বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪৩

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪৩
ইলমা বেহরোজ

আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ইকো এভারেস্ট এক্সপিডিশন দলটি আগামীকাল ক্যাম্প -১ এ যাবে। রাতে ওখানে থেকে পরের দিন আবার ফিরে আসবে বেসক্যাম্পে। তারপর দু’একদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার এগোবে।ওরা এখন আছে প্রায় ১৭৫০০ ফুট উচ্চতায়,আর লক্ষ্য ২৯০২৮ ফুট উচ্চতায় পৌঁছানো।এই বিশাল উচ্চতা একবারে আরোহণ করা যায়না।ধাপে,ধাপে আস্তে আস্তে উঠতে হয়।আগামীকাল তারই প্রথম ধাপ।বা প্রাথমিক পর্ব বলা যায়।ক্যাম্প-১ এ গিয়ে আবার ফিরে আসার কারণ এতে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া যাবে।যাতে অসুবিধায় পড়তে না হয়।এই অ্যাক্লাইমেটাইজ করতে করতে এগোনো ছাড়া উপায় নেই।অন্যথায় অচেনা পরিবেশ যখন তখন থাবা বসাতে পারে অনভ্যস্ত শরীরের উপর!

গরজ পরদিন ঠিক ভোর তিনটায় ঘুম ভাঙিয়ে দিল।ধারা কিছুতেই ঘুম থেকে উঠতে চাইছেনা।রাত করে ঘুমিয়েছে।বিভোরের বুকের পশম গুণতে লেগেছিল।কতটুকু সফল হয়েছে কে জানে।বিভোর মাঝপথে ঘুমিয়ে পড়ে।ধারাকে ডেকেও তোলা যাচ্ছেনা।আরো উম করে ঘুমাচ্ছে।বিভোর ঘুমন্ত ধারার গাল দু’আঙ্গুলে চেপে ধরে।সামনের চারটা দাঁত ভেসে উঠে।বিভোর ব্রাশ করিয়ে দেয়।তখন ধারার ঘুম ছুটে যায়।উঠে বসে ব্রাশ করে তৈরি হয়।
সাড়ে তিনটায় বেরিয়ে পড়ে পুরো দল।প্রথমে পাথুরে পথে চলা।তারপর একসময় বেসক্যাম্প অঞ্চল পার হয়ে বরফের রাজ্যে পৌঁছে।নানা আকারের নানা আকৃতির তুষারস্তূপ।ধোঁয়ার মতো হাওয়া উড়ে বেড়াচ্ছে।চোখে তা স্পষ্ট। ধারা বিমোহিত হয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— ” কি অপরুপ সৌন্দর্য।”
বিভোর বললো,
— “বেশি সুন্দর জিনিসে বিষ বেশি।”
ধারা ভ্রু বাঁকায়।
— “তোমার খালি অলুক্ষণে কথা।”
বিভোর হাসলো।

একজনের পিছনে আরেকজন। লাইন ধরে পরপর চলছে দলটি।বরফের ময়দান পার হয়ে খুম্বু আইসফল জোনে আসে ওরা।জুতার তলায় লাগিয়ে নেয় ক্র‍্যাম্পন।খুম্বু আইসফল জোন বরাবর শুধু বরফের ফাটল।কখনো খাড়া আইস ওয়াল দিয়ে উঠছে,কখনো আবার নামতে হচ্ছে।আইস ওয়াল দিয়ে উঠার পথে দঁড়ির সাহায্যে উঠতে হচ্ছে।ছোট,বড় ক্রিভাস আসছে একটার পর একটা।কিছু ক্রিভাসে আলো পড়লে দেখা যাচ্ছে অন্তত দশ থেকে বারো ফুট গভীরতার গর্ত।সামনে একটি বড় ক্রিভাস।বিভোর টর্চের আলো নিচে ফেলে।অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছেনা!এই ক্রিভাসের গভীরতা মাপার কার সাধ্যি!একজন একজন করে মই দিয়ে ক্রিভাস পার হচ্ছে।সাবধানে পা ফেলে।এলোমেলো পা পড়লে সোজা অন্ধকারের অতলে হারাতে হবে।

একসময় ধারার সিরিয়াল আসে।ধারা বিভোরের দিকে তাকায়।বিভোর চোখের ইশারায় সাহস দেয়।তবে ভেতরে ভেতরে ভাংচুর হচ্ছে।ধারা মই-এর ধাপে ধাপে জুতার ক্র‍্যাম্পন লাগিয়ে লাগিয়ে চলছে।মাঝখানে আসতেই মইটি দুলতে থাকে।ভয়ে আত্মা কেঁপে উঠে। সমস্ত আত্মবিশ্বাস, মনের জোর,লক্ষ্য দুর্নিবার জেদ সব দুলতে থাকে।পিছনে ঘুরে তাকাতে ঘাড়টা একটু বাঁকায় তখনি বিভোরের চিৎকার কানে আসে,

— “পিছনে তাকানোর দরকার নেই।ধীরে ধীরে
সোজা হাঁটো।মনের জোর বাড়াও।”
ধারা জোরে নিঃশ্বাস ফেলে।এক পা এক পা করে ফেলে।বিভোরের হৃদপিণ্ড কাঁপছে দ্রুতগতিতে।জপ করছে আল্লাহর নাম।ধারা যখন শেষ মাথায়, তখন পাশের একটি তুষারস্তূপ গুড়গুড় আওয়াজ তুলে ভেঙে পড়ে।ধারার সাথে বিভোরের নিঃশ্বাস থেমে যায়।বিভোর চিৎকার করে উঠে,
— ” বি কেয়ারফুল ধারা।ভয় পেয়োনা।কিছু হবেনা তোমার।”
ধারা লাফ দিয়ে মইয়ের পর্ব শেষ করে।এরপর আসে খাড়া চড়াই।খাড়া চড়াই পথে দড়িতে জুমার লাগিয়ে টেনে টেনে চলছে ওরা।জুমার দড়ি বরাবর সামনের দিকে এগোয়,পিছনদিকে আসে না।এই জুমারে লাগানো থাকে কাঁটা, সেটা দড়িতে আটকে থাকে।

ধারা হাঁপাচ্ছে। এমনকি সবারই কষ্ট হচ্ছে খুব।হাড় হিম করা ঠান্ডা চারিদিকে। চোখের সামনে বরফ থেকে নির্গত হচ্ছে রক্ত হিম করা ঠান্ডা ধোঁয়া।শরীর বিদ্রোহ করতে চাইছে বিশ্রামের জন্য।ধারার নিঃশ্বাসের সাথে ঠান্ডা ঢুকছে সর্বাঙ্গে।গরম কাপড় থাকা স্বত্তেও শরীর শীতল হয়ে আসছে।ইতিমধ্যে একজন রক্ত বমি করেছে।যিনি বমি করেছেন তিনি কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই এভারেস্ট জয় করতে এসেছেন।হয়তো কখনো ঠান্ডায় থেকেও অভ্যাস নেই।গুণে গুণে পা ফেলছে সবাই।প্রথমে একশো পা তারপর মিনিট কয়েক বিশ্রাম।তারপর কমতে কমতে ত্রিশ পা করে।খুব কষ্ট হচ্ছে বিভোরের।ধারার রীতিমতো শ্বাস কষ্ট শুরু হয়েছে।বুক হাপড়ের মতো উঠছে নামছে।আচমকা ধারা বমি করা শুরু করে।এদিকে রধবি তাড়া দিচ্ছে, জলদি চলো।

বিভোরের পায়ে কিছুটা জোর থাকলেও ধারা একদম নিস্তেজ হয়ে এসেছে।বিভোর এক হাতে ধারাকে ধরে।আর কিছুটা হেঁটে বিভোরও ক্লান্ত হয়ে পড়ে খুব।ধারার চোখ-মুখ রং পাল্টাচ্ছে।একটু বসে ধারাকে বুকের সাথে চেপে ধরে।রধবি বিস্কুট,জল এগিয়ে দেয়।বিভোর খায়, ধারাকে খাওয়ায়।ধারার হাঁপানি কমে আসে।আবার হাঁটা শুরু হয়।কিছুক্ষণ যেতেই ধারা আবারো বমি করে। নিস্তেজ হতে হয়ে পড়ে। তার উপর ওরা এখন যে এলাকায় আছে সেটি বড় বিপজ্জনক।যে কোনও সময় এখানে আইস টাওয়ারের অংশ ভেঙে পড়তে পারে।রধবি বার বার তাড়া দিচ্ছে তাড়াতাড়ি হাঁটতে।ধারা চেষ্টা করছে নিজেকে সামলানোর পারছেনা।দলের অনেকে পিছনে পড়ে রয়েছে।লরা নাকি জ্ঞান হারিয়েছে।লরার শেরপা লরাকে কোলে করে নিচে নেমে গিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে।মেয়েটা কি প্রস্তুত নয় এভারেস্ট জয়ের জন্য? মরতে এসেছে?
রধবি কিছুটা দূরত্বে আছে।বিভোর,ধারার সম্মূখ বরাবর একটি আইস টাওয়ার।ধারা আর হাঁটতে পারছেনা।রধবি হঠাৎ চিৎকার করে নেপালি ভাষায়,

— “বাবোর সরে যাও।আইস টাওয়ার…..
রধবি কথা শেষ করার আগে বিভোর সামনে তাকায়।বড় আইস টাওয়ারটি ঝুঁকছে ধীরে ধীরে।বিভোর তাড়া দেয়,
— ” ধারা উঠো।প্লীজ চেষ্টা করো।”
ধারা কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,
— “পারছিনা।পা..পা দুটি অবশ হয়ে আছে…
বিভোর আর কিছু না ভেবে দ্রুত ধারাকে কাঁধে তুলে নেয়।কিন্তু একি!সে সামনে এগুতে পারছেনা।শরীরটা আর কুলাচ্ছেনা।পা দুটি স্তব্ধ হয়ে গেছে। বিভোরের বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করতে থাকে।মনে মনে আল্লাহর সাহায্য কামনা করে,
— ” আল্লাহ প্লীজ।এতো নিষ্ঠুরতা করোনা।সাহায্য করো।”
রধবি চেঁচাচ্ছে,
— “বাবোর দ্রুত পা ফেলো।বাবোর….

বিভোর চোখ বুজে দ্রুত পা ফেলে দৌড়ানোর চেষ্টা করে।ততক্ষণে আইস টাওয়ার মাথার উপর পড়ে যেতেও পারে সে জানে।বিকট আওয়াজ তুলে কিছু একটা পড়ে।বিভোর চোখ খুলে।তার চেয়ে মাত্র এক হাত দূরে আইস টাওয়ারের বড় একটি অংশ পড়ে চুরমার হয়ে গেছে ভেঙে!ধারাকে ওভাবে কাঁধে রেখেই এলোমেলো পা ফেলে বিভোর এগুচ্ছে।
মাথার উপর কড়া সূর্য।কষ্টটা দ্বিগুণ হচ্ছে।বরফ থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে সূর্য রস্মি, আর তাতে শরীর আরো তেতে যাচ্ছে।প্রচন্ড তেষ্টা পাচ্ছে।অথচ জল নেই একফোঁটা।পিছনে তখন ফজলুল,প্রভাস, জেম্বার দেখা মিলে।ওরা এসে জানায়,একজনের উপর আইস টাওয়ার ভেঙে পড়েছে।বাজে ভাবে জখম হয়েছে।দ্রুত তাকে নিচে নামানো হচ্ছে।প্রভাস,ফজলুল বমি করেছে তিনবার।অবশেষে দুইটা নাগাদ ওরা পৌঁছে ক্যাম্প-১ এ।বরফের ময়দানে পরপর তাঁবু লাগিয়ে ক্যাম্প-১ তৈরি হয়েছে। বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বিভিন্ন দলের তাঁবু।কোনোটায় লোক আছে কোনোটায় নেই।কেউ ক্যাম্প-২ এ উঠে গেছে।কেউবা বেসক্যাম্পে ফিরে গেছে, কেউবা মালপত্র রেখে গেছে আবার আসবে। ধারাকে স্লিপিং ব্যাগে শুইয়ে পাশে শুয়ে পড়ে নিজে।
রধবি পরিষ্কার বরফ সংগ্রহ করে গলিয়ে জল করে।ধারার শ্বাসকষ্ট বেড়েই চলেছে।কথা বলতে পারছেনা।বিভোর ছোট তেলের বোতল বের করে রধবির হাতে দেয়।গরম করে দেওয়ার জন্য।রধবি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,

— “এটা দিয়ে কি হবে?”
— ” আমার ওয়াইফের জন্য।”
রধবি আর প্রশ্ন করে না।তেল গরম করে এনে দেয়।বিভোর তখন বলে,
— “ওর ঠান্ডা বেশি লাগলে বুকে – পিঠে তেল দিতে হয়।তাহলে ঠিক হয়।আমাকে কেউ ডেকোনা এখন।তাঁবুতেও যেনো কেউ না আসে।দেখবে।”
রধবি মাথা নাড়ায়।বিভোর তাঁবুতে ঢুকে ধারার বুকে,পিঠে তেল মালিশ করে দেয়।ধারার ঘন নিঃশ্বাস থেমে আসে উষ্ণতায়।তবে ক্লান্তি খুব শরীরে।বিভোর পাশে শুয়ে ধারাকে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে।ধারা বলে,
— “আমিকি পারবো? ”
বিভোর ধারার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
— “পারবে।আমরা কাল নেমে যাবো।আবার উঠবো।আবার নেমে যাবো।এরপর ক্যাম্প-২ এ উঠবো।নেমে যাবো।আবার উঠবো, নেমে যাবো।এভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে।দেখোনি সবারই সমস্যা হচ্ছিলো।”
ধারার কেনো জানি কান্না হচ্ছে এতো ভয়ংকর পরিস্থিতি চোখের সামনে দেখলো প্রাথমিক পর্বেই।তারপর…? ধারা আবেগী হয়ে বললো,

— “আমি যদি মরে যাই।তুমি কি দেশে ফিরে আরেকটা বিয়ে করবা?”
বিভোরের বুকে অস্থিরতা বাড়ে।এমনিতেই ধারার চিন্তায় মাথা ফেটে যায়।তার উপর কিসব বলছে!
বিভোর আরো শক্ত করে ধারাকে বুকের সাথে চেপে ধরে। বলে,
— “আমার আকাশের সুখতারা তুমি।এভাবে বলোনা।সব কিছু ভেঙে চুরে তোমাকেই ভালবাসতে চাই আজীবন।আমরা দুজনি ফিরবো দেখো।”
ধারা নিজের অবস্থানে থেকেই বলে,
— “তোমার প্রেমময় বৃষ্টি যন্ত্রনা হয়ে তোমার শহরে নামবে আমি জানি।বৃষ্টি মানে কান্না।আকাশেরা যখন কান্না করে তখন পৃথিবীতে বৃষ্টি নামে।আমি মরে গিয়ে বৃষ্টি হয়ে নামবো।”
— “কি আজগুবি কথা বলছো।বৃষ্টি মানে প্রেম।নতুন জীবন দেওয়া।সতেজ করে তোলা।তুমি আমার বৃষ্টি। বারে বারে প্রতিনিয়ত ভালবাসা নিয়ে বৃষ্টি হয়ে নামবে। বুঝছো?”
— “মিথ্যে।বৃষ্টি মানে কান্না।”
— “বৃষ্টি মানে প্রেম।”
— “না কান্না ”

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪২

বিভোর টের পায় ধারার শরীর গরম।জ্বর বাঁধলো নাকি!
ফজলুল, প্রভাস চা, বিস্কুট খাচ্ছে।এর মধ্যে টুকটাক কথা হচ্ছে।বাংলাদেশে এভারেস্ট জয়ী অন্য দেশের তুলনায় কম।তাঁরা জয়ী হয়ে ফিরলে উৎসব লেগে যাবে। তবে ফজলুলের মনে অন্য ভাবনা।বিভোর,ধারা,প্রভাস যদি এভারেস্টের বুকে হারিয়ে যায় এবং শুধু সে জয়ী হয়ে ফিরে দেশে তখন তো সে সেলিব্রিটি হয়ে যাবে।চারজন আসলো, ফিরেছে শুধু সে।মানে সে বীর!লোভে চোখ দুটি চকচক করে উঠে ফজলুলের।ফজলুল নিজেকে অনেক বড় বীরও ভাবে বটে।ওভার আত্মবিশ্বাসের তাগিদে সে নিশ্চিত এভারেস্ট জয়ী সে হবেই!বাকি তিনজনের মৃত্যু কামনা আসছে মনে প্রচন্ডভাবে!

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪৪