বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব ৯

বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব ৯
নুরুন্নাহার তিথী

রহমত শেখ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“ঠিক আছে। তোর যখন এখানেই ভালো লাগছে তখন আমি এখানেই তোকে ভর্তি করার জন্য কথা বলব। কিন্তু আমাকে যে ঢাকার অফিসও সামলাতে হবে। কী করব? আমার সাথে রিফাত থাকলেও ওর উপর পুরো ব্রাঞ্চের দায়িত্ব কী-ভাবে দেই বল? তোর ফুফিও অসুস্থ। বিছানায় পড়া। তোর ভাবীও প্রেগনেন্ট। ছেলেটা কয়দিক দেখবে? এতো দিক দেখে আমি রিফাতকে এখানে আসতে জোড় করিনি। এখন এতো বড়ো দায়িত্ব ও কী-ভাবে সামলাবে?”

রুহানী মুচকি হেসে চাচার পাশে গিয়ে বসল তারপর খাতাটা নিয়ে লিখল,
“ভাইয়া পারবে। তাছাড়া ফুফাও টুকটাক হেল্প তো করবেন আর তুমিও আছো। যাওয়া আসার মধ্যে থাকবে। ভাবীর বেবিটাও কিছু দিন পর চলে আসবে। মাত্র তিন মাসই তো বাকি। সিলেটের ব্রাঞ্চটা এতোদিন ছোটো ছিল, সেটাকে বাড়াও।”
জাহানারা শেখ বলেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“রিফাতের উপর আমরা ভরসা করি। কিন্তু তোর ফুফা লোকটা কোনোদিন তোর সাথে ভালো করে কথা বলেছে? বলেনি। উনার জন্যই এখানে আসতে হয়েছে। আমার তো মনে হয় উনিই রিহাকে খবর দিয়েছে। কেন যে উনি রিহাকে তোর নামে ছোটো থেকেই ভড়কান! বুঝি না আমি। আর তুই বলছিস, তোর ফুফা কম্পানি দেখবে! হাহ্! উনি তো এটাও চান না, রিফাত আমাদের কম্পানি দেখাশোনা করুক। তার ছোটো ছেলে নাবিল তার কম্পানির দায়িত্ব নিয়েছে বলে সে শান্ত আছে।”

“সেসব বাদ দাও জাহানারা। আমি এমসি কলেজে রুহানীর ভর্তির জন্য কথা বলে ঢাকা যাব। ঢাকার ব্রাঞ্চের কিছু সিলেটে ট্রান্সফার করব আর এখানের ব্রাঞ্চের পাশের প্লটটা ল্যান্ড লি*ডারের সাথে আলাপ করে কেনার চেষ্টা করতে হবে। তোমরা ১৫-২০ দিন এখানে থাকতে পারবে? আমাকে ঢাকায় থাকতে হবে। মনসুর ভাই আছেন। আর তুমি তোমার ছোটো ভাইকেও চাইলে ডেকে নিতে পারো।”

রহমত শেখের প্রশ্নের জবাবে জাহানারা শেখ বলেন,
“সমস্যা হবে না। তাছাড়া রুহানীর ক্লাস শুরু হলে ড্রাইভারই তো ওকে নিয়ে যাবে নিয়ে আসবে। বেশ পুরোনো ড্রাইভার। তুমি নিশ্চিন্তে যাও।”
রহমত শেখ স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলেন। অতঃপর রুহানীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

“কোন সাবজেক্টে পড়বি?”
রুহানী লিখে জানায়,
“উদ্ভিদবিদ্যা। ”
“আচ্ছা। আমি কথা বলব।”
রুহানী তার চাচার হাত জড়িয়ে খুশি প্রকাশ করে নিজের ঘরে চলে যায়। যাওয়ার পথে এক সার্ভেন্টকে ইশারায় তার ঘরে যেতে বলে। সার্ভেন্টটা রুহানীর ঘরে গেলে রুহানী তার হাতে গতকালকের আঁকা ছবিটা দেয় আর লিখে,

“এটাকে ফ্রেম করে বাঁধায় করে আনবেন। আমার ঘরে লাগাব।”
“আচ্ছা আপা।”
সার্ভেন্টটা ছবি নিয়ে চলে গেলে রুহানী বিছানায় বসে গল্পের বই নিয়ে। এখন পড়ছে হুমায়ূন আহমেদের ‘রূপা’ বইটা। আগুন্তকের কাজ গুলো পড়ে সে বেজায় মজা পাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে আরহানের সাথে সেদিন রাতের সাক্ষাতের কথা মনে পরছে। পরক্ষণেই নিজের ভাবনার লাগাম টানল। দুইদিনের পরিচয়ে কারও সম্পর্কে বেশি ভাবতে চাইল না। পানি খেয়ে আবার বই পড়াতে মনোনিবেশ করল।

লন্ডনে এসেই হোটেলে গিয়ে ঘুম দিয়েছে আরহান। এপ্রিলে লন্ডনের তাপমাত্রা বাংলাদেশের অনুযায়ী অনেক শিতল। সর্বোচ্চ ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো হয় যা বাংলাদেশের অনুযায়ী জানুয়ারিতে হয়। তবে আজকের তাপমাত্রা ১০ এর কম। মানে হাড় কাঁপানো শীত। যেহেতু লন্ডন বাংলাদেশ থেকে ৫ ঘণ্টা পিছিয়ে তাই ফ্লাইট গভীর রাতেই পৌঁছেছে।
সকাল হতেই ফোনে অনবরত কল ও ধুমধাম দরজায় কড়া পরতেই ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠল আরহান।

তার বুঝা হয়ে গেছে এই কাজ কার! জানালার পর্দা হালকা সরিয়ে দেখল সকাল হয়েছে। তারপর পর্দাটা আবার টেনে দিয়ে ঘরটাকে পুনরায় তমসায় আচ্ছাদিত করে বেড সাইড টেবিল থেকে তুলো নিয়ে কানে গুঁজে আবারও কম্বল মুড়িয়ে ঘুমাতে নিল কিন্তু তাও পারল না। দরজায় কড়া নাড়া যেন আরও জোড়ালো হলো। উঠে বসে ফোন হাতে নিল। অতঃপর দরজার বাহিরের মানুষটাকে টেক্সট করল,

“যা প্লিজ। আমি ঘুমাব। ডিস্ট্রাব করিস না।”
রুমে হিটারের উষ্ণতায় ঘুমটা বেশ জমে উঠেছিল। ফোনের স্ক্রিণে লন্ডনের তাপমাত্রা দেখে বুঝল খুব বেশি না। সবে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর মধ্যে বাহিরে কেন বের হতে হবে তাই সে ভেবে পায় না!
অপর পাশ থেকে ফিরতি মেসেজ আসলো,

“তুই বের হ। তন্নিও উঠে গেছে। আমরা ঘুরতে যাব।”
“তন্নি নিজে উঠেছে নাকি তুই উঠিয়েছিস? আমার তো সেকেন্ডটাই মনে হয়।”
“হ্যাঁ আমিই উঠিয়েছি। এবার তুই ফ্রেশ হয়ে হোটেল লবিতে আয়। আই অ্যাম ওয়েটিং। বেশি দেরী করলে এবার কিন্তু বু*লডো*জার নিয়ে আসব!”
আরহান মেসেজটা দেখে বাধ্য হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠল। ফ্রেশ হয়ে জ্যাকেট পড়ে বের হলো। লবিতে এসে সাফা, তন্নির পেছনে দিক দিয়ে গিয়ে ওদের মা*থায় টোকা দিলে সাফা তৎক্ষণাৎ ঘুরে বলল,

“এতো সময় লাগল কেন?
“হোটেলের লোকেরা তোকে কিছু বলে না? তোর এই জু*লুম কি তারা দেখে না?”
আরহানের অভিযোগপূর্ণ কথা শুনে সাফা কোনো তোয়াক্কা করল না। সে বলল,
“সবই সাফার কারিশমা! লেটস গো।”
তন্নি ক্লান্ত স্বরে বলে,

“তোকে একটা লন্ডনের ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিব। তখন তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবি।”
“উঁহু মোটেও না। আমি তো সিলেটি ছেলে বিয়ে করব!”
কথাটা বলেই আড়নয়নে আরহানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।
“শোন তন্নি, সিলেটি ছেলেরা লন্ডন মুখী হয় তাই সে এক ঢিলে দুই পাখি শি*কার করতে চায়। বুঝিস না?”
আরহানের কথা শুনে তন্নি হেসে উঠলেও সাফা রেগে গিয়ে ধা*মধুম কয়েকটা লাগিয়ে দিয়েছে। আরহান দূরে সরে হাসতে হাসতে বলে,

“আচ্ছা চল। আগে নাস্তা করি, তারপর বের হবো। টেমস নদীর ধারে টাওয়ার অফ লন্ডনের ওখানেই যাব।”
তারপর ওরা নাস্তা করতে চলে যায়।

টাওয়ার অফ লন্ডনের কাছেই ওরা তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। এখানে ওদের বহুবার আসা হয়েছে তাই ছবি তোলার হিড়িক নেই। আরহান কানে হেডফোন গুজে গান শুনছে আর হাঁটছে। হঠাৎ সাফা আবদার করে বসে,
“আইসক্রিম খাব। চল আরহান।”
তন্নি ঘাবড়ে গিয়ে বলে,

“না! আমার ঠান্ডার প্রবলেম আছে। এই ঠান্ডার মধ্যে কে আইসক্রিম খায়! আরহান শোন, এই মেয়ের কথা শুনিস না। এ একটা পা*গ*ল। বেশি আস্কারা পেলে মা*থায় উঠে নাচবে।”
“তুই বেশি বুঝিস তন্নি। সামনে তাকিয়ে দেখ, ওই বাচ্চাটাও আইসক্রিম খাচ্ছে। এখানে অনেকেই খাচ্ছে। চল তো আরহান।”

সাফা আরহানকে এক প্রকার টেনেই আইসক্রিমের দোকানের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। আরহান ওকে থামিয়ে বলে,
“আইসক্রিম খাওয়া লাগবে না। তোর না আজ ফ্লাইট আছে?”
“নোপ। আমি সিডিউল চেঞ্জ করে নিয়েছি। কাল তোর আর তন্নির সাথে ফ্লাইট। আমার বদলে নুহাশাকে পাঠাতে চাইছিলাম কিন্তু নুহাশা আরও একদিন ছুটি নিয়েছে। বুঝিসই তো! তাই অন্যজন যাবে।”

আরহান বলল,
“চল কফি খাই।”
“না! বললাম না আইসক্রিম!”
সাফার জেদের কাছে আরহান ও তন্নি পরাজয় স্বিকার করে আইসক্রিমের দোকানেই যায়।

রহমত শেখ বিকেলের দিকে এসে রুহানীকে তৈরি হতে বলল। রুহানীকে নিয়ে কলেজ দেখাতে যাবে। রুহানী জোড় করে জাহানারা শেখকেও রাজি করাল। তারপর তিনজনেই তৈরি হয়ে বেরিয়ে পরল।
এমসি কলেজের কাছে আসতেই দেখল বিশাল বড়ো গেইট তাতে বড়ো করে ‘মুরারিচাঁদ কলেজ, সিলেট’ লেখা। গেইটে পারমিশন নিয়ে গাড়ি ঢুকতেই রুহানী গাড়ির কাঁচ নামিয়ে বাহিরে দেখতে লাগল। সবুজে আচ্ছাদিত কলেজটা অতিমাত্রায় মনোরোম।

প্রথমেই পুরোনো ভবন গুলো। তারপর রাস্তা ধরে যেতে যেতে আরও অন্যান্য বিভাগের ভবন পরল। তারপর একটা ছোটো দিঘী। দিঘীর পাশেই গ্রন্থাগার। দিঘীর সিঁড়িতে ছাত্র-ছাত্রীরা বসে আড্ডা দিচ্ছে। কেউ কেউ ঘাসের উপর বসেও। পথে টিলার উপরে প্রিন্সিপ্যালের বাসভবনও পরেছে কিন্তু রহমত শেখ চাইছেন আগে উদ্ভিদবিজ্ঞান ভবনটা দেখিয়ে আনতে। আরও কিছুটা পথ এগুনোর পর সামনে আসে আকাশি রঙের উদ্ভিদ ও প্রাণীবিদ্যা বিভাগ। গাড়ি সেখানেই থামায়। ভবনের পাশে রাস্তা তারপর টিলা। এমন ছোটো বড়ো টিলাকে ঘিরেই পুরো কলেজ এড়িয়া।

ঘুরতে ঘুরতে জাহানারা শেখ নিজের সংশয় প্রকাশ করেন,
“মেয়েকে যে এখানে পাঠাব, এমন পাহাড়-টিলা, গাছপালা দেখে আমার ভয়ই করছে। এখানকার ছাত্র-ছাত্রীরা ও ছাত্রলী*গ কেমন কে জানে! গু*ম করে ফেললে! যতো পুরোনো কলেজ, ততো শক্তিধর।”
রহমত শেখ আশ্বস্ত করে বললেন,

বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব ৮

“তুমি ভয় পেয়ো না তো। কতো মেয়েরা এখানে পড়াশোনা করছে। প্রথম দিকে একটু প্রবলেম হলেও পরে ঠিক হয়ে যাবে।”
এদিকে রুহানী তন্ময় হয়ে হাঁটছে। রাস্তার কিনারাতে বৃষ্টির পানি জমে আছে। বোঝাই যাচ্ছে গতকাল রাতেও বৃষ্টি হয়েছিল।

বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব ১০