প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ১৫

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ১৫
Writer Mahfuza Akter

সৌহার্দ্য নিজের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে গা এলিয়ে বসে আছে। রাত নেমেছে। চারপাশে আঁধার, নিস্তব্ধতা! তরীদের বাড়ি থেকে অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছে সৌহার্দ্য। এরপর তরীর কোনো খোঁজ সে আর করেনি। করেও কোনো লাভ নেই। মিস্টার আফনাদ বলেছেন, তরী নাকি নিজেই ফিরে আসবে। অহেতুক নিজের পরিশ্রান্ত শরীর ও মনকে আর খাটাতে চায়নি সৌহার্দ্য। মাঝরাস্তায় একটা সুনশান পরিবেশে গাড়ি থামিয়েছে তাই। ক্ষণে ক্ষণে ঝিঁ ঝিঁ পোকার গুনগুন কানে ভেসে আসছে।

সৌহার্দ্য অশান্ত মন আজ আরো বেশি অশান্ত হয়ে উঠেছে। যেই নিরাশা এতোদিন ওকে ভেতর থেকে কুঁড়ে কুঁড়ে নিঃশেষ করছিল, সেই নিরাশা দূরীভূত হয়ে তাতে আজ নতুন করে আশার প্রদীপ জ্ব*লে উঠেছে। সবটা সত্যি বলে বিশ্বাস করতেও বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পকেট থেকে চেইনসহ লকেটটা বের করলো সৌহার্দ্য। চোখের সামনে সেটা ঝুলিয়ে ধরে দেখলো অপলক। আকাশে আজ ঠিক লকেটের আকৃতির মতোই একটা চাঁদ উঠেছে। দুটোকে পাশাপাশি দেখে সৌহার্দ্যের কাছে লকেটের চাঁদটাকেই বেশি সুন্দর লাগছে। তার চাঁদ তার কাছে বরাবরই সুন্দর, পৃথিবীর সবকিছু থেকে সুন্দর!!

সৌহার্দ্যের মাথার ভেতর এখন অনেককিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। সবটা সে ধীরে-সুস্থে করবে। তার যে অনেক কাজ! কিন্তু তার চেয়েও বেশি কিছু জানা বাকি। আজ যা জানলো, তার থেকেও আরো ভ*য়া*ব*হ কিছু আছে যা সবারই অজানা। একটা ভাবুক হৃদয় ও মস্তিষ্ক নিয়ে সৌহার্দ্য পুনরায় গাড়ি স্টার্ট দিলো।

বাড়ির গেইটের কাছাকাছি আসতেই বিপরীত দিক থেকে কাউকে অগ্রসর হতে দেখলো সৌহার্দ্য। সোডিয়ামের হলদেটে আলোয় অবয়বটাকে চিনতে অসুবিধা হলো না তার। সৌহার্দ্য দ্রুত গতিতে গাড়ি থেকে নেমে এসে তার একদম মুখোমুখি দাঁড়ালো।

তরী আনমনা হয়ে হাঁটছিল রাস্তা দিয়ে। সামনে -পেছনে, আগে-পরে কারো দিকে কোনো নজর নেই তার। হঠাৎ কারো সাথে আকস্মিক ধ্বাক্কায় তরী হকচকিয়ে গেল। ভড়কানো দৃষ্টি সৌহার্দ্যের মুখের ওপর থামলো। সৌহার্দ্য কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে! তরী ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো।
-“কোথায় ছিলে এতোক্ষণ?”

সৌহার্দ্যের অদ্ভুত শান্ত কন্ঠস্বর। তরীর কেমন যেন ভয় লাগলো। কাউকে কিছু না জানিয়ে ওভাবে হুট করে চলে যাওয়াটা নির্বুদ্ধিতার কাজ করেছে ও। সৌহার্দ্য তরীর দিক থেকে নজর সরিয়ে বললো,

-“কাজটা কতটুকু ঠিক করেছো তুমি, একবার ভেবে দেখতে পারো। যেখানেই যাও একববার জানিয়ে গেলেও পারো। তোমাকে কেউ বাঁধা দেবে না। এভাবে সবাইকে হয়রানি করিয়ে, চিন্তায় ফেলে কী লাভ পেয়েছো, আমি জানি না। জানতেও চাই না। তোমার কাউকে নিজের সম্পর্কে জানানোর প্রয়োজন না থাকলেও কিছু কিছু মানুষের তোমার সম্পর্কে জানার প্রয়োজন আছে। কারণ বৈধভাবে তাদের সাথে তুমি নিজের জীবন জুড়ে নিয়েছো!”

তরী অবাক হলো। এমন ঠান্ডা কথা দিয়ে কেউ রাগ ঝাড়তে পারে, তরীর জানা ছিল না। কী অদ্ভুত কান্ড! তরীর অবাকতার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে সৌহার্দ্য ওর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। শীতল কন্ঠে বললো,
-“তোমার যতটা মনে হয় যে, তুমি কারো লাইফে ম্যাটার করো না, তার থেকেও কয়েক গুন বেশি ম্যাটার তুমি করো। আমার ভালোলাগায় তুমি অতোটাও অপ্রিয় নও, যতোটা তুমি নিজেকে মনে করো।”

সৌহার্দ্য কালক্ষেপ করলো না হনহনিয়ে ভেতরে চলে গেল। তরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের যাওয়ার দিকে। শেষের কথাটার মানে ওর মস্তিষ্কে ধরা দিলো না।
সৌহার্দ্যের পিছু পিছু তরীকে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখে সবাই যেন প্রাণ ফিরে পেল। দাদী লাঠি ভর করে এগিয়ে গিয়ে কর্কশ গলায় বললেন,

-“কী রে, নাতবৌ! কই চইলা গেছিলি একলা একলা? সারাদিনে আর কোনো খবরই নাই তোর! বলি একবার আমারে জানাইয়া যাইলে কি আমি তোরে নিষেধ করতাম?”
সুজাতা সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“ওকে কোথায় পেয়েছিস, বল তো!”

-“কোথায় পেয়েছি? কোথায় গিয়েছিল? এসব কথা এখন বলে কোনো লাভ আছে? খুঁজে যে পেয়েছি, এটাই বড় কথা! এখন এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করা অফ করো। প্রচন্ড টায়ার্ড আমি। সারাদিন খোঁজা খুঁজি, দৌড়ঝাঁপের ওপরে থাকায় অনেক ধকল গেছে। একটু রেস্ট দরকার।”

সৌহার্দ্য পা চালিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। তরী আরেক ধাপ বিস্ময় নিয়ে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। সৌহার্দ্য ওকে খুঁজেছে? কেন খুঁজেছে? বিষয়টা হজম হলো না তরীর। আর কাউকে কোনো কথা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে মিস্টার রায়হান বললেন,
-“তুমিও ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও, বউ মা। আর এরকমটা করো না কখনো। সবাই কত চিন্তা করছিলাম আমরা!”
তরী মাথা নাড়ালো। দ্রুত পায়ে ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

মধু নিজের আলমারির কাপড়গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর পুরোনো ব্যবহার্য পোশাকগুলো এখনো সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে ও। প্রহরের কথাগুলো কানে বাজে তার এখনো।
-“একবার আগের মতো সেজে আসবে একদিন? মেয়েলি সাজ!”
কেন প্রহর ওকে এই কথা বলেছিল? প্রহরকে ও শুধু নিজের স্বার্থে সাহায্য করেছিল। তরীর খবরাখবর প্রহরকে দেওয়ার পেছনে ওর নিজের স্বার্থ ছিল বলেই ও প্রহরের সাথে যোগাযোগ রেখেছে এ কয়দিন। কিন্তু এখন তো আর এসবের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই!

ভাবনার মাঝেই মধু ধরাম করে আলমারিটা লাগিয়ে দিল। মানুষের অতীতের সুন্দর মুহূর্ত গুলো মনে তেমন দাগ না কে*টে থাকলেও, অতীতের তিক্ততা গুলো মানুষ কখনো ভুলতে পারে না। প্রহর ওর অতীতের অতি সুন্দর একটা অধ্যায় ছিল। শুধুমাত্র একটা অপ্রত্যাশিত উপসংহারের জন্য এখন সেটা তার জীবনের সবচেয়ে তিক্ত অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। শুধু মাত্র প্রহরের জন্য সে বেঁচেও থেকেও বেঁচে নেই! ভালো থেকেও ভালো নেই। তার জীবনের সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে শুধু প্রহরের কারণে।

বার বার ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। সেদিনের পর থেকে মধু-ই প্রহরের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। নিতান্ত বাধ্য হয়েই প্রহরের সাথে যোগাযোগ রেখেছিল এতোদিন। কিন্তু সেদিনের পর থেকে ওর ভেতরে জমে থাকা ঘা আবার পীড়া দেওয়া শুরু করেছে। পরীক্ষায়ও বসেনি ও সেকারণে। এ কয়েক দিনে প্রহর সবরকমের চেষ্টা করেছে মধুর সাথে যোগাযোগ করার। কিন্তু মধু হোস্টেলও চেঞ্জ করে ফেলেছে। প্রহর চাইলে ওকে খুঁজে বের করে দেখা করতে পারত। তবে ও চায় মধু ওর সাথে স্বেচ্ছায় কথা বলুক।

“শেষ বারের মতো একবার কথা বলবে না? শুধু শেষ বার।”
মেসেজটা স্ক্রিনে ভেসে উঠলেও মধু ওপর থেকে দেখলো শুধু। সিন না করে প্রহরকে ব্লক করে দিলো সব জায়গা থেকে। নাহ্! যা শেষ হয়ে গেছে, তা আবার শুরু করা যায় না। ভাঙা জিনিস জোড়া লাগে না কখনো। মধু নিজের জীবনকে দ্বিতীয় সুযোগ দিতে চায় না।

সে যেমন আছে, তেমন করেই বেঁচে থাকতে চায়। হোক না সেটা একা কিংবা নিঃস্ব হয়ে! একাকিত্বে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য আছে। সবার ভাগ্যে সেই সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ থাকে না। আর যার ভাগ্যে থাকে, তার চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কারো নেই।

সৌহার্দ্য বাড়ি ফেরার পর থেকে তরীর সাথে একটা কথাও বলেনি। তরীর ভীষণ গায়ে লাগছে ব্যাপারটা। ঠান্ডা মাথায় রাগ করে কথা বন্ধ করে দেওয়া মানুষগুলো খুব ভ*য়ং*ক*র হয়। এদের রাগ ভাঙে না সহজে। তরী বিছানায় বসে দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে ভাবছে কীভাবে সৌহার্দ্যের সাথে সব মিটমাট করিয়ে নেওয়া যায়!

সৌহার্দ্য খাওয়াদাওয়া শেষ করে আরো দশ মিনিট পর ঘরে ঢুকলো। তরী ওকে দেখে চমকালেও মুহুর্তেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল। সৌহার্দ্য ওর দিকে এক পলক তাকালো শুধু। তেমন পাত্তা না দিয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ালো। তরী হুড়মুড়িয়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সৌহার্দ্য তরীর পথ আগলে দাঁড়ানোতে খানিকটা চমকে গেল। ওকে অবাক করে দিয়ে তরী নিজের কান ধরে অসহায় মুখ করে তাকালো। মাথা নাড়িয়ে হাতের ইশারায় বললো, সে আর কোনোদিন এরকম করবে না।

সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। হাত বাড়িয়ে চোখের ইশারায় বোঝালো কথা দিতে। তরী সৌহার্দ্যের হাতের দিকে তাকিয়ে আবার ওর মুখের দিকে তাকালো। সৌহার্দ্য ভ্রু নাচালো। তরী বুঝতে পারলো, কথা না দিলে সৌহার্দ্য ওর সাথে আর কথা বলবে না। ইতস্ততবোধ নিয়েই তরী বাধ্য হয়ে সৌহার্দ্যের হাতের ওপর হাত রাখলো। সম্মতিপূর্ণ প্রথম স্পর্শ! হাতের দিকে সৌহার্দ্য অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলো। হাসির মানেটা তরী বুঝতে পারলো না। তরীর হাতটা আগলে নিয়ে ওর অবুঝ চাহনির দিকে তাকিয়ে সৌহার্দ্য বললো,

-“ঘুমিয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়েছে।”
তরী মাথা নাড়িয়ে বিছানার দিকে চলে গেল। সৌহার্দ্য বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো অনেকক্ষণ। যখন ঘরে ফিরে এলো, তখন মাঝরাত। ঘড়ির কাঁটা তিনটার কাছাকাছি। তরী নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ওর ঘনঘন নিঃশ্বাসের শব্দ সৌহার্দ্যের কানে আসছে। জানালা ভেদ করে এক ফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে, যার আলো সরাসরি তরীর মুখের ওপর পড়ছে। সৌহার্দ্য ওর মাথার কাছে গিয়ে বসলো। তরীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আপনমনে বললো,

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ১৪

-“আমার চাঁদের কাছে ঐ আকাশের চাঁদের সৌন্দর্য বরাবরই ফিকে হয়ে যায়। কারণ আমার চাঁদের পূর্ণিমায় প্রণয়াসক্ত হই আমি, যা ঐ সাধারণ চাঁদ কখনো করতে পারবে না আমায়! প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা শুধু আমার চাঁদ-ই আমার জীবনে নিয়ে আসতে পারে। শুধু আমার চাঁদেরই সেই ক্ষমতা আছে। কারণ সে আমার চাঁদ! শুধুমাত্র আমার!!”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ১৬