প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব ৩০

প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব ৩০
আরোহী নুর

হাসপাতালে অনেক তোরজোর শুরু হয়েছে,অনেক এমারজেন্সি দেখার পর ক্লান্ত হয়ে নিজের কেবিনের দিকে হাঁটা ধরল আঁখি,পথিমধ্যে আদৃতের কেবিন,কেন জানি মন টালন সেদিকটায়,মনের টানে সাড়া দিয়ে ঢুকে গেল সেই কেবিনে,আদৃত এখনও কেবিনে ফিরে নি, আঁখি কেবিনের একটা চেয়ারে এসে বসল,আদৃতের সান্নিধ্যে মনের প্রশান্তি তো সেই ছয় বছর আগেও পেত আঁখি,আজ কেবিনে আদৃত না থাকলেও তার গায়ের ঘ্রাণ যেন স্পষ্ট নিতে পারছে সে।বিষাদে মন ছেঁয়ে আছে,একটা ভুল পদক্ষেপ, ভালোবাসার মানুষটাকে ভুল বোঝার পরিণামস্বরুপ ছয় টা বছর নাশ হয়ে গেল তার,সব কিছুই শেষ হয়ে গেল।

আঁখির হঠাৎ চোখ গেল আদৃতের হ্যান্ড ব্যাগের উপর,ব্যাগের চেইন খোলা হয়ত তাড়াহুড়োয় খোলা রেখেই চলে গেছে,ব্যাগের ভিতর থেকে উঁকি মেরে আছে একটা ডায়েরি,আঁখির কৌতূহল জন্মালো তাতে,এমনিতে যে কারো জিনিসে কখনও না বলে হাত না দিলেও আদৃতের ক্ষেত্রে কখনও ফরমালিটি করে নি সে।তাই ওটা হাতে নিয়ে নিল,প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে লিখা সুখপাখি,নিচে ছোটো আকারে লিখা আমার হিটলার আঁখি।আঁখি আলতো করে হাত বুলালো লিখাগুলোর উপর,আন্দাজ করতে পারল কেবিনে কেউ আসছে তখন তাই ডায়েরিটা খুব গোপনে লুকিয়ে নিল তার কাপরের নিচে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

″আরে আঁখি,কখন আসলে এখানে?″
″এই তো একটু আগে।″
″তা বলো কোথায় গিয়েছিলে?তুমি জানো আমি কতটা পেরেশানিতে ছিলাম তোমাকে নিয়ে?″
″এতো ভাবেন কেন আমাকে নিয়ে?আমি কে হই আপনার?″

″সবকিছু কি শুধু বলে বোঝাতে হবে আঁখি?″
″বুঝে নেওয়ার ব্যর্থতায় বছরের পর বছর কাটিয়ে দেওয়া থেকে তো মুখে বলাই শ্রেয়।″
″মানে?″
″মানেটা কি বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করা যায় না?″

ছলছল চোখে আঁখির বলা কথাটা আদৃতকে আরও অস্থির করে তুলল।আদৃত ছোটে গেল আঁখির পাশে।
″কি হয়েছে আঁখি বলো আমায়? তুমি ঠিক আছো তো?এ কি তোমার হাতে কি হয়েছে?অনেকটা কেটে আছে,রক্তও শুকিয়ে গেছে, কি হয়েছে তোমার?কোথায় গিয়েছিলে?দেখি বসো তুমি আমি ফাস্ট এইড আনি।″
তখন সানিয়াকে মা*র*ধ*রে আঁখির হাতের কনুইয়ের নিচ অংশে অনেকটা কেটে গিয়েছিল আঁখির।আদৃত এবার বেগতিক পায়ে ফাস্ট এইড বাক্স এনে আঁখির ক্ষততে ওষুধ লাগাতে শুরু করেছে আঁখি অপলকে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

″এখনও ততটাই ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারছি যতটা ছয় বছর আগে করতাম আপনার ওই চোখে নিজের জন্য,তবে কেন আমি তা তখন অবিশ্বাস করে গেলাম,আজ যে বড্ড ইচ্ছে করছে ডা.সাহেব আপনাকে জড়িয়ে ধরি,চিৎকার করে কেঁদে বলি যে ওরা আমাদের ঠকিয়েছে, আমাদের ভালোবাসা ভুলের নিচে চাঁপা দিয়েছে ওরা।″

″তুমি বড্ড বেখেয়ালি,এখনও বাচ্চামো যায় নি তোমার,উপর থেকে শাসন করার তো কেউ নেই তাই এমন।″
″আপনি তো খুব শাসন করতেন,এখন কেন ছেড়ে দিলেন?″
″অধিকারটা কি আদোও আছে?″
″ধরে রাখতে জানলে কখনও কিছু হারায় না।″
কথাটা বলে আঁখি উঠে চলে গেল ডায়েরিটা এমনভাবে লুকাল যাতে আদৃত না দেখতে পায়।আদৃত বুঝে উঠতে পারল না আঁখির কথার মানে।

জিসান পৌঁছাল আমিরুল এর বাড়িতে কিছুটা হতাশ হলো সেখানে গিয়েও, কিন্তু পুরো খালি হাতেও তো ফেরে নি সে,সেখানে গিয়ে আমিরুলের পরিবারকে জেরা করে জিসান।অতঃপর সকল তথ্য জানতে পায় তার বাবার কাছে।
″মি.নজরুল,আপনিই তো আমিরুলের বাবা?আমিরুল যশোরে দ্বিতীয় বিয়ে করে থাকত কথাটা আপনি কবে থেকে জানেন?″

″বাবা ও যশোর একটা ভালো জব পেয়েছে বলেছিল,সেখানে থাকত মাঝে মধ্যে টাকা পাঠাত। কিন্তু ১বছর পর জানতে পারলাম ও তারই স্ত্রী নিলিমার দূর সম্পর্কের বোন রিদুকে বিয়ে করে নিয়ে সেখানে থাকছে।কথাটা শুনেই নিলিমা আয়ত্তের বাইরে চলে যায়,আমাদের না জানিয়েই সেখানে গিয়ে ঝগড়াঝাটি শুরু করে।″

″রিদু না তাহমিনা?″
″না বাবা রিদু ই।″
″আপনি এতো শিওর কি করে যে মেয়েটার নাম রিদু।″
″ওই মেয়েটা নিলিমার দূর সম্পর্কের বোন ছিল,কোনো এক কাজে কয়েকদিনের জন্য থাকতে এসেছিল আমাদের এখানে কিন্তু কয়েকদিন গেলে নিলিমা নিজেই তাকে ঘর থেকে বের করে দেয় তার উপর একপ্রকার জোর খাটিয়ে,যাতে আমরা অবাক হই আর তারপর তো জানতে পারি আমিরুল ওকে বিয়ে করেছে।″

″রিদুর কি কোনো ছবি হবে আপনাদের কাছে?″
″না বাবা,ও মানুষের সাথে মিশত কম,ছবিও উঠত না।″
″ওর বাড়ির ঠিকানা আছে?″
″হ্যাঁ ওর বাড়ির ঠিকানা বলতে পারব।″
″ঠিক আছে ঠিকানাটা লিখে দিন আমায়।আর হ্যাঁ ওকে যে আমিরুল বিয়ে করেছে খবরটা কে দিয়েছে আপনাকে।″
″ওর বাবা নিজেই ফোন করে।″

″কি!ওর নিজের বাবা জানিয়েছেন আপনাকে বিষয়টা।″
হ্যাঁ বাবা।আর এটাও বলেছেন উনার মেয়ের মানসিক অবস্থা ভালো নয় পারলে কোনো পদক্ষেপ নিতে ওর বিরুদ্ধে।উনার কথার মানে আমি কিছুই বুঝতে পারি নি তখন।

আজ আর আদ্রিশের ওখানে যেতে চায় নি আঁখি,সারাদিনের কাজে বেশ ক্লান্ত সে,আদ্রিশের সামনা করতে হলে যে অনেক শক্তির প্রয়োজন হবে তার,এদিকে ভেবে পাচ্ছে না আদৃতকে কি সব জানানো উচিৎ? সবকিছু শুনে কি প্রতিক্রিয়া করবে সে?সে কি সব কিছু সহ্য করে উঠতে পারবে?মেনে নিবে কি সবকিছু স্বাভাবিকভাবে না কি সৃষ্ট করবে কোনো ধ্বংসের তান্ডব।

আদৃতকে নিয়ে তো একপ্রকার ভয় হয় আঁখির,রাগ তার প্রচুর,হুটহাট চলে না আসলেও যখন আসে তখন ভ*য়ং*ক*র রুপ ধারণ করে আদৃত,তাতে নিজের ক্ষতি হবে কি না সে বিষয়েও কোনো হুশ থাকে না তার।তাই এতো ভাবছে আঁখি,বিষয়টা কি আদোও জানানো উচিৎ হবে আদৃতকে? অনেক ভাবার পর সিদ্ধান্ত নেয় আঁখি আদৃতকে জানাবে সব কিছু।আদৃতকে কক্ষে না পেলে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে আদৃত ছাঁদে,তাই সেদিকটায় যায়।ছাঁদে প্রবেশ করতেই থমকে যায় আঁখি সামনে চলমান দৃশ্য চোখে ভাসতেই,রিংকি একটা শর্ট নাইটি পরে জরিয়ে ধরেছে আদৃতকে,জোরে জোরে বলছে।

″আই লাভ ইউ আদৃত।আই লাভ ইউ।″
আদৃত তাকে সাথে সাথে টান দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে বেশ কর্কশ গলায় বলল।
″আমি তোমাকে ভালোবাসি না রিংকি,বুঝো না কেন?ভালোয় ভালোয় বলছি আমেরিকা চলে যাও, আমি তোমার টিকিট বুক করে দিয়েছি,কাল রাতে ফ্লাইট।″

″আমি যাব না,তুমি বলো আমার মধ্যে কি কমতি আছে যার জন্য তুমি আমাকে ভালোবাসো না?ওই ডিভোর্সির মধ্যে কি পেয়েছ যে দিন রাত ওর পিছন পরে থাকো?ও এমন কি দিবে তোমায় যা আমি দিতে পারব না?না কি রাত কাটায় তোমার সাথে তাই ওর শরীরের মায়া ছাড়তে পারছ না?″
″রিংকি…″

গর্জে উঠে আদৃত হাত উঁচুতে উঠিয়ে নিলেও রিংকির গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে ওঠতে পারে না।
″আমি কোনো মেয়ের গায়ে হাত তুলি না নইলে আঁখিকে অসম্মান করার শাস্তি কতটা ভয়াবহ হতে পারত বুঝিয়ে দিতাম তোমায় আজ,কাল রাতে বাড়ি ফিরে যেন আমি তোমাকে না দেখি,নইলে ভালো হবে না।″
আদৃত চলে আসতে নিলে আঁখিকে দেখতে পেল।

″আঁখি তুমি এখানে?″
″ওই আসলে খাবার দেওয়া হয়ে গেছে নিচে, ডাকতে এসছিলাম।″
আঁখি কিছুই শোনে বা দেখে নি এমন ভাব করে চলে গেল সেখান থেকে।
″আঁখি কিছু শোনে নি তো?রিংকির কথাগুলো যদি শুনে থাকে তবে নিশ্চিত খুব কষ্ট পাবে মনে যা আমি মেনে নিতে পারব না।″

আঁখি চলে আসলো নিজের কক্ষে,আজ ছয় বছর পর আদৃতকে নিয়ে সেই জ্বলন অনুভব করতে পারল মনে যা ছয় বছর আগে কোনো মেয়ের সাথে আদৃতকে দেখলে হতো আঁখির। প্রথম ভালোবাসা কখনও ভোলা যায় না,হয়ত জীবন চলতে গিয়ে তাকে মনের এক কোণে ধামাচাপা দিয়ে রেখে দেওয়ার প্রচেষ্টা করে ব্যর্থ প্রেমিকগণ,আঁখিও তো তাই করেছিল,কিন্তু অপ্রিয় এক তিক্ত সত্য আদৃতের প্রতি তার সেই সুপ্ত অনুভুতি যেন আবারও জাগিয়ে তুলল।

অনুভুতির মাত্রা আজ আগের মতো এতো প্রখড় না হলেও কম কোথায়।কিন্তু সর্বনাশা আরেকটা সত্য পিছু টানছে আঁখিকে,আঁখির সাথে যে আদ্রিশের নাম জুরে গেছে।ডিভোর্স নামক কলঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকা আঁখি কি করে আদৃতের পবিত্র জীবনে দাঁগ মাখাতে পারে!রিংকির বলা কথাটা, বড্ড আঁচড় কেটে গেছে আঁখির মনে মুহুর্তেই।না আঁখি সেই সত্য আর বর্তমানে আদৃতকে জানাবে না,যদি আদৃত এখনও তাকে ভালোবেসে থাকে,যদি তাকে আবারও ফিরে পেতে চায়,তখন কিভাবে ফিরবে আঁখি তার জীবনের এই কলঙ্ক সহিত?

কাজের লোকগুলো কাজ ছেড়ে চলে গেছে তার কারণ এখন অব্দি বুঝে উঠতে পারে নি আদ্রিশ,শুভ্রতা তার শ্বাশুড়ি মা আর রিহানকে নিয়ে আজ বেশ সকালে হাঁটতে বেড়িয়েছিল, বাড়ির প্রবেশ দ্বার দিয়ে ঢুকছিল তারা,আদ্রিশ তার রুমেই ছিল তখনই আদিলদের কক্ষ থেকে রিদিকার চিৎকার শোনা যায়।

″আদ্রিশ বাঁচাও আমায়,বাঁচাও।″
চিৎকার শুনে আদ্রিশ আর বাকি সবাই ছোটে যায় সেদিকে,আদ্রিশ দরজায় লাথি মারছে আর ডাকছে রিদিকাকে,কিন্তু ভেতর থেকে দরজা আটকানো শুধু রিদিকার চিৎকার শোনা যাচ্ছে।
″আদ্রিশ বাঁচাও আমায়,আদিল ভাইয়া প্লিজ আমার এতো বড় সর্বনাশ করবেন না।″

আদ্রিশ লাথি দিয়েই যাচ্ছে রিদিকাকে ডেকে ডেকে হঠাৎ দরজা খুলেই রিদিকা এসে ঝাঁপটে ধরল তাকে।আদ্রিশ তাকে ঝটপট নিজের থেকে ছাড়িয়ে দেখতে পেল তার ব্লাউজের বিভিন্ন অংশ ছেঁড়া সাথে নখের আঁচড়। চুলগুলো উসকোখুসকো। একপ্রকার কাঁপছে রিদিকা।পিছনে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে আদিল,পেরেশানিতে জিজ্ঞেস করল আদ্রিশ।

″কি হয়েছে রিদিকা?তোমার এ হাল কেমনে হলো?″
″আদিল ভাইয়া বেশ কয়েকদিন থেকেই আমার উপর কুনজর দিয়ে রেখেছিলেন, আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারলে উনাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করি।কিন্তু আজ ঘর খালি পেয়ে আমাকে ফন্দি করে নিজের কক্ষে ডাকালেন।বললেন না কি শুভ্রতা আপু বাইরে এদিকে উনি উনার ওয়ালেট খুঁজে পাচ্ছেন না একটু খোঁজে দিতে আর সেই সুযোগে দরজা লাগিয়ে উনি আমার সাথে… ″

এরপর আর কিছু না বলতে পেরে হু হু করে কান্না করে দেয় রিদিকা,আদ্রিশের শরীর জ্বলে উঠে অল্পতেই।সম্পর্কের সীমা লঙ্ঘন করে তেড়ে গিয়েই বড় ভাইয়ের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় আদ্রিশ,প্রবল ঘুষিতে তাকে আছড়ে ফেলে ফ্লোরে,আদিল এতটাই হতভম্ব হয়ে আছে যে এমন কিছুর বিপরীতে প্রতিক্রিয়া কি করা উচিৎ ভেবে বের করে উঠতে পারছে না।শুধু চোখ বেয়ে ঝড়ে চলেছে তার জলের স্রোত,আদ্রিশ আবারও আদিলকে মারতে গেলে শুভ্রতা এসেই আদ্রিশের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পরল।

″আদ্রিশ,বিশ্বাস করো আদিল এমনটা করতে পারে না,তুমি তো ওকে ছোটবেলা থেকে চিনো ও এমন নয়,প্লিজ ওকে মে*রো না আর,ও তোমার বড় ভাই,ওই রিদিকা মিথ্যা বলছে।″

প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব ২৯

″মিথ্যুক আর অন্যায়কারী তো তোরা,মানুষের খেয়ে মানুষের পরে মানুষের পিছনে ছু*রি চালাবি!আজ তোদের আসল অবস্থান দেখিয়ে দিব আমি।
কথাগুলো বলে শুভ্রতাকে লাথি দিয়ে পাশে ফেলে আদিলকে ফ্লোর থেকে তুলে আবারও মারার জন্য হাত উঠালে সেই হাত পাকড়াও করল আঁখি।

প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব ৩১