সূর্যশিশির পর্ব ২৬

সূর্যশিশির পর্ব ২৬
ইলমা বেহরোজ

সকাল নয়টা। রূপা তুরন্ত হাতে হোটেলের রান্নাঘর সামলাচ্ছে। দশটায় হিরণের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হবে। বাসানপুরের লেকে যেতে লাগবে পনেরো মিনিট। তাই সে নয়টা চল্লিশে বের হবে।
হোটেলে খরিদ্দারদের উপচে পড়া ভীড়।তিন-চারদিন পর হোটেলের কার্যক্রম শুরু করায় বাজারের মানুষ আগ্রহ নিয়ে হোটেলের ভেতর ঢুকছে। রূপারা সবসময়ই বাজারের আলোচনার মধ্যমণি এখন আবার নতুন গসিপ শুরু হয়েছে।

পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়িয়েছে, এলাকার সবচেয়ে ভদ্র, শান্ত, সুদর্শন পুরুষ ফাইয়াজ বখতিয়ার রূপাকে বিয়ে করতে চেয়েছে কিন্তু রূপার মা ভেবেছিল রুমির জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে৷ এটা নিয়ে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হয়৷ যখন ভুল ভাঙল তখন রুমি অভিমান করে নানারবাড়ি চলে যায়, রূপা বিয়ে করতে অস্বীকার জানায়। এলাকার আনাচে-কানাচেতে এখন এই আলোচনা চলছে। রূপার মতো মেয়ে ফাইয়াজের মতো পুরুষকে প্রত্যাখ্যান করেছে কোন দুঃখে? এ নিয়ে রূপার আফসোস না হলেও সমাজের মানুষের আফসোস করতে করতে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে৷ এসব নিয়ে আলোচনা করতেও অনেকে হোটেলে খেতে আসছে। এতে বারেক বা রূপার ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা যা সত্য তাই বলছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বারেক সঙ্গে এটাও বলেছেন, “আজ না হোক কাল। আমার রূপার ফাইয়াজের সঙ্গেই বিয়ে হবে৷”
রূপা বুঝে না, কোন আত্মবিশ্বাসে বারেক এ কথা বলেছেন! সে রান্না সম্পন্ন করে গামছায় হাত মুছে হাঁফ ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তখনই সুজন রান্নাঘরে চারটা পরোটা নিয়ে এসে বলল, “ওস্তাদ, পরোটার সঙ্গে এক প্লেট গরুর মাংস লাগব।”
“নিয়ে যা।”

“চাচায় কইছে তুমি লইয়া যাইতা। স্পেশাল কাস্টমার।”
সুজন দাঁতকপাটি বের করে হেসে পরোটাগুলো রেখে চলে যায়।
রূপা এতে বিরক্তবোধ করে। ভাবল, “কী এমন কাস্টমার যার জন্য তাকেই প্লেট সাজিয়ে নিয়ে যেতে হবে।”
রূপা যত্ন সহকারে পরোটা ও গরুর মাংস প্লেটে সুন্দর করে সাজিয়ে নিলো। তার পরনে ধূসর রঙের শার্ট, মম জিন্স, মাথায় ক্যাপ। তারপর রান্নাঘর প্রস্থান করে খরিদ্দারদের ভীড়ে এসে বলল, “চারটা পরোটা আর গরুর মাংস কার?”

ভীড় থেকে একজন হাত তুলল। সঙ্গে সঙ্গে রূপা হৃৎস্পন্দন টের পেল৷ মুহূর্তকালের জন্য হলেও সে থমকে গেল। অতঃপর অত্যন্ত শান্তভাবে হেঁটে গিয়ে ফাইয়াজের সামনে প্লেট রাখল। না চাইতেও ফাইয়াজের দিকে তাকাল। ফাইয়াজ তাকিয়েই ছিল৷
রূপা পেশাদার গলায় বলল, “আর কিছু প্রয়োজন?”
ফাইয়াজ পরোটা ছিঁড়ে শান্ত স্বরে বলল, “ঠান্ডা পানি আছে?”
রূপা বলল, “জি আছে। আপনি বসুন আমি নিয়ে আসছি।”

ফাইয়াজের হাত লেগে টিস্যুর বক্স পড়ে যায়৷ রূপা নত হয়ে তোলার সময় খেয়াল করল, ফাইয়াজের ডান পায়ে ছয়টা আঙুল। বক্সটি পুর্নবার টেবিলে রেখে, ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল এনে টেবিলে রাখলে পেছন থেকে একজন মধ্যবয়স্ক চাচা মশকরা করে বললেন, “কি রে রূপা, জামাইরেই খালি ঠান্ডা পানি খাওয়াবি, আমাদেরও দে৷ যে গরমডা পড়ছে!”
রূপার কান ঝাঁঝাঁ করে ওঠল৷ অপ্রস্তুত হয়ে ফাইয়াজের দিকে দৃষ্টি বিদ্ধ করে দেখল, ফাইয়াজের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে মন দিয়ে খাচ্ছে।

রূপা গ্রীবা ঘুরিয়ে কঠিন গলায় বলার চেষ্টা করল, “কে জামাই? কী বলছেন?”
চাচা হেসে বললেন, “ও আল্লাহ! চেতস কেন? আমরা কি কিচ্ছু জানি না?”
রূপা আবার ফাইয়াজকে এক পলক দেখল। ফাইয়াজ পূর্বের অবস্থানেই আছে। রূপা আর কথা বাড়াল না৷ এই ধরনের মানুষগুলো যা চায় বলবেই, আটকানোর চেষ্টা করে লাভ নেই।
সে রান্নাঘর থেকে ফোন নিয়ে এসে বারেককে বলল, “আসছি আব্বা৷ ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এসে যাব। সাইকেল কোথায়?”
বারেক বললেন, “বাসায়৷ সাবধানে যাস।”

রসন ভিলায় এসে সাইকেল নিয়ে বেরোতেই সুমনার হাজারটা প্রশ্নের মুখোমুখি হয় রূপা। কোথায় যাচ্ছিস? কেন যাচ্ছিস? এখন হোটেলে কাস্টমার বেশি থাকবে এখন কীসের বাহিরে যাওয়া — বিভিন্ন প্রশ্ন! রূপা জবাব না দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে। পিছন থেকে সুমনা জুতা ছুঁড়ে মারলেন। রূপা তাৎক্ষণিক হেসে ফেলল। সুমনার জুতা ছোঁড়ার দৃশ্য তার খুব পছন্দের!
বাসানপুর লেকে মানুষের সমাগম। নির্ধারিত ভাড়া দিয়ে নৌকাভ্রমণ সারছে তারা। প্রিয়জন, বন্ধু, স্বজন নিয়ে অনেক নগরবাসী এখানে ঢুঁ মারে। বদ্ধ জলাশয়ে নৌভ্রমণের স্বাদ নেয়। রূপা সাইকেল এক পাশে রেখে গাছের ছায়ায় বসে হিরণের নাম্বারে কল করল, প্রথমে রিসিভ হলো না।

দ্বিতীয় কলে হিরণ রিসিভ করে বলল, “সরি, দেরি করার জন্য৷ আরেকটু অপেক্ষা করুন। পথে আছি।”
রূপা বলল, “আচ্ছা, আসুন। আমি লেকের পাশে অপেক্ষা করছি।”
হিরণ ফোন কেটে বাইকে উঠে বসল। অদ্ভুত কারণে তার যেতে ইচ্ছে করছে না৷ কিন্তু অরুনিকার মন জয় করতে হলে তাকে যেতেই হবে। সেও দেখতে চায়, সেই মেয়ে কে যার জন্য সে সর্বক্ষণ অস্থিরবোধ করছে। হিরণ পাঁচ মিনিটের মাথায় বাসানপুরের লেকে চলে এলো।

চতুর্দিকে তাকিয়ে অনেকগুলো সুন্দর মুখশ্রীর মেয়ে দেখতে পেল।
হিরণ ভাবল, “অরুনিকার বন্ধু নিশ্চয়ই এদের মধ্যেই কেউ হবে৷”
সে কল করল রূপার নাম্বারে।
রূপা কল রিসিভ করে বলল, “এসেছেন?”
“জি। আপনি কোথায় আছেন?”
“লেকের উত্তর দিকে আমি, শিমুল গাছের নিচে।”
“দাঁড়ান, আসছি আমি।”

হিরণ উত্তরে এসে দেখে মানুষে চারপাশ গিজগিজ করছে। বেশিরভাগই যুগল। ছুটির দিন হওয়াতে মানুষ বেশি৷ হিরণ আবার কল করে প্রশ্ন করল, “আপনি কোন রঙের জামা পরেছেন?”
“ধূসর রঙের শার্ট আর জিন্স প্যান্ট। মাথায় সাদা ক্যাপ আছে।”
রোদের কারণে হিরণ চোখ ছোট ছোট করে রেখেছে। তার কপালের চামড়া কুঁচকানো। সে ঘাড় ঘুরিয়ে ডানে তাকাতেই চোখ দুটি রূপাকে দেখে ভস্ম হয়ে গেল। হিরণ স্তব্ধ হয়ে গেল, বাকহারা হয়ে গেল। রূপা হ্যালো, হ্যালো করছে। মাথায় আসমান ভেঙে পড়ার মতো অনুভব করছে সে৷ অরুনিকার বন্ধু রূপা কী করে হয়?

হিরণ অস্থির হয়ে কল কেটে আবার কল দিলো, দেখতে পেল, রূপার ফোনই বাজছে! রূপা তাকাতেই হিরণ শীঘ্রই মানুষের ভীড়ে লুকিয়ে পড়ে। তার মস্তিষ্কে ক্রমাগত হাতুড়ি পিটিয়ে কেউ বলছে, “এটা হতে পারে না! এটা হতে পারে না।”
সে মানুষের ভীড় ঠেলে উল্টোদিকে দৌড়াতে থাকল। বাইক অবধি এসে দ্রুত বাইক নিয়ে চলে গেল বহুদূরে। অরুনিকাকে বিয়ে না করা অবধি রূপার মুখোমুখি হওয়া যাবে না। তাহলে সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে!

রূপা চুল ছেড়ে ফ্লোরে বসে সিগারেট ফুঁকছে। দুশ্চিন্তা বেশি হলেই সে সিগারেটকে সঙ্গী বানায়৷ এই সিগারেটের অভ্যাস কবে, কী করে হয়েছিল সে ভুলে গেছে৷ শুধু জানে, সিগারেট টানায় একটা অদ্ভুত শান্তি আছে৷ হিরণের ফোন হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর রূপা অরুনিকার বাসায় কল করেছিল৷ সৌভাগ্যক্রমে অরুনিকা ফোনের নিকটে ছিল৷ রূপা তাকে জানিয়েছে, হিরণ সম্পর্কে। অরুনিকা বলেছিল, রাতে আপডেট দিবে৷ এখন বাজে রাত নয়টা ত্রিশ৷ কোনো কল এলো না।

এদিকে জেসমিন ও তার স্বামী ইশতেহার এসেছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে৷ বারেক এই সংবাদ পেয়ে হোটেল বন্ধ করে রূপাকে নিয়ে বাড়িতে চলে এসেছেন। তারপর থেকে রূপা নিজের রুমে বসে আছে। নিচ তলায় বিয়ে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে!
পরপর এতকিছু ঘটে যাচ্ছে। রূপা কী করবে, কোনদিকে মন দিবে ঠাওর করতে পারছে না। বাড়ির মেয়ের খবর নেই, কোথায় আছে, কেমন আছে কেউ জানে না। জিম সেন্টারে খোঁজ করেও সেই ছেলের সম্পর্কে কিছু জানতে পারেনি রূপা৷ অন্যদিকে, অরুনিকার হিরণ মজুমদারকে নিয়ে সন্দেহ বেড়েই চলেছে তার। কোনো কিছুর সমাধান হচ্ছে না, শুধু ছটফট করছে আর যা হচ্ছে তা মেনে নিচ্ছে সে।

হঠাৎ সুমনা দরজায় কড়া নেড়ে ডাকলেন, “রূপা?”
রূপা ধড়ফড়িয়ে উঠে দ্রুত জানালার দিয়ে সিগারেট ফেলে দুটো সেন্টারফ্রুট একসঙ্গে মুখে পুরল। দ্রুত চিবিয়ে ধীরেসুস্থে দরজা খুলতেই সুমনা বললেন, “এতক্ষণ লাগে? কী করছিলি?”
রূপা আড়মোড়া ভেঙে বলল, “ঘুমাচ্ছিলাম।”
“নিচে চল৷ তোকে ডাকছে।”

সাধারণত বিয়ের কথাবার্তায় মেয়েরা থ্রিপিস বা শাড়ি পরে, রূপা ক্ষণিকের জন্য ভাবল, তার কী পরা উচিত।
বলল, “আম্মা, আমার কি জামাকাপড় পরিবর্তন করতে হবে?”
সুমনা বললেন, “না। যেভাবে আছিস সেভাবে যেতে বলেছে।”

সুমনার এই বিয়েতে যে আগ্রহ নেই তা পরিষ্কার। সব আগ্রহ বারেকের। রূপা চুল হাত খোঁপা করে নিচে আসল৷ তার কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না৷ ড্রয়িংরুমে পা ফেলে প্রথমে ইশতেহারের মুখ দর্শন করল। এই প্রথম জেসমিনের স্বামীকে সে দেখেছে৷ গম্ভীর চোখমুখের একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ হুইল চেয়ারে বসে আছেন। চেহারার তীক্ষ্ণতা প্রমাণ করে তার ব্যক্তিত্ব কতটা প্রখর।
রূপাকে দেখে ইশতেহার প্রথমে বললেন, “তোমাকে আমি আজ প্রথম দেখলাম৷”
রূপা হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমিও আপনাকে আজ প্রথম দেখেছি।”

জেসমিন গদগদ কণ্ঠে আহবান করলেন, “আসো রূপা, আমার পাশে এসে বসো।”
রূপা জেসমিনের পাশে গিয়ে বসল। অন্যান্য মেয়েদের মতো তার মুখশ্রীতে কোনো উত্তেজনা বা লজ্জা নেই। সে ব্যাপারটাকে খুব শান্তভাবে নিচ্ছে৷ অনেকটা ব্যবসায়িক আলোচনার মতো।
বারেক বললেন, “ফাইয়াজ পাত্র হিসেবে আমার খুব পছন্দের। আমি এবং তোর মা এই প্রস্তাবে রাজি। এখন উনারা তোর সম্মতি চায়। জানিয়ে দে।”

রূপার হ্যাঁ, না একটা উত্তরে নির্ভর করছে তার নতুন জীবন। ফাইয়াজ নামের সেই লোকটা স্যারের খোলস থেকে বেরিয়ে স্বামীরূপে ধরা দিবে! ভেবেই রূপা ভেতরে ভেতরে শিউরে ওঠল। একটা তীক্ষ্ণ অনুভূতি পায়ের পাতা থেকে মাথা অবধি ছুটতে শুরু করল।

জেসমিন বললেন, “তুমি রাজি থাকলে আমরা বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করব। গতকালের ঘটনার জন্য না করো না। ফাইয়াজকে বিয়ে করে তুমি ঠকবে না৷”
গতকাল রূপার রাগ হয়েছিল ঠিক তবে সেটা সকাল হতে হতেই চলে গিয়েছিল। ছোটখাটো ক্ষত ভুলে যাওয়ার অভ্যাস তার আছে৷ তাই বেশিক্ষণ কিছু মনে থাকে না। রূপা বারেকের দিকে তাকাল। তীব্র উচ্ছ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকা প্রাণবন্ত মানুষটার মুখ চুপসে যাক রূপা চায় না।

সে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিতেই যাবে তখনই মনে পড়ল, অরুনিকা তো এ সম্পর্কে জানে না!
জীবনের এতো বড় সিদ্ধান্তে অরুনিকার মত থাকবে না? তা হয় না…কখনোই হয় না।
রূপা চট করে উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে অনুরোধ করে বলল, “ত্রিশ মিনিট সময় দিন প্লিজ। আমি ত্রিশ মিনিটের মধ্যে চলে আসব।”
কেউ কিছু বলার আগে রূপা সাইকেল নিয়ে অরুনিকার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল।

সূর্যশিশির পর্ব ২৫

আজ দারোয়ান বা আজিজুর আংকেল যেই সামনে আসুক সে থামবে না। অরুনিকার সঙ্গে সরাসরি বসে কথা বলবে। বারেক পিছন পিছন চিৎকার করে বাহিরে বেরিয়ে এলেন। ফাইয়াজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। উত্তর কী আসে জানার জন্য পায়চারি করছিল। রূপাকে এভাবে যেতে দেখে আর বারেককে অস্থির হয়ে পিছন থেকে ডাকতে দেখে সে ভাবল, “রূপা কি এবারও আমাকে গ্রহণ করল না? প্রত্যাখ্যান করল?”
ভেবেই ফাইয়াজের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।

সূর্যশিশির পর্ব ২৭