বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪০

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪০
ইলমা বেহরোজ

যে যার পছন্দমতো হোটেলে এগ- চাওমিন, মিট – চাওমিন খেলো। প্রতি প্লেট ২৫০ টাকা। এরপর হোটেলে ফিরে ঘন্টা তিনেক ঘুমিয়ে,সন্ধ্যার পূর্বমুহূর্তে বাজার ঘুরে দেখতে সবাই একজোট হয়ে বের হয়।বাজারে যে যার মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।বাজারে বেশি বিক্রি হচ্ছে পর্বতারোহণের সরঞ্জাম।ট্রেকিং বা রক ক্লাইম্বিং এর জন্য যা কিছু দরকার তার সবই পাওয়া যাচ্ছে এখানে। দামও কাঠমুন্ডু থেকে বেশ কম। সব জায়গায় সেল চলছে,পঞ্চাশ পার্সেন্ট – ষাট পার্সেন্ট ডিসকাউন্টে বিক্রি হচ্ছে প্রায় সবকিছু।বিভোর এটা ওটা দর-দাম করে বেড়াচ্ছে।ধারা বললো,

— “একবার বরং বাসায় কল করি। সবাইকে জানাই আমরা কোথায় আছি।”
বিভোর বললো,
— “হুম করো।আমিও করি।”
পরিবারের সাথে কথা শেষ করে আবার ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে বাজার।এখানে ফোন চার্জ ১০০ টাকা প্রতি মিনিটে। আর ইন্টারনেট ১০ টাকা প্রতি মিনিট।চারপাশে বড় বড় হোটেল। সেখানে বিদেশিদের জন্য নানারকম প্রমোদের ব্যবস্থা।সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পার হতেই বাইরে হালকা হাওয়া শুরু হয়। সঙ্গে বাড়তে থাকে ঠান্ডা।তাই দ্রুত হোটেলে ফিরে সবাই।ন’টার মধ্যে ডিনার শেষ করে সবাই রুমে চলে আসে।এরিমধ্যে রুমে জেম্বা আসে।বিভোর হেসে জড়িয়ে ধরে জেম্বাকে।জেম্বা বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “কাল আমরা স্যাংবোচে যাব বেশি উচ্চতায় চলাচল করে ধাতস্থ হওয়ার জন্য।”
বিভোর বললো,
— “ঠিক আছে।”
— “ব্রেকফাস্ট দ্রুত সারবে।”
— “আচ্ছা।ফজলুল ভাইয়া আর প্রভাস দা’কে বলা হয়েছে?নাকি আমি বলবো?’
— “বলে দিয়েছি।আসি।”
স্যাংবোচেতে একটা ছোট্ট এয়ারস্ট্রিপ আছে। সেখানেই ওদের সব মালপত্র আসার কথা।আরো দু-তিন দিন হয়তো এই নামচেবাজারে তাদের থেকে যেতে হবে। কারণ সব মালপত্র এখনো এসে পৌঁছায়নি।

ব্রেকফাস্ট সেরে আটটা নাগাদ ওরা বের হলো।হাতে ওয়াকিং স্টিক, পিঠে ন্যাসপ্যাক তাতে অল্প কিছু খাবার আর জল।বেশ চওড়া, খারা পথ।কিছু দূরে গিয়ে ডানদিকে বেরিয়ে গেছে এভারেস্ট বেসক্যাম্পের পথ।কিন্তু ওরা এগোচ্ছে খাড়া উপরে।উঠতে উঠতে সবাই খেয়াল করে মাথার উপরে ছোট্ট প্লেন উড়ছে।জেম্বা বললো,
— “উপরে আছে এয়ারস্ট্রিপ।সেখানেই মালপত্র আসবে।”

কিছুক্ষণ পর নয়টা নাগাদ ওরা পৌঁছে এয়ারস্ট্রিপে। গিয়ে দেখে, কিছুক্ষণ আগে যে প্লেনটা দেখেছিল সেটা এখন মাল নামাচ্ছে।মালপত্র দেখতে জেম্বা ওদিকে ছুটল।মালপত্র নামানো শেষে ফের উড়ে গেল প্লেনটি।যাত্রী নয় শুধু মালবহন করাই এই প্লেনের কাজ।বিভোরদের অর্ধেক মাল এসেছে।মালপত্র এক জায়গা রেখে আরেকটু উপরে উঠলো ওরা।জেম্বা বললো,
— “উপরে একটা খুব সুন্দর হোটেল আছে। এভারেস্ট ভিউ হোটেল। ওখান থেকে মাউন্ট এভারেস্ট খুব সুন্দর স্পষ্ট দেখা যায়।”
বড় বড় জুনিপারের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হালকা ঢালের পথ। একটু উপরে উঠে রাস্তা প্রায় সমতল। উঠার পথে ধারা বার কয়েক পিছলে খেয়েছে।সবসময়ের মতো বিভোর আগলে রেখেছে। এভারেস্ট ভিউ হোটেলটি বেশ সুন্দর করে সাজানো।এখানে সবই সুন্দর।যেদিকে চোখ যায় সৌন্দর্যের খেলা শুধু।হোটেল ছাড়িয়ে আরো কিছুদূর এগোনোর পর দেখা গেল রডোডেনড্রনের জঙ্গল।রডোডেনড্রনের জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে দেখা মিলে দুটি গ্রামের।গ্রাম দুটির নান খুমজুম আর খুনেদ।

দুইটা ত্রিশে হোটেল ফেরা হয়।ফিরেই লাঞ্চ সেরে নেয় ওরা।জলের অভাব রয়েছে এখানে।গোসলের ব্যবস্থা নেই। বলতে গেলে গোসল মোটামুটি বারণ।অগত্যা ভেজা তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।ধারা কম্ফর্টারের ভেতরে শুয়ে আছে।বিভোর পাশে বসে ল্যাপটপে কিছু করছে।ধারা প্রশ্ন করলো,
— “ল্যাপটপ এনেছো কেনো?”
— “সময় কাটানোর জন্য।”
— “সময় কাটানোর জন্য কি আমি নেই?”
বিভোর তাকায়।অদ্ভুত মুগ্ধকর সেই দৃষ্টি।বললো,
— “তোমাকে দিয়ে সময় কাটাবো?”
ধারা থতমত খেয়ে যায়।দৃষ্টি অস্থির হয়ে পড়ে।বলে,
— “না থাক।ল্যাপটপে যা করছো করো।আমি ঘুমাই।”

ধারা মুখ লুকোয়।বিভোর মৃদু হাসলো।চব্বিশ ঘন্টা হাঁটা লাগবেনা।তাই প্রায় সব অভিযাত্রী সময় কাটানোর জন্য এটা,ওটা নিয়ে আসে।বেসক্যাম্পেও একটানা অনেকদিন থাকতে হবে।অবশ্য বেসক্যাম্পে দলের বারবিকিউ পার্টি হয়।সময়টা ভালোই কাটে।সব ভয়-ভীতি-উত্তেজনা তো এভারেস্ট নিয়ে।
এরপরদিনের সকাল-দুপুর মিউজিয়াম, সাগরমাতা জাতীয় উদ্যান ঘুরাঘুরি করে কাটলো।জেম্বা স্যাংবোচে যায় মালপত্রের খুঁজে।কিছু এসেছে।আর কিছু রয়েছে।সাগরমাতা জাতীয় উদ্যান পৃথিবীর সর্বোচ্চ জাতীয় উদ্যান। এটি রয়েছে ৩০০০ মিটারেরও অধিক উচ্চতায়।এর মধ্যে অবস্থান করছে এভারেস্টসহ তিনটি আট হাজারি শৃঙ্গ।এর এক অংশ জঙ্গল যেখানে বিলুপ্তপ্রায় সব প্রাণী রয়েছে।
বিকেলে।শুক্রবার এখানে অনেক বড় হাট বসে।আজ সেই শুভ শুক্রবার।বিভোর ধারাকে নিয়ে হাট ঘুরতে আসে।কি নেই সেই হাটে!সবজি,মাছ,মাংস,কাঁচামাল, মুদির জিনিসপত্র সব রয়েছে।ধারা হাঁটতে হাঁটতে বললো,

— “এসব দেখে আমার ইচ্ছে জাগলো একটা।”
— “কি ইচ্ছে?”
— “শ্বশুর শাশুড়ী নিয়ে যখন আমার সংসার হবে। তখন তুমি বাজার করতে যাবা ভোরবেলা।দু’হাতে চারটে ব্যাগ নিয়ে ঘেমেনেয়ে বাড়ি ফিরবা।আমি আমার শাড়ির আঁচল দিয়ে তোমার কপালের ঘাম মুছে দেব।এরপর বাজারের ব্যাগ থেকে সবকিছু বের করে রান্না করবো।কি সুন্দর না?”
বিভোর হেসে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো।সন্ধ্যার দিকে ফজলুল,প্রভাস,বিভোর আড্ডায় বসলো।আড্ডার টপিক ম্যালোরি, হিলারি ও তেনজিং।যাদের নাম এভারেস্টের পাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলে।ধারা ঘুমিয়েছে সেই সন্ধ্যায়।বিভোর দশটার দিকে ল্যাপটপ বন্ধ করে ঘুমাবার প্রস্তুতি নেয়।চোখটা যখন লেগে আসে তখনি ধারার ডাক।বিভোর ঘুমকাতুরে কন্ঠে বললো,

— “কি হইছে?”
ধারা বললো,
— “ঘুম পাচ্ছেনা আমার।”
বিভোর ধারার চুলে মুখ গুঁজে বললো,
— “সন্ধ্যা থেকে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছো।ঘুম পাবে কেমনে।আমাকে ঘুমাতে দাও।”
— “দেবনা ঘুমাতে।”
বিভোরের সাড়া নেই।ঘুমিয়ে পড়েছে।ধারা কাতুকুতু দিতেই বিভোর ছিটকে দূরে সরে যায়।ধারা খিলখিল করে হেসে উঠে।বিভোর কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,
— “প্লীজ ঘুমাই।”
কথা শেষ করেই চোখ বুজে।ধারার বেশ লাগছে বিভোরকে জ্বালাতে।আবার কাতুকুতু দেয়।বিভোর উঠে বসে।ধারাও সামনে বসে।চোখ টিপে হাসে।এরপর বলে,
— “আমি জেগে আছি তুমিও জেগে থাকবা।”
বিভোর চোখ বুজে কি ভাবে।এরপর ধারাকে নিয়ে শুয়ে পড়ে।ধারার বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বলে,
— “খুব ঘুম পেয়েছে।প্লীজ ঘুমাই।”

বিভোরের ঘুম ঘুম কন্ঠটা ধারার দারুণ লাগছে।কিন্তু আর জ্বালাতে মন মানছেনা।বেচারা ঘুমাক।ধারা বিভোরের চুলে বিলি কেটে দেয়।বিভোর তখন ঘুমে বিভোর।পার হয়ে যায় ঘন্টাখানেক। ধারার কিছুতেই ঘুম আসছেনা।কানে আসছে কান্নার আওয়াজ।মেয়েটি আবার কাঁদছে!কি বেদনাদায়ক সেই কান্না।ধারাকে কাঁপিয়ে তুলে।ধারা বিভোরের মাথাটা সাবধানে বালিশে রাখে।জ্যাকেট পরে সেই মেয়েটার রুমের সামনে আসে।ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ।ধারার খুব করে ইচ্ছে হচ্ছে মেয়েটার সম্পর্কে জানতে।সাহস নিয়ে ধারা দরজায় টোকা দেয়।ওপাশের কান্না থেমে যায়।কয়েক সেকেন্ড পার হয়।দরজা খোলার আওয়াজ আসছে।দরজা খুলছে।নীল চোখের মেয়েটি ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে।ধারা ভয় পেয়ে যায়।ধারাকে দেখে মেয়েটি ছুরি নামিয়ে নেয়।কৌতূহল দৃষ্টি নিয়ে তাকায়।ধারা কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা।আমতাআমতা করে ইংলিশে বললো,

— “তুমি কাঁদছিলে…আচ্ছা…আচ্ছা আসি আমি।”
ধারা ঘুরে দাঁড়ায়। আবার ফিরে তাকায়।প্রশ্ন করে,
— “তোমার নাম কি? ”
মেয়েটি প্রাণহীন কন্ঠে শীতল গলায় বললো,
— “লরা গুহার।”
— “ওহ।ঠিকাছে।ঠিকাছে।”
কথা শেষ করে দ্রুত রুমে ফেরার জন্য পা বাড়ায় ধারা।তখন লরা হাতে ধরে আটকায়।স্পষ্ট ইংলিশ ভাষায় বললো,
— “তুমি বোধহয় অন্য কিছু জানতে এসেছিলে?”
ধারা সাহস পায়।মাথা নাড়ায়।লরা হাত ছেড়ে বললো,
— “ভেতরে আসো।”
ধারা রুমে ঢুকতেই লরা দরজা বন্ধ করে দেয়।ধারা লরাকে আগাগোড়া দেখে।অসম্ভব সুন্দর।তবে চোখের নিচে কালি জমেছে।ফর্সা মুখটায় তা বড্ড বেমানান লাগছে।লরা ধারার সোজাসুজি বসে।ধারা কিছু বলার পূর্বেই লরা বললো,
— “আমার কান্নার কারণ জানতে এসেছো?”

ধারা অবাক হয়না।শুধু মাথা নাড়ায়।উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে সে লরার দিকে।লরা একটা ছবি বের করে ধারার সামনে ধরে।সুদর্শন এক যুবকের ছবি।ধারা লরার চোখের দিকে তাকায়।লরার চোখ দুটি ভিজে আসছে।ধরা গলায় লরা বলে,
— “আমার ক্রিস।আমাদের বিয়ের কথা ছিল।ক্রিসের স্বপ্ন ছিল এভারেস্ট জয় করা।ফিরেই আমাকে বিয়ে করবে কথা দিয়েছিল।আমি এক বছর অপেক্ষা করেছি।ফিরেনি ও।ওই..ওই এভারেস্ট রেখে দিয়েছে আমার ক্রিসকে।”
লরা দম নেয়।ধারা হতবিহ্বল।লরা আবার বলে,

— “আমি খুঁজতে এসেছি ক্রিসকে।এভারেস্টেই ও আছে।বরফের তলদেশে।কিন্তু আছে ও এভারেস্টেই।”
লরা বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করে।কি যন্ত্রণা সেই কান্নায়।কি কষ্ট!ধারার বুকটায় চিনচিন ব্যাথা হচ্ছে। কেনো হচ্ছে?লরাকে স্বান্তনা দেওয়ার কথা তাঁর।অথচ সেই কাঁদছে।কিছু না বলে লরার রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে সে।রুমে এসে বিভোরের বুকে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ে।বুকটা কাঁপছে।উঠানামা করছে দ্রুতগতিতে।শরীরটা কাঁপছে।ঘুমন্ত বিভোরকে দু’হাতে খামচে ধরে।অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দেয় চোখ-মুখ।বিভোর চোখ খুলে তাকায়।ধারার ভাব-ভঙ্গি অস্বাভাবিক ঠেকছে।সে ধারার মুখ ছুঁয়ে প্রশ্ন করে,

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৩৯

— “ধারা।কি হয়েছে?”
ধারা চোখ তুলে তাকায়।চোখ দু’টি টকটকে লাল।বিভোরের ঘুম ছুটে যায়।ধারার উপর ঝুঁকে বললো,
— “কাঁদছো কেনো?কি হয়েছে?”
বিভোরের কোমল ছোঁয়া পেয়ে ধারা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বিভোরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।বিভোর হতবাক!ধারা ফোঁপাচ্ছে।বিভোর বার বার প্রশ্ন করছে, কি হয়েছে।ধারা কিছু বলছেনা শুধু কাঁদছে।একসময় কান্না ভেজা কন্ঠে ধারা বললো,
— “আমি তোমাকে খুব ভালবাসি।খুব।”

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪১