বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ১৭

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ১৭
ইলমা বেহরোজ

—-“আপনি ব্যাগ থেকে দড়ি বের করেছেন কেনো?
এতো লম্বা দড়ি ব্যাগে নিয়ে ঘুরেন কেনো?আমরা এখানে দাঁড়িয়েছি কেনো?গাছে দড়িটা বাঁধছেন কেনো?কি করছেন?বলবেন প্লীজ?”
ধারা উতলা হয়ে এক নাগাড়ে প্রশ্ন করে যাচ্ছে।বিভোর মন দিয়ে গাছে শক্ত করে মোটা দড়িটা বাঁধে।বাঁধা শেষে দড়ির শেষ মাথাটুকু ডান হাতে পেঁচিয়ে ধরে।তারপর ধারার সামনে এসে বললো,
—-“আমাকে জড়িয়ে ধরতে আপনার কোনো আপত্তি আছে?”
ধারা সামান্য নড়ে উঠলো।খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে বললো,
—-“কি…কিন্তু কেনো?”

বিভোর আঙ্গুলের ইশারায় লক্ষ্য দেখায়, যেখানে তাঁদের পৌঁছাতে হবে।ধারা আৎকে উঠে বললো,
—-“ওইখানে যেতে চাচ্ছেন?কিন্তু কেমনে?”
বিভোর তাড়া দেয়,
—-“প্লীজ আমাকে ভরসা করুন।বৃষ্টি এখন হালকা তারপর বেড়ে যাবে।”
ধারা দ্রুত এগিয়ে আসে বিভোরের সামনে।বিভোর বাম হাতে ধারার কোমর শক্ত করে ধরে বললো,
—–” আমার দুই’পায়ের উপর আপনার পায়ের ভর রাখুন।আর দু’হাতে গলা জড়িয়ে ধরুন।”
ধারা বিভোরের কথা মতো পায়ের উপর পা রাখে।দু’হাতে গলা জড়িয়ে ধরে।বিভোর ডান হাতে দড়ি টান টান করে শক্ত করে ধরে।পাহাড়ের গায়ে পা রেখে পাঁচ ফুট নামার পর আচমকা পাহাড়ের গা থেকে পা সরিয়ে ঝুলে পড়ে।হাত থেকে দড়ির প্যাচ খুলে যায়।ধারা চিৎকার করে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—-“ও বাবাইইইই!বাবাই।”
বিভোর ধারার মুখের পানে চেয়ে দেখলো ধারা চোখ-মুখ খিঁচে রেখেছে।বিভোর হেসে উঠলো।ধারা চোখ খুলতেই বিভোরের চোখ দু’টি আগে চোখে পড়ে।বিভোরের চোখের মণি ধূসর মনে হচ্ছে তাঁর!
বিভোর আশ্বস্ত করে বললো,
—-“ভয় পাবেন না কিছু হবেনা।চলে এসেছি।এবং বৃষ্টিও চলে এসেছে।আমার এক পায়ের উপর থেকে আপনার এক পা সরান।”
ধারা ডান পা সরিয়ে নেয়।ভয়ে বুক ধুকপুক করছে।
বিভোর দড়িটা আরো শক্ত করে ধরে।ঘেঁষে থাকা পাহাড়ের গায়ে এক পায়ে জোরে ধাক্কা দিয়ে কোথাও একটা লাফিয়ে পড়ে।ভয়ে ধারার হৃদপিণ্ড দ্রুত লাফাচ্ছে।ফুসফুস চলা বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

—–“ধারা চোখ খুলুন?”
ধারা চোখ খুলে।বিভোর হেসে বললো,
—–“এবার ছাড়ুন।”
ধারা আৎকে উঠে,
—-“নাহ!পড়ে যাবো।”
বিভোর হাসিতে মাখামাখি হয়ে বললো,
—-“আমরা মাটিতে আছি।”
ধারা পায়ের নিচে তাকায়।ঘাস দেখতে পায়।একটা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন।ধারা দূরে তাকায়।ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু তাঁর মাথায় বৃষ্টি পড়ছেনা।ব্যাপার কি!ধারা উপরে তাকায় দেখে অন্য আরেকটা পাহাড় ছাদ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মাত্র দুই-মিনিটে এতোটা নিচে!ধারা বিস্ময়ে হতবিহ্বল।

—-“এভাবেই থাকবেন?”
ধারা চমকে উঠে দ্রুত সরে যায়।দূরত্ব রেখে দাঁড়ায়।
বিভোর চুল খাড়া করতে করতে ঘাসের উপর বসে।ধারা মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো,
—-“বৃষ্টিতে ভিজলে তেমন কিছুই হতোনা।নিজেকে হিরো প্রমাণ করতে এতো কষ্ট করতে হতোনা।”
বিভোর হাসলো।স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
—-“বাহ!আপনি কথাও চিনেন দেখি।”
ধারা মুখ বাঁকায়।বিভোর হেসে বললো,
—-“দেখে মনে হয় না আপনার এতো ওজন।”
ধারার দু’ঠোঁট কেঁপে উঠে আক্রোশে।তেজ নিয়ে বললো,
—-“মানে বলছেন আমার ওজন বেশি?”
বিভোর আড়চোখে একবার তাকায়।চোখ সরিয়ে বললো,
—-“মেয়ে মানুষের সাথে কম কথা বলাই মঙ্গল।”

ধারা কিছু একটা বলতে গিয়েও বললোনা।দূরত্ব রেখে ঘাসের উপর বসে।দূর পাহাড়ে চোখ রাখে।চারপাশটা সীমাহীন আশ্চর্য সুন্দর মনে হচ্ছে।বৃষ্টির পানি পাহাড়কে আরো জীবিত করে তুলছে।সবুজ রঙ টা গাঢ় রূপ নিচ্ছে।যেদিকে চোখ যায়,যত দূর চোখ যায় বৃষ্টি আর পাহাড়।এতো সুন্দর!এতো মোহনীয়।ধারা রয়ে সয়ে বিভোরকে বললো,
—-“আপনি তখন বললেন ‘মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে’ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।এভারেস্ট…..
বিভোর ধারাকে কথার মাঝে বাধা দিয়ে বললো,
—-“আমার স্বপ্ন এভারেস্ট জয় করা।”
ধারার চোখ দু’টি কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো।অবিশ্বাস্য স্বরে বললো,

—-‘কি বলেন?এটা ঠিক আপনি খুব অসাধারণ ভাবে পাহাড় বেয়ে উঠা-নামা করতে পারেন।তাই বলে এভারেস্টের স্বপ্ন?”
বিভোর হালকা হাসলো।কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা।ধারা অপেক্ষা করছে বিভোর কখন কথা বলবে।নিরবতা ভেঙ্গে বিভোর বললো,
—-“এভারেস্ট অভিযানে যাওয়ার আগে কড়া প্রশিক্ষণ নিতে হয়।আর এই প্রশিক্ষণ দার্জিলিং এসে নিয়েছি।এর জন্য আমাকে টাকা গুনতে হয়েছে ৫০০ ডলার (৩৫, ০০০ টাকা)।এ ছাড়া অভিজ্ঞতা থাকতে হয় ২০ হাজার ফুটেরও বেশি উচ্চতা থেকে ঘুরে আসার।সেটাও করেছি।আর হুম,বিশ হাজার ফুট উপর থেকে ঘুরে আসার ব্যাপারটা বাধ্যতামূলক নয়।অনেকে আছে যারা ছোট ছোট পাহাড়ের মাধ্যমেই নিজের প্রস্তুতি নিয়েছে।
আনুমানিক কেটু পর্বতের ২২ হাজার ফুট উপরে উঠেছি আমি।আচমকা বিপদজনক আবহাওয়ার জন্য কেটু জয় করা সম্ভব হয়নি।”
ধারা বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়।বিস্ময় নিয়ে বললো,

—-“আল্লাহ!এটা কোথায়?”
—“পাকিস্তানের গিলগিত বালতিস্তা ও চীনের জিংজিয়ানের তাক্সকোরগান সীমান্তে। ”
—-“উচ্চতা কতটুকু?”
—-“৮,৮১১ মিটার (২৮,৯০৭ ফুট)।”
—-“দুঃখজনক!এত কাছে গিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে!
—-“কেটু হচ্ছে মাউন্ট এভারেস্টের পর বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ।”
ধারা চুপসে গেছে।বিভোরের মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে সে সিরিয়াস এবং সে প্রস্তুতি নিয়ে অনেক এগিয়ে এসেছে।যা জানা নেই তা সম্পর্কে জানার আগ্রহ ধারার অনেক বেশি।আবার প্রশ্ন করলো,
—-“এভারেস্ট অভিযানের জন্য কত টাকা লাগে?”
বিভোর হেসে বললো,

—-“অনেক।এভারেস্টে চড়তে হলে ২৫ হাজার মার্কিন ডলার (১৭ লক্ষ ৫০ হাজার! টাকা)দিয়ে নেপাল সরকার থেকে পারমিট নিতে হয়।আর যদি তিব্বত মানে উত্তর-পূর্ব রিজ দিয়ে যেতে চাই সেখানেও ১০ হাজার মার্কিন ডলার (৭ লক্ষ্য টাকা) দিয়ে পারমিট নিতে হবে।পাশাপাশি ইকুইপমেন্টসহ অন্যান্য খরচ তো আছেই।”
—-“এক জায়গায় কম অন্য জায়গায় বেশি টাকা কেনো?”
—-“অন্যদিন বুঝাবো।”
—-“আপনি পারমিট নিয়েছেন?”
—-“না নিবো আগামী বছর।আগামী মে যাত্রা শুরুর ইচ্ছে আছে।”
—-“আচ্ছা পর্বতরোহী সাথে কি যন্ত্রপাতি রাখে?”
বিভোর ধারার দিকে তাকায়।ধারার চোখ দু’টি চকচক করছে।মেয়েটার সব কিছুতে আগ্রহ বেশি।বিশেষ করে অজানা কিছু জানাতে।
বিভোর বললো,

—-“বেশ কিছু টেকনিক্যাল যন্ত্রপাতি লাগে।এর মধ্যে রয়েছে হালকা তাঁবু,শূন্য ডিগ্রি নিচের তাপমাত্রা প্রতিরোধক স্লিপিং ব্যাগ,আইসজ্যাকেট, উইন্ডব্রেকার ট্রাউজার,মাঙ্কি ক্যাপ,সানগ্লাস, হ্যান্ডগ্লাভস,কড়া সানস্ক্রিম,বিশেষ ধরনের দড়ি,পা ও কোমরের বেল্ট,পাহাড়ের খাড়া জায়গায় নিরাপত্তার জন্য দুমুখো ক্যারাবিনা,পর্বতের ঢালে নিজের শরীর আটকানোর জন্য হুক, অ্যালুমিনিয়ামের ফ্লোডিং মই,বরফের পথটি শক্ত না ফাঁপা তা পরীক্ষার জন্য আইস এক্স, হাঁটার লাঠি ইত্যাদি।”
ধারা দু’গালে হাত রেখে অবাক স্বরে বললো,

—-“বেশি অর্ধেক নাম প্রথম শুনলাম।আপনার সব যন্ত্রপাতি আছে?”
—-“না সব নেই।”
—-“বাংলাদেশে আছে সব?”
—-“না।নেপালের কাঠমান্ডুর থামেলে সব পাওয়া যায়।”
—-“আপনার বয়স তো কম।এই বয়সে কেউ এভারেস্ট জয় করে?”
বিভোর আওয়াজ করে হেসে উঠলো।ধারা যেনো এই মুহূর্তে কৌতুক শোনালো।ধারা ভ্রু কুঁচকায়। বিভোর বললো,
—-“সবচেয়ে কম বয়সে এভারেস্ট জয় করে আমেরিকান এক কিশোর।জর্ডান রোমেরা নাম।
বয়স মাত্র ১৩ বছর।”
ধারার মাথায় যেনো বাঁজ পড়লো।জিভ ভারী হয়ে এসেছে।কোনোমতে বললো,
—-“শুনলাম এভারেস্ট জয় অনেক কঠিন।ছোট ছোকরাটা কেমনে পারলো?”
—-“কপাল ভালো ছিলো।মনোবল ভালো ছিল তাই পারছে।”
—-“তাহলে আমিও আপনার সাথে যাবো।”
বিভোর মৃদু হেসে বললো,

—-“খুম্বু আইস ফল নামের একটা স্থান এভারেস্টের সবচেয়ে ভয়ানক স্থান।এই স্থান এতটাই বিপদাসংকুল যে এভারেস্টে যত প্রাণহানি ঘটেছে তার ৮০ ভাগই ঘটেছে এখানে।প্রায় ৫০ ভাগ নিহতদের লাশ এখান থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি।তাহলে বুঝেন যে কতোটা বিপদজনক স্থান এই খুম্বু আইস ফল!এই অংশটুকু পার হওয়া অভিযাত্রীদের জন্য পুলসেরাত পার হবার মত। বরফের পাত,গভীর খাদ,পরিবেশগত আবহাওয়া, শুন্য ডিগ্রীর নিচে তাপমাত্রা সব মিলিয়ে মৃত্যুপুরী।একটু অসাবধান হলেই সেখানে নিশ্চত মৃত্যু।হিমালয়ের আর কোথাও এমন ভয়ংকর স্থান নেই।”
বিভোর থামে।নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,
—-“খুম্বু আইস ফলে ১৯৯৬ সালের ১১ মে ১৯ জন অভিযাত্রী প্রান হারায়।এটাই এভারেস্টের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দূর্ঘটনা।আর স্বপ্নের এভারেস্ট জয় করতে হলে এই মৃত্যুপূরী পার হয়ে যাওয়া ছাড়া কোন পথ নেই ধারা।যেতে চান?”

ধারা নিশ্চুপ।এতো তথ্য তাঁর জানা ছিলোনা।সত্যি ভয়ংকর স্থান, ঠিক যেনো মৃত্যুপুরী।শরীর কাঁটা দিচ্ছে ভাবতে গিয়ে।কিন্তু অদ্ভুত এক টান অনুভব করছে ধারা।এভারেস্টের প্রতি টান!হুট করে টান টা উদয় হলো বুকে।আরেকটা ব্যাপারো ভাবাচ্ছে, এতো দুঃসাহসী একজন পর্বতরোহী তাঁর স্বামী!অথচ,দেখে একটাবারো মনে হয়নি মানুষটার বুকে এত বড় স্বপ্ন।কেটু পাহাড়ের বিশ হাজার ফুট ঘুরেও এসেছে।আবার ভয়ও হচ্ছে,বিভোর যদি মৃত্যুর কাছে হেরে যায়।কিছু না ভেবে ধারা বিভোরের কাছে এসে বসলো।বললো,
—-“আমিও আপনার অভিযানের সহযাত্রী হবো।সব প্রস্তুতি নিতে চাই।”
বিভোর নিজের অজান্তে ধারার দু’গালে হাত রেখে বলে,

—–“ধারা পাগলামি করবেন না।হয় জয় নয় মৃত্যু।পদে পদে মৃত্যু অপেক্ষা করে।একশো ভাগের মধ্যে চল্লিশ ভাগ যাত্রী মৃত্যুর কাছে হার মেনে নেয়।বাকি উনপঞ্চাশ ভাগ শারিরীক-মানসিক সমস্যা নিয়ে ফিরে।হেরে গিয়ে ফিরে।এটা সহজ নয়।আপনি দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান।তবুও এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন দেখবেন না প্লীজ।”
ধারা জড়ানো গলায় বললো,
—-“আপনি যে স্বপ্ন দেখছেন?আপনিতো যাবেন মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে।যদি হেরে যান?তখন…. তখন কি হবে?”
—-“কি হবে?”
—-“আপনি বড্ড অবুঝ।”
ধারার চোখে জল চিকচিক করছে।বিভোর বললো,
—-“আপনার গলা কাঁপছে ধারা।যার বর এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন দেখে তাকে এতো আবেগি মানায়না।”
ধারা চোখ বুজে।দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে।তাঁর বুক কাঁপছে।বিভোর বললো,

—–“বিয়ের রাতে না পালিয়ে বললেও পারতেন আপনার স্বাধীনতা দরকার।আমি আপনাকে স্বাধীনতা দিতাম ধারা।”
ধারা হকচকিয়ে গেল। দ্রুত দূরে সরে বসে।বিভোরও হকচকিয়ে যায়।এতক্ষণ দুজন ঘোরে ছিল।কিসব কথাবার্তা বলছিল নিজেদের অজান্তে।প্রেম এমন কেনো?না চাইতেও মনের সব আবেগ- ভালবাসা অজান্তে ঠেলে-ঠুলে বেরিয়ে আসে।আরো কিছুক্ষণ নিরবতায় কাটে।ধারার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।তিনেক মিনিট সময় নিয়ে সাহস করে প্রশ্ন করলো,
—-‘আপনি কীভাবে জানেন বিয়ের রাতে ট্রাভেলিং এর জন্য পালিয়েছি?”
বিভোরের স্বাভাবিক কন্ঠ,
—-“দিশারি কথার ফাঁকে মুখ ফসকে বলে ফেলছে।আপনি আর সায়ন তখন কথা বলছিলেন।”
সেদিন,

ধারা আর সায়ন সেন্ট পল’স স্কুলের এক কর্ণে বসে কথা বলছিলো।তখন দিশারি – বিভোর স্কুলটা ঘুরে দেখছিল। দিশারি বললো,
—-“জানিস, বিভোর?ধারা বিয়ের রাতের বরের বাড়ি থেকে পালাইছে।”
বিভোর জানে।তাই বিভোর শুনে অবাক হয়নি।বিভোরকে অবাক হতে না দেখে দিশারি বললো,
—–“শুধু তাই না!বরকে বলছে ওর নাকি বয়ফ্রেন্ড আছে।বয়ফ্রেন্ড ফ্রান্সে থাকে।আবার কি করছে জানিস?বরের ফোন দিয়ে ফ্রান্সের এক ছেলে বন্ধুরে কল দিছে।আবার ওই ছেলের বন্ধুরে আগে থেকেই সব শিখাইয়া রাখছে।”
বিভোর সচকিত হয়।আমতাআমতা করে প্রশ্ন করে,
—-“স..সত্যি?”
—-“হ সত্যি।ট্রাভেলিংয়ের জন্য এই কাহিনিডা করছে।এইযে এখন দার্জিলিং আসছে আমাদের সাথে এইটাও বাড়ি থেকে পালাইয়া।ওর বাপ নাকি বিয়ের কথাবার্তা বলতাছে।এজন্য পালাইছে।”
বিভোর বিড়বিড় করে,
—-“ডেঞ্জারাস।”

বৃষ্টি কমে আসছে।বাইরে চোখ রেখে বিভোর প্রশ্ন করলো,
—-“ধারা?”
—-“হু?”
—-“আপনার কাছে বৃষ্টি মানে কি?”
—-“মানে?”
—-“অনেকে ভাবে বৃষ্টি মানে কষ্ট আর কান্না।আপনার কাছে বৃষ্টির মানে কি?”
—-“প্রেম।”
বিভোর মৃদু হাসলো।ধারা বললো,
—-“হাসছেন যে?”
—-“এমনি।”
—-“আপনার কাছে বৃষ্টি কি?”
—-“জানিনা।তবে বৃষ্টি আমার খুব পছন্দ।বৃষ্টি পৃথিবীটাকে নতুন করে সজীব করে তুলে,সৌন্দর্য দ্বিগুণ করে তোলে।আমরা বৃষ্টির কাছে কৃতজ্ঞ!তবুও মানুষ বৃষ্টিকে কান্না যে কেন ভাবে!”

—-“ঠিক তাই।”
চার সেকেন্ড সময় নিয়ে বিভোর বললো,
—-“এভারেস্ট জয়ের স্বপ্নের কথা ভাইয়া,আব্বা আর আপনি ছাড়া কেউ জানেনা।”
—-“সায়ন ভাইয়াও না?”
—-“নাহ।কেটু পাহাড়ের ব্যাপারটাও জানেনা।”
—-“কেনো?”
—-“এমনি।প্লীজ আপনি কাউকে জানাবেন না।কথাটা আম্মার কানে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।সায়নের সাথে আম্মার সখ্যতা ভালো।মুখ ফসকে বলার সম্ভাবনা আছে তাই জানাইনি।যদি স্বপ্ন পূরণ হয় তখন গর্বের সাথে আম্মার সামনে দাঁড়াবো।”
—-“আচ্ছা ঠিকাছে।”
—-“চলুন ফেরা যাক।”
—-“চলুন।”

দুজন উঠে দাঁড়ায়।বিভোর দেখে দড়িটা হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে।ধারাকে বললো,
—-“ভয় পাবেন না।দাঁড়ান।আমি দড়িটা নিয়ে আসি।”
মাটি থেকে পা তুলে বিভোর লাফ দিয়ে পাশের পাহাড়ের মাটি আঁকড়ে ধরে।ধারা ভয়ে চোখ খিঁচে। বিভোর ডান হাতে দড়িটা শক্ত করে ধরে আবার ফিরে আসে।ধারা ঠিক আগের মতোন বিভোরের দু’পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ায়।দু’হাতে গলা জড়িয়ে ধরে।এবার আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে।ভয়ে নয় ভালবাসা নিয়ে!
ধারাকে নিয়ে উঠার সময় সামান্য বেগ পেতে হয়।হাত থেকে দড়িটা ছুটে যেতে চেয়েছিল।উল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।কিন্তু হয়নি।বিভোরের সতর্কতায় রক্ষে!মাটিতে পা রেখে ধারা বললো,

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ১৬

—–“তাহলে এইটাও জানেন আমি কতটা জেদি?নেক্সট ইয়ার আপনার সহযাত্রী হয়ে আমিও যাচ্ছি।আর এটাই ফাইনাল।আগামী মাস থেকে প্রশিক্ষণ নিতে চাই।সাহায্য করুন।নয়তো অন্য কারো সাহায্য নিয়ে হলেও আমি আমার সিদ্ধান্তে অটুট থাকবো।”
কথা শেষ করে ধারা আগে আগে হাঁটা শুরু করে।বিভোর হতবিহবল!এভারেস্ট চড়ার স্বপ্ন একবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে আর ফেরানো সম্ভব নয়,যদি সামর্থ্য থাকে।ধারার পরিবারের অবস্থা উচ্চবিত্ত।ধারা চাইলে অবশ্যই যেতে পারবে।কি হবে সামনে কে জানে।এই মেয়ে পিছু ধরবে মনে হচ্ছে।ছেলেখেলা পেয়েছে নাকি!বিভোর রাগে গদগদ হয়ে দড়িটা ব্যাগে পুরে হাঁটা শুরু করে।

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ১৮