বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২৪

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২৪
শারমিন আক্তার বর্ষা

ইমিগ্রেশনের ভেতরে রুহানিকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় আধঘন্টা যাবৎ খুঁজেও কোথাও পেলো না। হার মেনে কয়েকজন লোকজন কে রুহানির ছবি দেখাল। একজন রুহানির ছবি দেখে বলে, ‘কিছুক্ষণ আগে উনাকে ইমিগ্রেশন দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছি।’
সুক্ষ্ম শ্বাস ফেলে সকলে এয়ারপোর্টের বাহিরে আসে। আশপাশে খুঁজে কোথাও রুহানিকে দেখতে পায় না। রুহানির নাম্বারে অনবরত কল দিচ্ছে, ফোনটা বারবার বন্ধ বলছে। বিরক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে আসে। শ্যামার বাবা মি.মাহিন চিন্তিত হয়ে পরেন। কোনো উপায় না পেয়ে পুলিশের আশ্রয় নেয়। ইন্সপেক্টর আলী ভরসা দেন উনারা রুহানিকে খুঁজে বের করবেন।

ইমিগ্রেশন দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার পর থেকে রুহানির বুকের মধ্যে কেমন ধুক করে উঠে। গতকাল রাতে থেকে তার অস্বস্তি একটুও কমেনি বরং বেড়েছে। মনের মধ্যে কেউ হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে মনে হচ্ছিল। ইমিগ্রেশন দিয়ে ঢুকতে রুহানির মন তাকে বাঁধা দেয়। মন আর মস্তিষ্কের লড়াইয়ে দ্বিধায় পড়ে যায় রুহানি। এমন সময় তার মন তাকে বলে, ‘চলেই তো যাবি। যাওয়ার আগে মানুষ টার সাথে দেখা করা উচিত। তাকে জানানো উচিত তুই চলে যাচ্ছিস।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দ্বিতীয় বার কিছু ভাবেনি রুহানি। পিছনে ঘুরে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এয়ারপোর্টের বাহিরে চলে আসে। দৌঁড়ে একটা গাড়ির কাছে যায়। ট্যাক্সি ভাড়া করে, এ.স এর কোম্পানির নাম বলে৷ ট্যাক্সি ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেয়। অনেক পথ পাড়ি জমাতে হটাৎ গাড়ি জোরে ব্রেক কোষে। রুহানি কিছু বলার আগে, তার পাশে ডোর কেউ টেনে খুলে দেয়। আকস্মিক ঘটনায় তাজ্জব বনে যায় রুহানি। দুই জন মাস্ক পরা লোক রুহানি কে টেনে গাড়ি থেকে নামায়। রুহানি চেঁচামেচি করার সুযোগ পায়নি। তারা রুহানির মুখ চেপে ধরে। সকাল বেলা এদিকের রাস্তায় সচরাচর লোকজন চলাচল করে না।

ট্যাক্সি ড্রাইভার গাড়ি থেকে বের হল। উনি কিছু বলার জন্য মুখ খুলেন। একজন লোক ড্রাইভারের মুখের মধ্যে পিস্তল ঢুকিয়ে শক্ত গলায় বলল, ‘নিজের জীবন বাঁচাতে চাইলে চুপচাপ চলে যা। আর যদি কারো সামনে মুখ খুলিস তাহলে ওপারে চলে যাবি।’

ড্রাইভার ভয় পেয়ে গাড়ি সহ পালিয়ে যায়। রুহানি কে টেনে একটা কালো গাড়িতে ওঠায়। অন্ধকার আচ্ছন্ন একটা রুমের মধ্যে রুহানি কে নিয়ে আসে। এক ধাক্কা দিয়ে রুমের মধ্যে ফেলে দেয়। ফ্লোরের ওপরে পরে হাঁটু তে ব্যথা পায় রুহানি। মুখ বাঁধা বলে, শব্দ করতে করতে পারেনি। হাঁটু তে হাতের কনুইয়ে চট লেগেছে ভীষণ।
সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত একটা বন্ধ করে বন্ধির মতো বন্ধ হয়ে পরে থাকে রুহানি। সন্ধ্যা ছয়টার নাগাদ বন্ধ দরজাটা হঠাৎ খুলে যায়। পুরো রুমে ঘুটঘুটে অন্ধকার, দরজাটা খুলা মাত্র বাহির থেকে সাদা আলো রুমে উপচে পরে। পেছনে আলো সামনে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। পিটপিট করে লোকটাকে দেখল রুহানি। হেঁটে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে লোকটা।

রুহানি কে দেখে আপন মনে অট্টহাসি তে মেতে ওঠল লোকটা। রুহানির চুলের মুঠি ধরে নিজের মুখোমুখি করল। সারাদিন না খাওয়া খিদে লাগছে। শরীরটা দূর্বল হয়ে পরেছে। লোকটা রুহানির চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে দাঁত কটমট করে রুহানির মুখের দিকে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইল। চোখের ইশারায় দু’জন লোককে রুমের ভেতরে প্রবেশ করতে বলে। মুখ বাঁধা হাত পিছন দিকে করে বাঁধা। দু’টি লোক অনাবিক অত্যাচার করছে রুহানির ওপরে। চোখ দু’টি দিয়ে অঝোরে পানি পরছে। দু’জন লোক তাদের প্যান্টের বেল্ট খুলে রুহানির গায়ে মারছে। ব্যথায় মুখ দিয়ে অস্ফুট আওয়াজ করছে।

অন্য একজন সামনে দাঁড়িয়ে ভিডিও করছে। রুহানি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। দু’জন লোক রুহানি কে ধরে একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে দিয়েছে। কপাল কাটা রক্ত বের হচ্ছে, ঠোঁট দিয়েও রক্ত পরছে। আয়েশি ভঙ্গিতে বসে রুহানির দিকে তাকিয়ে ঠোঁট জোড়া বাঁকা করে হাসছে। তৃতীয় ভিডিও নিজে হাতে করছে লোকটি।
অন্য একজন রুহানির হাতের ওপর তার রেখে রুহানিকে স্পর্শ করে বলল, ‘মেয়েটা জোস বস। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমরা সবাই একটু ফূর্তি করতাম।’

রাত বারো টা. এখনও রুহানির জ্ঞান ফিরেনি। রুহানির দিকে এক পলল তাকিয়ে থাকল। ফোনে নতুন একটি সিম সেট করে। তিনটি ভিডিও একে একে আরিশের নাম্বারে সেন্ট করে নাম্বার টা ফোন থেকে খুলে ফেলে।
ডেভিল হাসি হেসে বলল, ‘এ.স তোর প্রাণভোমরা এখন আমার হাতে কি করবি তুই?’

আরিশ ফ্লোর থেকে ফোন হাতে নেয়। ইন্সপেক্টর নিহান কর্ণ কে কল দেয়। রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘ইন্সপেক্টর ত্রিশ মিনিটের মধ্যে পুরানো বাগান বাড়িতে আসুন। সাথে আপনার ফোর্স ও ইন্সপেক্টর আদ্রিক কেও নিয়ে আসবেন। কোনো পাল্টা প্রশ্ন করবেন না। যতটা বলেছি ততটাই করুন।’

বাগান বাড়ি! কপালে হাত দিয়ে গম্ভীর বসে আছে আরিশ। তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রবীর, তাজ ও অন্য পাশে ওয়াসিফ ও আমান। সামনে চেয়ারে ইন্সপেক্টর নিহান ও আদ্রিক বসে আছে। আরিশের ফোনে ভিডিও গুলো দেখে নির্নিমেষ চোখে আরিশের দিকে তাকাল। আরিশ টেবিলের ওপরে হাত শব্দ করে রেখে বলল, ‘আমি ওদের একটা কেও জ্যন্ত রাখবো না ইন্সপেক্টর। ওরা জানে না, ওরা এ.স এর কলিজার গায়ে হাত দিছে। আমার মনে হচ্ছে কেউ আমার শরীর থেকে কেউ আমার চামড়া ছিলে নিচ্ছে। আমি ওদের টুকরো টুকরো করে ফেলবো।’

আরিশের রাগ দেখে হতবুদ্ধি চোখে ওরা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। এই না কয়েক দিন আগেও বলেছিল, রুহানি ও’র দাবার গুটি ‘ও’ রুহানি কে ভালোবাসে না। তাহলে তার বিপদে সে এত রেগে গেলো কেনো?
এ.স ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে বলল, ‘ইন্সপেক্টর! আমি ওইদিন রাজেশ সরকারের বিরুদ্ধে আপনার হাতে সব প্রমাণ দিয়েছি। আজ আপনাকে ও’কে হাতেনাতে ধরে এ্যরেস্ট করতে হবে। আপনি ওদের এ্যরেস্ট না করলে আমার হাত থেকে একটা কেও কেউ বাঁচাতে পারবে না।’

ইন্সপেক্টর নিহান ও আদ্রিক একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে শক্ত ও গম্ভীর গলায় বলল, ‘তা নাহয় করা যাবে। কিন্তু আমরা ওদের ওখান পর্যন্ত পৌঁছাবো কিভাবে?’
‘আরিশ শাহ চাইলে গর্ত থেকে সাপ কেও বের করে আনতে পারে। আর সেখানে তো সামান্য গরু ছাগল কে খুঁজে বের করা খুব ইজি।’

এর আগেও যে কোনো কঠিন কেস সল্ভ করার জন্য নিহান কর্ণ সহ বড় বড় অফিসার গণ, ডিআইজি সহ অনেকে আরিশের থেকে সাহায্য নেয়। আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাফিয়া হলেও আরিশ কোনো খারাপ কাজে যুক্ত নেই। আড়ালে থেকে পুলিশের সাহায্য করে। আড়ালে থেকে অনেক মানুষ কে সাহায্য করে। যথা সম্ভব লোকেদের বিপদে এগিয়ে আসে। আরিশ শাহ নামে পুলিশে কোনো রেকর্ড নাই। আজ পর্যন্ত আঙুল তুলে কেউ আরিশ শাহ কে বলতে পারবে না সে অন্যায় করেছে বা অন্যায় কে প্রশ্রয় দিয়েছে। পুলিশ যে কাজ করতে পারে না সে কাজ মূহুর্তে এ.স করার ক্ষমতা রাখে।

রাত পোহাল, ভোর হল, এখনও রুহানির কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। রাতে একবার শ্যামার নাম্বারে কল দিয়েছিল আরিশ। শ্যামা কল রিসিভ করে ভয় পেয়ে যায়৷ আরিশের ধমক শুনে। আরিশ শ্যামাকে ধমকিয়ে জিজ্ঞেস করে কেন সে সারাদিন তাকে কল দেয় নি? কেন জানায়নি রুহানির নিখোঁজ হওয়ার খবর।
শ্যামা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘আমরা পুলিশ স্টেশনে গিয়ে ছিলাম ভাইয়া। এই সেই ঝামেলায় আপনাকে জানানোর কথা মাথায় আসেনি।’

আরিশ রাগান্বিত হয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘নিকুচি করেছে তোমার পুলিশ স্টেশন। তোমাকে আগেও বলেছি রুহানি আমার কাছে সব থেকে ইম্পর্ট্যান্ট। তবুও তুমি তার সম্পর্কে এত বড় একটা কথা জানাও নাই।’
শ্যামা নিচু কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে মাফ করে দিন ভাইয়া। আমাদের মাথায় তখন এতকিছু আসেনি।’

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২৩

শ্যামার কণ্ঠ শুনে আরিশ রাগ কমালো। রুহানির কথা তাকে জানালো না। কিছু না বলে কল কেটে দেয়। তীক্ষ্ণ শ্বাস ফেলে আরিশ। এক আঙুল কপালে ঠেকিয়ে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়। ঠোঁট জোড়া উল্টিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়ায়। চোখের কার্নিশ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরল। কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘কোথায় তুমি মায়ারনী? আমার ভুল হয়েগেছে। তোমাকে কারো ভরসায় ছাড়া উচিত হয়নি। আমার এয়ারপোর্টে যাওয়া উচিত ছিল।’

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২৫