বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৩৭

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৩৭
ইলমা বেহরোজ

ভারতের কর্ণাটক থেকে দেশ ফেরার আজ তিনদিন।ভোর দুপুরে দিশারি আসে।ধারা তখন রাঁধছিল।দিশারির পরনে শাড়ি।কি মিষ্টি দেখাচ্ছে।এটা সত্যি ধারার চেয়েও সুন্দরী দিশারি।রান্না শেষ হয়নি বিধায় ধারা রান্নাঘরে চলে আসে।পিছু আসে দিশারি।প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,

— “রান্না শিখলি কবে?”
ধারা মৃদু হেসে মৃদু স্বরে বললো,
— “বিভোর শিখিয়েছে।”
দিশারি হাসলো।বললো,
— “সায়ন সামান্য প্লেটটাও ধুতে পারেনা জানিস।আমার উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল।ওরে কাজ শিখাচ্ছি।গতকাল কাপড় ধোয়াইছি।”
ধারা বললো,
— “আহারে বেচারা ভাইটা!এদিক দিয়ে বিভোর অন্যরকম।”
দিশারি স্থির চোখে ধারাকে আগা-গোড়া পরখ করে নিয়ে বললো,
— “মোটা হয়েছিস দেখছি।সৌন্দর্যও বেড়েছে।”
ধারা হাসলো। লাজুক হাসি।
রান্না শেষ করে দুজন আড্ডায় মশগুল হয়।সায়নের নতুন চাকরি।এরিমধ্যে এ’কদিন দেশের বাইরে হানিমুনে ছিল।গতকাল ফিরেছে দেশে।আজই সায়ন অফিসে গিয়েছে।যাবার পথে দিশারিকে বাপের বাড়ি নামিয়ে দিয়ে যায়।দিশারির মন কেমন করছিল মা বাবার জন্য।কিছুক্ষণ মা-বাবার সাথে থেকে বিভোরের ফ্ল্যাটে চলে আসে ধারার সাথে দেখা করতে।চারটার দিকে বিভোর ফিরে।দিশারিকে দেখে উচ্ছাসিত হয়ে বললো,
— “আরেএ দিশু যে!কেমন আছিস?হানিমুন কেমন কাটলো?”
দিশারি চোয়াল শক্ত করে বললো,
— “ঝগড়া করে।”
ধারা বিভোর একসাথে হেসে উঠলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ফেব্রুয়ারির পনেরো তারিখ দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্যে বাসে উঠে ধারা।লক্ষ্য প্রশিক্ষণের জন্য দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট।ধারা রাজশাহী গিয়েছিল।থেকে এসেছে ছয়দিন।সবাইকে বলেছে সে প্রশিক্ষণের জন্য দার্জিলিং যাচ্ছে।সামিত দার্জিলিং পৌঁছে দিতে চেয়েছিল।কিন্তু শাফি বলে তার নাকি ট্যুর আছে দার্জিলিং।তাই সে ধারাকে নিয়ে যাবে।সামিত আর আসেনি।এদিকে শাফি ধারাকে বিভোরের ফ্ল্যাটে দিয়ে যায়।এরপরদিনই বিভোর,ধারা প্রস্তুতি নিয়ে রওনা দেয়।বিভোরের পরিচিতি রয়েছে এখানে।ধারাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে চলে আসে দেশে।

দেড় মাসের কোর্স শেষ করে দেশে ফিরে ধারা।শুকিয়ে গেছে অনেকখানি।শুকাবেই না কেনো।খুবই কঠিন ছিল প্রত্যেকটি দিনের প্রত্যেকটি ধাপ।তবে প্রশিক্ষণের প্রত্যেকটি ধাপ শিখে নিয়েছে সে যত্ন করে।এভারেস্টের যাত্রা শুরু হওয়ার আর মাত্র পাঁচদিন বাকি।একদিন ঢাকায় ধারা এবং বিভোর একসাথে থাকে।এরপরদিন দুজনই রাজশাহী চলে আসে।যথাসময়ে যাত্রা শুরুর লগ্ন চলে আসে।বেরুবার পূর্বে আচমকা সৈয়দ লায়লা বিভোরকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। বলেন,
— “যেমনে যাচ্ছিস তেমন করেই কিন্তু ফিরে আসবি।”

বিভোর বাদলের দিকে তাকায়।চোখের ইশারায় কিছু বলে।যার অর্থ,দেখেছিস বলার পরিণতি? বলেছিলাম না বলতে।সৈয়দ লায়লা কেঁদেই চলেছেন।বুকটা ভারী হয়ে আসছে বিভোরের।সৈয়দ লায়লা বারংবার একই কথা বলছেন,
— “ফিরে আসবি কিন্তু।আমার বুকটা খালি যেন না হয়।তুই আমার প্রাণ ভ্রমরা সেটা ভালো করেই জানিস।”
বিভোর চোখ ঘুরিয়ে দেখে বাবা দেলোয়ার,ভাই বাদল,বোনের মতো ভাবি সামিয়া তিনজনের মুখ ফ্যাকাসে।চোখের কার্ণিশে জল চিকচিক করছে।বিভোরের চোখ দুটো জ্বলছে।হুট করে আচমকা মনে পড়লো,সত্যিই তো সে মৃত্যুপুরীতে যাচ্ছে!যেখানে অসাবধানে এক পা ফেলানো মানে মৃত্যু!বিভোর দ্রুত নিজেকে সামলিয়ে নেয়।মনের জোর ছাড়া এ স্বপ্ন পূরণ হওয়ার নয়।দু’হাতে মা’কে জড়িয়ে ধরে।মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।বললো,

— “তুমি না অসুস্থ আম্মা।এমন করে কেঁদোনা।জল মুছো।এভাবে বিদায় দিওনা।”
সৈয়দ লায়লা চোখের জল মুছেন।বিভোরের মাথায় হাত রেখে চোখ বুজে আয়তুল কুরসি পড়েন।এরপর ফুঁ দেন।সৈয়দ দেলোয়ার বলেন,
— “ব্যাঠা সাবধানে থাকবি।”
বিভোর হেসে বললো,
— “আচ্ছা আব্বা।আপনি নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া করবেন।চিন্তা করবেন না এতো।আম্মাকে সামলাবেন।আর ভাইয়া আপুকে দেখে রাখবি।এই সময়টাতে আপুর তোকে খুব প্রয়োজন।বকাবকি করবিনা।আপু খেয়াল রেখো নিজের।”
সামিয়া মৃদু হেসে বললো,
— “তুমিও নিজের খেয়াল রেখো ভাই।”

শেখ আজিজুর সহ তাঁর পুরো পরিবার থম মেরে বসে আছে ড্রয়িং রুমে।কেউই বিদায় দিতে পারছেনা ধারাকে।ধারার ফোনে বিভোর বার বার কল দিচ্ছে।ধারা কল কেটে সবার উদ্দেশ্যে বললো,
— “আমাকে বের হতে হবে।”
সাফায়েত ধারাকে জড়িয়ে ধরে।সে কাঁদছে।আগে জানতোনা এভারেস্টে কি কি বিপদ আছে।কয়দিন আগেই জানলো।এরপর থেকেই বুকটা কাঁপে।একটা মাত্র বোন।কিছু হয়ে গেলে।না করতেও পারলোনা।সব যে প্রস্তুত।এতো কড়া প্রশিক্ষণ নিলো শুধুমাত্র এভারেস্ট জয়ের আশায়।গতকাল রাত থেকে চোখে ঘুম নেই তার।সাফায়েত অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বললো,
— “পরী নিজের খেয়াল রাখবি।প্রতিটি পদক্ষেপ সাবধানে নিবি।তোর কোন গুরু না আছে বললি।উনার সাথে সাথে থাকবি।যা বলে শুনবি।মন শক্ত রাখবি।ভয় পাবিনা কিছুতেই।আর…আর ফিরে আসবি আবার।আবার বিয়ে ঠিক করব আর তুই পালাবি।বুঝেছিস?”

ধারা ছলছল চোখেই হেসে ফেলে।পরিবারের সবাইকে অনেক কথায় আশা-ভরসা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে।একটা নির্দিষ্ট স্থানে বিভোরের সাথে এক হয়।এরপর দুজন ঢাকার উদ্দেশ্যে পা ফেলে সামনে।
ঢাকা এয়ারপোর্ট এসে দুজনই চমকে উঠে।খবরের কাগজ ও টেলিভিশনের নানা চ্যানেলের ফটোগ্রাফার ও সাংবাদিকের ভীর।এছাড়া চেনা-অচেনা অনেক মানুষ শুভেচ্ছা জানাতে এসেছে।সাথে আছে আরো দুজন এভারেস্ট অভিযাত্রী।প্রভাস সরকার ও ফজলুল সরওয়ার।
প্লেনে থাকাকালীন বিভোর ধারার এক হাত মুঠোয় নিয়ে চুমু খেলো।এরপর নরম কন্ঠে বললো,
— “আমার একটা ইচ্ছে বলি।”

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৩৬

ধারা বিভোরের দিকে তাকায়।স্থির দৃষ্টিতে।বিভোর বললো,
— “আমাদের বাড়ির পাশে খোলা জায়গাটায় একটা টিনছাদের ঘর বানাবো।ঘরে থাকবে একটা চকি।যখন বর্ষা আসবে।পুরোটা বর্ষা তুমি আমি ওই ঘরে থাকবো।টিনছাদে বৃষ্টি পড়বে ঝমঝম করে।জগৎ-সংসার তখন একাকার হয়ে যাবে বৃষ্টি পড়ার তীব্র শব্দে।সেই শব্দ কম্বলের নিচে একজন আরেকজনকে জাপ্টে ধরে চোখ বুজে শুনবো।সময়টা উপভোগ করবো ভীষণভাবে।”
ধারা বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়।মুগ্ধ নয়নে বিভোরের দিকে তাকিয়ে আছে।

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৩৮