বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৩৪

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৩৪
ইলমা বেহরোজ

বিভোর কপাল কিঞ্চিৎ কুঁচকে সোফায় আধাশোয়া হয়ে বসে টিভি দেখছে।ধারা কিছুক্ষণ আগে লাগেজ নিয়ে ফ্ল্যাটে এসেছে।কাপড় চেঞ্জ করে বিভোরের সামনে এসে দাঁড়ায়।বিভোর তাকায়।বলে,
— “আসো।”
ধারা সোফায় পা তুলে বিভোরের কোলে শুয়ে বললো,
— “কি ভাবছো?”
বিভোর ম্লান হাসলো।ধারা আবার প্রশ্ন করলো,
— “কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত?বলো আমাকে?”
বিভোর ধারার চোখের দিকে তাকায়।এরপর বললো,
— “তোমার হিমোফোবিয়া আছে বেমালুম ভুলেই গেছিলাম।”
ধারা ঠোঁট টিপে দুয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে।বিভোর আর কিছু বলছেনা তাই বললো,
— “ভুলে গিয়েছিলে বলে চিন্তিত?”
বিভোর মাথায় নাড়ায়।ধারাকে কোলে নিয়ে রুমে আসে।ঘনিষ্ঠ হয়ে পাশাপাশি শুয়ে বললো,

— “একটা কথা বলবো ধারা?”
— “হু?”
— “রিয়েক্ট করবেনা।মন দিয়ে শুনবে।”
ধারার মুখের রং চেঞ্জ হয়ে যায়।কি এমন বলবে?তবুও বললো,
— “আচ্ছা বলো।”
বিভোর ধারার এক হাতের আঙ্গুলের সাথে আঙ্গুল জড়িয়ে বললো,
— “একবার ট্রেকিং করে দেখলে তো কি অবস্থা হয়েছে।কুমার পর্বত খুব ঝুঁকিপূর্ণ টেকিংয়ের জন্য।আমরা যদি যাই গ্রুপের সাথে যাবো।তখন চোখের সামনে অনেকে আহত হবে।গলগল করে রক্ত বের হবে।নিজেরাও আহত হবো।আমিও গুরুতর আহত হতে পারি।আর যতবার যতজন আহত হবে।যতবার ব্লাডিং হবে ততবার তুমি সেন্সলেস হবা।তখন কি হবে?আমিকি তোমাকে কোলে নিয়ে ট্রেকিং করতে পারবো?তাহলে লাভ কি?ট্রেকিং তো করা উচিৎ তোমার।তোমার জন্যই এতসব।তাইনা?”
ধারা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “আমি যাবো এভারেস্ট।”
বিভোর ধারার চুল কানে গুঁজে দিয়ে বললো,
— “শুনো পাগলি,সবসময় এতো জেদ করতে নেই।এভারেস্টে আহত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।তখন তুমি ভয়ে সেন্সলেস হলে কি চলবে বলো?”
— “প্লীজ যাবো আমি।”
— “ধারা যুক্তি দিয়ে কথা বলো।হিমোফোবিয়া নিয়ে কেমনে পসিবল এত এডভেঞ্চার জার্নি?”
ধারা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,
— “প্লীজ।”
বিভোর ধারার কপালে চুমু দিয়ে বললো,
— “তুমি যা চাইবে দেবো।প্লীজ তোমার যেতে হবেনা।”
ধারা নিজের সিদ্ধান্ত অটুট রেখে নাছোড়বান্দা গলায় দৃঢ়ভাবে বললো,
— “আমি যাবোই।তুমি না নিলে, একাই যাবো।”
বিভোরের রাগ উঠে।বিছানা থেকে নেমে দরজায় জোরে লাথি দিয়ে বেরিয়ে যায়।দরজার আওয়াজে ধারা কেঁপে উঠলো।
বিভোর ছুরি দিয়ে পেয়াজ কাটছে।ধারা ধীর পায়ে হেঁটে আসে।রান্নাঘরে উঁকি দেয়।মনে হচ্ছে বিভোর এখনো রেগে আছে।কাঁচুমাচু হয়ে বিভোরের পাশে এসে দাঁড়ায়।বিভোর পাত্তা দিলোনা।নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে।ধারা বিভোরের পিঠে চিমটি দেয়।বিভোর ভ্রুক্ষেপহীন। ধারা বললো,

— “এইযে।”
বিভোর শুনেও না শোনার ভান ধরলো।ছুরি হাতে নিয়েই ফ্রিজের দিকে এগোয়।মুরগি বের করে আবার চুলার সামনে আসে।ধারা পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।ধারাকে সরাতে গিয়ে অসাবধানবশে
হাত থেকে ছুরিটা পায়ে পড়ে।নতুন ধারালো ছুরি ছিল।তাই সাথে সাথে পা কেটে যায়।বিভোর,”আঃ!” বলে আর্তনাদ করে উঠে।ধারার উৎকন্ঠা,
— “কি হইছে?”
বিভোর টুলের উপর বসে।বিভোরের পায়ে রক্ত দেখে আৎকে উঠে ধারা।কাঁপতে থাকে থরথর করে।মাথা ভনভন করছে।অজ্ঞান হওয়া যাবেনা কিছুতেই।ধারা দ্রুত রুমে ঢুকে এইড বক্স নিয়ে আসে।বিভোর বললো,
— “দাও আমার কাছে।তুমি রুমে যাও।”

ধারা শুনলোনা।তুলা দিয়ে রক্ত মুছতে থাকে।সাথে শরীর কাঁপছে থরথর করে।ভয়ে কাঁদছেও।কিন্তু সে ভয় পেতে চাচ্ছেনা।অজ্ঞান হতে চাচ্ছেনা।বিভোরের রক্ত পড়া বন্ধ করতে হবে।মনের জোর বাড়ায় কাঁপতে কাঁপতে স্যাভলন লাগিয়ে দেয়।এরপর ব্যান্ডেজ করে।বিভোর বাধা দেয়নি।খেয়াল করে ধারা অজ্ঞান হচ্ছেনা।কাঁপছে,কাঁদছে কিন্তু অজ্ঞান হচ্ছেনা।কেনো?ব্যান্ডেজ করে শেষে ধারা ক্লান্ত হয়ে ফ্লোরে বসে।আচমকা লুটিয়ে পড়ে ফ্লোরে।বিভোর আহত পায়ে ধারাকে কোলে করে রুমে নিয়ে আসে।এরপর পরিচিত একজন ডাক্তারকে কল করে।হিমোফোবিয়া নিরাময় সম্পর্কে জানতে।এই রোগ কি কোনোরকম ট্রিটমেন্ট করে সারানো যায়।ডাক্তার চেম্বারে আছেন।বিভোর তৈরি হয়ে বেরিয়ে যায়।চেম্বারে এসে ডাক্তারের সাথে আলোচনা শুরু করে।
ডাক্তার বললেন,

— “হিমোফোবিয়া নিরাময়ে ওষুধের চাইতে দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি আর মনোবলই বেশি কাজে দেয়।রোগীকে মনে রাখতে হবে রক্ত কেবল মানবদেহের অতি প্রয়োজনীয় একটি উপাদান।একে ভয় পাবার কিছুই নেই।”
বিভোর বললো,
— “আচ্ছা আর কোনো তথ্য?”
— ” আর হিমোফোবিয়া নিরাময়ে এক্সপোজার থেরাপি বেশ ফলাফল দিয়ে থাকে। এই থেরাপিতে রোগীকে বারবার রক্তের সংস্পর্শে এনে সেটির সাথে অভ্যস্ত করানো হয়।এতে করে রোগী বুঝতে পারে রক্ত নিয়ে যে ভয় সে এতদিন পেয়ে আসছিলো তা নিতান্তই অমূলক। এভাবে তার ভয় ও আতঙ্ক কেটে যায়।”
আরো কিছু তথ্য জেনে বিভোর ফ্ল্যাটে আসে।ধারা তখনো অজ্ঞান।কিছুক্ষণ পর ধারা জেগে উঠে।
বিভোর ধারার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

— “ঠিক আছো?”
— “হু।’
বিভোর রসিকতা করে বললো,
— “শুনো,রক্ত কিনেছি।”
ধারা চোখ-মুখ খিঁচে বললো,
— “কিসের রক্ত?কেনো?”
— “মানুষের রক্ত।তুমি আমি গোসল করবো রক্ত দিয়ে।আজীবন সুন্দর থাকবো।”
রক্তের কথা শুনে ধারার শরীরের পশম কাঁটা কাঁটা হয়ে যায়।
— “যাহ কি বলছো।”
— “সত্যি।সায়ন এখনি নিয়ে আসবে।আমি অর্ডার করেছি অনলাইনে।”
— “হ।বলছে।অনলাইনে রক্ত অর্ডার করা যায়।চাপা মারো।আর সায়ন ভাইয়ার না আজ হানিমুনে যাওয়ার কথা।”
— “যাবে রাতে।এখন রক্ত নিয়ে আসছে।”
— “চাপা রাখো।আজাইরা বকবক।পায়ের রক্ত পড়া কমছে?”
— “হু কমছে।বাট চাপা না সত্যি।যদি ভয় পাও।অজ্ঞান হয়ে যাবা এমন মনে হয়।তবে এখন যা যা বলবো তাই করবে।”
— “দূর মজা নিচ্ছ।”
— “আরে শুনো।”

ধারাকে বুঝিয়ে দেয় শরীরের নিয়ন্ত্রন হারানোর পথে হলে কি কি করতে হবে।কলিং বেল বেজে উঠে।বিভোর দরজা খুলে দেয়।সায়নকে প্রশ্ন করে,
— “দেখতে রক্তের মতো তো?”
সায়ন হেসে বললো,
— “হান্ড্রেড পার্সেন্ট।”
— “দে।”
সায়ন একটা প্যাকেট বিভোরের হাতে দিয়ে চলে যায়।বিভোর সাদা বালতিতে কাগজের দ্রব্য গুলে।দেখতে একদম রক্তের মতো।সহজে কেউ ধরতে পারবেনা এটা কি।বিভোর বালতিটা নিয়ে রুমে আসে।এসেই হেসে বললো,
— “রক্ত চলে এসেছে।”
ধারা কেঁপে উঠলো।বিভোর ধারার সামনে বালতিটা ধরে বললো,

— “ভয় পাবানা।এগুলো ভয় পাওয়ার মতো কিছু না।নরমাল ভাবে নাও।”
ধারা চাদর খামচে ধরে।বালতির দিকে তাকাতেই শরীর গুলিয়ে উঠে।নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে।অনুরোধ করে বলে,
— “প্লীজ এটা সামনে থেকে সরাও।আমার ভয় করছে খুব।এ..এত রক্ত।”
বিভোর আরো এগিয়ে আসে।ধারা পিছিয়ে যায়।ডুকরে কেঁদে উঠে।বলে,
— “আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।মাথা ঘুরাচ্ছে।কষ্ট হচ্ছে।প্লীজ সরাও এটা।আমি নিতে পারছিনা।”
বিভোর বালতিটা দূরে রেখে বললো,
— “যা যা বলছিলাম করো।অজ্ঞান হওয়া যাবেনা।”

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৩৩

ধারা নিজের হাত দুটোকে পায়ের কাছে নিয়ে আসে মুষ্টিবদ্ধ করে।যেন কিছু একটা আঁকড়ে ধরে আছে। এভাবে ১০-১৫ সেকেন্ড থাকে।এরপর দম ফেলে ধীরে ধীরে। শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মানসিক চাপকে সামলে নেয়।হাতের পেশিগুলোকে শিথিল করে ফেলে।পায়ের পাতা দিয়ে ভূমির ওপর চাপ প্রয়োগ করে।একইসাথে নিজের হাটুকে হাত দিয়ে চেপে ধরে।এরপর পায়ের পেশিকে শিথিল করে। যেভাবে আছে সেভাবেই ১৫-২০ সেকেন্ড পার করে।
নিজের শরীরকে নাড়িয়ে এমন একটি ভঙ্গিমা করে যেন ধারা উঠে দাঁড়াতে চলেছে।এটা অনেকটা দরজায় কলিংবেল বাজলে হাত-পা ঝাড়া দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ানোর মতো। পুনরায় শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি কমিয়ে আনে।এভাবে শরীরের সবগুলো পেশির কসরত সমাপ্ত হয়।মানে ধারার সমস্ত শরীর এখন আশঙ্কামুক্ত।বিভোর হাসে।ধারা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে।বিভোর জড়িয়ে ধরে বললো,
— “রক্ত দেখে এভাবে অভ্যস্থ হতে হবে।মনোবল বাড়াবে।দেখবে একদিন আর রক্ত ভয় পাচ্ছনা।”

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৩৫