বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ২৬

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ২৬
ইলমা বেহরোজ

খোলা জানালা দিয়ে বাতাস ঢুকছে সাঁ সাঁ করে।ধারার আজ মন ভালো নেই।ঠান্ডায় হাতের পশম কাটা কাটা হয়ে আছে।তাতেও ভ্রুক্ষেপ নেই তাঁর।
ফোনটা বেজে উঠে।ধারা উঠে বসে ফোন ধরে।
——“হুম।”
——“মন খারাপ?”
——“না।”
——“কন্ঠটা আলগা।”
——“একটু।”
——“কেনো?”
——“কাল একটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে।দেখা হবেনা।অথচ,তুমি এরপরদিনই ঢাকা চলে যাচ্ছ।মন খারাপ হবেনা?আমি যেতে চাইনা।বাবাই জোর করছে। ”
বিভোর এক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললো,
——“আমিও কাল ব্যাস্ত থাকবো।”
ধারা আগ্রহ নিয়ে বললো,
——“সত্যি?”
——“হু।”
ধারার জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হচ্ছে কেনো ব্যাস্ত থাকবে বিভোর।কিন্তু করলোনা।আড়াইটা অব্দি ফোনে কথা বলে দুজন ঘুমিয়ে পড়ে দু প্রান্তে।

মেয়র রাজ্জাক রহমানের মেয়ের বিয়ের ইনভাইট রক্ষার্থে এসে ধারার চোখ কপালে।সাথে হাতও।
একই বাড়িতে শেখ বংশ ও সৈয়দ বংশ মুখোমুখি।
সাফায়েত,সামিত ভ্রু’জোড়া কুঁচকে ফেলে বাদল এবং তাঁর বাবা সৈয়দ দেলোয়ার হোসেনকে দেখে।
বাদল সাফায়েতকে জিভ দেখিয়ে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করে।সাফায়েতের শরীর জ্বলে উঠলো।ইচ্ছে হয়,এক্ষুনি গিয়ে বাদলের ঘাড়ের চামড়া ছিড়ে নিতে কামড় দিয়ে।কিন্তু করলোনা।এখানে তাঁর পলিটিক্স শ্বশুর বাপ যে আছেন।তাঁর জন্য কোলাহল শুরু হলে শ্বশুরের সম্মান যাবে।আর এতে শ্বশুর ছেড়ে দেওয়ার লোক নয়।রাগটা হজম করে নেয় সে।
ধারা শেখ আজিজুরকে বললো,
——“বাবা আমি ওদিকে যাই?”
আজিজুর বলেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—–“এখানে কালসাপ আছে সাবধানে থাকবি।কখন ছোবল মেরে দেয়।বুঝবি না।”
বিরক্তিতে ধারা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।তারপর অন্যদিকে হাঁটা শুরু করে।তাঁর উদ্দেশ্য বিভোরকে খোঁজা।বিভোর এদিকেই কোথাও আছে হয়তো।হন্ন হয়ে খুঁজেও বিভোরের দেখা পেলোনা সে।দু’তলায় উঠে আসে।বিয়ে শুরু হবে আরো কিছুক্ষণ বাদে।ঘোরাঘুরি শেষে বারান্দা পেরিয়ে যখন নিচে নামতে যাবে চোখ পড়ে গেইটের দিকে।
বিভোর!সাদা পাঞ্জাবি -পায়জামা পরা।পাঞ্জাবির উপর ব্ল্যাক কটি।চুল খাড়া করা।চোখে সানগ্লাস।কি হ্যান্ডসাম লুক!ধারা মুগ্ধ হয়।তারপরই জেলাস ফিল করে।এখানে কত লুচু মেয়ে আছে।নজর দিবে।আর এতো ভাব মেরে কেন বিয়েতে আসতে হবে?ধারা দ্রুত নেমে যায়।বিভোর গেইট পেরিয়ে বাগানে ঢুকার পূর্ব মুহূর্তে একটা কাগজের টুকরো এসে পায়ের কাছে পড়ে।বিভোর এদিক-ওদিক তাকায়।কাউকে দেখতে পায়না।কাগজ খোলার আগ্রহ বোধও করলোনা।কাগজের টুকরো পিছনে রেখে সামনে এগিয়ে যায়।ধারা কপাল চাপড়ে বিড়বিড় করে,

——“উফ!এত কষ্ট করে কলম কাগজ যোগাড় করলাম।লাভ কি হলো!”
ধারা তক্কে তক্কে থাকে।তাঁর বাপ-ভাইয়ের আড়ালে কীভাবে বিভোরের সাথে যোগাযোগ করা যায়।ফোনও আনেনি।বিয়ে বাড়িতে গেলে ধারা ফোন সাথে নেয়না।হাতে কিছু নিয়ে ঘুরতে তাঁর ভালো লাগেনা।ধারা ছটফট করতে থাকে।এর মধ্যে খেয়াল করে সামিত ডাকছে।ধারা সিঁড়ি ভেঙে বাগানে চলে আসে।বিভোর তখন ভাবি সামিয়ার সঙ্গে গল্পে মগ্ন।
ধারা লিয়ার পাশে দাঁড়ায়।লিয়া বার বার জিজ্ঞাসা করছে তাঁকে কেমন লাগছে।ধারা উত্তর দিচ্ছে তবে বিভোরের দিকে তাকিয়ে।লিয়ার চোখে কয়েক ক্ষণ পর ব্যাপারটা ধরা পড়ে।তবে সে নিশ্চুপ থাকলো।

সামিয়া ধারাকে দেখে বিভোরকে ভ্রু উঁচিয়ে ইশারা করে পিছনে তাকাতে।বিভোর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।বিভোর তাকাতেই ধারা চোখ সরিয়ে নেয়।ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।লিয়ার কানের দুল দেখে, শাড়ি দেখে।প্রশংসা করে।বিভোর হতভম্ব!ধারা এখানে!বিভোর সানগ্লাস খুলে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ায়।ধারাও তাকায়।দুজনে মুচকি হাসে।কিছু বলতে চাচ্ছে দুজনই কিন্তু পারছে না।ধারা ইশারা করে অন্যদিকে আসতে।বিভোর ঘাড় নাড়ায়।ধারা বাবা আজিজুরকে বললো,

——“বাবাই একটু ওদিক থেকে আসি?”
শেখ আজিজুর তীক্ষ্ণ চোখে একবার সৈয়দ ফ্যামিলিকে দেখেন।তারপর ধারার মাথায় হাত রেখে বলেন,
——-” সাবধানে থাকবি।এখানে বিষাক্ত নাগ-নাগিন ঘুরে বেড়াচ্ছে।কখন ছোবল মেরে নীল করে দিবে বুঝবিনা।”
ধারা হাসবে না কাঁদবে ঠাওর করতে পারলোনা।বিভোরের দিকে একবার তাকিয়ে অন্যদিকে সরে যায়।দুয়েক মিনিট পর বিভোর সুযোগ বুঝে জায়গা থেকে কেটে পড়ে।বিভোর-ধারার কান্ড দেখে সামিয়া এবং লিয়া দুজনই মৃদু হাসে।এর মাঝে দুজনের চোখাচোখি হয়।সৌজন্যতা রক্ষার্থে দুজন আবার হাসলো।সামিয়াকে রাজশাহী এসেই সব বলে বিভোর।এবং লিয়া হালকা অভিমানে আছে।ধারা তাঁর কাছে এই ব্যাপারটি শেয়ার করলোনা!
মাঝপথে শাফির সাথে দেখা হয় ধারার।সাফি হেসে বলে,

——“কিরে টুইংকেল?কই ছুটছিস?”
ধারা কিছু বলার পূর্বেই শাফির দেখে বিভোর এদিকেই আসছে।বুঝে ফেলে।মুচকি হাসে।সেদিন শাফির অভিমান ভাঙতে ধারা কি কান্নাকাটি যে শুরু করেছিল!আর দার্জিলিং এ হওয়া সব কিছু বলে।এরপর থেকে শাফির বিভোরকে ভালো লাগে।
ধারাকে কিছু বলতে না দিয়ে শাফিই বলে,

——“আমার কাজ আছে।কই যাচ্ছিস যা।সাবধানে থাকিস।”
——“আরেএ ভা..
শাফি দ্রুত হেঁটে চলে যায়।এর মধ্যে বিভোর আসে।ধারার হাতের কব্জিতে শক্ত করে ধরে বাড়ির অন্য পাশে ছুটে।
ধারা বিল্ডিংয়ের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এবং বিভোর কিছুটা দূরত্বে দু’হাত ভাঁজ করে ধারার দিকে তাকিয়ে আছে।ধারা হেসে বলে,
——“কি দেখছো?”
——“সাজগোজে প্রথম দেখছি।”
——“তো?”
——“বেশিই সুন্দর!আসমানের পরী জমিনে যেন পা রেখেছে।”
ধারা লজ্জায় লাল হয়ে যায়।লজ্জাকে আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করতে করতে বললো,

——“বিয়ের রাতে দেখেছো প্রথম মনে নেই?”
——“সেদিন খেয়াল করিনি।এখনো মনে করতে পারিনা সেদিন কেমন লেগেছিল।তাই আজই প্রথম।”
কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা।এরপর ধারা নখ খুঁচাতে খুঁচাতে বললো,
——“বিবাহিত ছেলেদের হ্যান্ডসাম লুক নিয়ে বিয়ে বাড়িতে আসা আইনে নিষেধাজ্ঞা করা হউক!”
বিভোর জোরে হেসে উঠে।রসিকতা করে বলে,
——“ইনডিরেক্টলি আমাকে হ্যান্ডসাম লাগছে বলছো?রাইট?”
ধারা নিশ্চুপ।
বিভোর রসিকতা করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে আবারো বললো,

——“বুঝলা মেয়ে খুঁজছি প্রেম করার জন্য।বিয়ে বাড়িতে অনেক সুন্দরী মেয়ে থাকে।কিন্তু পাচ্ছিনা।”
ধারা দুয়েক সেকেন্ড বিভোরের দিকে তাকিয়ে থাকে।তারপর ঘুরে হাঁটা শুরু করে চলে যাওয়ার জন্য তখনি বিভোর হাতে ধরে আটকে ফেলে।সাথে সাথে ধারা চিৎকার করে উঠে,
——“ওয়া!ওয়াও!হোয়াট এ সিন!একদম মুভির সিন।নায়িকা চলে যেতে চাইবে নায়ক হাতে ধরে আটকিয়ে দিবে।তুমি নায়ক আমি নায়িকা।ওয়াও।”
ধারার লাফালাফি দেখে বিভোর হতবিহ্বল!তেইশ বছরের একটা মেয়ে কেমন করে লাফাচ্ছে আবার লেহেঙ্গা পরে!কানের দুল,টিকলি,হার দুলে দুলে ঝনঝন আওয়াজ তুলছে।সেই সাথে চুড়ি ও পায়েলের রিনঝিন সুর।সব মিলিয়ে অদ্ভুত শোনাচ্ছে বিভোরের কানে।
সাফায়েত সামিতের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়।তারপর কানে কানে বলে,

——“বিভোর ছেলেটা কিন্তু ফাটাফাটি।”
সামিত চোখ গরম করে তাকায়।সাফায়েত চুপসে যায়।দূরে তাকিয়ে দেখে বাদল একটা চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে তাঁর দিকে তাকিয়েই হাসছে।সাফায়েত একটা চেয়ার যোগাড় করে সেও একই স্টাইলে বসে।বাদল এবার অন্য স্টাইলে বসে সাফায়েত আবারো কপি করে বাদলকে।বাদল ছোট ইটের টুকরো কুড়িয়ে সাফায়েতের দিকে ছুঁড়ে মারে।
সাফায়েতের নাক বরাবর এসে লাগে টুকরোটি।সে হন্ন হয়ে আরেকটু বড় টুকরো খোঁজা শুরু করে।ছোট পাথর খুঁজে পায়।ছুঁড়ে মারে বাদলের দিকে বাদল চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে সামিয়ার পায়ের কাছে পড়ে।সাফায়েত দাঁত বত্রিশটা বের করে কিটকিট করে হেসে উঠে।একজন লোক দৌড়ে এসে বাদলকে তুলতে চাইলে।বাদল ধমকে উঠে,

——“লাগবেনা।আমি উঠতে পারি একা।”
বাদল উঠে দাঁড়ায়।অনেকের মনোযোগ তাঁর উপর।দু’তিনটা মেয়ে বার বার তাকিয়ে দেখছিল তাঁকে এমন সময়ই পড়ে গেলো।বিরক্তিকর!তবে সে প্রতিজ্ঞা করে সাফায়েতকে ছাড়বেনা।নিজেকে স্বাভাবিক করে শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়ায়।বউ স্টেজে চলে এসেছে।বাদল নিজেকে স্বাভাবিক প্রমাণ করতে সামিয়ার সাথে কয়টা সেলফি তুলে।সাফায়েত বাদলের পাত্তা না পেয়ে অন্যদিকে মনোযোগ দেয়।তখনি বাদল একটা কাগজ – কলম যোগাড় করে সেখানে লিখে,
—–“দুই দিন ধরে কিছু খাইনা দশটা টাকা ভিক্ষা দেন!”
এরপর কাগজটা একটা ওয়েটারের কাছে দিয়ে ওয়েটারকে সব বুঝিয়ে দেয়।বিনিময়ে এক হাজার টাকা দেয়।ওয়েটার সাবধানে কোল্ড কফি দেওয়ার বাহানায় সাফায়েতের পিঠে কাগজটি লাগিয়ে আসে।বউয়ের ভাইয়ের সাথে সেলফি তুলতে সাফায়েত স্টেজে উঠে তখনি আশে-পাশের মানুষেরা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে।সাফায়েত ঠাওর করতে পারেনা এদের হাসির কারণ।তাই নিজেও হাসে।সেলফি তোলা শেষে সামিতের পাশে এসে দাঁড়ায়।তখনি সামিত চোখ-মুখ বিকৃত করে বলে,

——“মানুষ তোকে নিয়ে হাসছিল।পিঠে এটা কি লাগাইছিস?নিজেকে জোকার বানাতে ভালো লাগে তোর?”
সাফায়েত চমকে উঠে।পিঠে হাত দিয়ে কাগজের নাগাল পায়।কাগজটা টেনে হাতে নেয়।লেখাটি দেখতে মেজাজ বিগড়ে যায়।বাদলের দিকে তাকায়।বাদল হাসছে।মানে ওরই কারসাজি।সাফায়েত আচমকা ক্ষুধার্ত বাঘের মতো বাদলের দিকে ছুটে এসে বাদলের শার্টের কলার ধরে বলে,
——-” তুই এইটা করছস না?”
বাদল মুহূর্তে রেগে গিয়ে সাফায়েতের চুল মুষ্টি বদ্ধ করে ধরে।সাফায়েতের মাথা ব্যাথায় দপদপ করে উঠে।বাদলের শার্টের কলার ছেড়ে দু’হাতে বাদলের দু’কান খামচে ধরে।শুরু হয় মহিষ লড়াই!বাদলের চাচাতো ভাই,সৈয়দ দেলোয়ার, শেখ আজিজুর, সামিত একে একে সবাই যুদ্ধে নেমে পড়ে।শেখ আজিজুর চেঁচিয়ে বলেন,
——-“হারামজাদা বাদইল্লে আমার ব্যাঠারে ছাড়।নইলে তোর চৌদ্ধ গোষ্ঠীরে জেলে পুরে দিবো।আমি একসময় খ্যাতিমান আইনজীবী ছিলাম।ভুলে যাস না।”
সৈয়দ দেলোয়ার হুংকার ছাড়েন,

——“বাপের ব্যাঠা হলে করে দেখা।জন্ম তো দিছিস কয়টা বেজাত ব্যাঠা-বেঠি।”
——“দেলোয়াইরে আর একটাও কথা বলবিনা।”
——‘তুই চুপ থাক।বাদলের মা তুমি আমাদের ড্রাইভার সুরুজের জুতাটা নিয়ে আসো।ওর জুতায় অনেক গন্ধ।”
সৈয়দ লায়লা আৎকে উঠেন।দুই ঘন্টা জার্নি করে বাড়িতে যেতে হবে?তিনি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেন,
——“পারবনা।”
মুহূর্তে বিয়ে বাড়িতে শুরু হয় কোলাহল, বিশৃঙ্খলা।সামিত ইতিমধ্যে কল করে পুলিশ ডেকে নেয়।
সাংবাদিকরা মুহূর্তে সারাদেশে খবর ছড়িয়ে দেয়।মেয়রের মেয়ের বিয়ে তাই তাঁরা তক্কে তক্কে ছিল।
এক-দুজন সাংবাদিক আরো রস মিশিয়ে বলছেন,
——“মেয়রের বাড়িতে দুই পরিবারের সংঘর্ষ!আমাদের ধারণা এরা পাগলা গারদ থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত, আচরণ তাই বলছে।এখনো অব্দি কেউ নিহত হয়নি।তবে খুব দ্রুতই হবে আশা করা যাচ্ছে।”

বিভোর প্রায় অনেক্ষণ যাবৎ এদের সামলানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছেনা।বিভোরের চাচাতো বড় ভাই আশফাক আর সামিতকে দেখে মনে হচ্ছে এরা কুস্তি লড়তে নেমেছে।বাদল এবং সাফায়েত সেই যে চুলে আর কানে ধরেছে।ছাড়ার নাম নেই।সেই সাথে মুখে তো বিকৃত কথা আছেই।ধারার বাবা আর বিভোরের বাবা বিরামহীন ভাবে তর্ক করে যাচ্ছে। শিক্ষিত মানুষেরা এমন হয়?তিন-চার জন ছাড়া কেউ আটকাতেও আসছেনা।ভিডিও করাতে ব্যাস্ত সবাই!সম্মানিত মেয়র সাহেব শিওর দুই ফ্যামিলির নামে মানহানির মামলা করবেন।গেইটে পুলিশকে দেখে বিভোর সরে যায়।দূরে বসে দু’হাত মাথায় ঠেকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।সামিয়ার কাছে অনেকবার সে শুনেছে এই দুই পরিবার নিয়ে নাকি বিচারও হয়েছে।শপিংমলের সামনে এবং আরেকবার কাঁচাবাজারের সামনে রক্তারক্তি কান্ড করেছে তাই।ধারা অসহায় দৃষ্টিতে বিভোরের দিকে তাকায়।চোখে তাঁর হার মানা দৃষ্টি।বিভোর এত কিছু দেখার পরও ধারাকে ইশারায় আশ্বস্ত করে।বলে,সব ঠিক হবে।

বাইরে ঝুম বৃষ্টি।আবহাওয়া বড্ড শীতল।বছরের প্রথম দিন বিধায় শাফির মেহেরকে সময় দিতে হচ্ছে।দুজন একটা কফিশপে বসে আছে।কথায় কথায় মেহের খুব সাবধানে প্রশ্ন করলো,
——“বাবু?তোমার বোন প্রেম করে যে ছেলেটার নাম কি?”
——“মুহতাসিম মাহতাব বিভোর।”
——“নাইস নেম।তুমি না বলতা তোমার বোন প্রেম-ট্রেম করেনা।আর কখনো করবোনা।এখন ঠিকই করে।আচ্ছা ওই জামাইয়ের সাথে ডিভোর্স হইছে বাবু?”
——“না হয়নি।”
মেহের ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,

——“তাইলে এক হিসাবে তোমার বইন পরকীয়ায় লিপ্ত।”
শাফির হাসিখুশি মুখটা মুহূর্তে চুপসে যায়।চাপা স্বরে রাগ নিয়ে শাফি বললো,
——“কি বলছো?তুমি কাকে নিয়ে কথা বলছো কার সামনে বুঝতে পারছো?”
মেহের শাফির রাগ অগ্রাহ্য করে।শাফি আবারো ক্রোধ নিয়ে বললো,
——“যে ছেলের সাথে প্রেম করে ওই ছেলেই ওর হাসবেন্ড।”
মেহের কফিতে মাত্র চুমুক দিয়েছে তখনি শাফির এমন কথাতে মুখ থেকে কফি ছিটকে শাফির শার্টে পড়ে।শাফি চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে।মেহের বিস্ময় নিয়ে বলে,

——“সেকি!”
শাফি কিছু বললোনা।সে টিস্যু দিয়ে শার্ট থেকে কফি মুছতে ব্যস্ত।মেহের বললো,
——“জামাইয়ের সাথে আবার প্রেম?দেখা হইলো কই?”
শাফি বিরক্ত নিয়ে বললো,
——“দার্জিলিং।আমার কাজিনের ফ্রেন্ড ধারার হাসবেন্ড। ”
মেহের প্রশ্ন করলো,
——“তোমাদের ফ্যামিলির সাথে তোমার বোনের শ্বশুরবাড়ির অনেক সমস্যা না?”
——“হুম।কি হবে আল্লাহ জানে।যখন ভাইয়ারা আর বাবাই এসব জানবে।”
মেহের অবাক হবার ভান ধরে বললো,
——“সেকি!জানেনা উনারা?তুমি বলোনি?”
——“ধারা চায়নি।আর উনারা মানবে না।”
মেহের হাতজোড়া ঘাড়ের কাছে ঠেকিয়ে আয়েসি ভঙ্গিতে বললো,
——“ওহ।”

সারারাত ফোনে কথা বলে সারাদিন ধারা ঘুমায়।এক সপ্তাহ হলো বিভোরের ঢাকা চলে যাওয়ার।এক সপ্তাহ বিভোর রাজশাহী ছিল।কত মধুর স্মৃতি দিয়ে গেল।যা ভেবে দিন কেটে যায় ধারার।তৃতীয় দিন যখন ওরা বের হয় তখন ঝুম বৃষ্টি নামে।ধারা ঠান্ডা সহ্য করতে পারেনা।বিভোর শপিংমল থেকে রেইন কোট কিনে ধারাকে পরিয়ে দেয়।তারপর দুজন বৃষ্টি
তে ভিজে হাতে হাত রেখে।বিভোরের পরনে ছিল আকাশি রঙের শার্ট।প্রথম দুটো’ বোতাম ছিল খোলা।কি যে অসাধারণ লাগছিল বিভোরকে।ধারাকে কোলে নিয়ে বৃষ্টিতে অলি-গলি ঘুরে বেড়ায় বিভোর।অনেকে ভিডিও করেছে।তবে,ধারার মুখ ঢাকা ছিল।সেদিন ধারা আবিষ্কার করে বিভোরের লজ্জা খুবই কম।আর রোমান্টিক ভারী।চতুর্থ দিন প্রথম ফুসকা খাওয়া হয় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে।বিভোর ঝাল খেতে খুব ভালবাসে।এত ঝাল খাচ্ছিলো যে ঠোঁট রক্ত লাল ধারণ করে।সেই মুহূর্তের অনুভূতি বর্ণনা করার ভাষা ধারার নেই।সাধারণত ছেলেরা মেয়েদের রূপে বার বার মুগ্ধ হয়।আর ওদের বেলায় উল্টো।বেশি মুগ্ধ হয় ধারা!

——-“আসবো পরী?”
সাফায়েতের ডাকে ধারার সম্বিৎ ফিরে।হেসে বলে,
——-“আসো ভাইয়া।”
সাফায়েত ধারার পালঙ্কের এক কর্ণে বসে।তারপর ধারাকে বললো,
——-“প্রেম-ট্রেম করিস নাকি?”
ধারা ভারি চমকালো।তারপর নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
——“হঠাৎ এমন মনে হবার কারণ?”
সাফায়েত হেসে বললো,
——“ইদানীং রাত দুইটা – তিনটায় তোর রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার পথে ফিসফিসানি শুনতে পাই।
আমি শিওর প্রেম করছিস।”
ধারা বুঝে যায় অস্বীকার করার পথ নেই।মিথ্যা কথা সাজাতেও পারছেনা।তাই বুকে সাহস নিয়ে বলে,

——“হুম করি।বাট প্লীজ কে সে জানতে চেয়োনা আপাতত।সময় হলে বলবো প্রমিস।”
সাফায়েত ব্যথিত ভাব নিয়ে বললো,
——“যাহ বাবা!আগেই না করে দিলি।আমি আরো…..যাক গে,কাউকে ভালবাসিস এইটাই অনেক।এবার বিয়েটা হবে।খুব দ্রুত সময়টা নিয়ে আয়।অপেক্ষায় আছি তোর বিয়ের।”
ধারা হাসলো।সাফায়েত উঠতে গিয়ে আবার বসে পড়ে।ধারার দিকে তাকিয়ে বললো,
——“পরীটা যারে ভালবাসছে সে কিন্তু অনেক লাকি পারসন।দেখতে এখনি ইচ্ছে হচ্ছে।তবুও ধৈর্য্য ধরলাম দ্রুত তাঁর সাক্ষাৎ পাবো আশা করি।”
ধারা মাথা কাত করে বললো,

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ২৫

——“অবশ্যই।”
সাফায়েত রুম থেকে বেরিয়ে যাবার পথে বললো,
——“যত ইচ্ছে ফোনে কথা বল।বিল আমার।”
ধারা এবার জোরে হেসে ফেলে।সাফায়েতও হেসে বেরিয়ে যায়।এরপর মাইশা আসে।ধারার সঙ্গে আড্ডা দিতে।গত এক সপ্তাহ আড্ডা দিতে পারেনি।পরিবারের সবার মন খারাপ ছিল।মেয়রের মামলাতে ফেঁসে যায় ওরা।মামলা নিয়ে অনেক কাহিনি হয়।সেসব সামলাতে গিয়ে পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্য হিমশিম খায়।গতদিন সব ঠান্ডা হয়,মীমাংসা হয়!এলাকায় মুখ দেখানো দায় এখন!

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ২৭