বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৩৫

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৩৫
ইলমা বেহরোজ

দুই সপ্তাহ পর।কর্ণাটকের মধ্যে দ্বিতীয় পর্বত শৃঙ্গ কুমার পর্বতে ট্রেকিংয়ের জন্য বের হয় দুজন।দক্ষিণ ভারতের সবচেয়ে কঠিন ট্রেক এটি।গত দুই সপ্তাহয় ধারার হিমোফোবিয়া অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।সেই সাথে দুজন প্রতিদিন ভোরে দৌড়িয়ে শরীরের প্রস্তুতি নিয়েছে।নতুন করে ট্রেক টি-শার্ট, ট্রেক প্যান্ট,ট্রেকিং জুতা কিনে নেয়।রবিবার দুপুরে কর্ণাটকে এসে পৌঁছায়।এরপর রাত নয়টায় বেঙ্গালুরু থেকে একটি সংস্থার সাথে যাত্রা শুরু করে।পরদিন কুক্কা নামে একটি জায়গায় পৌঁছে সকাল পাঁচটায়।নাস্তা করতে করতে ট্রেক গাইড এবং বাকি ষোল জনের সাথে পরিচয় পর্ব শেষ হয়।ধারাকে নিয়ে মেয়ে ছিল পাঁচজন।একজন খ্রিষ্টান তিনজন হিন্দু আর ধারা।ট্রেক গাইডের নাম শঙ্কর রায়।তিনি বলেন,বসে কখনো বিশ্রাম না নিতে।দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিতে।এবং পানি কম খেতে।যখন খাড়া পাহাড় বেয়ে উপরে উঠা হবে তখন ঝুঁকে না হেঁটে শিরদাঁড়া সোজা করে হাঁটতে।

এরপর ছয়টা ত্রিশে ট্রেক শুরু হয়।ট্রেকের রাস্তাটি মায়াবী গহীন অরণ্যে আচ্ছাদিত।কিছুক্ষণের মধ্যে নিস্তব্ধতা নেমে আসে।মানুষের কন্ঠের সাড়া-শব্দ নেই।শুকনো পাতায় জুতার ঘর্ষণে মরমর আওয়াজ।আর পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ চারিদিকে।নিরবতা ভেঙে ধারা বললো,
— “এভাবে চুপচাপ হাঁটতে ভালো লাগেনা।”
নিস্তব্ধতার মাঝে ধারার আস্তে কথা বলাটা মাইকে কথা বলার মতো আওয়াজ তুলে।সবার কানে যায়।খ্রিষ্টান মেয়েটি পিছিয়ে আসে।ধারার পাশাপাশি দাঁড়ায়।আস্তে করে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “নাম কি তোমার?”
ধারা হেসে বললো,
— “সিদ্রাতুল ধারা।আর তোমার?”
— “ঈলেনা আনা।”
— “আমি শুধু আনা বলি?মনে হচ্ছে আমরা এক বয়সী।”
— “অবশ্যই।তুমি বাংলাদেশি?”
— “হুম।তুমি?”
— “আমিও বাংলাদেশি।”
— “আমরা তাহলে এক দেশি।”
— “হুম।”
— “এখানে চেনা-পরিচিত কেউ আছে তোমার?”
— “আছে।ওইযে ব্লু টি-শার্ট পরা উনি আমার বড় ভাইয়া।”
— “তাই নাকি।”
— “হুম।”
— “দু’ভাই বোনই ট্রেকার দেখছি।”
— “হুম।”
বিভোর বললো,
— “এতো কথা কেন বলো ধারা।তেষ্টা পাবে।”
— “সরি আর বলবনা।”
সাইত্রিশ বয়সী একজন লোক ঘাড় ঘুরিয়ে হেসে বললেন,
— “প্রতিবার ট্রেকিংয়ে একটা মেয়ে থাকবেই যে কথা ছাড়া থাকতে পারেনা।”
সবাই হাসলো।বিভোরও।

চার কিলোমিটার হাঁটার পর ধীরে ধীরে সবাই বিশ্রামের জন্য থেমে যায়।বিভোর,ধারা,আনা,এবং আনার ভাই গারেতের দম বাকি এখনো।তাঁরা এগুতে থাকে।জঙ্গল গভীর থেকে গভীরত হচ্ছে।রাস্তায় এক পা ফেলার জায়গা শুধু।দু’পাশে ঘন ঝোঁপঝাড়।কিছুক্ষণ পর আনা এবং গারেত থেমে যায়।বিভোর,ধারার আংশিক দম বাকি।ওরা হাঁটতে থাকে।মাঝে দু-তিন বার এক ঢোক করে পানি খায়।মিনিট বিশেক হাঁটার পর শরীর ক্লান্ত হয়ে আসে।ধারা শরীরের ভার ছেড়ে ঘাসে শুয়ে পড়ে।বিভোর বললো,

— “জোঁক আছে ধারা।উঠো।”
ধারা লাফিয়ে উঠে।বিভোর হেসে খেজুর বের করে।
ধারাকে দেয়।এবং নিজে খায়।পানি খেয়ে নতুন উদ্যমে যাত্রা শুরু করে।পথিমধ্যে বিভোর বললো,
— “ভাত্তারা মানে তে পৌঁছে দুপুরের খাবার খাবো।”
— “ওকে।”
— “খুব কষ্ট হচ্ছে?”
— “তার চেয়েও আনন্দ হচ্ছে বেশি।এতো এডভেঞ্চারময় লাইফ লিড করবো ভাবিনি।খুব খুশি আমি।”
বিভোর হাসে।স্থির হয়ে দাঁড়ায়।ধারা পিছন ঘুরে বললো,
— “দাঁড়ালা কেন?”
বিভোর এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললো,
— “কেউ নাই আশেপাশে।”
ধারা ভ্রু কুঁচকে বললো,

— “তো?”
— “এনার্জি কমে যাচ্ছে।একটু কিস-টিস হলে এনার্জি বাড়বে।আর এটা ট্রু।”
ধারা হেসে হাঁটা শুরু করে।বিভোর পিছন ডাকে,
— “আরে ধারা।বিশ্বাস করো।এটা ট্রু।হাসবেন্ডের চুমুতে অনেক পাওয়ার।জাস্ট একটা নিয়ে দেখো মনে হবে সুপারম্যান হয়ে গেসো।উড়ে উড়ে ট্রেকিং শেষ হয়ে যাবে।”
ধারা এবার জোরে হেসে ফেললো।বিভোর ধারার হাতে ধরে আটকায়।ধারা বললো,
— “সিরিয়াসলি?”
— “তবে কি মিথ্যে?”
বিভোর ধারার একদম নিকটে চলে আসে তখনি আনার কন্ঠ,
— “ধারা।”
ধারা চমকে চোখ খুলে।বিভোর দ্রুত সরে যায়।একবার আনাকে দেখে হাঁটা শুরু করে।আনা এসে অপরাধী স্বরে বললো,

— “সরি ধারা।ভুল সময়ে এন্ট্রি নিয়েছি।”
ধারা লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে।আমতাআমতা করে বললো,
— “আরে না তেমন কিছুনা।চলো হাঁটি।”
— “হুম চলো।একটা ব্যাক্তিগত প্রশ্ন করি?”
— “হুম করো।”
— “শুরুতেই বুঝেছি।তোমারা দুজন কাছের।তবে, হাসবেন্ড ওয়াইফ নাকি গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড বুঝতেছিনা।”
ধারা হেসে বললো,
— “হাসবেন্ড আমার।”
গারেত আনাকে ডাকে পানি খেতে।তখন বিভোর ধারাকে ফিসফিসিয়ে বললো,

— “এমন গহীন অরণ্যেও থার্ড পারসনের অভাব নেই।শালার কপাল।”
ধারা হেসে বিভোরের সামনের চুল কয়টা টেনে দেয়।বিভোর বললো,
— “তোমাকে সুপারম্যান করাও হলোনা।”
ধারা চোখ গরম করে বললো,
— “তুমি আজ ফাজিল হয়ে গেছো খুব।হাঁটবা নাকি মারবো।’
প্রায় সাত কিলোমিটার হাঁটা শেষ হলে ওরা ভাত্তারা মানে তে পৌঁছায়।তখন দুপুর একটা বিশ।বিভোর, ধারা,আনা,গারেত ছাড়া কেউ তখনো পৌঁছায়নি।দুপুরের খাবার হিসেবে খুব সাধারণ খাবার সাম্বার,ভাত আর দইয়ের ঘোল খেলো ওরা।খাওয়া শেষে ট্রেক গাইড সহ আরো তিনজনের দেখা পায়।
ট্রেক গাইড বলেন,

— “একদিনে যাত্রা শেষ করা সম্ভব।কিন্তু এবারের ট্রেকিংটা অন্যরকম।আমরা চূড়ায় তাঁবু টানিয়ে থাকবো।রাতে একটু খোশগল্প, আমোদ-প্রমোদ করার প্ল্যান আছে।আপনারা কি থাকবেন?বাকিদের আগেই জানানো হয়েছে।আপনারাতো নতুন যোগ দিলেন।তাই এখন বলতে হলো।শুরুতে বলতে বেমালুম ভুলে গিয়েছি।”
— “শিওর।” বিভোর হেসে বললো।
ট্রেক গাইড বলেন,

— “আর মনে রাখবেন,রাতে আক্রমণের শিকার হতে পারেন।প্রস্তুতি রাখবেন।আগে এমনটা হতোনা।ইদানীং কিছু চক্র এখানে ঘুরে বেড়ায়।ট্রেকারদের জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়।মেয়েদের অসম্মান করে।সো বি কেয়ার ফুল।”
বিভোর এক হাতে শক্ত করে ধারাকে ধরে।ধারা বিভোরের দিকে তাকায়।বিভোর চোখের ইশারায় বুঝায়,চিন্তা করোনা।আমি আছি।তবুও ধারার ভয় হচ্ছে।কি হবে সন্ধ্যার পর আল্লাহ জানেন।বিভোর ব্যাগটা আরেকবার দেখে নেয়।ছুরি আছে নাকি।এরপর বনদপ্তরের কার্যালয়ে নিজেদের নাম এবং জিনিসপত্র নথিভুক্ত করে দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রেকের জন্য রওনা দেয়।শুরু হয় শুকনো ঘাসের জমি।কড়া রোদ তখন মাথার উপর।শরীর ঘামছে।সবাই টুপি পরে নেয়।বিভোর ধারাকে বললো,

— ” ক্যাপ আনোনি তাইনা?”
ধারা অপরাধীর মতো মাথা এদিক-ওদিক কাত করলো।বিভোর নিজের ব্যাগ থেকে দুটো টুপি বের করে।একটা ধারাকে দেয় এবং বলে,
— “আসার আগে বার বার বলছি সব নাও।তবুও নাওনি।দরজা বন্ধ করার আগে চোখে পড়ে ক্যাপটা সোফায়।তখন নিয়ে আসি।মেয়েরা এতো কেয়ারলেস কীভাবে হয়?”
ধারা গর্ব করে বলে,
— “হাসবেন্ড এতো কেয়ারিং হলে ওয়াইফকে কেয়ারলেস হতেই হয়।”
— “এটা কি তোমার বানানো রুলস?”
— “ধরে নাও।”
বিভোর হেসে ধারার হাতে ধরে শক্ত করে।প্রশ্ন করলো,
— “খারাপ লাগছে?”
ধারার চোখ ছোট হয়ে গেছে।মুখে ক্লান্তির ছাপ।তবুও হেসে বললো,
— “উহু।”
— “পানি খাবা?”
— “দাও।”

ক্রমশ সবার ক্লান্তি বাড়তে থাকে।যে যার মতো পথে বসে পড়ছে বিশ্রামের জন্য।বিভোর-ধারা এগিয়ে আছে।সবার মনে কুমার পর্বতের চূড়ায় পৌঁছার খুশির স্রোত শুরু হয়েছে।খাড়া পাহাড় বেয়ে উপরে উঠা শুরু।চিকন মাটির রাস্তা পাশে গভীর খাদ।ধারা যেভাবে হাঁটছে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।বিভোর বার বার বলছে,
— “ধারা সাবধান।এতো সাইট দিয়ে হেঁটোনা।মাঝখান দিয়ে হাঁটো।”
কিন্তু ধারা সাবধান থাকতে পারলোনা।মাটি ভেঙে পড়ে যায়।বিভোর চিৎকার করে নিচে তাকায়।বিভোরের চিৎকার শুনে কিছুটা দূরত্বে থাকা আনা এবং গারেত দৌড়ে আসে।ধারা দু’হাতে মাটি খামচে ধরে ঝুলে আছে।বিভোরকে উঁকি দিতে দেখে চিৎকার করে আকুতি করে,

— “প্লীজ তুমি নেমোনা।”
বিভোর নিচে নামার জন্য পা বাড়ায়।এই রিস্ক নেওয়ার সাহস তাঁর নেই।ধারা একবার ছুটে গেলে শেষ হয়ে যাবে।গারেত বিভোরকে বললো,
— “এভাবে আপনি উনাকে বাঁচাতে পারবেন না।দড়ি আছে?”
বিভোর ভয়ে বুদ্ধিহীন হয়ে পড়ে।গারেতের মুখে দড়ি কথাটি শুনে হুশ আসে।দ্রুত দড়ি বের করে নিচে ছুঁড়ে দেয়।বলে,
— “শক্ত করে দড়িটা ধরো।”
কিছুক্ষণের চেষ্টায় ধারাকে উপরে তোলা সম্ভব হয়।বিভোর ধারাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।ধারা উপলব্ধি করে বিভোরের বুক উঠানামা করছে দ্রুতগতিতে।বিভোর ধারার দু’গালে হাত রেখে অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বললো,

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৩৪

— “আমার বুকটা এখনো শান্ত হচ্ছেনা।তুমি কেন এতো কেয়ারলেস।কবে ঠিক হবে।”
ধারা হতবাক।বিভোর কাঁদছে।গলা কাঁপছে।জল গড়িয়ে গাল অব্দি চলে এসেছে।বেশি ভয় সে নয় বিভোর পেয়েছে।আর বিভোরের হৃদপিণ্ড দ্রুতগতিতে চলছে।ঊনিশ-বিশ হলেই ধারা চিরতরে হারিয়ে যেতো জীবন থেকে।ভাবা যাচ্ছেনা একদম।

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৩৬