সূর্যশিশির পর্ব ২৪

সূর্যশিশির পর্ব ২৪
ইলমা বেহরোজ

জেসমিন ফ্রেমসহ একটি ছবি নিয়ে এলেন। রূপার হাতে দিয়ে বললেন, “এইযে আমার আম্মা।”
রূপা ফ্রেমটি হাতে নিয়ে দেখল, জামদানি পরিহিতা হাস্যজ্বল কিশোরীর মতো মায়াবী এক প্রাপ্তবয়স্ক নারী ফুল বাগানে দাঁড়িয়ে আছে। তার মায়াবী মুখ, নিখুঁত ঠোঁট, ডাগরডোগর চোখ — সাদাকালো ছবিতেও তার সৌন্দর্য ঠিকরে বের হচ্ছে৷ রূপার রূপ কখনো এই নারীর ধারেকাছেও না। তবে হ্যাঁ, ভ্রু আর কপালের দিকে সাদৃশ্য রয়েছে বটে। রূপা বলল, “ভীষণ সুন্দর।”

জেসমিন হেসে বললেন, “হ্যাঁ, খুব সুন্দর।”
তিনি রূপার হাত থেকে ফ্রেমটি হাতে নিয়ে ছবিতে হাত বুলিয়ে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বললেন, ” আমার যখন আঠারো বছর বয়স তখন আম্মা আমাকে একা করে চলে গেল। ফাইয়াজের বয়স দুই বছর ছিল। আমি নিজের সন্তানের মতো কোলেপিঠে করে ফাইয়াজকে বড় করেছি। বলা হয়নি, আমার আব্বা ফাইয়াজের জন্মের আগে সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন তখন ফাইয়াজ আম্মার পেটে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমরা দুই ভাইবোন মানুষের লাঞ্ছনা – বঞ্চনা সহ্য করেছি, সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি টিকে থাকতে। অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য স্কুল বলো বা কলেজ, ভার্সিটি, সব জায়গায় ফাইয়াজ প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা ভোগ করেছে৷ সেটা প্রেমঘটিত হোক, বন্ধুত্ব বা অন্যকিছু, প্রত্যাখ্যান ছিল ওর প্রতিদিনকার সঙ্গী। “প্রত্যাখ্যান” শব্দটা ওর জন্য ভীষণ বেদনাদায়ক। বিষণ্ণ হয়ে পড়ে, রেগে যায়। সহ্য করতে পারে না।

যদিও দিন পাল্টেছে, এখন সব জায়গায় ফাইয়াজ মুগ্ধতা ছড়িয়ে বেড়ায়। তবুও ওই শব্দটার প্রতি ওর খুব রাগ রয়ে গেছে৷ তুমি ফাইয়াজকে কেন ফিরিয়ে দিয়েছো রূপা? তুমি কি কাউকে ভালোবাসো, তোমার কোনো চাহিদার কমতি আছে ওর মধ্যে? আমাকে বলো।”

জেসমিন এমন কিছু প্রশ্ন করবেন রূপা ভাবেনি৷ সে কিয়ৎক্ষণ অপ্রস্তুত হয়ে চুপ করে রইল। জেসমিন অপেক্ষা করছেন উত্তরের। রূপা বলল, “কাউকে ভালোবাসি না। কখনো কোনো চাহিদা ছিল না আমার। আমি কখনো বিয়ের কথাই ভাবিনি। আর উনাকেও প্রত্যাখ্যান করিনি…শুধু —”

রূপার কণ্ঠ থেমে গেল। জেসমিন আগ্রহ নিয়ে নির্নিমেষ লোচনে চেয়ে আছেন। রূপা বলল, “এতদিন জেনে এসেছি স্যারের সঙ্গে আমার ছোট বোনের বিয়ের কথা চলছে, হুট করে উনি আমাকে আংটি পরিয়ে দিয়ে বললেন, উনি আসলে আমাকে বিয়ে করছেন মানে আমাকে পছন্দ করেছিলেন। এমন অবস্থায় আমার রিয়েক্ট করা কি স্বাভাবিক না? আমি ইচ্ছে করে কষ্ট দেইনি। আমি ওই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। অতীতের কোনো ব্যথায় আঘাত লাগবে জানলে হয়তো অন্যরকম ব্যবহার করতাম।”

রূপা এমনভাবে কৈফিয়ত দিচ্ছে যে জেসমিন মুগ্ধ না হয়ে পারলেন না৷
রূপার এক হাত ধরে বললেন, “তাহলে ফাইয়াজকে বিয়ে করতে তোমার আপত্তি নেই? আমি তোমার বাসায় যাব বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে?”

রূপা কোনো অভিব্যক্তি দেয়ার পূর্বে ফাইয়াজ এসে ঢুকল ড্রয়িংরুমে। রূপা সচকিত হয়ে তাকাল। দুজনের চোখাচোখি হয়। একটা ভিন্ন স্বাদের অনুভূতি ভুঁইফোঁড়ে বেরোনোর মতো হঠাৎ জেগে উঠল রূপার বুকের ভেতর। ছেলেদের মতো পোশাক পরে, চুল ঝুটি অথবা খোঁপা করে ঘুরে বেরানো মেয়েটাকে খোলা চুলে দেখে না চাইতেও ফাইয়াজ সেকেন্ড কয়েক সময় নিয়ে দেখল৷ তারপর অত্যন্ত শান্তভাবে রূপাকে পিছনে রেখে চলে গেল ভেতরের রুমে।
জেসমিন ফিসফিসিয়ে বললেন, “প্রস্তাব নিয়ে যাব?”

রূপা কী বলবে ভেবে পায় না! সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।
জেসমিন তা উপলব্ধি করে বললেন, “তোমাকে দুইদিন সময় দিলাম৷ এর মধ্যে জানাবে।”
বলেই হাসলেন তিনি৷ রূপা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল৷
জেসমিন বললেন, “তুমি বসো। আমি তোমার জন্য চা করে আনি। তারপর আবার গল্প করব।”
“না, না…আমি যাই। সন্ধ্যা হয়েছে।”

“আরে বসো। রং চা নিয়ে আসছি৷ আমি শুনেছি, তোমার রং চা পছন্দ। যাচ্ছি আমি। তুমি কিন্তু কোথাও যাবে না।”
জেসমিন দ্রুত পায়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন৷ রূপা সোফায় হেলান দিয়ে বসল। সারাদিন এদিক-ওদিক ঘুরে শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে, ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে৷ সে আরেকটু আরাম করে বসে চোখ বুজল।

জেসমিন চা বানিয়ে আবিষ্কার করলেন, রান্নাঘরে কেক নেই৷ ইশতেহার হয়তো নিয়েছে৷ তিনি কম্পিউটারে কাজ করতে করতে কেক অথবা বিস্কুট খেতে পছন্দ করেন৷ জেসমিন নিজের রুমে যেতেই রান্নাঘরে ফাইয়াজ আসল। ফ্রিজ থেকে দুটো আপেল, আরেকটা ডালিম নিয়ে দেখল, পাশে রং চায়ের কাপ! জেসমিন আর সে দুধ চা খায়। ইশতেহার চা পছন্দ করে না। তাহলে এটা নিশ্চয়ই রূপার জন্য। ফাইয়াজ লবণের কৌটা নিয়ে সেখান থেকে তিন চামচ লবণ চায়ে ঢেলে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল৷

জেসমিন চা, কেক, বিস্কুট, ডালিম, আপেল, আঙুর — বাসায় যা যা ছিল সব ট্রে তে সাজিয়ে নিয়ে এসে দেখলেন, রূপা ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। ফ্যানের তীব্র ঘূর্ণিতে রূপার চুল উড়ছে। জেসমিনের মায়া হয় ডাকতে। তিনি সেন্টার টেবিলের উপর ট্রে রেখে ফ্যানের বাতাস আরো বাড়িয়ে দিলেন৷ রূপা গভীর ঘুমে মগ্ন।
ভেতর থেকে ফাইয়াজের কণ্ঠ এলো, “আপা, চা দাও।”
জেসমিন বললেন, “আসছি।”

মনে মনে ভাবলেন, “রূপা যেহেতু ঘুমে চা রেখে তো লাভ নেই৷ উল্টো ঠাণ্ডা হয়ে খাবার অযোগ্য হয়ে যাবে৷ তার চেয়ে বরং দুধ মিশিয়ে ফাইয়াজকে দিয়ে দেয়াই ভালো হবে।”
তিনি রং চায়ে দুধ মিশিয়ে ফাইয়াজের রুমে গেলেন। ফাইয়াজ সবেমাত্র ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে।
জেসমিন চা দিয়ে কপট রাগ নিয়ে বললেন, “পরেরবার থেকে নিজে বানিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করবি। আমি আর পারব না।”
ফাইয়াজ চোখ তুলে বলল, “হঠাৎ কী হলো?”

“দেখ, আমি তোর দাসী না৷ আমার বয়স হচ্ছে, তোর ফরমায়েশ খাটা আর সম্ভব না৷ তুই অন্য ব্যবস্থা কর।”
“ঠিক আছে, চব্বিশ ঘণ্টার জন্য কাজের লোক নিয়ে আসব। সে ফরমায়েশ খাটবে।”
“তা হবে না। বাহিরের মানুষ আমার বাড়িতে আমি রাখব না। আমার এসব ভালো লাগে না।”
“কী চাচ্ছো সরাসরি বলো।”
“একটা বউ।”

জেসমিন আড়চোখে তাকালেন ফাইয়াজের অভিব্যক্তি দেখতে৷
ফাইয়াজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “তুমি বরং দুলাভাইকে বিয়ে দিয়ে বউ নিয়ে আসো।”
জেসমিন রাগার নাটক করে বললেন, “কী বললি!”
ফাইয়াজ হেসে চায়ে চুমুক দিয়ে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল।
দ্রুত মুখ থেকে চা ফ্লোরে ফেলে দিয়ে বলল, “বিয়ে করব না বলে চায়ে এতো লবণ দিতে হবে? এটা কোন ধরণের অত্যাচার শুরু করলে আপা?”

জেসমিন অবাক হয়ে বললেন, “লবণ কেন দিতে যাব?”
ফাইয়াজ চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল, ” তাহলে কী দিয়েছো?”
“চিনি আর দুধ দিয়েছি।”
“তুমি খেয়ে দেখো।”
জেসমিন চায়ে চুমুক দিয়ে চোখমুখ বিকৃত করে ফেললেন৷
বললেন, “সত্যিই তো লবণ! বোধহয় চিনির বদলে লবণ দিয়ে ফেলেছি। ভাগ্যিস, রূপা খায়নি। নয়তো মেয়েটা আমার সম্পর্কে কী ভাবত!”

ফাইয়াজ চকিতে তাকাল।
বলল, “এটা রূপার চা?”
“হ্যাঁ। সারাদিন অনেক কষ্ট করে মেয়েটা, ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তাই আর ডাকিনি। খাবার নষ্ট করাও তো ভালো না৷ তাই তোর জন্য নিয়ে এসেছি।”
ফাইয়াজ বলার মতো আর ভাষা খুঁজে পেল না।
অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়লে নিজেকেই পড়তে হয়; কথাটির যথাযথ প্রমাণ পেল আজ।
জেসমিন বললেন, “তুই বস, আমি আবার নিয়ে আসছি।”

ফাইয়াজ শব্দহীন পায়ে ড্রয়িংরুমে আসল। নিদ্রায়মাণ রূপার ঘাড় বাঁকা হয়ে আছে। ফাইয়াজের খুব অস্থিরবোধ হয়। ইচ্ছে করে, রূপাকে নরম বিছানায় নিয়ে রাখতে। সেখানে আরামে ঘুমাক। এতো কেন ঘুরে বেড়ায় মেয়েটা?
সে ধীর পায়ে হেঁটে রূপার নিকটে এসে দাঁড়াল।
যখনই ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে ঘাড় ঠিক করতে যাবে তখনই চোখ খুলল রূপা। চোখের সামনে ফাইয়াজের মুখ দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল।

ফাইয়াজ সঙ্গে সঙ্গে কাঠিন্যপূর্ণ গলায় বলল, “এটা কি তোমার ঘুমানোর জায়গা? নিজের বাড়ি নেই? অন্যের বাড়িতে না বলেকয়ে ঘুমিয়ে পড়াটাও এক ধরনের অসভ্যতা। যাও, নিজের বাড়ি যাও।”
ফাইয়াজের হুঁশিয়ারি গলা শুনে জেসমিন ছুটে আসলেন। রূপার চোখ নিমিষে ছলছল করে ওঠে।
ফাইয়াজ পুনরায় তাড়া দিলো, “যাচ্ছো না কেন? দ্রুত যাও।”

সূর্যশিশির পর্ব ২৩

জেসমিন ধমকে উঠেন, “এটা তোমার কী ধরনের ব্যবহার ফাইয়াজ? এভাবে বলছো কেন?”
ফাইয়াজ জেসমিনের দিকে ফিরে বলল, ” হয় তুমি বলো নয়তো তুই বলো, একেকবার একেক সম্বোধন নাটক লাগে। আর এইযে…তুমি আর কখনো অন্যের বাড়িতে এভাবে ঘুমিয়ে পড়বে না৷”
রূপা দ্রুত পায়ে ড্রয়িংরুমে ছেড়ে বেরিয়ে যায়। জেসমিন পিছন পিছন এসে ডাকলেও সে থামল না। এক ছুটে নিজের বাড়িতে চলে গেল৷ ফাইয়াজ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল পূর্বের স্থানে।

সূর্যশিশির পর্ব ২৫