বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩৩

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩৩
তাসফিয়া হাসান তুরফা

সকালবেলা ঘুম ভেঙে বিছানা উঠতে যেয়ে বাধা অনুভব করলাম। ভ্রুদ্বয় আপনাআপনিই কুঞ্চিত হয়ে গেলো। চোখ মেলে পাশে থাকাতেই চোখ গেলো শান্তভাবে ঘুমন্ত পূর্ণর দিকে। ঘুমের মাঝেই এখনও শক্তভাবে কোমড় জড়িয়ে ধরে আছেন আমায়। কালরাতে উনার সাথে এভাবে ঘুমিয়েছি মনে হতেই লজ্জার দল উড়ে এসে ভর করলো আমার গালে।

চোখ পিটপিট করে আমি আলতো হাতে তার হাত সরিয়ে নিলাম নিজের উপর থেকে। আস্তে-ধীরে শোয়া থেকে উঠে বিছানায় বসলাম তার পাশে। উনার মাথায় হাতের পিঠ দিয়ে তাপমাত্রা পরখ করে নিলাম। যাক! জ্বরটা পুরোপুরিই চলে গেছে। একদম স্বাভাবিক তাপমাত্রা এখন। মুচকি হেসে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম বাথরুমে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বের হয়ে এসে চুল আঁচড়াচ্ছিলাম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। পূর্ণ নড়েচড়ে উঠলেন। আয়নাতেই উনাকে আড়চোখে পর্যবেক্ষণ করছিলাম আমি৷ ঘুম থেকে উঠে চোখ না খুলেই পাশ হাতড়িয়ে আমায় খুজলেন উনি, যেটা দৃষ্টিগোচর হলোনা আমার। কেন যেন বিষয়টি একিসাথে বিস্ময় ও ভালোলাগা সৃষ্টি করলো আমার অন্তরে! আমায় না পেয়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলেন উনি। পূর্ণ আয়নার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো আমাদের। উনাকে তাকাতে দেখে দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিলাম আমি। হাতের কাজ শেষ করে উনার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

—এখন শরীর ভালো লাগছে আপনার?
—বউ রাতভর সেবা করলে কি শরীর ভালো না থেকে উপায় আছে? শরীর-মন দুটোই ভালো হয়ে গেছে আমার।
মুচকি হেসে বললেন উনি। উনার কথাটি মনে দাগ কাটলো আমার। তবে এ কথার বিপরীতে আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম নাহ। তাই চুপচাপ চলে যাচ্ছিলাম তখনি পূর্ণ আমার হাত ধরে ফেললেন। আমি পেছনে তাকাতেই বললেন,

—এক কাপ কফি বানিয়ে দেবে, তুরফা?
—করে আনছি। আপনি বসুন।
—আবার সেদিনের মতো চিনি দিও না আজ৷ একদিন কোনমতে খেয়েছি বলে ভেবোনা রোজ রোজ খেতে পারবো আমি।
বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুচকে বললেন উনি। উনার চেহারা দেখে খুব হাসি পেলো আমার। সেদিন ভালোই জব্দ হয়েছিলেন লোকটা! তবুও মেকি রাগ দেখানোর জন্য চোখ পাকিয়ে তাকালাম উনার দিকে। বিনিময়ে উনি অন্যদিক তাকিয়ে হাসলেন। আমিও হালকা হেসে রুম ত্যাগ করছিলাম। দরজার কাছে পৌঁছাতেই পূর্ণ হঠাৎই দ্রুতকদমে এগিয়ে এসে থামালেন আমায়। উনাকে আমার সামনে দাড়াতে দেখে আরেকদফা অবাক হলাম আমি। গোলগোল চোখে জিজ্ঞেস করলাম,

—আবার কি হয়েছে? সামনে এলেন কেন এভাবে?
পূর্ণ জবাব দিলেন না। তার দৃষ্টি গভীর। যে দৃষ্টির ভাষা পড়তে ব্যর্থ হলাম আমি! উনি খানিকটা এগিয়ে এসে আমার দিক কিছুটা ঝুকে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন,
—এভাবে বাহিরে যাবে তুমি?

পূর্ণর কথায় আপনাআপনিই ভ্রুযুগল কুচকে গেলো আমার। নিজের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম ওড়না ছাড়াই বেরিয়ে যাচ্ছিলাম রুম থেকে। তার মানে এতক্ষণ উনার সামনে ওড়না ছাড়া ঘুরেছি, কথা বলেছি? এটা ভাবতেই আক্কেলগুড়ুম হলো আমার! লজ্জায়-অসস্তিতে উনার দিকে তাকাতে পারলাম নাহ আমি। লোকটাও কেমন অসভ্য। এতক্ষণ ওড়না ছাড়া দেখলো একবারের জন্য বুঝতেও দিলোনা। ছিহঃ!! রাগান্বিত কণ্ঠে বললাম,

—আপনি যেহেতু এতক্ষণ খেয়াল করেছিলেন তবে আগে বলেন নি কেন আমায়??
আমার কথা শুনে পূর্ণ ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠলেন। সকালের মিস্টি রোদ এসে উনার চোখেমুখে খেলা করছে, তার মধ্যে ঠোঁটের কোণে এই দুষ্টু হাসি! বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না আমি। উনি ধীর স্বরে বললেন,

—আমার সামনে এভাবে থাকলে তো কোন সমস্যা নেই, এজন্যই বলিনি। তাই তোমারও এত বিব্রত হওয়ার কিছু নেই৷ তবে অন্য কারও সামনে ভুলেও এভাবে যাওয়া চলবেনা। তার মধ্যে বাহিরে কত মানুষ আছে আজ। মাথায় আছে তোমার? চুপচাপ ওড়না পড়ে নেও, স্টুপিড।

আস্তে করে শুরু করা কথাটা হঠাৎ ধমকে রুপ নেওয়ায় ভড়কে গেলাম আমি। আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে ওড়না খুজতে লাগলাম। বিছানার কোণে খুজে পেলাম কাংক্ষিত ওড়না। মনে পড়লো কালরাতে উনার মাথায় জলপট্টি দিতে এটা ব্যবহার করেছিলাম। এতক্ষণে শুকিয়ে গেছে সেটা। কই আমি উনার জন্য এতকিছু করলাম আর সকালবেলা সেই উনিই আমাকে আবার ধমক দেওয়া শুরু করেছেন! ভাবতেই মুখ ফুলিয়ে ওড়না নিতে গেলাম বিছানা থেকে। তবে এক্ষেত্রেও পূর্ণ গটগট করে হেটে আমার আগে চলে এলেন। বিছানা থেকে ওড়নাটা তুলে নিজেই আমার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে নরম কণ্ঠে বললেন,

—হয়েছে ম্যাডাম, আর গাল ফুলাতে হবেনা। এখন আপনি বাহিরে যেতে পারেন।
আমি এক পলক উনার দিকে চেয়ে চলে যাচ্ছিলাম। তখনি পূর্ণ বিছানায় হেলান দিয়ে বললেন,
—তুমি চাইলে এখন থেকে ওড়না ছাড়াই আমার সামনে থাকতে পারো। আমি কিন্তু মাইন্ড করবোনা।

উনার লাগামহীন কথা শুনে হকচকিয়ে পেছনে ঘুরতেই চোখে পড়লো তার শয়তানি হাসি। ভ্রু নাচিয়ে তাকালেন আমার দিকে। চোখ পাকিয়ে উনার দিক তাকিয়ে তাকে “অসভ্য লোক” উপাধি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। পেছন থেকে ভাসছে তার উচ্চস্বরে হাসির শব্দ৷ লোকটা দিন দিন বেহায়া হয়ে যাচ্ছেন কেমন যেন! উফ। অসহ্যকর!!

রান্নাঘরে প্রবেশ করতেই বড়াম্মুর দেখা মিললো। আমায় দেখে এগিয়ে এসে বললেন
—আচ্ছা তুরফা, পূর্ণর কি শরীর খারাপ ছিলো কাল রাতে? খাবার টেবিলে ঠিকমতো কথা বললোনা কারও সাথে, কোনরকম খেয়েই চলে গেলো। চোখ-মুখ লালচে হয়ে ছিলো আমার ছেলেটার।
বড়াম্মুর কথায় চিন্তার রেশ খুজে পেলাম আমি! মায়েদের মনকে আল্লাহ কিভাবে সৃষ্টি করেছেন আমার জানা নেই। সন্তানের কিছু হলেই মা কোন না কোনভাবে টের পেয়েই যান! কি চমৎকার বন্ধন! বড়াম্মুর চিন্তা আর বাড়াতে মন চাইলোনা আমার। তাই মলিন হেসে বললাম,

—চিন্তা করোনা, বড়াম্মু। তোমার ছেলের জ্বর এসেছিলো কাল রাতে। তবে আমি সামলে নিয়েছি। ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলাম উনায়, এখন ঠিক আছেন। কফি খেতে চাইছেন। তাইতো উনার জন্য কফি করতেই এসেছি এখানে।
আমার কথায় প্রশান্তি খেলে গেলো বড়াম্মুর চোখেমুখে। আমার গালে হাত রেখে বললেন,

—আমাদের ছোট্ট তুরফা এখন বড় হয়ে গেছে! বউ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে শিখেছে! মাশাল্লাহ! তোদের সম্পর্কটা দেখে আমার অন্তরে যে কি শান্তি অনুভব হয় মা আমি বলে বুঝাতে পারবোনা। সবসময় এভাবেই সুখে-দুঃখে পাশে থাক দুজন।
বড়াম্মুর কথায় হালকা হেসে কফি বানাতে মনোযোগ দিলাম আমি। উদ্দেশ্য এখন পূর্ণকে কফি দিয়ে এসে কাজিনমহলের সাথে গল্পগুজব করা!

কাজিনদের সাথে বসে আছি বাড়ির বাহিরে মাচানে। হাসিঠাট্টা, একেঅপরকে ক্ষেপানো সবকিছুই হচ্ছে এখানে। তাসিন ভাইয়া হঠাৎই বলে উঠলেন,
—এতদিন পর সবাই এলাম বাড়িতে। কোথাও একসাথে ঘুরতে যাবোনা তা কি হয়? ঘোরাঘুরি ছাড়া বাসায় বসে বসে জমছেনা। কি বলিস সবাই?

ভাইয়ার কথায় হইহই পড়ে গেলো। সবাই জোরেশোরেই সাড়া দিলো। তখনি আমার চাচাতো বোন মিলা আপু বললেন,
—তোর মতো গাধার মাথা থেকে এত ভালো বুদ্ধি কিভাবে বের হলো, তাসিন? আজ কি সূর্য উঠেনি নাকি আকাশে?
মিলা আপুর কথায় হাসির রোল পড়ে গেলো একদফা। তাসিন ভাইয়া রেগে বললেন,

—আমি গাধা না, তোরাই অন্ধ। বুঝলি? এজন্যই এতদিনেও আমার মতো বুদ্ধিমানের কদর করতে শিখলি নাহ!
—তুই? আর বুদ্ধিমান? দিনদুপুরে এমন জোকস মারতে লজ্জা লাগেনা?
তাসিন ভাইয়াকে খোচা মেরে বললেন মিলা আপু। দুই ভাইবোনের খুনসুটিতে মজা লুটছে বাকি সবাই। তাসিন ভাইয়া রেগে বললেন,

—তোরা সবাই খারাপ আমি তো জানিই। তাই তোদের সাথে তর্ক করে লাভ নেই। তুরফা এতদিন ছিলোনা, এখন তুরফার থেকে শুনতে হবে আমাকে ওর কাছে কেমন লেগেছে। তাহলেই আসল সত্যটা জানা যাবে। তাহলে বল তুরফা, তোর আমাকে বুদ্ধিমান লাগে না??
প্রশ্নটা করেই তাসিন ভাইয়া আমায় ইশারায় “হ্যাঁ” বলতে বললেন৷ তাকে দেখে হাসি পেলো। মুখ টিপে হেসে মাথা নাড়তেই পূর্ণ চলে এলেন সেখানে। আসতে না আসতেই উনার রাশভারি আওয়াজ শুনা গেলো তৎক্ষণাৎ।

—এক স্টুপিড আরেক স্টুপিডকে জিজ্ঞেস করছে সে বুদ্ধিমান কি না! হাও ফানি!
পূর্ণর কথায় সবাই হোহো করে হেসে উঠলো। এদিকে লজ্জায় অপমানে মুখ কালো করে একে-অপরের দিক চেয়ে রইলাম তাসিন ভাইয়া আর আমি। এভাবে ভরা মাহফিলে আমাদের অপমান করার জন্য রাগে উনার মাথা ফাটিয়ে দিতে মন চাইলো আমার। তবুও উনি সদ্য জ্বর থেকে উঠেছেন তাই মুখে কলুপ এটে চুপ করে বসে রইলাম। প্রান্ত ভাইয়া বললেন,

—এটা ভালো ছিলো, বড় ভাইয়া। তবে তাসিনের পাশাপাশি তুরফা বেচারিকে এভাবে না বললেও পারতে। সবসময় এমন করো কেন ওর সাথে?
প্রান্ত ভাইয়াই আমার মনের কথা বুঝলেন। উনার দিকে দুঃখী মুখ করে চেয়ে রইলাম আমি। সেদিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে পূর্ণ বললেন,

—তুরফাকে কোন দিক দিয়ে তোর বেচারি মনে হয় বল তো? তোর দেখি ওর সম্পর্কে আইডিয়াই নেই।
—থামবেন আপনি? কি শুরু করেছেন এসেই?
তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললাম আমি।

—দেখেছিস এবার? আমার সাথে মুখে মুখে তর্ক করে! এত তেজ ওর। আর তোরা ওকে ভুল বুঝে বেচারি ভেবে আসছিলি এতদিন! আমাকে বেচারা বল। ওর সাথে থাকতে হয় আমার! কিভাবে ওকে সহ্য করি আল্লাহই জানে!
পূর্ণর কথায় হেসে উঠলেন প্রান্ত ভাইয়া। সাথে হাসলো সবাই। এদিকে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো আমার। কি যা-তা বলছেন সবার সামনে? লোকটা আসলেই খুব খারাপ। সবাই এতক্ষণ নিজ নিজ জায়গায় বসেছিলো, পূর্ণ পরে আসায় দাঁড়িয়ে আছেন বিধায় দিশা আপু বললো,

—তুমি এখানে বসো, পূর্ণ। আমি অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছি। দাঁড়িয়ে থাকবো কিছুক্ষণ।
তবে পূর্ণ তাকে উঠিয়ে বসতে রাজি হলেন নাহ। বরং উনি বলে উঠলেন,
—তুই বসেই থাক ওখানে। তোর উঠা লাগবেনা। বরং তুরফা উঠে যাক। বাড়ির বউ কাজ না করে সারাদিন বসে থেকে খায়, ওর তো কিছু করা দরকার! এই তুরফা যাও তো, কিছু খাবার নিয়ে এসো সবার জন্য।
পূর্ণর কথায় আরেকদফা রাগ ভর করলো আমার মধ্যে। এখানে আমি বাড়ির বউ হিসেবে আড্ডা দিচ্ছিলাম নাহ, বাড়ির মেয়ে হিসেবে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তাও উনার সহ্য হলোনা। আমাকেই উঠাতে হলো। তীক্ষ্ণ চোখে উনার দিক চেয়ে উঠে নাস্তা আনতে চলে গেলাম আমি।

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩২

সবার গল্পগুজব, হাসি-ঠাট্টার মাঝে ঠিক হলো যে আমরা কাশবন বেড়াতে যাবো। শরতকালে যদি কাশবনেই না যাই তবে আর কি হলো? কাশবন শুনে খুশি হয়ে গেলাম আমি! আমার বরাবরই কাশফুল দেখতে ভালো লাগে। সেখানে গিয়ে কে কিভাবে ছবি তুলবে সেগুলো প্ল্যান চলতে লাগলো। আমিও খুশি মনে রেডি হতে চলে এলাম রুমে। এতদিন পর পরিবারের সাথে, কাজিনদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার কথা ভেবে খুশির রেশটা দ্বিগুন হয়ে আছে আমার অন্তরে..!!

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩৪