বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৩৯

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৩৯
ইলমা বেহরোজ

বিকেল নাগাদ হাঁটতে বের হয় দুজন।দুধকোশী নদীর ডান দিকে ছোট গ্রাম জোরসাল।দু-একটা হোটেল,খাওয়ার জায়গা, একটু এগিয়ে আর্মি চেকপোস্ট, দুধকোশী উপর একটা দড়ির ব্রিজ….আর পাঁচটা গ্রামের মতোই দেখতে।চোখে পড়ে আরো কয়টি দল।হাঁটতে হাঁটতে ধারা প্রশ্ন করলো,
— “গ্রামের সবাই খুব গরীব তাইনা?”

বিভোর মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁসূচক বুঝায়। শুধু এই গ্রাম নয় গোটা এলাকাটাই বড় গরীব। সাধারন মানুষ কেউ চাষাবাস করে,কেউ মাল বাহকের কাজ করে সংসার চালায়।প্রচুর পোর্টার দেখা যায় রাস্তায়।তাঁদের পিঠে বোঝা।হাতে T আকৃতির লাঠি।মাঝে মাঝে ওই লাঠিতে হেলান দিয়ে একটু জিরিয়ে নেয়।তারপর আবার চলে।পোর্টাররা হোটেলে খাবার পৌঁছে দেয় বা কোনো ট্রেকিং দলের লাগেজ বহন করে।মেয়েরা জমি চাষ করে।ইয়াক চরায়।তবে এদের ছাড়াও আরো একশ্রেণীর মানুষ আছে যারা হোটেলের মালিক ও কর্মচারী।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে ফেরা হয়। ব্যালকনিতে বসে প্রভাস, ফজলুল,বিভোর, ধারার কিছুক্ষণ আড্ডা চলল।অন্ধকার যত বাড়তে থাকে ঠান্ডা তত বাড়ে।অগত্যা যে যার রুমে এসে লেপের নিচে ঢুকে।কালকের গন্তব্য নামচেবাজার। অনেক চড়াই ভাঙতে হবে। ২৭৪০ মিটার উচ্চতার জোরসাল থেকে ৩৪৪০ মিটার উচ্চতার নামেচেবাজার। অভিযানের দ্বিতীয় দিনে ট্রেকে সেটা চাট্টিখানি কথা নয়। ধারা বিভোরের বুকে মুখ গুঁজেই ঘুমে তলিয়ে গেছে।বিভোরের ঘুম আসছেনা।

এরপরদিন।ভোর পাঁচটার দিকে ট্রেকাররা বেরিয়ে পড়েছে পথে।তাঁদের বেরোতে বেরোতে প্রায় সাড়ে সাতটা।একটু এগোনোর পর আর্মি চেকপোস্ট। পারমিট দেখতে চাইছে।পারমিট দেখানো হলো।এরপর দড়ির ব্রিজ। এতক্ষণ গ্রামটা ছিল দুধকোশী নদীর ডান পাশে। দড়ির সেঁতু বেয়ে এবার ওরা বাঁ পাশে এলো।নদীর ধার দিয়ে দিয়েই চলা। আধঘন্টা পর আবার ব্রিজ,আবার নদী পেরোনো।যতবার ব্রিজ আসে ততবার ধারা বিভোরকে বলে,
— “এবার বোধহয় পা ফসকে পড়েই যাব।এত নড়ে কেন সেঁতু।আমার সেঁতু খুব ভয় লাগে।”
কিন্তু পড়েনি একবারো।বিভোর পিছন থেকে নিরাপত্তা দিয়েছে।বিভোরের আবার দড়ির সেঁতু বেশ লাগে।মনে হয় সে দোলনাতে আছে।

এরপর ঠোটেকোশী নদী পেরিয়ে খারা চড়াই। এই ঠোটেকোশী বাঁদিক থেকে এসে পড়েছে দুধকোশীতে। কারো মুখে কথা নেই।যে যার মতো হাঁটছে তো হাঁটছে।চড়াই ভাঙছে তো ভাঙছেই!ধারা বিরক্ত হয়ে উঠে।দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।নিজেকে নিজে বিড়বিড় করে শাসায়,
— “কে বলছিল?এভারেস্ট আসতে?বরের মাথায় বারি মেরে স্মৃতি ভুলিয়ে দিতি।তাইলে বর ও আসতো না তুই ও না।এখন হাঁট।বেশি করে হাঁট।হাঁটতে হাঁটতে মরে যা।”

ধারার কথাগুলো বিভোরের কানে আসে।ঠোঁট টিপে হাসে।ধারা প্রতিদিনই একা একা কথা বলে।এটা নতুন না।তবে বেশ লাগে বিভোরের।বিভোর পানির বোতল বের করে ধারাকে দেয়।ধারা এক ঢোক খায়।বিভোরও এক ঢোক খায়।আবার হাঁটা শুরু হয়।আরও প্রায় ঘন্টাখানেক চড়াই ভাঙার পর এমন একটা বিন্দুতে পৌঁছায় যেখান থেকে চোমোলুংমাকে স্পষ্ট দেখা যায়। সারা পৃথিবী যাকে মাউন্ট এভারেস্ট বলে জানে।তবে তিব্বতে তার নাম চোমোলুংমা।যার অর্থ পৃথিবীর ধাত্রীমাতা। নেপালে এভারেস্টের সরকারি নাম সাগরমাতা। জায়গাটা পরিষ্কার করে পাথর দিয়ে সাজানো। আকাশ একটু মেঘলা, তবুও বেশ লাগলো স্বপ্নসুন্দরীকে।এভারেস্ট বা সাগরমাতা দর্শন করে সবার শরীরের সব জড়তা, মনের সব ক্লান্তি এক লহমায় উধাও হয়ে গেল। দূর হয়ে গেল যাবতীয় আরামপ্রিয় আতুসেপনা।আসে মনের জোর। ধারা পুরোপুরিভাবে সতেজ হয়ে উঠে।এভারেস্ট দর্শন ম্যাজিকের মতো কাজ করে সর্বাঙ্গে।

এই পথে আবার বহু ট্রেকার। অভিযাত্রীরা দেখা হলে একে অপরকে হাতজোড় করে বলছেন ‘নমাস্তে’।কি আশ্চর্য নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান এদের প্রত্যেকেই একটি হিন্দি বা নেপালি শব্দ উচ্চারণ করছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।ব্যাপারটা দেখতে বেশ ভালো লাগা অনুভূতি হচ্ছে।একটা জায়গায় প্রভাস,বিভোর,ধারা,ফজলুল দাঁড়ায়।ধারা দাঁড়িয়েছে বিভোরের পেট জড়িয়ে ধরে।মাথা হেলান দিয়ে রেখেছে বিভোরের বুকে।ধারা খেয়াল করে নীল চোখের মেয়েটি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দেখে।নীল চোখ দুটিতে জল চিকচিক করছে!অদ্ভুত!
৩-৪ টা ছেলে হাতে কাগজের বাক্স,পিঠে ঝোলা নিয়ে এদিক-ওদিক হাঁটছে। কিছু একটা বিক্রি করছে।ফজলুল ডেকে আনে একটি ছেলেকে।সে কমলালেবু বিক্রি করে।একটির দাম পঞ্চাশ টাকা!প্রভাস দরদাম করে।একশো বিশ টাকায় চারটা কমলালেবু নেয়।ধারা আগ বাড়িয়ে আরো একশো টাকা দিয়ে দেয়।তাঁর বড় মায়া হচ্ছে।এত গরীব মানুষ দেখে।ওদের শুধু কয়টা মাসই বিক্রির সুযোগ।বিভোর ধারাকে বললো,

— “ওরা এসবে অভ্যস্থ ধারা।”
ধারা কিছু বললোনা।তবে কমলালেবুর এক কোয়া খেয়ে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল।এতো মিষ্টি!আর সুস্বাদু। খাওয়া শেষে আবার পা চালানো শুরু হয়।আধাঘণ্টার ভেতর পৌঁছে যায় নামচেবাজারে।নামচেবাজার একটি জমজমাট জায়গা। পাহাড়ের U- আকৃতির ডাল বরাবর গড়ে উঠেছে প্রচুর ঘরবাড়ি-দোকান-বাজার।ওরা সুন্দর এক প্রবেশপত্র পেরিয়ে ঢুকলো।এক পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে জলধারা। তার পাশ দিয়ে উপরে ওঠার রাস্তা। রাস্তার ধারে সেই ঝরনার জলে অনেক লোক কাপড় কাচছে,স্নান করছে।শহরের দোকান-পাট বেশ সাজানো। ওরা উঠল ইয়াক হোটেলে।তিন তলায় ১১৩ নাম্বার ১১৪ নম্বর রুমে।আরও কয়েকটি দল এ হোটেলে উঠে।ধারা ফ্রেশ হয়ে বের হয়।বিভোর তখনো ওয়াশরুমে।ধারা শুনতে পায় পাশের রুম থেকে কান্নার শব্দ আসছে।মেয়েলি কান্না।কে কাঁদে?ধারা আগ্রহ নিয়ে পা বাড়ায়।দরজা হালকা ফাঁক করা।সেইটুকুতে দেখতে পায় নীল চোখের মেয়েটি রুমের ছাদের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে আর বলছে,

— “ক্রিস প্লীজ কাম ব্যাক!প্লীজ…….!কাম ব্যাক।”
এতো সুন্দর মেয়েকে কান্নায় মানাচ্ছেনা একদম।ধারার বুকটা হুহু করে উঠলো।অদ্ভুত অনুভূতিতে ভেতরটা কেঁপে উঠছে।বিষাদময় মন নিয়ে রুমে ঢুকে।বিভোর বেরিয়ে আসে ওয়াশরুম থেকে।ধারাকে থম মেরে বসে থাকতে দেখে বললো,
— “খারাপ লাগছে ধারা?”
ধারা যেনো শুনলোনা।বিভোর পাশে এসে বসে।ধারার কাঁধে হাত রাখে।ধারা কেঁপে উঠলো।বিভোরের দিকে তাকায়।বিভোর প্রশ্ন করলো,
— “কিছু হয়েছে?”
— “না।”
বিভোর আর কিছু বললোনা।ধারাকে আচমকা কোলে তুলে নিতেই ধারা চিৎকার করে উঠে,
— “আরেএ!আজব! হুটহাট কোলে তোলার কি মানে?”
বিভোর জানালার দিকে এগোতে এগোতে বললো,
— ” আমার ভালো লাগে।”

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৩৮

জানালার সামনে এসে ধারাকে দাঁড় করায়।এরপর পর্দা সরিয়ে দেয় বিভোর।ধারার চোখ দুটি চকচক করে উঠে।ঠোঁটে ফুটে হাসি।গোটা নামচেবাজার চোখের সামনে।আর সাথে দেখা যাচ্ছে, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একের পর এক বরফশৃঙ্গ। অসম্ভব সুন্দর এই দৃশ্য দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল ধারা। স্তব্ধ হয়ে শুধু তাকিয়ে রইলো।কি সুন্দর দেখাচ্ছে।এ যেন স্বপ্নের রাজত্ব।ছোটবেলা হাতিম,আলিফ-লায়লায় এমন অনেক জায়গা দেখা যেত।ভয়ংকর সুন্দর!ধারা ঘুরে দাঁড়ায়।বিভোর খালি গায়ে দাঁড়িয়ে সামনে।ধারা এক আঙ্গুল বিভোরের বুকের মধ্যিখানে রেখে বললো,
— “এই মানুষটা আমায় এতো কেনো ভালবাসে আপনি কি জানেন বিভোর মশাই?”
বিভোর এক হাতে ধারার কোমর আঁকড়ে ধরে বললো,

— “বোধহয় মিষ্টি মেয়েটার মিষ্টি হাসি দেখার জন্য।”
ধারা হাসে।অসম্ভব সুন্দর সেই হাসি। সূর্যের আলোর মতো ঝিলিক দিয়ে উঠে গেঁজ দাঁত।আর চোখের কার্নিশে যেন জমে জল।ধারার কপালে ছড়িয়ে থাকা অবাধ্য চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে বিভোর বললো,
— “এভাবেই হাসবে আজীবন।”

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪০