকে নয়ন চিনে না তবে অনেকবার সাকিব ভাইয়ের জিম সেন্টার নাকি দেখেছে। ওখানে খোঁজ করতে গিয়েছিলাম, গিয়ে দেখি গেইট বন্ধ। কাল আবার যাব।”
“তুই ছেলেটার নাম জানিস?”
“না।”
” তাহলে খুঁজবি কী করে?”
“জানি না, কিন্তু চেষ্টা করব।”
“আচ্ছা, খেতে আয়। খাবার বেড়ে দিচ্ছি।”

এই আহবানে রূপা হাসল। সুমনা দেখেও না দেখার ভান করে জায়গা ত্যাগ করলেন। রূপা ফোন চার্জে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। শৈশব থেকে এই অবধি কত কি হয়ে গেল তার সাথে! সব সহ্য করেছে। আর আজ কি না একজনের কটু কথায় মন খারাপ করছে! রূপা নিজেকে নিজে বুঝাল।
গোসল সেড়ে খেয়েদেয়ে ঘুমাল। দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠল রাত এগারোটায়৷ স্বপ্নে বিশ তলা এক বিল্ডিং থেকে পড়ে যাচ্ছিল সে! রূপা পানি খেয়ে গলা ভেজাল।

উদাস নয়নে জানালার বাহিরে চেয়ে থেকে কত কী ভাবল! যখন অরুনিকার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ না হয় তখন সে খাতায় নিজের মনের কথাগুলো, প্রশ্নগুলো লিখে, নিজে পড়ে, ভেবে তারপর ছিঁড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়।
আজও তাই করতে বসে।
আজ সে লিখল —
রাহাতি জান্নাতের খু’ন যেখানে হয়েছে সেখানে কে ছিল?
এখনো কেন মনে হয় জঙ্গলে আমাকে কেউ দেখছিল?
পাঁচশো টাকার নোট কে ফেরত দিয়ে গেল? ওখানে আর কে ছিল?
সেই মানুষটা কী করে চিনল আমার বাড়ি?
রুমি কার সঙ্গে পালাল? এখন কী অবস্থায় আছে?

ফাইয়াজ স্যার আমাকে পছন্দ করে থাকলে এমন ব্যবহার কেন করল? সেদিন আমার রিয়েক্ট করা কি স্বাভাবিক ছিল না?
অরুনিকার হিরণ মজুমদার কে? কেন বুকের ভেতরটায় এতো অস্থিরবোধ হয়?
রূপা প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর নিজের মতো বানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল, পারল না; ব্যর্থ হলো।
সে ভাবল, “অরুনিকা থাকলে ভালো হতো। ও যেকোনো কিছু নিজের মতো আন্দাজ করে বলে দিয়ে শান্ত করে দিতে পারে। কবে দেখা হবে আবার!”

অরুনিকার শূন্যতায় ভীষণ অসহায়বোধ করে রূপা।
চার্জ থেকে ফোন খুলে বিকেলে কল আসা নাম্বারে কল করে। প্রথম কল না ধরলেও, দ্বিতীয় কলের সময় ওপাশ থেকে বলল, “কে বলছেন?”
রূপা বলল, “হিরণ মজুমদার?”
“জি। আপনি কে?”
“অরুনিকার বন্ধু।”
“ওহ আচ্ছা। বাহিরে আছি আমি, কিছুক্ষণ পর কল করছি।”
“ঠিক আছে।”

রূপা কল কেটে দিয়ে কপাল কুঁচকাল৷ কণ্ঠটা পরিচিত পরিচিত! কথাবার্তা সাবলীল, মার্জিত। অরুনিকার সঙ্গে এই ব্যাপারটা মিলে। বাকি কী কী মিলে সেটাই দেখতে হবে। রূপা ফোন রেখে যখনই উঠতে যাবে, ফোনে টুং করে শব্দ হলো।
সে ফোন নিয়ে দেখল অচেনা নাম্বার থেকে একটা বার্তা এসেছে। বার্তাটি হলো, সরি!
রূপা সঙ্গে সঙ্গে উক্ত নাম্বারে কল করল। ফোনের মালিক কল কেটে দিলো। রূপা পুনরায় কল দিলো, এবার ফোন বন্ধ পেল!

সে আনমনে বিড়বিড় করল, “অদ্ভুত!”
বাহিরে বাতাস হচ্ছে৷ এতো গরমে এই বাতাস মরুভূমিতে হঠাৎ বৃষ্টি আসার মতো। রূপা ছাদের কর্ণারে গিয়ে দাঁড়াল। তার পরনে মেয়েদের ট্রাউজার আর ফতুয়া! অরুনিকা উপহার দিয়েছিল। সব কাপড় ভেজা থাকায় বাধ্য হয়ে পরেছে।
আবার ফোনে বার্তা আসল। এখনের বার্তাটি হলো, সুন্দর!
রূপা দ্রুত কল দিলো, এবারও কল কেটে দিলো। দ্বিতীয় কলে ফোন বন্ধ পেল।
রূপা নাম্বারটিতে মেসেজ দিলো, “আরে ভাই, কে তুমি?”
মিনিটখানেক পর প্রতিত্ত্যুর এলো, “বেয়াদব।”

রূপা লিখল, “সাহস থাকলে কল করুন।”
তাৎক্ষণিক জবাব আসল, “আমার সাহসিকতা সম্পর্কে আমি অবগত। অন্যকে দেখানোর কোনো অভিলাষ নেই।”
“আপনি পুরুষ নাকি মহিলা?”
এরপর আর জবাব এলো না৷ রূপা কল করে নাম্বারটি ব্যস্ত পেল। বেশ কয়েকবার কল করে যখন বুঝতে পারল, তাকে ব্লক করা হয়েছে; তার ওষ্ঠে হাসি ফুটল। অজানা মানুষটিকে চেনার স্পৃহা জাগল চিত্তে।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বাতাস উপভোগ করার পর হিরণ কল করে।
কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলল, “কোথায়, কখন দেখা করতে চান বলুন।”
রূপা বলল, “আগামীকাল সকাল দশটায়, বাসানপুরের লেকে।”
“পৌঁছে যাব।”

সূর্যশিশির পর্ব ২৪

“রাখছি তাহলে।”
রূপা কল কেটে ঠায় দাঁয়িয়ে রইল৷ কণ্ঠটা এতো চেনা!
হিরণ ফোন কেটে মাথা চুলকাতে শুরু করে৷ কার সাথে যেন গলার স্বরটা সাদৃশ্য! কিন্তু কার সাথে তা বুঝতে পারছে না।

সূর্যশিশির পর্ব ২৬