বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩২

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩২
তাসফিয়া হাসান তুরফা

জ্বরের ঘোরে কাতর হয়ে আছেন পূর্ণ। হালকা গোঙানির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে উনার কাছে থেকে। আমি কম্পনরত হাতে উনার ভারী দেহকে সোজা করে শুয়ে দিলাম। বিছানায় ভাজ করে রাখা কাথাটা নিয়ে তার উষ্ণ শরীর ঢেকে দিলাম। তবুও উনি ইষৎ কাপছেন তাই আমি রুমের আশেপাশে অন্য কাথা খোজার জন্য চোখ বুলালাম।

রুমের কোণে অবস্থিত এক পুরনো আলমারি চোখে পড়লো। দ্রুত পায়ে হেঁটে আলমারির কাছে গিয়ে খুলে দেখি ওর ভেতরে কিছু বালিশ আর দুটো কাথা রাখা আছে। কাথাটি নিয়েই পূর্ণর কাছে গেলাম। উনাকে পুনরায় কাথা দিয়ে ঢেকে দিলাম। কিছুক্ষণ যেতেই উনার কম্পনের বেগ কমে এলো। চিন্তিত মুখেই একটি সস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

উনি চোখ বন্ধ করে এখনও ঘুমের ঘোরেই আছেন। এদিকে আমি ঠান্ডা মাথায় ভাবতে লাগলাম কি করে তার জ্বর কমানো যায়। সবাই মাত্র খেয়েদেয়ে ঘুমিয়েছে। তাদের কাচাঘুম ভাংতে সায় দিলোনা মন। বাথরুম থেকে এক মগ পানি নিয়ে এসে বিছানার পাশের সাইড টেবিলে রাখলাম।

হাতের কাছে সুতি কাপড় বলতে তৎক্ষণাৎ আমার ওড়নাই চোখে পড়লো তাই সেটাই পানিতে ভিজিয়ে তার মাথায় জলপট্টি দিতে লাগলাম। কিছুক্ষণ জলপট্টি দেওয়ার মাঝেই তার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এলো। শরীরের তাপমাত্রাও বেশ কিছুটা কমে এসেছে এতক্ষণে। ভাবলাম এখন উনাকে ওষুধ দেওয়া উচিত, যেহেতু কিছুক্ষণ আগেই খেয়েছেন তাই ভরপেট থাকা অবস্থায়ই ওষুধ দিয়ে ফেলতে। এতে জ্বরটাও একেবারেই কমে যাবে।

যা ভাবা সেই কাজ। তবে নিজের ব্যাগ ঘেটে ফার্স্ট এইডের কোন বক্স পেলাম নাহ, হতাশ মনে নিজের উপর নিজেই ক্রুদ্ধ হলাম আমি। আসলেই পূর্ণ ঠিকি বলে আমি বড্ড খামখেয়ালি, ওষুধপত্রের মতো দরকারি জিনিস যে সাথে করে ক্যারি করতে হয় এটাও আমি করিনা।

অসহায় মুখে ফিরে আসছিলাম বিছানায়, হঠাৎই কি মনে করে যেন পূর্ণর ব্যাগ চেক করলাম। উনার ব্যাগ কিছুদূর হাতড়াতেই পেয়ে গেলাম কাংক্ষিত ফার্স্ট এইডের বক্স! লোকটা আসলেই প্রচন্ড কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন, দরকারি জিনিস সব সাথে নিয়েই ঘুরেন। বক্স থেকে প্যারাসিটামল বের করে খেতে দিলাম উনাকে। পূর্ণ খেতে চাইছিলেন নাহ, একপ্রকার জোর করেই খাইয়েছি তাকে। ওষুধ খেয়ে উনি আবার ঘুমে ঢলে পড়লেন। তার গায়ে ভালোভাবে কাথা টেনে দিয়ে জানালার ধারে গিয়ে দাড়ালাম আমি।

এভাবে ঠিক কতক্ষণ অতিক্রম হয়েছে আমার জানা নেই। সময় গড়িয়ে চলেছে নিজের মতোন। অশান্ত মনকে শান্ত করতে আকাশের চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আছি। আজকের চাঁদটা সেদিনের মতো বড় নয়। সেদিন চাঁদটাও যেন হাসছিলো আমার খুশিতে যেদিন পূর্ণ আমার সাথে ছিলেন, আজ আমার একাকিত্ব দেখে যেন চাঁদটা মন খারাপ করে আছে। পেছন ঘুরে পূর্ণর দিকে তাকালাম আমি, এখন জ্বর নেই বোধহয় আর।

শান্তভাবে ঘুমোচ্ছেন। ধীর পায়ে উনার শিয়রে বসে আলতোভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। লোকটাকে এমন নিথরভাবে পড়ে থাকতে দেখতে মোটেও ভালো লাগছেনা আমার। মনে হচ্ছে কখন উঠবেন আর উনার চিরচেনা গম্ভীর স্বরে ডাকবেন আমায়। একিসাথে রাগও হলো উনার উপর৷ কি দরকার ছিল এতক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজার? অযথাই ভিজলেন অসময়ের বৃষ্টিতে, জ্বর তো বাধবেই! উপরন্তু উনি আমার রাগ ভাংগানোর জন্য ভিজেছিলেন এটা ভাবতে আরও বেশি খারাপ লাগলো আমার।

মনের কস্ট কখন চোখের অশ্রু হয়ে ঝরে পড়লো বুঝে এলোনা আমার। এরই মাঝে নড়েচড়ে উঠলেন পূর্ণ। ঘুম থেকে উঠে আধো চোখে চারপাশ চেয়ে আমার দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইলেন চুপচাপ। যেন সদ্য ঘুম ভেঙে বুঝার চেস্টা করছেন এখানে কি হচ্ছে। খানিক মুহুর্ত বাদে কোমল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

—কাদছো কেন তুমি? আমার জন্য চিন্তা হচ্ছে?
এতক্ষণ পর উনার কণ্ঠ শুনে আমার বাকশক্তি লোপ পেলো যেন! আমি কিছু বলতে পারলাম নাহ। ঠোঁট চেপে ধরে কান্না থামানোর চেস্টা করলাম। হঠাৎ করেই লোকটার প্রতি নিজেকে বড় দূর্বল লাগছে। আমাকে কথা না বলতে দেখে পূর্ণ কাথার নিচ থেকে উনার হাত বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

—আমি ঠিক আছি তো, তুরফা। শুস,,কাঁদে নাহ। এই যে আমার হাত ধরে দেখো।
আস্তে করে উনার হাতের তালুতে হাত রাখলাম আমি। তার হাতে-গায়ে পরশ লাগিয়ে বুঝলাম তাপমাত্রা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে বটে। তবুও খানিকটা উষ্ণতার রেশ আছেই। গলার দিকে সামান্য ঘেমে গেছে উনার তাই উপর থেকে দ্বিতীয় কাথাটা সরিয়ে দিলাম আমি। পূর্ণ চুপচাপ দেখছেন আমায়। আমি অভিমানী কণ্ঠে বললাম,

—কেন ভিজলেন বৃষ্টিতে এতক্ষণ? নিচে নেমে কি কথা বলা যেতো না? আপনার হঠাৎ এত জ্বর দেখে আমি কত ভয় পেয়েছিলাম জানেন??
আমার কথা শুনে পূর্ণ মৃদু হাসলেন। এই ফ্যাকাশে চেহারায়ও তার হাসির সৌন্দর্য বিন্দুমাত্র ম্লান হলোনা। উনি মুখে হাসি রেখেই বললেন,

—তুমি সব কথাতেই এত ঘাবড়ে যাও কেন, পাগলি? এই সামান্য জ্বর পূর্ণকে কাবু করতে পারেনা, বুঝেছো?
এক মুহুর্ত থেমে বললেন,
“আমি সেদিনও বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম খুব, জ্বর আমার সেদিনও এসেছিলো। সেদিনই যখন কিছু হয়নি আর আজ তো তুমি পাশে আছো, আজ কিভাবে কিছু হতো?”
পূর্ণর কথা শুনে কান্না থামিয়ে চকিত দৃষ্টিতে তাকালাম আমি। সেদিন বলতে উনি কোনদিনের কথা বলছেন? কৌতুহলী কণ্ঠে বললাম,

—কোনদিনের কথা বলছেন আপনি? কি হয়েছিলো সেদিন? আর আপনি বৃষ্টিতে ভিজেছিলেন কেন এত? বৃষ্টি কি আপনার খুব পছন্দ?
আমার কথায় উনি মলিন হাসলেন। ধীম সুরে বললেন,
—আগে পছন্দ ছিলোনা। এখন ভালো লাগে।
পূর্ণর কথা শেষ না হতেই বাহিরে ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করলো। জানালা খোলা থাকায় যে বাতাসে শিউরে উঠলাম আমরা দুজনেই। উনার ঠান্ডা লাগতে পারে ভেবে আমি জানালা বন্ধ করে দিয়ে চলে এলাম। পূর্ণর দিকে তাকাতেই উনি বললেন,

—আমার ঠান্ডা লাগছে, তুরফা।
—আরেকটা কাথা গায়ে দিয়ে দিবো?
চিন্তিত মুখে কথাটা বলেই উঠতে লাগলাম কাথা নেওয়ার জন্য। উনি তৎক্ষণাৎ ধরে ফেললেন আমার হাত। কোমল সুরে বললেন,
—তুমি আমার পাশে শুয়ে পড়ো তাহলেই হবে।
পূর্ণর কথায় একিসাথে বিস্ময় ও লজ্জা ঘিরে ধরলো আমায়! জ্বরের ঘোরে কিসব বলছেন নিজেও বুঝতে পারছেন তো? স্তিমিত সুরে বললাম,

—আমার ঘুম ধরছেনা। এখন আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন, আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। আপনি ঘুমানোর পরে আমি ঘুমাবো। আপনার রেস্টের প্রয়োজন।
—তুমি আমার খেয়াল রাখতে রাখতে নিজের অযত্ন করবে এটা আমি হতে দিবোনা। আমি ঘুমাবো, সাথে তোমাকেও ঘুমাতে হবে। এটাই হচ্ছে শর্ত। এখনি আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ো চুপচাপ।

পূর্ণর কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে গেলাম আমি। উনি খুব জেদি। যা বলবে সেটাই করবে! তাই উপায় না পেয়ে উনার পাশে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎই পূর্ণ উনার কাথার মাঝে টেনে নিলেন আমায়। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলাম আমি! আমার বিস্ময়কে আরও বাড়িয়ে দিতে উনি একহাতে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে অতি নরম গলায় বললেন,

—আজকের রাতের জন্য তোমার উষ্ণতা আমার সাথে ভাগাভাগি করবে, তুরফা?
নিঃসংকোচ সামান্য আবদার যাতে সাড়া না দিয়ে পারলাম নাহ আমি। এত সুন্দরভাবে চাইলে কেউ মানা করতে পারে? আমিও পারলাম নাহ। আলতোহাতে জড়িয়ে ধরলাম উনাকে। এই নিশুতি রাতে তার বুকের ঢিপঢিপ ধ্বনি শুনতে বেশ লাগলো। পূর্ণ ধীরস্বরে বললেন,

—বৃষ্টির সাথে একজনের জীবনের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে, শুনবে?
আমি মাথা নেড়ে বুঝালাম “আমি শুনবো”। এবার উনি আরেকটু প্রবলভাবে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। যদিও সরাসরি জবাব দিলেন নাহ। বরং কণ্ঠে একরাশ স্নিগ্ধতা মিশিয়ে বললেন,

—বৃষ্টির প্রতি ছিলো তার বড্ড অভিমান। জীবনের সবচেয়ে বড় কস্ট সে বৃষ্টির দিনেই পেয়েছিলো! কেন তার সাথে এমনটা হলো কিশোরমনের ছিলো অভিযোগ, তাই তো বৃষ্টির প্রতি অবহেলা বাড়তে লাগলো প্রতি রোজ। তবে প্রকৃতির খেলা যে বড়ই অদ্ভুত। যা বুঝার সাধ্য নেই কারও। প্রমাণ পেলো সে আরও একবার। বৃষ্টি তার কৈশোরের অভিমান নিভিয়ে দিলো যৌবনের এক বৃষ্টিময় দিনে। নিজহাতে তুলে দিলো বৃষ্টিকন্যাকে তার হাতে…
—তারপর?

পূর্ণর কোন সাড়া না পেয়ে মাথা উঠিয়ে উনার দিকে তাকালাম। অক্ষিজোড়া বন্ধ হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। শান্ত নিঃশ্বাস বলে দিচ্ছে এতক্ষণে ঘুমের রাজ্যে বিচরণ করছেন উনি। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। গল্পটা পুরোটা শুনাই হলোনা। অসম্পূর্ন থেকে গেলো। তবে শুনতে খুব ভালো লাগছিলো। অন্য একদিন উনার থেকে জেনে নিবো। ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করতেই পূর্ণর উষ্ণতার আবেশে শিহরণ জাগলো মনে।

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩১

মনে হচ্ছে এতক্ষণ মনের মধ্যে বিরাজমান অশান্ত ভাবটা যেন নিমিষেই উড়ে গেছে উনার কাছে আসায়! মনটা যেন বলছে উনার কিছু হলে আমি ভালো থাকবোনা। আমার ভালো থাকার জন্য হলেও উনার ভালো থাকা প্রয়োজন। উনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম আমিও…

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩৩