বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৪১

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৪১
সাদিয়া জাহান উম্মি

চোখে মুখে পানির ছিটা পড়তেই আস্তে আস্তে চোখ খুললো আরাবী।মাথাটা এখনো ঝিমঝিম করছে। ঝাঁপসা দৃষ্টি পরিষ্কার হতেই নিজেকে কারো বাহুডোরে আবিষ্কার করলো।সাথে সাথে শ্রবণ হলো জায়ানের উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর, ‘ এখন কেমন লাগছে?ঠিক আছো তুমি?’
আরাবী উঠে সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করলে জায়ান আরাবীকে সাহায্য করলো।আরাবী উঠে বসতেই দূর্বল গলায় বললো, ‘ আমি ঠিক আছি!’

সাথি আরাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম কন্ঠে বলে, ‘ হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছো।আমরা কতো ভয় পেয়েছিলাম জানো?’
আরাবী মলিন হাসলো।নিহাদ সাহেব বললেন, ‘ এখন থেকে জায়ান ওকে আরো বেশি বেশি করে খাওয়াবে।এতো দূর্বল হলে চলবে নাকি?’
জায়ান হাসলো বাবার কথায়।আরাবী এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘুরিয়ে ওর মাকে খুঁজছে।কিন্তু না পেয়ে জায়ানকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ আম্মু কোথায়?’
জায়ানের জবাব, ‘ আব্বুর কাছে আছে।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সাথে সাথে আরাবীর সকালের সব ঘটনা মাথা চড়া দিয়ে উঠলো।অস্থির হয়ে উঠলো মন।প্রায় একপ্রকার তাড়াহুড়ো করে দাঁড়িয়ে ছুট লাগালো একপলক বাবাকে দেখার জন্যে। এদিকে আরাবীকে এমন করতে দেখে জায়ান ঘাবড়ে গেলো।চিল্লিয়ে উঠলো, ‘ আরাবী সাবধানে!’

কিন্তু কে শুনে কার কথা।এক ছুটে কবরস্থানে গিয়ে দেখলো ওর মা এখনো ওর বাবার কবরের উপর লেপ্টে আছেন।কান্না করছেন এখনো।দীর্ঘ দিনের অপেক্ষার সমাপ্তি।এতো সহজে কি কান্না থামে? আরাবী আর একমুহূর্ত দেরি করলো না।বাবার কবরের ঠিক মধ্যিখানটায় মাথা এলিয়ে দিলো।সাথে সাথে আরাবীর শরীর ঝংকার দিয়ে উঠলো।মনের মাঝে এক শান্তির প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেলো।মনে হলো সত্যি সত্যি বাবার বুকের মাঝে নিজের মাথা গুঁজে দিয়েছে।সাথে সাথে দরদর করে জল গড়িয়ে পরলো আঁখি কোল হতে। ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে দিলো আরাবী।পৃথিবীর সমস্ত কাতরতা কন্ঠে ঢেলে ঢেলে ডেকে উঠলো, ‘ আব্বু! আব্বু গো! আব্বু ও আব্বু,আব্বু।আব্বু আমি এসেছি আব্বু।আব্বু আমি আরাবী।আব্বু!’

মেয়ের এমন অস্থির কাতরতা ভড়পুর এক একটা ডাক শুনে আরাবীর মা আচঁলে মুখ লুকিয়ে আরো জোড়ে কাঁদতে লাগলেন।আরাবী যেন আজ সব ভুলে বসেছে।এতোদিনের সকল,দুঃখ, কষ্ট সব যেন বাবার কবরের মধ্যিখানটায় মাথা রাখতেই ঠেলেঠুলে বেড়িয়ে এসেছে। বুক ভাঙ্গা আর্তনাদগুলো বিভৎসভাবে কান্নায় রূপান্তর হয়েছে।কি করুন সেই দৃশ্য।জায়ানের মতো শক্তপোক্ত মানুষটাও আজ স্ত্রীর বাবা হারানোর তীব্র বেদনা অনুভব করতে পারছে বোধহয়।জায়ানের চোখজোড়া লাল হয়ে উঠেছে।

এই শক্ত হৃদয়ের মানুষটার হৃদয়ও যে ভীতরে ভীতরে কাঁদছে তা ওর চোখ দেখলেই বোঝা যাবে। মৃত্যুর পরেও বাবাকে একপলক দেখতে পারেনি আরাবী।না ওর মা’কে দেখতে দিয়েছে একবার কেউ। দুনিয়াতে যে এতো পাষান হৃদয়ের মানুষও হয়।তা সেদিন ছোট্ট আরাবী একটু হলেও বুঝতে পেরেছিলো।একে একে সকল যন্ত্রনার ঘটনাগুলো মনে পরে যাচ্ছে আরাবী।কাঁদতে কাঁদতে অভিযোগের সুরে বলছে ও, ‘ আব্বু! তু..তুমি জানো? তো..তোমার মা না বড্ড খারাপ আর পা…পাষাণ হৃদয়ের গো আব্বু।তোমার মৃত্যুর পর এ..একটাবার তোমাকে দেখতে দেয়নি আমাদের।

আমি আর আ…আম্মু কতো কেঁদেছি।মা উনার পায়েও ধরেছিলো।তার দেখাদেখি আমিও উ..উনার পায়ে পরেছিলাম।কিন্তু উনি দেননি আব্বু। এমন পাষাণ মহিলার গর্ভে তো..তোমার মতো মানুষ কি..কিভাবে জন্ম নিলো আব্বু?তুমি কেন চলে গেলে আব্বু?তো..তোমায় ছাড়া আমরা একটুও ভালোছিলাম না আব্বু।ও আব্বু।তুমি শু..শুনছো আমার কথা?ও আব্বু!’
আজ বাবাকে পেয়ে আরাবী যেন একটা ছোট্ট বাচ্চা শিশুর ন্যায় বাবার কাছে নালিশ করছে।মায়েরা যখন বাচ্চাদের মারলে তারা বাবাদের অফিস থেকে বাসায় ফিরার অপেক্ষা করে।তারপর বাবা আসলে কেঁদে কেঁদে সকল নালিশ জানায়।

আরাবীও ঠিক একইভাবে আজ ওর বাবার কাছে নালিশ করছে।কিন্তু আফসোস সেই বাচ্চাদের বাবা তাদের নালিশগুলো শুনে যেমন চকোলেট দিয়ে কান্না থামায়,অথবা আদুরেভাবে কপালে চুমু খান,অথবা মিথ্যে রাগ দেখিয়ে মায়েদের বকে দেন।কিন্তু আরাবীর সাথে হলো সম্পূর্ণ বিপরীত।ও নালিশ করলো ঠিকই কিন্তু ওর বাবা শুনলো না।শুনেও যদি থেকে থাকেন মেয়ের এমন আর্তনাদ।তারপরেও আরাবীর বাবা কিছুই করতে পারবেন না।

জায়ান সহ্য করতে পারছে না আর আরাবীর এই কান্না।দ্রুত পায়ে আরাবীর কাছে গিয়ে ওকে টেনে তুললো জায়ান।আরাবী দূর্বল হয়ে পরেছে। জায়ান দুহাতে আরাবীর সর্ব মুখশ্রীতে লেগে থাকা পানিগুলো মুছে দিলো।নিজেকে সম্পূর্ণ শক্ত রাখার চেষ্টা করে।ধরা কন্ঠে বলে, ‘ হয়েছে তো।আর কাঁদেনা।তুমি এতো কাঁদলে আব্বু তো কষ্ট পাবেন।তিনি কিন্তু খুব কষ্ট পাচ্ছেন আরাবী।আর কাঁদেনা। হয়েছে তো।নালিশ করে দিয়েছো না আব্বুর কাছে? তিনি সব শুনেছেন আরাবী।আর কাঁদেনা।তিনিও কাঁদছেন, কষ্ট পাচ্ছেন তোমার কান্না দেখে।’

আরাবী হিঁচকি উঠে গিয়েছে।তাই জায়ানের কথার কোনপ্রকার জবাব দিতে পারলো না।জায়ান আরাবীকে ধরে দাড় করালো।নিজের সাথে আরাবীকে ধরে আগলে রাখলো।অতঃপর আরাবীর মায়ের উদ্দেশ্যে বললো, ‘ আম্মু।হয়েছে তো আর কাঁদবেন না।আপনি যদি এমন করেন আরাবীকে সামলানো কষ্ট হয়ে যাবে।প্লিজ আম্মু সামলান নিজেকে।আরাবী কিন্তু অনেক দূর্বল হয়ে গিয়েছে।’

জায়ানের কথায় যেন আরাবী মা নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলেন।অতঃপর সাথি এগিয়ে এসে উনাকে ধরে নিয়ে গেলেন।তবে বার বার পিছনে ফিরে তাকাচ্ছিলেন।আরাবীকে ধরে নিয়ে আসছে জায়ান।চোখ বুঝে জায়ানের গায়ে গায়ের সবটা ভাড় ছেড়ে দিয়ে হেটে যাচ্ছে।অতঃপর মহিলারা কবরস্থান হতে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কবর জিয়ারত করে নিলেন।তারপর শেষ হতেই জায়ান সবাইকে নিয়ে বাড়ির ভীতর প্রবেশ করলো। জায়ান আরাবীকে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো।আরাবীকে একগ্লাস পানি খাইয়ে দিলো।সাথিকে ইশারা দিতে তিনিও আরাবীর মা’কে পানি দিলেন।পানি খেয়ে আরাবী ঠিক সেইভাবেই বসে আছে।জায়ান নরম স্বরে বললো, ‘ আরাবী দেখো।এটা তোমাদের বাড়ি।তোমার আর আম্মুর বাড়ি।আরাবী দেখবে না?’

আরাবী দূর্বল চোখে চারপাশ তাকিয়ে দেখলো।ছোট্টো বেলার কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে তার।এই ড্রয়িংরুমে কতো বাবার পিঠে চড়ে বাবাকে ঘোড়া বানিয়ে খেলেছে।কতো দুষ্টুমি করেছে। একে একে সব মনে পরছে আরাবীর।চোখ ভরে উঠলো আবারও।জায়ান আরাবীর চোখজোড়া মুছে দিয়ে বলে, ‘ কাঁদে না তো।’

এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলেন শায়লা ভূইয়া আর শিলা আহমেদ। সাথে আজ একটা ছেলেও আছে। সেটা আর কেউ না শিলা আহমেদের ছেলে শাওন হোসেন।শাওন কেমন একটা লোলভ দৃষ্টিতে আরাবীর দিকে তাকিয়ে আছে। আরাবী সেই দৃষ্টি লক্ষ করে জায়ানের পেটের কাছের পাঞ্জাবি খামছে ধরলো।জায়ান সেটা দেখতেই ওর চোয়ালজোড়া শক্ত হয়ে আসলো।নূরকে ইশারা করলো আরাবীকে ধরতে।নূর ভাইয়ের ইশারা মতো এগিয়ে গেলো দ্রুত।এদিকে শাওন আরাবীর দিকে দৃষ্টি রেখেই বলে,’ তুই নাকি আরাবী? বড় হয়ে গেছিস।সাথে সুন্দরীও।তোকে আমার প….!’

বাকিটুকু কথা সম্পূর্ণ হলো না শাওনের।তার আগেই জায়ানের শক্তপোক্ত পেশিবহুল হাতের ঘুষি গিয়ে পরলো শাওনের গালে।শাওন ছিটকে নিচে পরে গেলো।শিলা দ্রুত ছেলেকে ধরলেন।অতঃপর আস্তে ধীরে দাড় করালেন।শাওনের ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হচ্ছে,নাসিকাপথ হতেও রক্ত আসছে।শাওন রক্তগুলো মুছে নিলো হাত দিয়ে।শিলা ছেলের এমন অবস্থা দেখে রাগে কিড়মিড় করে বললো, ‘ তোমার সাহস কি করে হলো আমার ছেলেকে মারার? তোমাকে আমি পুলিশে দিবো।’
জায়ানের রাগে কপালে রগগুলো দপদপ করছে।চোয়াল শক্ত,মুখশ্রী লাল হয়ে আছে।জায়ান দাঁতে দাঁত চেপে বলে, গো এহেইড।নাকি আমি হেল্প করবো পুলিশে ফোন দিয়ে?দিবো?যদি একবার ফোন দেই অতঃপর সবকটা বিনাবাক্যে জেলে যাবেন বলে দিলাম।’

অতঃপর আবারও তেড়ে শাওনের কাছে গেলো।শিলা কিছু বলার আগেই সপাট করে একটা চড় মারলো জায়ান।শাওন সহ শিলাও পরে যেতে নিলেও নিজেদের সামলে নিলেন।জায়ান রাগে কিড়মিড় করে বললো, ‘ ফারদার যদি দেখি আমার আরাবীর দিকে চোখ তুলে তাকাতে তোর চোখ আমি উপরে ফেলবো।সম্মান দিয়ে কথা বলবি।ওয়ান সেকেন্ড। তুই কথাই বলবি না কোন।ইনফেক্ট আপনারা কেউই বলবেন না।আমার ফ্যামিলির প্রতিটা মেম্বার হতে দূরে থাকবেন।নাহলে বিনাবাক্যে উপরের টিকিট কনফার্ম করে দিবো। আর এই বাড়িতে যে তোদের থাকতে দিচ্ছি এটাই অনেক।আমি শুধু আম্মু আর আরাবীর একটা কথার অপেক্ষায় আছি।কারন এই বাড়ির মালিক তারা।তারা একবাক্যে অনুমতি দিলে আমি সাথে সাথে তোদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো।আম্মু আপনি কি বলেন?’

আরাবী মা জায়ানের প্রশ্ন শুনে বলে, ‘ বাবা আমি তো আর উনাদের মতো জানোয়ারের হৃদয় দিয়ে তৈরি না। আমি মানুষ।আমার মায়া,দয়া আছে।কিন্তু উনারা যে জানোয়ার তা আমি জানি।জানোয়ারের যেমন কারো প্র‍তি কোন মায়া নেই।উনাদেরও নেই। কিন্তু আল্লাহ্ আমায় মানুষ বানিয়েছেন।আর মোট কথা তারা আমার স্বামীর ফ্যামিলি এখন তারা যতোই খারাপ হোক।তাই সেই উছিলায় আমি তাদের বাড়ি হতে বের করে দিবো না।

তাদের এই বাড়িতে থাকতে দিলাম।ভিক্ষা স্বরূপ। আর বাবা তোমাকে আমি আরাবীর বাবার কোম্পানির দায়িত্ব দিয়ে দিলাম।না করবে না বাবা।তুমিই যেহেতু আমাদের সব ফিরিয়ে দিয়েছো। নাহলে তো আমরা আজীবনও এসবের ধারে কাছেও আসার সাহস পেতাম না।বাবা না করো না। আমি চাই আরাবী আর তুমি একসাথে ওর বাবার কোম্পানিটা সামলাও এখন থেকে।আমার কথা ফেলো না।’

আরাবীর মায়ের কথা জায়ান ফেলতে পারলো না।আদেশ সরূপ মেনে নিলেন।এদিকে জায়ানের এমন ভয়ংকর রাগ দেখে শায়লা ভূইয়া,শিলা আহমেদ আর শাওন ভয়ে দমে গেলেন।আর একটা বাক্য উচ্চারন করে করলেন নাহ। অতঃপর জায়ান বললো, ‘ চলো।এখন বাড়ি যাই সবাই।’

আরাবীর মা আমতা আমতা করে জায়ানকে বললো,’ বাবা আমি এখানেই থাকি? এটাই তো আমার বাড়ি বাবা। আরাবীর বাবার স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে!’
জায়ান আরাবীর মায়ের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,’ আমাকে নিজের ছেলে মানেন।অথচ নিজের ছেলের কাছে থাকতে চাইছেন না? আমি আপনার কথা মেনে নিতাম আম্মু।যদি এখানে কেউ ভরসাযোগ্য মানুষ থাকতো।কিন্তু এখানে আমি আপনাকে কার কাছে রেখে যাবো?এই পশুদের মাঝে আপনি একা থাকতে পারবেন না আম্মু।তবে আমি আপনাকে আর আরাবীকে রোজ শুক্রবার এখানে নিয়ে আসবো।তবুও এখানে থাকার কথা বলবেন না।আমি আমার মা’কে নিজের কাছে রাখার ক্ষমতা রাখি।চলুন আম্মু।আমাদের দেরি হচ্ছে।’

আরাবী মা ছলছল চোখে তৃপ্তির হাসি দিলেন।নিজের মেয়ের ভাগ্য যে এতো ভালো হবে ভাবতে পারেননি তিনি। আরাবী জায়ানকেই একধ্যানে দেখে যাচ্ছে।ঠিক কি বলবে জায়ানকে।কি দিয়ে ধন্যবাদ দিবে।জায়ান যা করেছে তার কাছে ধন্যবাদ শব্দটা খুব ছোট হয়ে যায়।জায়ান আরাবীর কাছে এসে আরাবীর হাত ধরলো।নমনীয় কন্ঠে বলে,’ চলো বাড়ি যাবার সময় হয়ে গিয়েছে।’

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৪০

আরাবী সন্তর্পণে ভরসাযোগ্য হাতটা আঁকড়ে ধরলো।জায়ানকে বুঝালো যে আপনি আমার সব।সব মানে সব।জায়ান আলতো হেসে বেড়িয়ে গেলো বাসা হতে।অতঃপর জিহাদ সাহেবের কবরটা আরেকবার আরাবী আর ও মা দেখে নিয়ে সবাই বাড়ির পথে রওনা দিলেন।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৪২