বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৪২

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৪২
সাদিয়া জাহান উম্মি

অফিস থেকে মাত্রই ফিরেছে জায়ান।বেশ ক্লান্ত আজ ও। আরাবীর বাবার কোম্পানিটায় আজ গিয়েছিলো ও। আরাবী কাল থেকে জয়েন করবে।মেয়েটার উপরে বড্ড চাপ পরে যাবে।কিন্তু কিছু করার নেই।আরাবীকে সবটা বুঝতে শিখতে হবে।নিজেরটা নিজেকেই সামলে নেওয়াটা শিখতে হবে। অবশ্য আরাবীর পাশে তো ও আছেই।বিপদে আপদে সর্বদা নিজের স্ত্রীর পাশে আছে ও।

তবে ইফতিকে বলেছে হাফ টাইম যেন ও সামলায়।কারন সকালে আরাবীর ভার্সিটি আছে।ভার্সিটি শেষ করে তারপরেই দুপুরের থেকে আরাবী বসবে অফিসে।তবে খুব বেশি জরুরি হলে জায়ানও যাবে।কিছু করার নেই দুটো কোম্পানি সামলানো অনেক টাফ ব্যাপার।কারন নিহাদ সাহেব এখন বিশ্রাম নিয়েছেন।তার শরীরটা ভালো না।তাই তিনি জায়ান আর ইফতির কাধে সম্পূর্ণ কোম্পানির দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ক্লান্ত শরীরটা টেনে টুনে ডায়নিং টেবিল হতে একগ্লাস পানি খেয়ে নিলো জায়ান।অতঃপর রুমের দিকে অগ্রসর হলো।রুমের দরজা খুলেই দেখতে পেলো আরাবী নামাজ পরছে।সারাদিনের ক্লান্তিগুলো নিমিষেই যেন হাওয়া হয়ে গেলো।ঠোঁটের কোল ঘেসে হাসির রেখা দিলো। জায়ান দ্রুত পায়ে রুমে প্রবেশ করে আলমারি হতে জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। বেশি সময় নিলো না।ঝটপট গোসল সেরে ওযু করে নিয়ে নিজেও গিয়ে আরাবীর সাথে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলো। অবশ্য আরাবীর নামাজ প্রায় শেষের দিকে।নামাজ শেষ হতেই আরাবী জায়নামাজ গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালো। জায়ানকে দেখে হাসলো আরাবী।তারপর বিনাবাক্যে ওয়াশরুমে গিয়ে জায়ানের জামা কাপড়গুলো ধুয়ে বারান্দায় শুকাতে দিয়ে দিলো।তারপর নিচে রান্নাঘরে গিয়ে চট করে একগ্লাস শরবত বানিয়ে রুমে এসে দেখলো জায়ানের নামাজ শেষ। আরাবী রুমে এসে বললো, ‘ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।শরবতটা খেয়ে নিন!’

জায়ান হাসিমুখে এগিয়ে আসলো আরাবীর কাছে।আরাবীর কপালে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে দিলো। আরাবী মৃদ্যু হাসলো।জায়ান শরবতটা হাতে নিয়ে একটানে শেষ করে ফেললো।আরাবীর হাতে গ্লাসটা দিয়ে বলে, ‘ নামাজ শেষে উঠলে কেন?আমার নামাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বসে থাকবে নাহ?’
আরাবী মৃদ্যু আওয়াজে বলে, ‘ উঠতাম না।আসলে আপনি গোসল করেছেন সেটা টের পেয়েছি।তাই গিয়ে আপনার জামা-কাপড়গুলো ধুয়ে দিলাম।আর আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো সেইজন্যে এই শরবতটা বানিয়ে আনলাম।’
জায়ান আরাবীকে কাছে টেনে এনে জড়িয়ে ধরে বলে,’ ধন্যবাদ সবকিছুর জন্যে।’
পরক্ষণে হালকা দুষ্টু হেসে বললো, ‘ তবে শরবতটার বদলে অন্যকিছু দিলে আরো ভালো লাগতো।রাতে ডিনারও করা লাগতো না তাহলে।’

আরাবী প্রথমে বুঝতে পারেনি জায়ানের এমন কথা।কিন্তু জায়ানের চোখেমুখে দুষ্টুমির ছাপ দেখে যা বুঝার বুঝে ফেললো আরাবী।জায়ানের কাছ থেকে দ্রুত সরে গেলো।লজ্জা পেয়েছে বেশ আরাবী।গ্লাস নিয়ে নিচে যেতে যেতে বলে, ‘ আপনার অসভ্য ইংগিতগুলো নিয়ে দূরে থাকেন।সবসময় মাথাতে এসবই ঘুরে।নিচে আসুন খাবার দেই।নূর,বাবা,মা,আম্মু খেয়ে নিয়েছে।শুধু আপনি আর আমি বাকি।’

জায়ান নিশব্দে হেসে উঠলো।আরাবী লজ্জা পেয়েই এমন করে পালিয়ে গেলো সেটা বেশ বুঝেছে জায়ান।দ্রুত আরাবীর পিছে পিছে নিচে চললো। অতঃপর খাবারের পালা শেষ হতেই।আরাবী জায়ানকে রুমে যেতে বলে।ও বাকি টুকটাক কাজগুলো সেরে নিলো।এতে প্রায় একঘন্টা লেগে গেলো।সব কাজ শেষে আরাবী জোড়ে শ্বাস ফেললো।সবগুলো লাইট নিভিয়ে দিয়ে রুমের দিকে চলল।রুমের দরজা খুলে ভীতরে ঢুকে আবার দরজা লাগানো শেষ হতেই ঝট করে জায়ান কোলে তুলে নিতেই ভয় পেয়ে মৃদ্যু আওয়াজ করে উঠে আরাবী।আকস্মিক এমন করায় অনেকটা ভয় পেয়েছে ও।জায়ান হেসে দিলো।আরাবী নিজেকে সামলে নিয়ে রাগী চোখে তাকালো জায়ানের দিকে।আরাবীকে এমনভাবে তাকাতে দেখে জায়ান বললো, ‘ উফ! রেগে গেলে আরো সুন্দর লাগে তোমায়।লুকিং সো হট!’

আরাবী রাগে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ‘ ছি! অশ্লীল কথাবার্তা!’
জায়ান আরাবীর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,’ এখন অশ্লীল কাজও করবো।ইউ নো নাহ?’
আরাবী জায়ানের কোল থেকে ছাড়া পাবার জন্যে ছটফট করছে।আর বলছে, ‘ ছাড়ুন আমায় অসভ্য লোক।শুধু বাজে কথা বলে।আমায় এইভাবে ভয় দেখালেন কেন আপনি?ছাড়ুন!’

জায়ান আরাবীকে বিছানায় সুইয়ে দিয়ে ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো।অতঃপর বললো, ‘ এতো ছাড়ুন ছাড়ুন করো কেন?একটু তো ধরুন ধরুন তো বলতে পারো? নিজ ইচ্ছায় আমাকে কখনো একটা চুমু পর্যন্ত দিয়েছো আমায়?’
আরাবী মুখ ফুলালো জায়ানের কথায়।বিরবির করে বললো, আমি আপনার মতো নির্লজ্জ না।আমার লজ্জা করে নাহ?’
জায়ান আরাবীর গালে চুমু খেলো।মৃদ্যু কেঁপে উঠলো আরাবী।অতঃপর জায়ানের দিকে তাকালে জায়ান বলে,’ এতো লজ্জা কোথায় পাও তুমি? আমার সামনে কিসের লজ্জা?’

আরাবী দৃষ্টি নত করলো।তারপর মিনমিন করে বললো,’ আপনার সামনেই তো আমি লজ্জা বেশি পাই।আর কারো সামনে এতো লজ্জা আমার আসে না।আপনি আপনার ওই শীতল চোখের চাহনী নিয়ে আমার দিকে তাকালেও আমার লজ্জা করে।তো আমি করবো?’
জায়ান হেসে দিলো আরাবীর কথায়।অতঃপর আরাবীর কানে কানে বললো, ‘ আচ্ছা তুমি লজ্জা পেতে থাকো আমি তোমার লজ্জা ভাঙ্গাতে থাকি।তোমার এই লজ্জারাঙ্গা মুখটা আমার ভীষন পছন্দ।তো ম্যাডাম এখন কি আপনার লজ্জাটা আজ রাতে আবার ভাঙ্গাতে পারি?’
আরাবী লাজুক হেসে মাথা নাড়িয়ে জায়ানের বক্ষে মুখ লুকালো।অতঃপর রাতটা তাদের পার হলো দুজন দুজনার ভালোবাসায় মাখামাখি হয়ে।

কেটে যেতে লাগলো দিনের পর দিন। মাসের পর মাস।বছরের পর বছর।আরাবী গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে।বেশ কঠিন গিয়েছে সময়গুলো সংসার সামলানো,পড়াশোনা,সাথে অফিস সামলানো।বেশ কষ্ট করতে হয়েছে আরাবীকে।তবে জায়ান ওকে প্রতিটা পদক্ষেপে সাহায্য করেছে।ওর পাশে থেকেছে।তাই আরাবী সবটা কষ্ট হলেও সবটা সামলাতে পেরেছে। সাথি সংসারের দায়ভার আরাবীর কাধে দিয়েছে বছর হবে।সে এখন প্রায় অসুস্থ থাকে।

তাই আরাবীকে সবটা বুঝিয়ে শুনিয়ে ওর হাতে তুলে দিয়ে তিনি হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন।আরাবী অফিস রুমে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।বড্ড ক্লান্ত লাগছে।ইদানিং কাজের প্রেসার অনেক। আরাবী প্রায় নেতিয়ে যায় কাজ করতে করতে।হাঁপিয়ে উঠে।তারপরেও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও মনোবল শক্ত করে রুখে দাঁড়ায়।বাবার স্বপ্নটাকে সে কিছুতেই ভেস্তে যেতে দিবেন্না।নিজের মনপ্রাণ লাগিয়ে কাজ করে ও।কোম্পানিটাকে আরো বড়ো করার স্বপ্ন বুনে নিয়েছে মনের মাঝে।তা বাস্তবতায় রূপ দিতে হলেও ওকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। চোখ বুজে এসব চিন্তাই করছিলো আরাবী।এমন সময় মাথার উপর কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে তাকায়।আরাবী সেই দূর্বল চোখের চাহনী দেখে ইফতি নরম কন্ঠে বলে,’ ঠিক আছিস তুই?এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে?’

আরাবী হালকা হাসলো।সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দূর্বল গলায় বলে,’ ও কিছু না ভাইয়া।কাজের প্রেসারটা অনেক ইদানিং। ক্লান্ত লাগছে।’
আরাবী ব্যাগ গুছিয়ে নিতেই ইফতি আরাবীর হাত ধরে যেতে যেতে বলে,’ চল বাড়িতে।খেয়ে দেয়ে জম্পেশ ঘুম দিস।’
আরাবী ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলে ইফতির সাথে বাড়ি চলে গেলো।অবশ্য জায়ান আর ইফতি একসাথেই আসে ওকে নিতে।কিন্তু আজ দুদিন যাবত জায়ান বিডিতে নেই।অফিসের কাজে ডুবাই গিয়েছে।জায়ানকে ছাড়া যে দিনগুলো কি বিটঘুটেভাবে কাটছে আরাবীর তা বলে বুঝানো যাবে না।বাড়িতে এসে দেখলো ওর দুই মা রাতের রান্নাবান্না সেরে ফেলেছেন।কয়েকদিন যাবত এটাই করছেন তারা।ছেলে মেয়েরা এতো কষ্ট করছেন।দম ফেলবার সময় নেই।বিশেষ করে আরাবী পড়াশোনা,

সংসার আর অফিস তিনটে সামলাতে গিয়ে মেয়েটার শরীর সাস্থ্য একেবারে ভেঙ্গে গিয়েছে।শরীর শুকিয়ে কাঠ গয়ে গিয়েছে।সাথির মাজে মাজে মন খারাপ হয়।মেয়েটাকে সংসারের দায়িত্ব এতো তাড়াতাড়ি দিয়ে বোধহয় তিনি ভুল করেছেন মনে হয়।কিন্তু কিছু করার নেই তার।তিনি কিছুই মনে রাখতে পারেন না ঠিকঠাক।সব ভুলে যান।চোখে কম দেখান।হাটুতে ব্যাথা। এখন আর আগের মতো সবটা সামলাতে পারেননা তিনি।

এদিকে সাথি আর লিপিকে এতো কাজ কর‍তে দেখে দুজনকে একদফা বকে দিলো আরাবী।এটা রোজই করে।দুইমাকে কতো শাষন করে।কিন্তু তারা শুনলে তো?বয়স হচ্ছে দিনদিন আরো বাচ্চা হয়ে যাচ্ছেন যেন তারা।নিহাদ সাহেবও কোন অংশে কম না।হাসিঠাট্টার মাধ্যমে রাতের খাবারদাবার শেষ হলে।সবকিছু গুছিয়ে রেখে রুমে আসলো আরাবী।রুমে আসতেই জায়ানের নিসঙ্গটা মনটাকে একনিমিষে বিষিয়ে তুললো। একটু আগেই তো কথা বললো।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৪১

তাও মন খারাপ হয়েই যায়।ভালোবাসার মানুষটিকে দেখার জন্যে,ছোঁয়ার জন্যে মনটা ছটফট করতে থাকে অনবরত।ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো আরাবী।জায়ানের শোয়ার স্থানটায় হাত বুলিয়ে ঘুমিয়ে গেলো।ঘুমানোর আগে বিরবির করে বললো,
‘ কবে ফিরবেন আপনি?জলদি এসে পড়ুন।আপনার কাঠগোলাপ আপনাকে ভীষন মিস করছে।’

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ শেষ পর্ব