বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩৪

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩৪
তাসফিয়া হাসান তুরফা

আকাশির মাঝে সাদা রঙের কাজ করা সুতির শাড়ি পড়ে আপুদের সাথে রুমে রেডি হচ্ছি আমি। সব বোনেরা প্ল্যান করে কাছাকাছি রঙের শাড়ি পড়ে একরকমভাবেই সেজেছি আজকে। ছেলেরাও সবাই অন্যরুমে রেডি হচ্ছে। পাঞ্জাবি পড়বে তারা সবাই। আমি চুল ছেড়ে রাখতে চেয়েছিলাম তবে অন্য আপুরা চুল খোপা করায় অগত্যা আমাকেও করতে হলো। সামনের কিছু এলোচুল বের করে রেখে খোপা করা শেষ করতেই ডাক পড়লো বাহিরে যাওয়ার জন্য। ছেলেরা রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো রুমের সামনে। সব বোনদের সেজেগুজে দেখে তাসিন ভাইয়া দাত বের করে হেসে বললো,

—আমার বোনেরা যেন একেকটা আকাশের পরি। তোরা যে এত সুন্দর আগে তো জানতাম নাহ! মাশাল্লাহ।
মিলা আপু মেকি হেসে বললেন,
—এতদিন পর জানলি তুই সেটা? তুই তো চোখ থাকতেও অন্ধ রে তাসিন!
তাসিন ভাইয়া ক্ষেপে কিছু বলবেন তার আগেই পূর্ণ গম্ভীর গলায় বললেন,
—হয়েছে এবার থাম তোরা। কোথাও যাওয়ার আগেও তোদের ঝগড়া করতে হবে। শুধু শুধু টাইম নস্ট করছিস। কোনদিন বড় হবিনা না নাকি তোরা?
পূর্ণর কথায় একেঅপরের দিক চেয়ে থেমে গেলো তাসিন ভাইয়া আর মিলা আপু। এদিকে সবার সামনে পূর্ণর এত ভাব দেখে খুব বিরক্ত হলাম আমি!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—নিজে এত বড় দামড়া হয়ে আমার সাথে সবসময় ঝগড়া করেন তার বেলায় কিছুনা! আবার মানুষকে ডায়লোগ দিচ্ছেন!
বিড়বিড় করে বললাম আমি। পূর্ণ এক ভ্রু তুলে আমার দিক তাকালেন। আমাকে মাথা থেকে পা অবধি বিশ্লেষণ করে খানিকটা কেশে বললেন,
—কিছু বলতে চাও, তুরফা?
পূর্ণর কথায় সবার মনোযোগ আমার দিকে নিবদ্ধ হলো। হঠাৎ করে সবার উৎসুক দৃষ্টি নিজের উপর পড়ায় ভড়কে গেলাম আমি। তীক্ষ্ণ চোখে পূর্ণর দিক চেয়ে বললাম,

—কিছু বলার নেই আমার। বলছিলাম এখন আপনার দেরি হচ্ছেনা? দাঁড়িয়ে আছেন কেন? চলুন তাড়াতাড়ি। আপনিও সময় নস্ট করছেন এখন।
কথাটি বলেই হনহন করে হাটা শুরু করলাম আমি। পূর্ণ বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আছেন আমার দিকে। উনাকে যে আমি এভাবে বলবো তিনি হয়তো ভাবতে পারেন নি। এদিকে কাজিনমহল মিটিমিটি হাসছে। তাসিন ভাইয়া মিনমিন করে বললেন,

—ইতিহাস সাক্ষী আছে বড় বড় মহাপুরুষেরাও বউয়ের সামনে যুক্তিহীন হয়ে যায়। এই নিয়ম দেখছি তোমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়, বড় ভাইয়া।
পূর্ণ কড়া চোখে তাকালেন তাসিন ভাইয়ার দিকে। যে চাহনিতে মুখে হাত দিয়ে থেমে গেলো তাসিন ভাইয়া। অতঃপর পূর্ণ দ্রুতকদমে এগিয়ে এলেন আমার পিছু পিছু। বাকি সবাইও চলতে আরম্ভ করলো নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে! সিড়ি দিয়ে নামতে শুরু করার আগে হঠাৎ পূর্ণ পেছন থেকে আমার শাড়ির আঁচল ধরে ফেললেন। শাড়িতে টান লাগায় এক পলক পেছনে ফিরলাম আমি। পূর্ণকে দেখে রাগী চোখে জিজ্ঞেস করলাম,

—কি হয়েছে? আঁচল ধরেছেন কেন এভাবে? কেউ দেখলে কি মনে করবে?
—যার যা মনে করার করুক। আমি আমার বউয়ের আঁচল ধরেছি, অন্য কারও নয়! এমনিতেই তুমি শাড়িতে পুরোপুরি অভ্যস্ত নও, তারমধ্যে আঁচলটাও এত বড় রেখেছো। সিড়ি দিয়ে নামার সময় পায়ের নিচে পড়লে কি হবে?
উনি কথাগুলো বলতে বলতে পেছন থেকে আঁচল এনে আমার কাধের উপর দিয়ে দিলেন। সামনের একগোছা চুল সযত্নে সরিয়ে দিয়ে বললেন,

—এখন যাও। কুচি ধরে সাবধানে নামো সিড়িতে। আমি তোমার পেছনেই আছি।
পূর্ণর কোমলতা মিশ্রিত কথায় শান্তচোখে উনার দিকে চেয়ে রইলাম আমি। সাদা পাঞ্জাবিতে ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা এক টুকরো হাসিতে উনাকে কোনঅংশেই আমার প্রেমিক পুরুষের চেয়ে কম লাগছেনা বটে!

একটু আগে সবার সাথে আমায় ক্ষেপিয়ে হাসিঠাট্টা করা এই শুভ্র মানবটা এখন যে এইভাবে একান্তে নরম সুরে আমার সাথে কথা বলছেন, এটা কি কেউ ভাবতে পারে? উনার মনের প্রকৃতিতে যেন ক্ষণে ক্ষণে ঋতুবদল হয়! কখনো উনি রৌদ্রতপ্ত গ্রীষ্মের মতো রাগ দেখান, কখনো মন খারাপের দিনে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে মন ভালো করে দেন, সবার সামনে উনি শীতের মতো ঠান্ডা আচরণ করেন। আবার কখনো একান্তে নিভৃতে শরতের শুভ্র মেঘের মতো আমার হৃদয়ে কম্পন তুলেন! এই পূর্ণকে পরিপূর্ণভাবে বুঝা যেন বড্ড দায়!

কাশবনে পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে মুগ্ধ চোখে চারপাশ দেখছি সবাই। কাশফুলের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়না এমন প্রকৃতিপ্রেমী আদৌ আছে?শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘের ছড়াছড়ি। এমনিতেই শরতকাল নজরকাড়া সুন্দর, তার সৌন্দর্যে নতুনমাত্রা দিতেই যেন কাশফুলের জন্ম! দখিনা হাওয়ার সাথে কাশফুলগুলো তাল মিলিয়ে দুলছে আপন সুরে। সেদিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছি আমি, হাসিমুখে পাশে তাকাতেই চোখ পড়লো মুগ্ধ চোখে আমার দিক চেয়ে থাকা পূর্ণর দিকে! উনার চাহনিতে কি যেন ছিলো, বেশিক্ষণ সেদিক তাকিয়ে থাকতে পারলাম নাহ আমি। অবচেতন মনে হঠাৎ করেই খেলে গেলো লাজুকতা!

উনার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্যদিকে চলে গেলাম আমি। বাকি কাজিনদের সাথে ছবি তুলতে মনোযোগ দিলাম। খানিকবাদেই পূর্ণও এলেন সেখানে। সব কাজিনরা মিলে গ্রুপ ফটো তুললাম। পূর্ণ আর আমার একান্ত ছবি তুলে দেওয়ার জন্য জিদ করলো প্রিয়া। আমি পূর্ণর দিকে তাকাতেই উনি হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে।

জড়তা ভেঙে প্রসন্নচিত্তে সে হাতে হাত রাখলাম আমি। উনি শক্ত করে চেপে ধরলেন আমার হাত। রাশি রাশি কাশফুলের সামনে একসাথে দাড়ালাম দুজন। একটি ছবি তুলতেই হঠাৎ উনি পেছন থেকে কোমড়ে হাত রাখলেন আমার। চমকে উঠে উনার দিকে তাকালাম আমি। প্রায় মুহুর্তেই লজ্জার রেশ ছেয়ে গেলো দু’গালে! উনি ভ্রু উচিয়ে হাসলেন আমার দিক তাকিয়ে। ঠিক সে সময় ক্যামেরায় ক্লিক করলো প্রিয়া। উল্লাসিত গলায় বললো,

—উফ, পিকচার পারফেক্ট! ইশ কি সুন্দর লাগছে ভাইয়া-ভাবীকে!
প্রিয়ার কথায় সে ছবি দেখতে চলে এলো বাকি কাজিনরা। ওর কথায় সায় দিলো সকলেই। এদিকে লজ্জায় কিছু বলতে পাচ্ছিনা আমি কারণ পূর্ণ এখনও আমার কোমড় চেপে ধরে আছেন সবার সামনে। উনাকে সরানোর চেস্টা করতেই মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালেন উনি। ভাবখানা এমন যেন এখানে কি হচ্ছে উনি কিছুই জানেনা! এমন সময় ফোন বেজে উঠলো উনার। বিরক্তিতে মুখ কুচকে গেলো উনার। আমায় ছেড়ে ফোন রিসিভ করে অন্যদিকে চলে গেলেন উনি। খানিকবাদে ফিরে এসে বললেন,

—তোরা সবাই কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি কর। আমি ১০ মিনিট পর আসছি। একটা কাজের কথা বলতে হবে বাবার সাথে।
—ঘুরতে এসেও কি তোমার ফোনটা সাথে আনতে হলো, বড় ভাইয়া? তোমার ফোনটাই অলক্ষুণে! ভালো মুহুর্তে বেজে উঠে। এটাকে নিয়ে আসাই উচিত হয়নি তোমার!

বিরক্তিমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন প্রান্ত ভাইয়া। পূর্ণ কিছু বললেন নাহ। করুন চোখে আমার দিক চেয়ে ফোন কানে নিয়ে চলে গেলেন গাড়ির কাছে! সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। প্রান্ত ভাইয়া ঠিক বলেছেন উনার ফোনটা আসলেই অলক্ষুণে! অসময়ে বেজে উঠাই তার একমাত্র দায়িত্ব। তাসিন ভাইয়া ব্যঙ্গ করে বললেন,

—তুরফা বোন, বড় ভাইয়ার ফোনটাই তোর একমাত্র সতিন। বুঝলি? এটাকে যথাসম্ভব উনার থেকে দূরে সরিয়ে রাখবি।
তাসিন ভাইয়ার কথায় হেসে উঠলো সবাই। মলিন মুখে হাসলাম আমিও। কাজিনদের সাথে আরও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম আশেপাশে। পড়ন্ত বিকেলেই যেন কাশবনের আসল সৌন্দর্য প্রকাশ পায়! যে সৌন্দর্যের স্বাদ নিতে ছুটে এসেছে আমাদের মতো আরও অনেকে!

মানুষের কোলাহল, চারদিকে লোকজনের ছবি তুলা, হৈ-হুল্লোড়ে মুখোরিত হয়ে আছে পুরো কাশবন! চারদিক চেয়ে সেগুলোই দেখছিলাম আমি। এমন সময় চোখ পড়লো আমার কলেজের কয়েকজন ছেলেমেয়ের উপর। ওরাও বোধহয় বন্ধুবান্ধবরা মিলে ঘুরতে এসেছে। দীর্ঘদিন পর চেনামুখ দেখে তাকিয়ে ছিলাম ওদের দিকে আমি।

এমন সময় ওদেরও চোখ পড়লো আমার উপর! অনেকদিন পর আমায় দেখে আমার কাছে ছুটে এলো সবাই। জানতে এলো আমি কার সাথে এসেছি, ভার্সিটির জন্য কি প্ল্যান ইত্যাদি! আমিও টুকটাক কথা বললাম তাদের সাথে। একসাথে ছবিও তুললাম তাদের সাথে। এমন সময় বন্ধুমহলের এক ছেলে সামিন এগিয়ে এসে বললো,

—তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে, তুরফা। আসো একটা সিংগেল ছবি তুলি আমরা!
ওর কথায় ভ্রু কুচকে গেলো আমার। এই ছেলেটাকে কলেজ থেকেই আমার পছন্দ নাহ, কেমন গায়ে পড়া টাইপের। তবুও আমার বন্ধুদের সাথে থাকে বলে বাধ্য হয়ে কথা বলতে হয়। ওর এমন প্রস্তাব মোটেও পছন্দ হলো না আমার। ভদ্রভাবে মানা করলাম তবুও ছেলেটা নাছোড়বান্দার মতো ছবি তুলতে চাইছে। বিরক্ত হয়ে কিছু বলবো এমন সময় পূর্ণর রাশভারি আওয়াজে ভারী হলো চারপাশ।

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩৩

—কি হচ্ছে এখানে?
বন্ধুমহলসহ আমিও চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখি পূর্ণ গম্ভীর মুখে চেয়ে আছেন আমাদের দিকে। এদিকে উনার শান্ত গম্ভীর দৃষ্টি যেন আমায় বলছে এটা ঝড় আসার পূর্বের নীরবতা!

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩৫