বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৪০

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৪০
সাদিয়া জাহান উম্মি

মধ্যরাত্রি পেরিয়ে গেছে বহুক্ষন।জায়নামাজের উপরে বসে দু হাত তুলে আল্লাহ্’র কাছে নিজের মনের কথাগুলো ব্যক্ত করছে আরাবী। দু চোখ বেয়ে অজোড়ে অশ্রু ঝরছে আরাবীর। তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করছে ও।
এদিকে ঘুমের মাঝে আরাবীকে নিজের সন্নিকটে না পেয়ে কপাল কুচকে আসে জায়ানের।গাঢ়ো ঘুমটা কেটে গিয়েছে।আস্তে আস্তে চোখ খুলে বিছানায় আরাবীকে না পেয়ে ধীরে উঠে বসে জায়ান।

ড্রিম লাইটের আলোতে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখা মিলে তার কাঠগোলাপের। যে নামাজ আদায় করছে।আল্লাহ্ তায়ালার কাছে মনের কথা ব্যক্ত করছে দুহাত তুলে।চোখ দিয়ে ঝরছে অশ্রু।তবে আজ আরাবীর অশ্রু সিক্ত চোখজোড়া কোন পিড়া দিলো না জায়ানকে।বরং মনের মাঝে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেলো। জায়ান লম্বা হাই তুলে বিছানা থেকে নেমে দাড়ালো।আলমারির কাছে গিয়ে সেটা খুলে একটা পাঞ্জাবি বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে আসলো। ড্রয়ার হতে টুপি নিয়ে পরিধান করে নিজের স্ত্রীর থেকে একটু সামনে জায়নামাজ বিছিয়ে ও নিজেও তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতে লাগলো।হোক না রাতটা নির্ঘুম।আজ নাহয় তারা দুজন মিলে তাদের রাতের ঘুমটা আল্লাহ্’র নামে করে দিলো।এদিকে মোনাজাত শেষ করে জায়ানকেও ওর সাথে নামাজ আদায় করতে দেখে ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে আরাবীর।আবারও রাব্বুল আলামিনের দুয়ারে লুটিয়ে পরে ও। ফজরের আজান দিলে দুজন সালাত আদায় করে একেবারে গিয়ে একটু বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। আরাবীকে বুকে টেনে নিয়ে জায়ান চোখজোড়া বুজে নেয়। আরাবী ধীর আওয়াজে বলে, ‘ ভালো লাগলো আমার খুব যে আপনিও আমার সাথে নামাজ আদায় করলেন।’

জায়ান চোখ না খুলেই জবাব দিলো, ‘ তুমি প্রতিদিন ডেকে দিও তাহলে একসাথে দুজন নামাজ আদায় করে নিবো।’
আরাবী মুচঁকি হেসে বললো, ‘ এটা তো আমার কর্তব্য জনাব।’
‘ আচ্ছা এখন ঘুমাও একটু।’ বলে জায়ান আরাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো একদময় আরাবীর চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসে।

সকাল দশটা………..
বাবার একটা ছবি নিয়ে বসে আছে আরাবী।আজ ওর বাবার মৃত্যুবার্ষিকি।বাবার ছবিতে হাত বুলিয়ে ব্যাথিত নিশ্বাস ফেললো আরাবী।কি একটা জীবন ওর। নামাজ পরে বাবার নামে দোয়া করা ছাড়া ও আর কিছু করতে পারবে নাহ।বাবার কবরটা একটু জিয়ারত করবে তাও পারেনা আরাবী।শুধু বাবার নামে দুজন এতিম শিশুকে একবেলা খাইয়ে দেয়।কিন্তু এছাড়া তো আর কিছুর করার সামর্থ্য ওর নেই। অশ্রুচোখে বাবার ছবিতে হাত বুলিয়ে দিলো আরাবী।বিরবির করে বলে, ‘ বাবা তোমার মেয়ের ভাগ্যটা বড্ড খারাপ।তোমার কবরটা পর্যন্ত আমি কখনো দেখতে পারলাম না বাবা।’

এমন সময় ঘর হতে জায়ানের কন্ঠ ভেসে আসলো।আরাবীকে ডাকছে।আরাবী চোখজোড়া মুছে ঘরের ভীতরে এলো।জায়ান সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা, মাথায় টুপি দেওয়া।বড্ড সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে।আরাবী মুগ্ধ হয়ে দেখলো নিজের স্বামিকে।জায়ান আরাবী এমনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হালকা হাসলো।তারপর বিছানা হতে একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে আরাবীর সামনে আসলো।আলতো করে হাত গলিয়ে দিলো আরাবীর গালে।এতে যেন আরাবীর হুশ আসলো।জায়ান হাতের ব্যাগটা এগিয়ে দিলে।আরাবী সেটা হাতে নেয়।জিজ্ঞাসুচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘ এটা কিসের?’

জায়ান অপরহাতে আরাবীর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ‘ যাও এটার ভীতরে একটা শাড়ি আছে পরে আসো। আমরা একজায়গায় যাবো।’
আরাবী দৃষ্টি নত করে হালকা আওয়াজে বললো, ‘ আমার মনটা ভালো নেই আজ।আমি কোথায় যাবো না।প্লিজ রাগ করবেন না।’
জায়ান নরম কন্ঠে বললো, ‘ আমি জানি তোমার মন ভালো নেই।আর এই কারনেই আমরা বাহিরে যাবো।তুমি একা না।বাবা,মা,নূর,ইফতি,চাচ্চু,ছোটমা,আর আম্মুও যাবে।যাও তৈরি হয়ে আসো।’

জায়ানের কথায় অবাক হলো আরাবী।ওর মাও নাকি যাবে।আশ্চর্য আর সবাই হয়তো জানে না যে আর ওর বাবার মৃত্যু বার্ষিকি কিন্তু ওর মা তো জানে।তাহলে সে কিভাবে রাজি হলো?মনের কথা মনে রেখেই আরাবী ওয়াশরুমে চলে গেলো শাড়ি নিয়ে। শাড়ি পরা শেষ হতেই আরাবী বের হয়ে আসে।সাদা একটা শাড়ি।শাড়িটার মাঝে জারি সুতোর কাজ করা।আরাবীকে যেন এই শাড়িতে ভীষন সুন্দর লাগছে।জায়ান আরাবীর কাছে এসে আরাবীর কপালে চুমু খেলো।বললো, ‘ মাশা-আল্লাহ ভীষন সুন্দর দেখাচ্ছে।’

আরাবী মাথা নাড়ালো।তারপর গিয়ে চুল আচড়িয়ে খোপা করে শাড়ির সাথে সাদা একটা হিজাব বেধে নিলো। তারপর জায়ানের সাথে চললো।নিচে আসতেই অবাক হলো আরাবী।সবার গাঁয়েই শুভ্র রঙ্গের পোষাক।আরাবী তাও কোন প্রশ্ন করলো না।চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো। একে একে সবাই গাড়িতে উঠে বসতেই জায়ান কাঙ্খিত স্থানে রওনা দিলো।আধাঘন্টা পর গাড়ি থামতেই একে একে সবাই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো সবাই।আরাবী অবাক হলো।এটা তো একটা এতিমখানা আর বৃদ্ধাশ্রম। জায়ানের দিকে তাকালো আরাবী। জায়ান ওর মনের কথা বুঝতে পেরে বলে, ‘ আজ জিহাদ বাবার মৃত্যু বার্ষিকি সেটা আমরা জানি।তাই তার নামে এখানে খাবারের ব্যবস্থা করেছি।’

জায়ানের কথা শুনে চোখ ভরে উঠলো আরাবীর।লোকটা এতো ভালো কেন? আরাবীকে কাঁদতে দেখে জায়ান বললো, ‘ কেঁদোনা চলো ভীতরে।সবাই চলে গিয়েছে।’
আরাবী জায়ানের হাত ধরে ভীতর প্রবেশ করলো।অতঃপর খুব সুন্দরভাবে আয়োজনটা সম্পন্ন হয়।আরাবী মা তো একটু পর জায়ানের কাছে এসে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে এরজন্যে।বিকেল হয়ে আসলে সবাই বাসায় যাওয়ার জন্যে রওনা হলো।তবে বাড়ির পথে গাড়ি না যাওয়ায় আরাবী প্রশ্ন করলো, ‘ এটা তো বাড়ির পথ না।কোথায় যাচ্ছেন?’

জায়ান কোন কথা বললো না চুপচাপ থাকলো।তবে যখন গাড়ি থামতেই ওরা সবাই নামলো।আরাবীর মা সামনে তাকাতেই বিষ্মত হয়ে গেলেন। আরাবী একটু সময় লাগলো জায়গাটা চিনতে তবে।ও নিজেও চিনে ফেললো।চোখ বড় বড় হয়ে আসলো আরাবীর।পাশে দাঁড়ানো জায়ানের হাত খামছে ধরলো আরাবী।ওর শরীর যে থরথর করে কাঁপছে তা বেশ বুঝতে পারছে জায়ান।আরাবীর মা’কে মিলি আর সাথি সামলে রেখেছেন।তার অবস্থাও আরাবীর মতো।জায়ান আরাবীর হাতটা শক্ত করে ধরে বললো, ‘ যাবে না নিজের বাড়িতে?’

আরাবী কোনকিছুই বলছে না।কেমন পাথরের মতো জমে গিয়েছে। জায়ান নিজেই আরাবীকে নিয়ে গেট পেরিয়ে ভীতরে প্রবেশ করলো।তবে বাড়ির ভীতরে না গিয়ে।বাগানের ওইপাশে নিয়ে গেলে।সেখানে আরাবীর বাবাদের পারিবারিক কবরস্থান।একটু আগাতেই ইখতিয়ার সাহেব আর সাথে একজন হুজুরকে দেখতে পেলেন তারা। মহিলারা আর আগালেন না তারা একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেন।আরাবীর মা ছটফট করছেন সেখানে যাওয়ার জন্যে।তাকে সাথি আর মিলি বুঝাচ্ছেন।আরাবী চুপচাপ নূরের সাথে দাঁড়িয়ে আছে।শুধু ফ্যালফ্যাল করে সবটা দেখছে ও।

ছেলেরা সবাই ওজু করে আসলো।তারপর জিহাদ সাহেবের কবর জিয়ারত করলো একসাথে।হুজুর চলে যেতেই।এবার মহিলারা সবাই আগালেন।কবরের গেট পেরিয়ে ভীতরে প্রবেশ করতেই আরাবীর মা স্বামির কবরের উপর নিজেকে লুটিয়ে দিলেন।কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন তিনি।এই প্রথম।এই প্রথম স্বামির কবরটার দর্শন পেলেন তিনি। নিজেকে সামলাতে পারলেন না কিছুতেই।কবরটা আঁকড়ে ধরে শব্দ করে কাঁদছেন।উনার এমন হাহাকার দেখে আজ সবার চোখেই পানি জমেছে।এদিকে আরাবী এখনো পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে।

ওর মস্তিষ্ক সবটা ধারন করতে পারছে না।এতো কিছু যে একসাথে পেয়ে যাবে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ও। বুকের ভীতরটা কেমন লাগছে ও কাউকে বুঝাতে পারবে না।চিৎকার করে কাঁদতে চাইছে আরাবী।তবে আসছে না।শুধু নিরবে অশ্রু ঝরছে দুচোখ বেয়ে।এদিকে ওকে এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জায়ান আরাবীর মাথায় হাত রাখলো মায়া ভরা কন্ঠে বললো,’ বাবার কবরটা একবার স্পর্শ করবে না আরাবী? তোমার বাবা আরাবী।ওখানে শুয়ে আছেন তিনি।বাবার বুকে মাথা রাখবে না?’

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৩৯

আরাবীর ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপছে।কিছু বলতে চাইছে আরাবী।কিন্তু কন্ঠ গলিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।চোখজোড়া ঝাপ্সা হয়ে আসছে আরাবীর। অপ্রতাশিত সবকিছু আজ জাদুর মতো একসাথে পেয়ে।মস্তিষ্ক দূর্বল হয়ে পরলো আরাবীর।জ্ঞান হারিয়ে পরে যেতে নিতেই জায়ান ঘাবড়ে গিয়ে দ্রুত দুহাতে জড়িয়ে নিলো নিজের কাঠগোলাপকে।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৪১