বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২৫

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২৫
শারমিন আক্তার বর্ষা

কপালের র’ক্ত ফোঁটা গুলো শুকিয়ে লালচে দাগ হয়ে গেছে। শরীরে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। গলা শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। পিটপিট করে নেত্রযুগল স্থির করে রুহানি। জানালা একপাট খোলা। গাছের লতাপাতার ফাঁক দিয়ে এক রক্তিম সূর্যের কিরণ দেখা মিলছে। চোখ মেলে রাখতে পারছে না রুহানি। ভ্রু যুগল উঁচু করে জোরপূর্বক চোখ মেলে রাখার চেষ্টা করছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে এটা একটা পরিত্যক্ত বাড়ি। আর বাহিরে শুধু গাছপালা।

যেমন মুভিতে দেখা মিলে, নায়িকাকে তুলে জঙ্গলের একটা ঘরে এনে রাখে তেমন হচ্ছে। রুহানি ধরে নেয়, এটা কোনো জঙ্গলের মাঝে একটা বাসা৷ ঘরের মধ্যে কিছু নেই। শুধু চার দেয়াল। রুহানির থেকে কিছুটা দূরে শুধু একটা চেয়ার রাখা।
ফ্লোরে রক্তগুলো শুঁকিয়ে গেছে। একমনে ভাবছে, তাকে কেনো এখানে তুলে আনা হলো? আর কেনো তার ওপর এত অত্যাচার করা হচ্ছে? ভেবে পাচ্ছে না। ভাবনার মধ্যে ফোঁড়ন কাটে। একজন লোক দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করল। শরীর দূর্বল, পেটে কিছু পরেনি। বৃথা চেষ্টা করল রুহানি। তবুও চোখ মেলে রাখতে পারল না। ভালোই হয়েছে তাছাড়া এতটা যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা ওর হয়তো ছিল না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘রাজেশ রুহানি কে নিয়ে কোথায় রাখতে পারে? এমন কোনো জায়গা নেই। যেখানে আমরা খোঁজ করিনি। কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না এ.স। বুঝতে পারছি না রুহানি কে নিয়ে সে কোথাও গেছে?’
হাতের মধ্যে কফি মগ, চোয়াল শক্ত করে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরিশ। তীক্ষ্ণ চোখে জানালার বাহিরে গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট জোড়া উল্টিয়ে রাগী চোখে তাজ এর দিকে পিছু ঘুরে তাকাল। তাজ ওরা আরিশের চোখে-মুখে রাগ দেখে চোখ নামিয়ে নেয়।

শব্দ করে হেঁটে তাজ ও প্রবীরের সামনে দাঁড়ায়৷ টেবিলের ওপর রাজেশ সরকারের সকল প্রোপার্টির হিসাব নিকাশ করছে। হাতে একটা কলম নিয়ে কাগজের ওপরে একটা বাড়ির ওপর মার্ক করে। শক্ত ও গম্ভীর গলায় বলল, ‘সব জায়গা দেখা হলেও এখনও একটা জায়গা বাকি আছে। রাজেশ সরকারের ফার্মহাউস।’

ইন্সপেক্টর নিহান এগিয়ে আসেন। মার্ক করা বাড়ির ওপরে একনজর দেখে আরিশের দিকে তাকায়। কিছু জিজ্ঞেস করবে এমন সময় আরিশ আরও বলল, ‘দুই ঘন্টা ধরে আসিফ ও হাউসের ওপর নজর রাখছে। ও আমাকে কিছুক্ষণ আগে জানিয়েছে, রাজেশ ফার্মহাউসে থেকে একাই বেরিয়ে গেছে। এবং হাউসের চারপাশে অনেক গার্ড হাউস প্রোটেকশনে আছে। আমি চিন্তিত রুহানি কে রাজেশ ওর ফার্মহাউসে রাখছে।’

ওয়াসিফ এ.স কাঁধে হাত রাখে। বলল, ‘তুই এখনও বলবি? তুই মেয়ে টাকে ভালো বাসিস না?’
প্রতিত্ত্যরে মুখ দিয়ে একটা শব্দ ও বের করেনি আরিশ। নিশ্চুপ রয়ে যায়। বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসে ভারী শ্বাস। একজন গুপ্তচর খবর দিয়েছে, রাজেশ তার শহরের এক ফ্ল্যাটে উঠেছে। রাজেশ কখন কোথায় যাচ্ছে সে খবর এ.স কে পাই পাই জানানো হচ্ছে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। কেউ এখনও রুহানির খবর পায়নি। রুমের মধ্যে একেক জন একেক রকম করে বসে আছে। শ্যামা, নাজিন, লাবণ্য, রাইসা ও আয়রা অনেকক্ষণ কান্না করেছে। সকলের চোখের নিচে কালচে দাগ হয়ে গেছে। বিছানার এককোণে বসে নাক টানছে শ্যামা। রুহানির হারানোর সংবাদ এখনও ইয়ানা কে জানানো হয়নি। জড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘রুহির কিছু হলে আমি আন্টিকে কি জবাব দিবো? আন্টি যখন জানতে চাইবেন, উনার মেয়ে কোথায়? তখন আমি কি বলবো?’

আদনান ও সাইফ ভারী গলায় বলল, ‘তোরা কান্নাকাটি বন্ধ কর। আমাদের রুহি একদম ঠিক আছে। দেখিস চলে আসবে৷ হয়তো এদিক ওদিক কোথাও গেছে। আর ওর ফোনের ব্যাটারি ডাউন হয়েগেছে।’
আরিফ ও নিশান সোফার ওপর থেকে ওঠে দাঁড়ালো। একে অপরের দিকে তাকিয়ে একসাথে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, ‘তোদের মতো আমি ঘরের মধ্যে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারবো না। আমরা দু’জন যাচ্ছি রুহিকে খুঁজতে। পুলিশের ওপর আমি ভরসা করতে পারছি না। আমাদের বন্ধু বিপদে আছে। আমরা হেলাফেলা করতে পারবো না।’

বলে ব্যস্ত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। পিছু পিছু সাইফ ও আদনান হনহনিয়ে বের হল। বাড়ির সামনে চারজন দাঁড়িয়ে গবেষণা করছে। কে কোন দিক যাবে?
রুমের মধ্যে বসে কান্না কাটি করে লাভ নাই। শ্যামা ওদের সাথে নিয়ে বের হয়ে যায়। ওরাও বসে থাকতে পারছে না। নিজেদের খুঁজতে হবে।

গোটা ১দিন ৫ঘন্টা সময় ধরে রুহানির ফোন বন্ধ। লাগাতার কল দিয়েছে ইয়ানা। কিছুক্ষণ পরপর কল দিচ্ছে তবুও ফোন বন্ধ। রুহানির নাম্বার ছাড়া ওর কোনো বন্ধুর বাংলাদেশ নাম্বার ইয়ানার কাছে নেই। হঠাৎ মেয়ের ফোন বন্ধ হওয়ায় চিন্তা সে। লাস্ট রুহানির সাথে কথা হয়েছিল তখন, যখন রুহানি এয়ারপোর্ট পৌঁছে ছিল। তার পর এতক্ষণে রুহানির ওর মা’র সাথে কানাডা থাকার কথা। মেয়ে আসছে শুনে এক ঘন্টা আগে কানাডার এয়ারপোর্টে ইয়ানা অপেক্ষা করছিল। কিন্তু রুহানি আসেনি আর না ওর বন্ধু রা আসছে। তিন ঘন্টা অপেক্ষা করে বাড়ি ফিরে আসে। মনের মধ্যে ধুকধুক করছে। অজানা এক ভয়ের আশংকায় চোখ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পরে।

অস্বস্তি হচ্ছে, গলার টাই ঢিলে করে দিলেন। তবুও অস্বস্তি কমছে না। গলা থেকে টাই খুলে টেবিলের ওপর রাখে। ঘন্টা খানেক সময় ধরে অফিসে আসছে ইয়াসির। অফিসে না এসেও অফিসের সব খবর উনি রাখেন। কিছুক্ষণ আগে অফিসের পিএম কল দিয়ে উনাকে জানায়। এ.স আজ একবারও অফিসে আসেনি। আর তাকে কলেও পাওয়া যাচ্ছে না।
খবরটি শুনে অফিসে চলে আসে ইয়াসির। নিজেও বার কয়েক আরিশ কে কল দেন। কিন্তু আরিশ কল রিং হলেও রিসিভ করে না।

বেশ গম্ভীর হয়ে সোফার ওপরে বসে পরেন। আরিশের মিটিং রুমটা হচ্ছে অনেক বড়। রুমের পাশে ছোট ছাঁদ রয়েছে। হঠাৎ করে ইয়াসিরের অস্বস্তি অনুভব হতে লাগল। গলা শুকিয়ে আসছে। বুকের মধ্যে বার বার মোচড় দিচ্ছে। ভয় লাগছে, কিসের জন্য ভয় পাচ্ছেন উনি। অস্বস্তি কমানোর জন্য টেবিলের ওপর থেকে এক গ্লাস পানি পান করেন। তবুও কিছু হয় না। টাই খুলে টেবিলের ওপর রাখেন। হেঁটে ছাঁদে চলে আসেন। কিছুটা অস্বস্তি কমছে এই আশংকায়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ইয়াসির কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে৷ বার বার বুকের মধ্যে অজানা ভয় বিরাজ করছে। মনে হচ্ছে খুব আপন কাউকে হারাতে চলেছে। বা হারিয়ে ফেলেছে।

রাজেশ সরকার নিজ ফ্ল্যাট থেকে বের হচ্ছে। কানে ফোন, কারো সাথে কথা বলছে। দুই জোড়া চোখ আড়াল থেকে উনার ওপর নজর রাখছেন। গাড়িতে ওঠে বসেন। গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেন। নির্জন রাস্তা দিয়ে গাড়িটি চলছে, ফোনের দিকে তাকিয়ে ফোন স্ক্রোল করছে রাজেশ।

রাজেশের গাড়ির থেকে অনেকটা দূরে সাত আটটা গাড়ি ওর গাড়িটা কে ফলো করছে। সেদিকে রাজেশ বা ওর ড্রাইভারের খেয়াল নেই। কিছুক্ষণ পর, বাগান বাড়ির সামনে আসে গাড়ি থেকে নেমে পরে। রাজেশ কে দেখে একজন পিস্তল হাতে লোক এগিয়ে আসে। রাজেশ তার সাথে কথা বলতে বলতে ভেতরে চলে যান। বাড়ির অন্য দিকে খোলা মেলা আকাশের নিচে বসে পা ঝুলিয়ে বসে কথা বলছে রাজেশ। এমন সময় একজন লোক সাহস করে সবার মাঝখান থেকে সরে যায়। তারাতাড়ি পা চালিয়ে হেঁটে যেতে লাগে রুহানি যে রুমে বন্ধি সে রুমটায়।

দরজা খুলার শব্দ শুনে পিটপিট করে তাকায় রুহানি। মুখের ওপরের কাপড়টা আর নাই। হয়তো কেউ খুলে দিয়েছে। রুহানি লোকটাকে দেখে অস্ফুটস্বরে বলল, ‘পানি… পানি।’
লোকটা লোভনীয় ভাবে মুখ দিয়ে জিব বের করে। জিবের লালা দিয়ে ঠোঁট মুছে রুহানির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মূহুর্তে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলল রুহানি।

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২৪

রুহানির পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে লোকটা। বাজে মনোভাব পোষণ করে, একহাত রুহানির গায়ের ওড়নার ওপর রাখে। ওড়না ধরে টান মারল। রুহানি চট করে চোখ মেলে তাকাল। বড়বড় চোখ করে সামনে লোকটার দিকে তাকাই। লোকটা রুহানির গাল স্পর্শ করে বিশ্রী হাসি দেয়। জেনো বহু যুগ পর, এক বিশাল মাছ ধরেছে সে।

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২৬