প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ১৪

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ১৪
Writer Mahfuza Akter

তরীর নিখোঁজ হয়ে যাওয়াটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে সৌহার্দ্যের। বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না সে। বিকেলের পর থেকে নিঃশ্বাস ফেলারও জোঁ পায়নি ও। যে জায়গার কথা মনে এসেছে, সেখানেই গেছে খুঁজতে। অবসন্ন, শ্রান্ত দেহটা ড্রাইভিং সিটে এলিয়ে বসে আছে এখন। মাথায় চলছে হাজার রকমের চিন্তা।

তরী গত রাতে ঐরকম অস্বাভাবিক আচরণ করে পাশের রুমে চলে গেল। ধারণা করা যায় খু*নটা ঐসময়ের আগে পরেই হয়েছে। কিন্তু তরী খু*ন করবে? অবিশ্বাস্য! ওর দ্বারা আর যাইহোক, এই কাজটা করা সম্ভব নয়। তাহলে প্রহর সন্দেহ করার পরেই তরী নিখোঁজ হয়ে গেল কেন?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেয়েটাকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে না। উটকো ঝামেলা মনে হয় সৌহার্দ্যের। কিন্তু এখন ওকে খুঁজে বের করতে ইচ্ছে করছে। এমন মনে হচ্ছে, মেয়েটাকে হারিয়ে ফেললে অনেক মূল্যবান কিছু হারিয়ে যাবে তার থেকে। নিজের ভাবনার ওপর নিজেই বিরক্ত সৌহার্দ্য। এই মন ও মস্তিষ্কের দ্বন্দ্ব তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা বরাবরই অসহ্য লাগে! হঠাৎ করেই মনে হলো, আসল জায়গায় খুঁজতেই ভুলে গেছে সে। কিছু একটা ভেবে হুড়মুড়িয়ে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো সৌহার্দ্য।

ড্রয়িং রুমে পিনপতন নীরবতা! মিস্টার রায়হান কপালে হাত চেপে হুইলচেয়ারে বসে রয়েছেন। সৌহার্দ্যের দাদী সোফায় বসে বারবার ঝুঁকে ঝুঁকে বিরবির করে কিছু একটা পড়ছেন। তরীকে নিয়ে অজানা শঙ্কায় তার মন বারবার অশুভ ইঙ্গিত দিচ্ছে।

-“আমার চাঁদরে তুমি কোনো বিপদে ফেল না, আল্লাহ! ওকে তুমি রক্ষা করো।”
দাদীর প্রার্থনা বারবার কর্ণগোচর হলেও সেদিকে তেমন মনযোগ দিচ্ছে না কেউ।
সুজাতা ফোনে কাউকে কল করেই চলেছেন আর অনবরত পায়চারী করছেন, জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাচ্ছেন চিন্তিত ভঙ্গিতে। ফোন কান থেকে নামিয়ে সুজাতা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললেন,

-“এতোক্ষণ তরীকে ফোনে রিচ করতে পারছিলাম না। এখন তো সৌহার্দ্যও আমার কল রিসিভ করছে না! চিন্তায় তো আধ*ম*রা হয়ে যাবো আমি মনে হচ্ছে!! ”
মিস্টার রায়হান বিরক্ত হলেন। সোজা হয়ে বসে বললেন,
-“আহ্! আজেবাজে বকছো কেন বলো তো! সৌহার্দ্য মেয়েটাকে খুঁজতে গেছে। কোনো খোঁজ পেলে তো জানাবে! চিন্তা কম করে মাথা ঠান্ডা রাখো।”

চিন্তা তার নিজেরও কম হচ্ছে না। তরীর হুট করে গায়েব হওয়াটা প্রচন্ড অস্বাভাবিক। কোনো কিছু সন্দেহ করছে ও। কিন্তু এতো কাঁচা কাজ কি তরীর দ্বারা করা আদৌ সম্ভব! আজই একটা খু*ন হলো আর আজই তরী উধাও। সন্দেহের তীরটা নিজের গায়ে পাকাপোক্ত ভাবে বসানোর মতো কাঁচা কাজ করার মেয়ে তো তরী না!

তাহলে চিন্তার বিষয় একটাই! তরী কি হুট করে গায়েব হয়ে গেল নাকি ওকে গায়েব করে ফেলা হয়েছে? ভাবতেই মিস্টার রায়হানের সমস্ত ইন্দ্রিয় কাজ করা বন্ধ করে দিলো।
বদ্ধ ঘরের ভেতর অজানা শঙ্কায় তিনটি মন হা*সফা*স করতে লাগলো অনবরত!!

সৌহার্দ্য তরীদের বাড়ির সামনে গাড়ি থামালো। মনে মনে প্রার্থনা করলো, এখানে যেন তরীকে পায় সে! হসপিটালে তরীকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেও প্রহরের সাথে কথা বলার পর থেকে তরীকে আর পাওয়া যায়নি। ও গাড়িতেই উঠেনি আর।
সৌহার্দ্য কলিং বেল বাজালে তরীর বাবা মিস্টার আফনাদ দরজা খুললেন। সৌহার্দ্যকে দেখে মলিন হাসলেন যেন তিনি জানতেনই যে, সৌহার্দ্য আসবে। বললেন,

-“এসো, ভেতরে এসে বসো।”
সৌহার্দ্য কথাটা শুনেও শুনলো না যেন! ভেতরেও ঢুকলো না। উল্টো জিজ্ঞেস করলো,
-“তরী! তরী কি এখানে এসেছে?”
-“না, কিন্তু ও কোথায় সেটা আমি জানি। তুমি চিন্তা না করে একটু শান্ত হও।”

মিস্টার আফনাদের কথা শুনে সৌহার্দ্য চোখ ছোট ছোট করে ফেললো। কথাটা ঠিক বোধগম্য হলো না তার। তবে এখন মাথা কাজও করছে না ঠিকমতো। তাই ভেতরে প্রবেশ করে আরাম করে বসলো। কপালের ঘামগুলো মুছে কয়েকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেই ক্ষান্ত হলো সে। মাথা ঠান্ডা করে কয়েক মিনিট ভাবলো।

-“আঙ্কেল, আপনাকে আমি ভালো করেই চিনি ও জানি। বাবার সবচেয়ে ভালো বন্ধুর কথা জিজ্ঞেস করলে বাবা আপনার কথাই বলবেন- এটা আপনিও জানেন! এখন আমাদের বিয়ের পর আপনাদের সম্পর্ক আরো গভীর হয়েছে।”
মিস্টার আফনাদ শুকনো হাসলেন। তাকে ওপর থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, তিনি মনে মনে কিছু একটা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সৌহার্দ্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বললো,

-“তরী একটা সাধারণ মেয়ে- এটা বাইরের সবাই জানলেও যারা ওকে কাছ থেকে দেখেছে, তারা জানে ও এতোটাও সাধারণ নয়। ওকে নিয়ে সবার মনে অনেক প্রশ্ন। কিন্তু আমার মাথায় অজস্র প্রশ্ন জমাট বেঁধেছে। আর এই মুহুর্তে আমার এটাই মনে হচ্ছে যে, আপনি আমার সব প্রশ্নের উত্তর জানেন।”

মিস্টার আফনাদ হুট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। সৌহার্দ্য আরো কিছু বলার আগেই তিনি ভেতরে চলে গেলেন। মিনিট না ঘুরতেই তিনি ফিরেও এলেন। এক হাতে একটা কফি মগ, আরেক হাতে এক গ্লাস কোল্ডড্রিংকস। সৌহার্দ্যের দিকে গ্লাসটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

-“আমার মেয়েটা সাধারণ একটা মেয়ে- এটা সত্যি নয়। কিন্তু ওর চেয়ে অসহায় মেয়ে আর আছে কিনা আমার জানা নেই। এতোটা দুর্ভাগ্য নিয়ে কেউ পৃথিবীতে এসেছে বলে আমার মনে হয় না।”
-“মানে?”
সৌহার্দ্য চোখে প্রশ্ন! আফনাদ সাহেব চশমা খুলে চোখ মুছলেন। তবুও তার চোখ পুনরায় ভিজে গেল। তিনি ভাঙা কন্ঠে বললেন,

-“আজ আমি তরীর জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যিটা তোমাকে বলবো। আমি কখনো এই কথাটা কারো কাছে প্রকাশ করিনি। কারো কাছে না! তোমাকে বলবো, কারণ তোমার সাপোর্ট ওর অনেক প্রয়োজন।”
-“সত্যটা কী?”
-“আমি তরীর জন্মদাতা পিতা নই। ও আমার পালিত সন্তান।”

সৌহার্দ্য অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। এমন কিছু সে আশা করেনি। মিস্টার আফনাদ তরীর বাবা নয়! তাহলে?
-“আমি তো জানতাম তরী আপনার প্রথম পক্ষের সন্তান! তাহলে আপনি তরীকে এডপ্ট করেছিলেন?”
মিস্টার আফনাদ না-বোধক মাথা নাড়ালেন। সৌহার্দ্য জিজ্ঞেস করলো,
-“তাহলে?”

মিস্টার আফনাদ এবার নিজের আবোগ নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ হলেন। কান্নার গতি অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেল তার। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে তার জীবনে দেখা সবচেয়ে ভ*য়াবহ রাতের দৃশ্য। পৃথিবীর কদর্যতার সবচেয়ে নিকৃষ্ট রূপ তিনি সে রাতেই দেখেছিলেন হয়তো।
-“আমি তরীকে মাটির নিচ থেকে খুড়ে বাঁচিয়ে এনেছি। ওকে একজন জীব*ন্ত পুঁ*তে দিয়েছিলো।”
-“হোয়াট?”

সৌহার্দ্য বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। এরকমটা সে কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। তরীর সাথে এমন কিছু ঘটেছে? ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য ঠেকছে সৌহার্দ্যের কাছে। সে অপলক তাকিয়ে থেকে বললো,
-“মানে এটা কীভাবে সম্ভব? কে ওর সাথে এমনটা করেছিল?”

-“আমি জানি না। লোকটার মুখ দেখতে পাইনি। কেন ওকে না মে*রে এভাবে পুঁ*তে ফেলতে চেয়েছিল, সেটা আমি আজও ভেবে পাইনি। কিন্তু সেই রাতের কথা আমি কোনোদিনও ভুলতে পারবো না। আজ থেকে এক যুগ আগের সেই কালরাত! প্রচন্ড ঝড় ছিল সেই রাতে। অফিস থেকে একই গাড়িতে বাড়ি ফিরছিলাম আমি আর তোমার বাবা। রায়হানকে ওর বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে আমি নিজের বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম।

আমার গাড়িটা মাঝপথে খারাপ হয়ে যায়। ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম সেদিন। একটা ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে বাসায় যোগাযোগের চেষ্টা করছিলাম। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। সেই আলোয় আমি অদূরে দেখতে পেয়েছিলাম, একজন মাটি খুড়ছে আর তার পাশে একটা অবচেতন দে*হ পড়ে আছে। এমন দৃশ্য আমার সারা শরীরে শিহরণ ছড়িয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু অদ্ভুত হলেও সত্যি যে, আমার ভয় লাগছিল না।

আমি পুলিশে ফোন করার চেষ্টা করি। কিন্তু ঝড়ের কারণে নেটওয়ার্কের অবস্থা এতোটাই খারাপ ছিল যে, আমি কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। তাই ভেবেছিলাম আমাকেই কিছু করতে হবে। এগিয়ে গিয়ে একটা গাছের পেছনে লুকিয়ে সবটা দেখেছিলাম। মানুষটা তরীকে বুকে জড়িয়ে কপালে চু*মু দিয়ে গ*র্তে ফেলে দিয়েছিল।

আমি শুধু অবাক হয়ে দেখছিলাম। শ্বাসরুদ্ধকর একটা পরিস্থিতি! লোকটা নিজের কাজে এতোটাই বিভোর ছিল, যে আশেপাশে তাকাচ্ছিল না। যখন সে নিজের কাজ শেষ করে চলে গেল, এর বেশ কয়েক মুহুর্ত পর তার অনুপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে আমি আমার গাড়ি থেকে মাটি খোঁড়ার মতো কিছু একটা খুঁজে এনে মা*টির নি*চ থেকে তরীকে বের করি।

আমি ভেবেছিলাম, হয়তো সেটা কোনো মৃ*তদে*হ হবে, আর এটা দিয়ে সেই খু*নীটাকে বের করা যাবে। কিন্তু যখন দেখলাম মেয়েটার শ্বাস চলছে, তখন আমি দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। সাত-আট বছরের বাচ্চা একটা মেয়ে! ওর শ্বাস খুব ধীর গতিতে চলছিল। আমি আর সময় নষ্ট না করে ওকে কোলে নিয়ে ছুট লাগিয়েছিলাম। হয়তো আল্লাহ চেয়েছিলেন বলেই ওকে আমি কাছাকাছি একটা হাসপাতালে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। মৃত্যুর সাথে লড়াই করে ও বেঁচে গিয়েছিল!”

সৌহার্দ্য থম মেরে বসে রইলো অনেকক্ষণ। তার মানে তরীর প্রকৃত পরিচয়ও সবার অজানা! মিস্টার আফনাদের প্রথম দিকে বলা কথাগুলোর মানে সৌহার্দ্য এখন বুঝতে পারলো।
-“তারপর? আপনি আর চেষ্টা করেননি যে তরীর সাথে এমনটা করেছে, তাকে খুঁজে বের করার?”

-“কোনো উপায় ছিল না আর। আমি তো এটাও বুঝতে পারিনি যে, ঐ লোকটা ছেলে ছিল, নাকি মেয়ে! তরীর পুরোপুরি সুস্থ হতে অনেক সময় লেগে গিয়েছিল। কিন্তু ও পুরোপুরি নীরব হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তারদের ধারণা, ও আগে থেকেই কথা বলতে পারতো না। তবে কারা কেন ওর সাথে এমন করেছে, সেটা হয়তো তরীর জানা নয়তো ও ভুলে গেছে।”
সৌহার্দ্য বিমর্ষ ভঙ্গিতে বসে রইলো। মিস্টার আফনাদ স্বাভাবিক হয়ে সৌহার্দ্যকে বললেন,

-“কিন্তু তরীর গলায় ঐসময় একটা লকেটসহ চেইন ছিল। যদিও লকেটটা থেকে আমি কোনো ক্লু খুঁজে পাইনি।”
বলেই মিস্টার আফনাদ নিজের ঘর থেকে লকেটটা এনে সৌহার্দ্যকে দেখালেন। সৌহার্দ্য লকেটটা হাতে নিয়ে চোখের সামনে ঝুলিয়ে দেখলো।

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ১৩

একফালি বক্র চাঁদের মতো কারুকার্য শোভিত সুন্দর একটা লকেট। সৌহার্দ্য নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারলো না। অবিশ্বাস্য দৃষ্টি তাক করে রইলো হাতের বস্তুটির দিকে। চশমার আড়ালে থাকা র*ক্তিম চোখ জোড়া জ্ব*লজ্ব*ল করে উঠলো। সৌহার্দ্যের শুকনো ওষ্ঠ থেকে নিসৃত হলো একটি মাত্র শব্দ,
-“চাঁদ!!!”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব ১৫