বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু গল্পের লিংক || নুরুন্নাহার তিথী

বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব ১
নুরুন্নাহার তিথী

কাজি কবুল বলতে বলার পরও প্রায় অনেকটা সময় হয়ে গেল, বিয়ের কনে নিশ্চুপ! বিয়ের কনে নীরব হলেও আশেপাশের মহল কিন্তু নীরব না। কনে বিয়েতে রাজি না এই নিয়ে নানা রকমের গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তাতে বিয়ের কনে রুহানীর কোনো হেলদোল নেই। রুহানী নিরন্তর তার চাচার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেছে। তখন রুহানীর চাচা রহমত শেখ এগিয়ে এলেন। তিনি এসে তার ভাতিজির মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেসা করলেন,

“বল মা। কবুল বল।”
হঠাৎ রুহানীর নয়নযুগল ছলছল করে ওঠল। জলে টইটুম্বুর তার দুইটি নয়ন। রহমত শেখ সেই অশ্রুসিক্ত আঁখিযুগলের ভাষা বুঝতে পারলেন। কিন্তু তিনি যে নিরুপায়। সে যা করছেন সবটাই রুহানীর জন্য করছেন। রহমত শেখ ইশারায় আবারও কবুল বলতে বললেন কিন্তু রুহানী এখনও নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল।
ছেলে পক্ষ থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ একজন বলে ওঠলেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“কী ব্যাপার রহমত সাহেব? আপনার ভাতিজি কি এই বিয়েতে রাজি না? রাজি না হলে আমাদের ডেকে অপমান করানোর মানেটা কি? আপনি মেয়ের অনুমতি না নিয়ে বিয়ে ঠিক করেছেন নাকি? কিন্তু যখন আমরা মেয়েকে আংটি পড়াতে এসেছিলাম তখন তো আপনি বলেছিলেন মেয়ে বিয়েতে রাজি তাহলে? এখন কেনো মেয়ে কবুল বলছে না?”

বরবেশে থাকা জিহানও অপেক্ষা করছে কখন হুরপরীর মতো রুহানী কবুল বলবে। মেয়েটির সৌন্দর্যে সে তো কবেই পা*গল হয়েছে। কাল পর্যন্ত তো রুহানীকে দেখে মনে হচ্ছিল না যে সে বিয়েতে রাজি না! আজ কবুল বলতে এতো সময় নেওয়া কারণটাই জিহান বুঝতে পারছে না।
ছেলে পক্ষ থেকে আরেকজন বলে ওঠে,

“আপনাদের মেয়ের কী অন্যত্র পছন্দ আছে?”
রহমত শেখের কর্ণকুহরে কথাটা পৌঁছানো মাত্রই তিনি বলে ওঠলেন,
“না না। আপনারা ভুল ভাবছেন। আমার রুহানীর অন্যত্র পছন্দ নেই। ও আসলে,,”
“কী আসলে রহমত সাহেব? যদি অন্যত্র পছন্দ নাই থাকে তবে আধাঘণ্টা যাবত তাকে কবুল বলতে বলার পরেও বলছে না কেন?”

রহমত শেখ তার ভাতিজির কাছ থেকে উঠে গিয়ে উপস্থিত সকলকে বোঝাতে লাগলেন,
“আসলে কী বলেন তো, আপনারা তো জানেন যে আমার ভাই-ভাবি বেঁচে নেই। এখন তাই ওর একটু মন খারাপ করছে। আপনারা একটু অপেক্ষা করুণ, ও এখনি কবুল বলবে।”
“আপনার ভাতিজি এত বছরে মন খারাপ করেনি না-কি?তার বিয়ের দিনে কবুল বলার সময়ই মন খারাপ করা লাগল? কতটা সময় হয়ে গেল এখনো সে কবুল বলল না। এবার আপনি দেখেন তাকে কবুল বলতে বলেন নয়তো আমরা আর অপেক্ষা করব না।”

কথাটা বললেন বরের খালা। রহমত শেখ প্রত্যুত্তরে মাথা নিচু করে মৃদু কণ্ঠে বললেন,
“জি আমি দেখছি। আমি একটু ওর সাথে আলাদাভাবে কথা বলে আসি।”
রহমত শেখ রুহানীকে স্টেজ থেকে উঠিয়ে কমিউনিটি সেন্টারের একটা রুমে নিয়ে গেলেন। তারপর তিনি ভালে করে দরজা লাগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন,

“কী হয়েছে রুহু মা? কবুল বলছিস না কেন?
কবুল বলে দে মা। আর এরকম করিস না।”
রুহানী তার চাচার দিকে একনজর তাকিয়ে রুমের ভেতর খাতা-কলম খুঁজছে। তখনই সামনে একটা টেবিলে ছোটো নোটপ্যাড ও কলম দেখতে পেলো। রুহানী সেগুলো নিয়ে লিখতে বসে গেল। রহমত শেখ রুহানীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি দেখলেন রুহানী লিখছে,

“তুমি আমাকে সেদিন বলেছিলে ছেলে জানে যে আমি কথা বলতে পারি না। কিন্তু গতকাল গায়ে হলুদের দিন ছেলে আমাকে বারবার কথা বলতে কেন উদ্দত করছিল? সকাল থেকে আমি অনেকবার তোমাকে এই প্রশ্নটা করতে চেয়েছিলাম, বোঝাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমার একটা কথাও শোনোনি। এখন আমার কথার উত্তর দাও। কেন? উনি আমাকে কথা বলতে বললেন? তুমি কি তাদের সত্যিটা জানাওনি? তুমি জানো, আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম। আমি কাউকে ঠকিয়ে বিয়ে করতে চাই না।”

কাগজে ভাতিজির লেখাগুলো পড়ে রহমত শেখ মাথা নিচু করে রইলেন। রুহানী লেখা শেষ করে তার চাচুর দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চাচার এই ঝুঁকে যাওয়া মস্তক দেখে সে কিঞ্চিত সন্দেহ করতে পারছে যে তার চাচা বর পক্ষকে এই সত্যিটা জানায়নি। রুহানীর কপোল বেয়ে গড়িয়ে পরলো এক সূক্ষ্ম জলের ধারা। সেই ধারাকে নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা বেশ কঠোর হয়ে শা*সন করে মাঝ পথেই রুখে দিল। অতঃপর সে আবারও খাতায় লিখল,

“তুমি এখনই হয় বাইরে গিয়ে বলবে আমি কথা বলতে পারি না। নয়তো বলবে আমি এই বিয়ে করব না। আমি চাই না তার ধোঁকার শি*কার হোক। তারা যদি বিয়ের পর জানতে পারে আমি বোবা তখন কি তারা অশান্তি করবে না? বিয়ের পর অশান্তির থেকে সব সত্যি সব ধোঁয়াশা এখনি ক্লিয়ার করো।”
রহমত শেখ এবার তার ভাতিজির হাত ধরে বসলেন। তিনি বললেন,

“মা রে, একটু বোঝার চেষ্টা কর। মা এমন করিস না। আমার দিকটা বোঝার চেষ্টা কর রে মা। তুই তো জানিস মেয়েদের একটু সামান্য ক্ষুৎ পেলেই সবাই সেটাকে বাড়িয়ে, চড়িয়ে আরো বড়ো করে দেখে। তুই একটু বোঝার চেষ্টা কর। এভাবে হলে আমি তোর বিয়ে দিতে পারবো না।

তুই বল, এই পর্যন্ত কয়টা বিয়ের ঘর গিয়েছে? শেষে তোকে আমি এইখানে, এই সিলেটে নিয়ে এসেছি। এখানে আশেপাশের মানুষজন খুব একটা আমাদের চিনে না। বিয়েতে দেখ, আত্মীয়-স্বজনও কেউ নেই। আমি যা করছি সব তোর ভালোর জন্যই করছি রে মা। আমি তোর চাচা। ছোটো থেকে ভাই-ভাবীর পর তোকে আমি ও তোর চাচী নিজের সন্তানের মতে লালন পালন করে বড়ো করেছি। আমি নিশ্চয়ই তোর কোনো ক্ষতি চাইবো না। তোর জন্য আমরা কী না করেছি? তুই সবই জানিস।”

রুহানি চোখের জল ছেড়ে নিজের কান্না গুলো গিলে নিল। হাত দিয়ে চোখের জল মুছে তার চাচাকে একটা চেয়ারে বসালো। তারপর সে তার চাচার পায়ের কাছে বসে কাগজ কলম নিল। সেখানে লিখল,

“আমি কি তোমার কাছে খুব বেশি বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম চাচ্চু? এতগুলো বছর যখন তোমরা আমাকে লালন পালন করে নিজেদের মেয়ের মতো আদর-যত্ন দিয়ে বড়ো করতে পেরেছো, আগলে রাখতে পেরেছ, তাহলে সামনে কি পারবে না? আমি চাইনা এই সামান্য একটা মিথ্যের জন্য বাকি জীবন আমি কারো গলগ্রহের শি*কার হই। আমি চাই না, আমার সামনে প্রতিনিয়ত কেউ তোমাকে যা তা বলে গা*লিগা*লাজ করুক। আমি চাই না সেসব।

আমি কোন মিথ্যার উপর ভিত্তি করে নিজের নতুন জীবন শুরু করতে চাই না। এর থেকে ভালো তুমি আমাকে বলে দাও, তোমার যদি আমাকে রাখতে সমস্যা হয় তাহলে বলে দাও। আমি দূরে কোথাও চলে যাব। কিন্তু মিথ্যা দিয়ে আমি সম্পর্ক শুরু করব না।”

রহমত শেখ রুহানীর লেখাগুলো পড়লেন। তখনি দরজায় একটা টোকার শব্দ শোনা গেল। রুহানী গিয়ে দরজা খুলে দেখতে চাইলে রহমত শেখ বাধা দেন। তিনি রুহানিকে বসিয়ে নিজে গিয়ে দরজা খুলেন। অতঃপর দরজা খুলে দেখেন তার স্ত্রী জাহানারা শেখ কেমন করুণ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দরজা খোলা মাত্রই জাহানারা রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে রুহানিকে এসে জড়িয়ে ধরেন। তিনি কান্নারত কন্ঠে বলেন,

“সব শেষ হয়ে গেল রে মা। সব শেষ। বাহিরে জানাজানি হয়ে গিয়েছে, যে তুই কথা বলতে জানিস না।”
কথাটা শোনামাত্রই রহমত শেখ ধপ করে সোফায় বসে পরলেন।

বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব ২