বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৪৩

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৪৩
তাসফিয়া হাসান তুরফা

রেস্টুরেন্টের ছাদে বসে আছি কাউচে। রাইসা ও আমাকে বসিয়ে রেখে বন্ধুদের সাথে কথা বলতে গেছেন দুই ভাই। চেয়ে চেয়ে চারপাশ দেখছি। কথায় আছে বন্ধুদের কাছে গেলে গম্ভীর মানুষও চঞ্চল হয়ে উঠে, সবাই নিজেদের শৈশবে ফিরে যায়। কথাটা পূর্ণর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়! কিভাবে হেসে হেসে কথা বলছেন উনি সবার সাথে, প্রাণোচ্ছল হাসি!

দেখলেই মনটা ভরে উঠছে আমার! উনাকে এভাবে প্রাণখুলে হাসতে সচারাচর দেখা যায়না তবে যখন হাসেন তখন চারপাশের সবকিছু ছাড়িয়ে শুধু উনাকেই দেখতে ইচ্ছে করে! তবুও বেহায়া চোখদ্বয়ের দৃষ্টি ফিরিয়ে অপরপাশে তাকালাম।
বামপাশে তাকাতেই ছাদের এক কোণে চোখ পড়লো রায়হান ভাইয়ার উপর! রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে কথা বলছেন কারও সাথে। মাঝেমধ্যে দু-একবার হাসছেনও!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মাথাটা আরও খানিকটা এলিয়ে দিতেই চোখ পড়ে প্রিয়ার উপর। রেলিঙের অপর পাশে দাঁড়িয়ে দিব্যি অনর্গল কথা বলছে রায়হান ভাইয়ার সাথে! তাদের দুজন এভাবে একসাথে দেখে কিছুটা অবাকই হয়ে গেলাম আমি! প্রিয়া বেশ ফাস্ট, আসতে না আসতেই রায়হান ভাইয়াক খুজে বের করে গল্প করাও শুরু করে দিয়েছে! তাই তো বলি ওকে খুজে পাওয়া যাচ্ছিলোনা কেন!

আড়চোখে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলাম তাদের। দুজনের জুটিটা নেহাৎ মন্দ হয়না! বেশ লাগছে একে-অপরকে একসাথে! এরই মাঝে হাতে টান পড়ায় পূর্ণ মনে করে আমি বললাম,

—আপনি এসেছেন?
—না। তোর উনি এখনো আসেনি। এটা আমি। এদিকে তাকা, তখন থেকে কোনদিকে তাকিয়ে আছিস? কি দেখিস?
রাইসার গলায় পাশ ফিরে ওর দিকে সরু চোখে তাকালাম। সামনে তাকিয়ে দেখি পূর্ণ আর প্রান্ত দিব্যি খোশগল্পে ব্যস্ত বন্ধুদের সাথে। কি এমন কথা বলছেন সবাই? হয়তো অনেকদিন পর এক হয়ে পুরনো স্মৃতি আলোচনা করছেন সবাই! কে জানে? রাইসাকে কিছু বলবো এমন সময় প্রান্ত ভাইয়া এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। রাইসা ও আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

—তোমরা যাও। ওখানে বড় ভাইয়া আছে ওর বন্ধুদের সাথে। আমারও বন্ধু আছে কিছু। পরিচয় করিয়ে দেবে তোমাদের সাথে। প্রিয়াটা যে কোথায় গেলো, আমি ওকে নিয়ে আসছি!
প্রান্ত ভাইয়ার মুখে প্রিয়ার কথা শুনে বিচলিত হয়ে গেলাম আমি। যদি রায়হান ভাইয়ার সাথে ওকে দেখে ফেলেন? সন্দেহ করতে পারেন তো! তাই আমতা আমতা করে বললাম,
—ভাইয়া, আপনি রাইসাকে নিয়ে যান। আমি প্রিয়াকে নিয়ে আসছি। একটু আগেই দেখলাম ওকে, আপনার কস্ট করে খুজতে হবেনা।

—তাই? ওকে দেখেছো তুমি? তাহলে নিয়ে আসো। তবে জলদি এসো তুরফা, নয়তো না নিয়ে যাওয়ার অপরাধে আমাকে তোমার জামাইয়ের রাগের শিকার হতে হবে!
প্রান্ত ভাইয়ার কথায় হাসলাম আমি। ওরা চলে যেতেই দ্রুত কদমে প্রিয়ার কাছে গেলাম। রায়হান ভাইয়া আমাকে এক পলক দেখে চুপ হয়ে গেলেন। উনার সাথে কুশল বিনিময় শেষে প্রিয়াকে নিয়ে অন্যদিক চলে এলাম আমি। ওর মাথায় গাট্টা মেরে বললাম,

—নিজেকে একটু কন্ট্রোল করা শিখো, পাগলি। এখনি তোমার ভাই আসছিলো এদিকে। আমি উনাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাইসার সাথে পাঠিয়ে দিয়েছি! প্রান্ত ভাইয়াকে তো চিনোই? একবার সন্দেহ করলে কিছু হওয়ার আগেই সব শেষ হয়ে যেতো তোমার!

—আল্লাহ! তাই? আমার তো কথা বলতে বলতে কিছু মনেই ছিলোনা। থ্যাঙ্কিউ, ভাবী। এ যাত্রায় বাচিয়ে দিলে।
—হুম ঠিক আছে। এখন চলো তোমার ভাইদের কাছে। ওদের বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে।
প্রিয়া কিছু বলার আগেই পেছন থেকে বাহুতে টান পড়লো আমার! একটু আগের ঘটনা মনে হতেই রাইসার কথা মাথায় এলো। তাই পেছনে না তাকিয়েই বিরক্তিকর সুরে বললাম,

—আবার টানছিস কেন? যাচ্ছি তো আমি!
কোন সাড়াশব্দ না পাওয়ায় পেছনে তাকাতেই চোখে পড়লো পূর্ণর বিস্ময়কর চাহনি। অবাক স্বরে বললেন,
—কি বলছো এসব? তুই করে বলছো কেন?
এবার উনাকে দেখে থতমত খেয়ে গেলাম আমি। পূর্ণকে দেখে ভীত সুরে আমি বললাম,
—আপনি? সরি আমি বুঝিনি। ভেবেছিলাম রাইসা হবে তাই তুই করে বলেছি৷ একটু আগে ও এভাবে টেনেছিলো তো তাই আর কি!

আমার চেহারা দেখে মৃদু হাসলেন পূর্ণ। নাক টেনে দিয়ে বললেন,
—আচ্ছা বুঝেছি! ভয় পেতে হবেনা। আমি কিছু বলবোনা তোমায়।
পূর্ণর কথায় ইষৎ হাসলাম আমিও। এদিকে প্রিয়া গলা পরিষ্কার করে বললো,
—এক্সকিউজ মি, আমিও কিন্তু এখানেই আছি। ভুলে যেয়োনা কেউ।
প্রিয়ার কথায় লজ্জা পেয়ে গেলাম আমি। পূর্ণ ওর দিকে চোখ পাকিয়ে বললেন,

—তাই না? তুই এখানে আছিস বলেই তো তোকে খুজে পাচ্ছিলাম না আমরা। সব জায়গা বাদ দিয়ে ছাদের কোণার দিকে কি করিস তুই?
—ক-কিছু না, বড় ভাইয়া। আ-আমি তো এমনিই এসেছিলাম।
তোতলানো কণ্ঠে বললো প্রিয়া। পূর্ণ একবার সন্দেহের চোখে ওর দিকে তাকিয়ে পরমুহুর্তেই মুখ স্বাভাবিক করে সামনে যেতে যেতে বললেন,

—সব কথা বাদ। এখন সামনে চলো সবাই। আমার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে। রায়হানও এসেছে। রাইসার সাথে কথা বলছে দেখলাম। ওর সাথে দেখা হয়েছে তোমাদের? চলো দেখা করবে সবার সাথে।
আমি ও প্রিয়া আড়চোখে একে-অপরের দিকে তাকিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ উনার সাথে এগিয়ে চললাম। উদ্দেশ্য সবার সাথে পরিচয় হওয়া!

পূর্ণ উনার বন্ধুদের সামনে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাকে দেখে সবাই হাসিমুখে সাক্ষাত করলো। পূর্ণকে অবশেষে বিয়ে করাতে রাজি করানোর জন্য আমাকে অভিনন্দন জানালো সবাই। উনাদের কথায় আমি হাসবো না কাদবো বুঝছিলাম নাহ। রিশাদ নামের এক বন্ধু তো বলেই ফেললো,

—অবশেষে তোর উইকেট পড়ছে, মামা! আমি তো ভাবছিলাম তুই সারা জীবন সালমান খান হয়েই থাকবি। অল থ্যাংকস টু তুরফা ভাবী।
উনার মুখের কথা ছিনিয়ে আরেক বন্ধু বললো,
—একদম মনের কথা বলছিস, দোস্ত। কতদিন ওয়েট করছি পূর্ণর বিয়ে খাবো বলে। কিন্তু এ শালা তো বিয়ের দাওয়াতই দিলোনা।

—আমার তো মনে হয় ডিরেক্ট আমাদের চাচা বানায়ে তারপর জানানোর প্ল্যান ছিলো পূর্ণর। তাই না মামা?
উনার বন্ধুদের কথায় হোহো করে হেসে উঠলেন প্রান্ত ভাইয়া। রাইসা ও প্রিয়াও দেখি মিটিমিটি হাসছে। এদিকে আমি লজ্জায় অজ্ঞান হয়ে যাবো যাবো অবস্থা। ভেবেছিলাম পূর্ণ রাগ করবেন বা কিছু বলবেন অথচ জনাব দেখি নিজেও মজা নিচ্ছেন। ঠোঁট কামড়ে হেসে বন্ধুদের বললেন,

—বউ আমার এখনও ছোট। তাই আপাতত তোদের চাচা হওয়ার শখ পূরণ করতে পাচ্ছিনা। আপাতত আরও কয়েক বছর ওয়েট কর, যেমনটা আমি করছি!
—ওহহো মামা, তুমি দেখি বাপ হওয়ার জন্য খুব এক্সাইটেড। সব তো মনে হয় অলরেডি প্ল্যান করে রেখেছো!
উনাদের কথায় চোখ বড় বড় হয়ে গেলো আমার। অসভ্য লোকটা বলছে কি মানুষের সামনে? উনার বন্ধুরাও বা কেমন বেহায়ার মতো কথা বলছে! লজ্জায় আমার নাকের ডগা পর্যন্ত লাল হয়ে গেলো। পূর্ণ হয়তো সেদিকে খেয়াল করলেন। কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলেন। গম্ভীর মুখে বললেন,

—কিছু বলতে চেয়েছিলাম তোদের কিন্তু তুরফা লজ্জা পাবে তাই ওর সামনে বলবোনা। আমি চাইনা ও আনকম্ফোর্টেবল হোক।
অতঃপর আমার দিকে ঘুরে বললেন,
—তুমি কিছু মনে করোনা। আমার অনেক পুরনো বন্ধু তো এরা। আমরা সবাই এমন ফ্রি ভাবেই কথা বলি নিজেদের সাথে। অসস্তি লাগলে বলবে?
আমি আড়চোখে উনার দিক তাকিয়ে মাথা উপর-নীচ করে “হ্যাঁ” বললাম। রিশাদ ভাইয়া প্রান্ত ভাইয়ার কাধে চাপড় দিয়ে বললো,

—বুঝলে ছোট ভাই, তোমার বড়দা তো দেখি একদম বউভক্ত হয়ে গেছে! পূর্ণ এত নরম সুরে কথা বলতে পারে! তুমি কোনদিন ভেবেছিলে?
—এটা তো কেবল শুরু। আরেহ তোমরা তো এখনও আসল কাহিনিই জানোনা।
হেসে বললেন প্রান্ত ভাইয়া। পূর্ণ উনার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাতেই রিশাদ ভাইয়া ও অন্য বন্ধুদের নিয়ে সাইডে চলে গেলেন তিনি। এতকিছু হয়ে গেলো অথচ রায়হান ভাইয়ার খোজ নেই। কোথায় যে গেছেন উনি আমি বুঝতে পারলাম নাহ! একটু পর আরও গল্পগুজব করে খেতে চলে গেলাম সবাই।

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৪২

খাওয়ার পর নাকি গানের আয়োজন হবে! এদিকে পূর্ণকে গান গাওয়ার জন্য রাজি করাচ্ছে সবাই। অন্যদিকে তাকিয়ে দেখি রায়হান ভাইয়ার হাতেও গিটার! যা দেখে অবাক হয়ে গেলাম আমি! তাহলে কি উনি গিটার আনতে গিয়েছিলেন নাকি? উনিও কি গান গাইবেন নাকি? তাহলে তো আজ বেশ ভালোই আসর জমবে! উচ্ছাসিত চোখে গানের আসর শুরু হওয়ার অপেক্ষা করলাম আমি!

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৪৪