বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪১

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪১
ইলমা বেহরোজ

বিভোর আর জিজ্ঞাসা করেনি কেনো কাঁদলো ধারা।ধারা বলতে চাইলে এমনি বলবে।আপাতত শান্ত হওয়া দরকার।বিভোর ধারার মাথায় বিলি কাটে।ধীরে ধীরে ধারা শান্ত হয়।কিছু মুহূর্তের ব্যবধানে ঘুমে তলিয়ে যায়।বিভোরের মাথা ব্যাথায় ভনভন করছে।ধারার কপালে চুমু দিয়ে কম্ফর্টার টেনে চোখ বুজে।ঘুম ভাঙ্গে ফজলুলের ডাকে।দরজায় কড়া নাড়ছে অনেক্ষণ।বিভোর দুলে দুলে হেঁটে এসে দরজা খুললো।এরপর ঘুমকাতুরে কন্ঠে বললো,

— “গুড মর্ণিং ফজলুল ভাই।”
— “গুড মর্ণিং।অন্যদিন ছয়টায় উঠো।আজ আট টা বেজে গেলো উঠোনি।তাই ডাকতে আসলাম।”
— “থ্যাংক ইউ ভাই।ভালো করেছেন।নয়তো উঠতে আরো সময় পার হয়ে যেতো।”
— “আমার আর প্রভাসের ব্রেকফাস্ট শেষ। তোমরা খেয়ে নিও।”
— “আচ্ছা ভাই।”
ফজলুল চলে যায়।বিভোর এলোমেলো পা ফেলে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে।দুই মিনিট পর জোর করে শরীরটা বিছানা থেকে তুলে।পর্দা সরিয়ে দেয়।ঝপাৎ করে আলো এসে পড়ে ধারার চোখেমুখে।ধারা চোখ খুলে।আড়মোড়া ভেঙে বিভোরকে ডাকে।বিভোর ওয়াশরুম থেকে জবাব দেয়,
— “দ্রুত উঠুন প্রিন্সেস।আমাদের রাজ্য পরিদর্শনে বের হতে হবে।”
ধারা মিষ্টি করে হাসে।বিভোর এতো আদর করে কেনো কথা বলে!মনটা ভরে যায়।ধারা উঠে বসে জবাব দেয়,
— “একবার রানীসাহেবা একবার প্রিন্সেস!আচ্ছা কয়টা বাজে গো।”
বিভোর জবাব দেয়,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “আট টা।”
— “ওমা এত বেলা।”
নয়টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট শেষ হয়।এরপর বের হয়।চলে আসে ক্যাংজুমা।ক্যাংজুমা থেকে সামনে দেখা যায় এভারেস্ট, আমাদাব্লাম, লোৎসে। আর পিছনদিকে ক্যানটেগা, কুসুমকাঙরি।অসামান্য সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একের পর এক শৃঙ্গ।
কত কাছাকাছি এভারেস্ট!তবুও এখনো কত পথ বাকি!ক্যাংজুমা থেকে নামতে নামতে ওরা তেসিং এসে পৌঁছায়। এরপর অনেকটা নেমে এসে ঝুলন্ত ব্রিজ দিয়ে দুধকোশী পেরোয়। আরো কিছুটা উঠে আসার পর এলো এক চৌমাথা। এরপরই শুরু হয় একটানা চড়াই। ওরা পাকদণ্ডি বেয়ে ৩৮৬০ মিটার উচ্চতার ট্যাংবোচে – তে পৌঁছালো একটা নাগাদ।টানা চার ঘণ্টা এক নাগাড়ে হাঁটা হয়েছে।ট্যাংবোচের প্রবেশদ্বার পেরিয়ে একটি চোরতেন, আর একটু এগিয়ে বাঁদিকে বৌদ্ধগুম্ফা। এইখানে কিছু খেয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বাঁধ সাধলো ধুলো।ইয়াক চলেছে ধুলো উড়িয়ে। শুরু হয় ধুলোঝড়। অগত্যা খাওয়া স্থগিত। আবার হাঁটা।

রডোডেনড্রনে ঘেরা মায়াবী পথ বেয়ে নামতে নামতে আধাঘন্টা পৌঁছে যায় দেউচে। লাঞ্চ করতে উঠে রডোডেনড্রনের হোটেলে। আরো কিছুটা সময় লাগবে রান্না শেষ হতে শুনে সুসজ্জিত লাউঞ্চে যে যার মত লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। ক্লান্তিতে বিভোর ঘুমিয়ে পড়ে।ধারা সজাগ।তবে চোখ বুজে বিশ্রাম নিচ্ছে।জেম্বার ডাকে উঠে মশুর ডাল আর পাঁপড়ভাজা দিয়ে আনন্দে করে চারজনই পেট ভরে ভাত খেলো।হোটেলের রুম খুলে দিল মালকিন।রুমে ঢুকে আবার সবাই চোখ বুজে। ঘুমিয়েও পড়ে।ঘুম থেকে উঠে দেখা গেলো হাতে এখনো প্রচুর সময়। তাই এগিয়ে যাওয়ার জন্য সবাই প্রস্তুত হয়।ভরাপেটে আলসেমি করে হাঁটছে ফজলুল,প্রভাস,বিভোর,ধারা।ধারা বার বার বলছে,

— “দূর ভাত খাওয়ার পর হাঁটা যায়!”
বিভোর বললো,
— “কিছু করার নেই। হাঁটো।”
প্রভাস বললো,
— “শরীরটা তুলতুলে বিছানা চাইছে।ঘুম পাচ্ছে।”
ফজলুল প্রভাসের কথার পিছনে বললো,
— “আমারো দাদা।”
দুধকোশী সরে গেছে।রাস্তা এখন ইমজাখোলা বরাবর। লুকলা থেকে সোজা উত্তর দিকে হেঁটে ওরা পৌঁছেছে নামচেবাজার। এরপর থেকেই হাঁটছে উত্তর-পূর্ব দিক বরাবর।নামচেবাজার থেকে উত্তর-পূর্বে ট্যাংবোচে, সেখান থেকে আরো উত্তর-উত্তর – পূর্বে দেউচে, তারও উত্তর পূর্বে প্যাংবোচে।প্যাংবোচে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় পাঁচটা বেজে যায়।সারাদিন হেঁটে প্রায় সবাই পরিশ্রান্ত।ধারার ক্লান্ত চোখ’দুটি লরাকে খুঁজছে।ওরা আগেই হয়তো রওনা দিয়েছে।গ্রামের প্রায় শেষ প্রান্তের ভিউ হোটেলে এসে একটু বিশ্রাম করে।এরপর গ্রামটা দেখতে বের হয়।সন্ধ্যা নামার আরো ঘন্টাখানিক বাকি তখন।

রবিবার।৯ এপ্রিল।প্রথমে ওরা বৌদ্ধ গুম্ফায় আসে।প্যাংবোচে থেকে বেশ খানিকটা ওপরে গ্রামের মাথায় এই গুম্ফাটি।বড় বড় ফার গাছ, ফুলে ভরা রডোডেনড্রন,মাঝখান দিয়ে গুম্ফায় যাওয়ার পথ।হালকা চড়াই।এখানে পূজো করার ব্যবস্থা রয়েছে।ভিন্ন ধর্মের অভিযাত্রীরা ঘন্টা ধরে পূজো করলো।পূজো-পর্ব মিটলে সাড়ে আটটা নাগাদ হোটেলে ফিরে ব্রেকফাস্ট সেরে সাড়ে নয়টায় বেরিয়ে পড়ে আবার।ইমজাখোলা বরাবর হাঁটতে থাকে সবাই।লরার দেখা পেয়েছে ধারা।কিছুটা দূরত্ব রেখেই লরা হাঁটছে।লরাকে দেখলে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক ছিঁড়ে!চল্লিশ মিনিট পর পৌঁছালো সোমোরে গ্রামে।কিছু ঘরবাড়ি, কয়েকটা হোটেল নিয়ে ছোট গ্রাম সোমোরে। উচ্চতা ৪০১০ মিটার।

গ্রামে দাঁড়ালো না ওরা। গ্রাম ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে ছোট একটা ব্রিজ দিয়ে নালা পেরোলো।নালাটা আবার ইমজাখোলা নদীতে গিয়ে মিশেছে শেষমেশ। কিছুটা এগিয়ে রাস্তাটা দু’দিকে ভাগ হয়ে গেছে।বাঁদিকে ফেরিচের পথ ছেড়ে ডানদিকের ঢুকার পর দেখা গেলো আমাদাব্লাম ওদের একদম ডানদিকে।আস্তে আস্তে কেমন বদলে যাচ্ছে তাঁর রূপ।যত এগোনো হচ্ছে, আমাদাব্লাম ধরা দিচ্ছে নিত্য নতুন রঙে, মনভুলানো রূপে।উত্তর-পূর্ব দিক বরাবর হাঁটতে হাঁটতে আড়াই ঘন্টা পথ পাড়ি দিয়ে ওরা পৌঁছালো ডিংবোচে।উচ্চতা ৪২৪৩ মিটার। এখানকার ইমজা ভ্যালি হোটেলে দলটি উঠলো।আকাশে তখন ঝলমলে রোদ।বাইরে বেশ খানিকটা জায়গা পাথর দিয়ে পাঁচিলের মতো করে ঘেরা। সেখানেই বসার ব্যবস্থা,হাত মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা। রোদ্দুরে বসে পড়ে সদলবলে।তারপর লাঞ্চ।এরপর আবার সেই আদুরে রোদে গা এলিয়ে বসে আড্ডা।একসময় মেঘ এসে ঢেকে দিল রোদ।শুরু হলো হালকা ঝিরঝিরে তুষারপাত। যে যার মতো রুমে এসে গা ঢাকা দেয়।বিকেলে যথারীতি বিভোর, ধারা, ফজলুল বের হয়।প্রভাস বেরোবে না।সে ঘুমাচ্ছে।লরা বের হয় তখন।ধারা হাত নাড়িয়ে হাই দেয়।লরা এগিয়ে আসে।পিছন পিছন আরেকজন বিদেশি যুবককে আসতে দেখা যায়।যুবক নিজ ইচ্ছায় এসে বললো,

— “তোমরা কি বের হচ্ছো? আমিকি সাথে আসতে পারি? ”
বিভোর হেসে বললো,
— “শিওর।”
কথায় কথায় জানা গেলো যুবকটি একজন ট্রেকার।সে এভারেস্ট যাচ্ছেনা।ব্যাসক্যাম্প অবধি যাচ্ছে।নাম আমান্ডা।কানাডা থেকে এসেছে।পাঁচজন একটা রেস্তরাঁয় আসলো।চা হাতে নিয়ে চলে কিছু সময় আড্ডা।রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে নদীর পাশে হাঁটে।ছোট-খাটো পর্বত চারদিকে।মেঘলা আকাশ।মাঝে মাঝে হচ্ছে তুষারপাত। লরার সাথে কথা বলে ধারা জানতে পারে, লরা ওর চেয়ে দশ বছর সিনিয়র!অথচ, সে ভেবেছে তার চেয়ে ছোট হলেও হতে পারে।ধারা বিভোরের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়।বিভোর তাকায়। ধারা কাঁচুমাচু হয়ে বললো,

— “আমিকি বুড়ি হয়ে গেছি?”
বিভোর খ্যাঁক করে উঠলো।তারপর বললো,
— “তা হতে যাবা কেনো?”
— “আমার বয়স চব্বিশে চলে যাবে কয়দিন পর।কাউকে যদি বলি আমার বয়স অনুমান করতে তখন একুশ-বাইশ বলে।মানে আমাকে দেখে দু’বছর কম বয়সী মনে হয়।আর অন্যদের বয়স তেত্রিশ, চৌত্রিশ। তবুও দেখে মনে হয় আঠারো বয়সী।”
ধারার কথা শুনে বিভোরের খুব হাসি পায়।কিন্তু ধারাকে সিরিয়াস মনে হচ্ছে।হাসলে নির্ঘাত ফাঁসি!
বিভোর স্বান্তনা দিয়ে বললো,
— “বিদেশিরা এমনই।বাদ দাও।আমিও বুড়া তুমিও বুড়ি।মিলে গেছে।”
কথা শেষ করে বিভোর জিব কাটে।ধারা চোয়াল শক্ত করে বললো,
— “আমাকে বুড়ি বললা?”

বিভোর কিছু বলার পূর্বেই ধারা জায়গা থেকে দ্রুত গতিতে সরে যায়।ধারাকে অনুসরণ করে বিভোর তাকায়।দেখে, লরা পা ফসকে পড়ে যাচ্ছিলো ধারা দ্রুত লরার জ্যাকেট টেনে ধরে।এরপর ফজলুল,আমান্ডার সহযোগিতায় উপরে তুলে আনে।ওরা একটা পর্বতের চূড়া ধরে হাঁটছিলো।নিচে ইমজাখোলা নদী।আরেকটু হলে লরা নদীতে হারিয়ে যেতো। জানতে পারে লরা সাঁতার জানেনা!কি ভয়াবহ বিপদ গেলো।বিভোর ধারার কাজে ভীষণ খুশি হয়।ধারার পাশ কেটে হাঁটার সময় ইচ্ছে করে পড়ে যাওয়ার ভান ধরে।ধারার বুক সেকেন্ডে কেঁপে উঠলো।দ্রুত বিভোরের হাত চেপে ধরে।বিভোর হাসলো।ভ্রু-জোড়া এদিক-ওদিক নাড়িয়ে বললো,

— “হিরোইন থাকতে হিরো পানিতে পড়ে যাবে!এ তো অসম্ভব দেখছি।”
ধারা ভ্রু কুঁচকে ফেলে।বিভোরের হাত ছেড়ে দেয়।বিভোর টাল সামলাতে না পেরে সত্যি সত্যি পড়ে যাচ্ছিলো।দ্রুত সামলে নেয় নিজেকে।এরপর বলে,
— “আরেএ ছাড়লে কেনো।পড়ে যেতাম তো।”
ধারা নবাবি চালে বলে,
— “যেতে!আই ডোন্ট কেয়ার।”

কথা শেষ করে ধারা সামনে এগোয়।বিভোর হা করে তাকায়।ধারা পিছন ঘুরে তাকিয়ে হাসে।বিভোরও হাসে।দৌড়ে ধারার পাশে আসে।সূর্যাস্তের আগেই হোটেলে ফিরে পাঁচজন।ফিরে আবার চা।প্রতি কাপ পঞ্চাশ টাকা!আটটার মধ্যে ডিনার সেরে ফেলে।
আগামীকাল ওদের থোকলা যেতে হবে।অন্যসব ট্রেকাররা প্যাংবোচে থেকে সোমোরে দিয়ে ফেরিচে হয়ে থোকলা যায়।থোকলা থেকে পৌঁছায় এভারেস্ট বেসক্যাম্পে।কেউ ডিংবোচে আসেনা।বিভোরদের দলসহ দুটি দল ডিংবোচে এসেছে।কারণ,তিনটি দলের কিছু মালপত্র এখনো আসেনি।এসব মালপত্র গিয়ে ওখানে পৌঁছাবে, গোছগাছ হবে,বেসক্যাম্প স্থাপন করতে সময় লাগবে।তাই দেরি করে পৌঁছানোই ভালো।ঘুরাও হয়ে গেলো।তা ছাড়া আবহাওয়া সঙ্গে, তাপমাত্রার সঙ্গে আরেকটু বেশি অভ্যস্ত হওয়ার সুবিধা পাওয়া গেলো।

দশ এপ্রিল।সকাল নয়টায় হাঁটা শুরু হলো।সাড়ে ছয়টায় বেড টি।আট টায় প্যানকেক-চাপাটি-টিবেটিয়ান, ব্রেড ডিমসেদ্ধ দিয়ে ব্রেকফাস্ট। পথ প্রথমে পশ্চিম দিক বরাবর।সেই পথ ধরে অনেকটা হেঁটে ডিংবোচের মাথায় উঠে আসে।মাঝে মাঝে চোরতেন।আড়াই ঘন্টা হেঁটে পৌঁছালো থোকলা।ঢোকার ঠিক আগে শ্রান্ত পথিকদের অভিবাদন জানালো একটা ঝোরা,খুম্বু খোলা। এটা খুম্বু হিমবাহ থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখানে একটাই বড় হোটেল আছে। নাম ‘থোকলা থোকলা ‘।কম হাঁটা হয়েছে।তবুও সবাই সিদ্ধান্ত নেয় আজ এখানেই থাকবে।বারোটার মধ্যে লাঞ্চ সেরে বাইরে এসে দেখে এখানে পৌঁছেছে অজস্র ট্রেকার।কেউ ওপর থেকে নামার পথে এখানে এসেছে, কেউ নিচ থেকে উঠার পথে খাওয়া সেরে নিচ্ছে। আবার কেউ থেকে যাচ্ছে।সব মিলিয়ে বেশ জমজমাট হোটেল থোকলা থোকলা।বিকেলে এলো গরজ।বিভোরদের রাঁধুনি।গরজ আজ ভোরবেলা স্যাংবোচে থেকে ইয়াক নিয়ে বেরিয়েছে। একটানা এসে ইয়াকগুলোকে ফিরেচে-তে য ছেড়ে দিয়ে এটুকুই হেঁটে চলে এসেছে। কাল আবারো ইয়াক নিয়ে সোজা বেস ক্যাম্পে পৌঁছে যাবে।পাসাং শেরপা আজই বেসক্যাম্পে পৌঁছে গেছে।

এরপরদিন।আজকের পথ সামান্য। থোকলা থেকে লোবুচে।৪৬২০ মিটার থেকে ৪৯১০ মিটার উচ্চতায় পৌঁছানো।প্রথমে টানা চড়াই।সেই পথে ইতিমধ্যে কয়েকজন যাওয়া আসা শুরু করেছে।পাথর বালি ছড়ানো মাটির পথ।তার উপর গতকাল রাতে অনেক বরফ পড়েছে।তাই খুব সাবধানে চলতে হচ্ছে।এরপর রোদ বেড়ে গেলে বরফ গলা শুরু হবে।পথ পিছল হবে। টানা ৪৫ মিনিট প্রাণান্তকর চড়াই ভেঙ্গে ওরা উঠে এলো একটা ময়দানে। চারপাশে অনেক চোরতেন প্রচুর স্মৃতিফলক।ধারা কিছু একটা দেখিয়ে বললো,
— “প্রেয়ার ফ্ল্যাগ টাঙানো না?”
বিভোর বললো,
— “হু।”

এই স্মৃতিফলক গুলি সবই মৃত এভারেস্ট অভিযাত্রীদের স্মরণে নির্মিত। এগুলো দেখে সবার মন খারাপ হয়ে গেল। এই মৃত মানুষ গুলো শেষ দিনগুলি সঙ্গে ওদের আজকের দিনের কোন পার্থক্য নেই।এরা যে উদ্দেশ্য নিয়ে, যে স্বপ্ন নিয়ে এখানে এসেছিল, সেই একই লক্ষ্য নিয়ে একই শৃঙ্গ জয়ের স্বপ্ন চোখে নিয়ে ওরা এগিয়ে চলছে।সবাই চুপ হয়ে যায়।বিভোরের বুকটা হাহাকার করে উঠে।মা’কে আবার ফিরে গিয়ে দেখার সুযোগ হবে?হবে একটা কয়েক বছরের সংসার ধারাকে নিয়ে? বিভোর ধারার দিকে তাকায়।ধারাও তাকায়।ধারার চোখে জল।মৃত্যু পিছন ঘুরছে মনে হচ্ছে।ভয় লাগছে খুব।বিভোর ধারার কপালে চুমু দিয়ে বলে,
— “কিছু হবেনা।মনকে শক্ত করো।”
সমস্ত স্মৃতিফলকগুলির মধ্যে একটি সবচেয়ে বড়।বিভোর এর আগে এখানে আসেনি ধারা জানে।তবুও স্বভাবগত প্রশ্ন করে,
— “বড় স্মৃতিফলকটি কার?”
বিভোরের আগে জেম্বা বললো,

— “বাবুছিরি শেরপার।উনি ১৬ ঘন্টা ৫৬ মিনিটের মধ্যে এভারেস্ট শৃঙ্গে পৌঁছে আবার নেমে এসেছিলেন।তখন এটাই ছিল দ্রুততম আরোহণের রেকর্ড।মৃত্যুর আগে দশবার এভারেস্ট জয় করেছেন। একবার একটানা ২১ ঘন্টা এভারেস্ট চূড়ায় থেকেছিলেন।আর উনার মৃত্যুও হয় এভারেস্টেই।ছবি তুলার সময় পিছোতে পিছোতে অজান্তেই পড়ে যান ক্রিভাসে।”
ধারা কিছু বললোনা।বাবুছিরি শেরপার স্মৃতিফলকের পাশে এসে বসে সে।তারপর আবার হাঁটা।এবার পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হালকা চড়াই।কালকের তুষারপাত পুরো রাস্তাটাকে ঢেকে দিয়েছে বরফে।সামনের তিনদিকই বিভিন্ন শৃঙ্গ আর গিরিশিরা দিয়ে ঘেরা। মাত্র সাড়ে এগারোটা বাজে।আজই গোরখশেপ চলে যাওয়া যেত।এখান থেকে মাত্র দু’ঘন্টার পথ।এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে পাসাংরা এখনো ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে উঠতে পারেনি।এখন চলে গেলে ওদেরও সমস্যা বিভোরদের ও।তাই সিদ্ধান্ত হয়।আজ লোবুচেতেই থেকে যাওয়ার।

হোটেলে রুম নিলো।এই হোটেলে মাছ পেয়ে আহ্লাদে আটখানা সবাই।বাঙালির স্বাদ তো মাছে-ভাতেই।রাতটা কাটে খুব ভালো।ভূতের মুভি দেখে।ধারা ভূত খুব ভয় পায়।মাকড়সার মতো বিভোরের বুক খামচে ধরে এক চোখ বন্ধ রেখে মুভি দেখেছে।ধারার কান্ড দেখে বিভোরের সেকি হাসি!

সকাল আট টা থেকে হাঁটা শুরু হয়। পর্বত-পরিবৃত হয়ে পাকদন্ডি বেয়ে চলতে থাকে সবাই।চারপাশে নাম জানা, না জানা অসংখ্য শৃঙ্গ নয়ন ভোলানো রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে।সমস্ত শৃঙ্গ-এর মধ্যে সবচেয়ে ডানিদিকে আছে সুন্দরী নুপৎসে।এখানে হরেক রকমের পাখি চোখে পড়ছে।এগারোটা নাগাদ পৌঁছালো গোরখশেপ।লাঞ্চ সেরে বারোটায় আবার হাঁটা শুরু।গোরখশেপে পাশাপাশি দুটি হোটেল।সেই হোটেল ছেড়ে নামতেই সুন্দর ময়দান।রাস্তা চলে গেছে সোজা বেসক্যাম্পের দিকে।গোরখশেপের হোটেলগুলোর ছাড়িয়ে একটা ময়দান মতন জায়গা। সেখান থেকে বাঁদিকে যে পথ চলে গেছে সেটা পৌঁছেছে কালাপাথুর।বেস ক্যাম্প থেকে এভারেস্ট দেখা যায়না।এই কালাপাথর থেকে এভারেস্ট দেখা যায় স্পষ্ট। এভারেস্টের যত ছবি তোলা হয় সব এই কালাপাথর জায়গাটি থেকে।সামনে এগুতে এগুতে এভারেস্ট চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।শরীরে বয়ে যাচ্ছে অদ্ভুত অনুভূতি।সবার মনেই একই আশংকা, ছুঁতে কি পারব এভারেস্টের চূড়া!

ঘন্টাখানেক হেঁটে চলার পর দূরে খুম্বু গ্লেসিয়ারের দিকে তাকালেই চোখে পড়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে প্রচুর তাঁবু।আরো আধাঘন্টা হাঁটার পর ওরা আসে খুম্বু গ্লেসিয়ারের ওপর।দেখা মিলে, পাথরের উপর পাথর সাজিয়ে তাতে অনেক প্রেয়ার ফ্ল্যাগ এবং বিভিন্ন দেশের পতাকা জড়িয়ে রাখা।তার ওপরে একটা বোর্ডে লিখা, এভারেস্ট বেসক্যাম্প।অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাতা আছে রং-বেরংয়ের অজস্র তাঁবু।এভারেস্ট অভিযাত্রীদের তাঁবু!
ধারা বিভোরের এক হাত শক্ত করে চেপে ধরে।বেস ক্যাম্পের দিকে তাকিয়ে ঘোর নিয়ে বললো,

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪০

— “মৃত্যু এবং স্বপ্ন পূরণের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি আমরা।”
বিভোর বাহুডরে ধারাকে টেনে নিয়ে বলে,
— “মৃত্যু তাড়া করবেই।আমাদের দৌড়াতে হবে।এজন্য দরকার শারিরীক এবং মানসিক শক্তি।”
— “আমার রগে রগে শিরশির অনুভূতি হচ্ছে।উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে আসছে।”
— “শান্ত হও পাগলি।”

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪২